সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ট জীব মানুষের মধ্যে যিনি ছায়াহীন কায়ার একমাত্র অধিকারী, যাঁর পবিত্র মুখের লালা অতি মূল্যবান মহৌষধ এবং থুথু অতি উত্তম সুরভি। যাঁর পবিত্র অঙ্গের প্রতিটি ঘর্মবিন্দু বহুমূল্য মৃগনাভীর চেয়েও অধিক সুগন্ধময় এবং যাঁর পবিত্র প্রস্রাবের প্রতি কাতরা মিশকে আম্বরের থেকেও দামী। যাঁর মুবারক তনু পবিত্র নূর দ্বারা সৃষ্ট এবং যাঁর অপূর্ব সুন্দর দেহের প্রতিটি অঙ্গ অলৌকিক শক্তি বলে বলীয়ান। তাঁর পাক পবিত্র সৌম্যাকৃতির যথাযথ বর্ণনা যে কত অসম্ভব তা সকল বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কাছে অবশ্য বিদিত।
যেমন বিখ্যাত মনীষী আল্লামা মুনাভী (র.) অতি দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করেছেন যে, প্রত্যেক ব্যক্তির অবশ্যই এরূপ আকীদা থাকা উচিত যে, হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বরকমতয় দেহ যেসব গুণে গুণান্বিত সেসব গুণে গুণবান আর কেউ কখনও হয়নি বা কখনও হতে পারবে না। (খাসায়িলে নববী)
আল্লামা কুরতবী (র.) বলেন- নবীজির সমূহ সৌন্দর্য বিশ্ববাসীর নিকট প্রকাশিত হয় নাই অন্যথায় লোক নবীজির দীপ্যমান সৌম্যমূর্তি দর্শনের ক্ষমতা রাখত না। (খাসায়িলে নববী)
সুতরাং যাঁরা নবীজির পবিত্র রূপলাবণ্যের সামান্যতম রম্যতা দর্শন করেছেন তাঁরা বিশ্বলোকের সমূহ সৃষ্টির মধ্যে নবীজিকেই সর্বাধিক সুন্দর বলে স্বীকার করেছেন। যেমন নবীজির প্রিয়তম পাত্রী হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) বলেন- যদি যুলাইখার সহচরীগণ নবীজির নূরানী চেহারার অপূর্ব সুন্দর জ্যোতি দর্শন করতেন তবে তারা নিজ নিজ হস্ত কর্তনের পরিবর্তে তাদের হৃদয় কেটে ফেলতেন। (খাসায়িলে নববী)
নবীজির একান্ত প্রিয় সহচর ও বিশ্বস্ত জামাতা হযরত আলী (রা.) হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অত্যুজ্জ্বল নূরানী বদনের সীমাহীন সৌন্দর্য দর্শন করতঃ অতি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন- আমি হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ন্যায় এত সুন্দর সৌম্যাকৃতি তার পূর্বে ও পরে আর কাউকে দেখিনি। (শামায়িলে তিরমিযী, হাদীস-০৫)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অন্যতম সাহাবী হযরত জাবির (রা.) বলেন- আমি কোনো এক চাঁদনী রাতে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অতি মনোমুগ্ধকর চন্দ্র মুখখানি দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছিলাম। আমি সেই রাত্রে কখনও চন্দ্রের চপল জ্যোতি দর্শন করছিলাম আবার কখনও নবীজির সুশান্ত বদনের নূরানী আভা অবলোকন করছিলাম। অবশেষে বাধ্য হয়ে আমি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে, নবীজির জ্যোতির্ময় মুখখানি উর্ধ্ব গগণের উজ্জ্বল চন্দ্র হতে অধিকতর সুন্দর। (শামায়িলে তিরমিযী, হাদীস-১০)
যাই হোক নবীজির এহেন মনোমোহনাকৃতির সামান্যতম বর্ণনা এবং তার অপূর্ব সুন্দর আচার আচরণের যৎকিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা লোক সমক্ষে তুলে ধরার জন্য আমি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যেসব গ্রহণযোগ্য কিতাবের আশ্রয় গ্রহণ করেছি তন্মধ্যে বিশেষ খ্যাতনামা লেখক ইমাম তিরমিযী (র.) লিখিত শামায়িলে তিরমিযী; বিশ্ববরেণ্য মনীষী কাযী আয়াদ (র.) এর লিখিত ‘আশ শিফা বিতারীফি হুকুকীল মুস্তাফা’, দ্বাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দীদ শাহ আব্দুল হক মুহদ্দিসে দেহলভী (র.) রচিত ‘মাদারিজুন নাবুওয়াত’ এবং পবিত্র হারামে নববীর সুবিখ্যাত বক্তা আল্লামা জাফর ইবনুল হুসাইন (র.) রচিত মৌলুদে বরঝঞ্জী প্রভৃতি কিতাবের নামই বিশেষ উল্লেখযোগ্য।
নবীজির পবিত্র সুন্দর আকৃতি
উচ্চতার দিক দিয়ে যদিও নবীজি মধ্যমাকৃতির ছিলেন তবুও খোদা প্রদত্ত অলৌকিক শক্তিবলে সমবেত জনসমাবেশে তাঁর উন্নত মস্তক সর্বোচ্চ বলেই দর্শকের মন আকর্ষণ করত। তাঁর মাথার উপরের কেশধাম প্রায়ই কর্ণতল পর্যন্ত লম্বিত ন্যস্ত এবং স্বভাবত কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত ছিল। গায়ের রং ছিল ঈষৎ লালিমাযুক্ত শ্বেতবর্ণ। সদা হাস্যে সমুজ্জল চেহারার উপর এক অপূর্ব স্বর্গীয় জ্যোতি সর্বদা বিরাজ করত। সীমাহীন সম্ভ্রম হেতু কেউ তাঁর অনিন্দ্যসুন্দর চেহারার দিকে চক্ষু তুলে কথা বলার সাহস রাখত না। তাঁর অপূর্ব মান সম্ভ্রমের ছাপ দর্শনে আগন্তুকের মনে অত্যন্ত ভীতির সঞ্চার হত।
নবীজির প্রশান্ত ললাট সামান্য প্রশস্ত এবং নাসিকা কিছুটা উন্নত ছিল। সুরমা মাখা নেত্রদ্বয় যথোচিত ভাটা ভাটা ও অতি সুদীপ্ত ছিল। ঘোর অন্ধকারেও তিনি দিবালোকের ন্যায় সমানভাবে দেখতেন। তিনি যখন কোনদিকে দৃষ্টিপাত করতেন তখন তাঁর নয়নযুগলের অতি কৃষ্ণবর্ণ নয়নতারা দুটি অলৌকিক শক্তিবলে অত্যুজ্জ্বল তারকাসম জ্বলজ্বল করে উঠত। তিনি সামনে ও পিছনে সমভাবে দেখতেন। তাঁর যুগল বিযুক্ত অথচ অতি সুবিন্যস্ত ছিল। সুন্দর মুখমন্ডলের মধ্যে পবিত্র মুখখানি ছিল যথোচিত বিস্তৃত। দাঁতগুলো চিকন, চাকচিক্যময় এবং লালাসিক্ত। হাত পায়ের মাংসপেশীগুলো অতি সুষ্ঠু, সুন্দর ও মাংসযুক্ত। চরণদ্বয়ের নিম্নভাগ অপেক্ষাকৃত গভীর এবং উপরিভাগ অত্যন্ত স্বচ্চ ও পৃষ্ঠ। চলাফেরার সময় তিনি অতি সুশিক্ষিত বীরের ন্যায় জোর কদমে চলতেন, তবে সেই চলন ছিল অতি আড়ম্বরশূন্য। হাঁটাচলার সময় তিনি সামনের দিকে একটু ঝুঁকে পদক্ষেপ নিতেন যেন কোন উচ্চভূমি হতে নিম্ন ভূমিতে অবতরণ করছেন। নবীজির পবিত্র বক্ষস্থল ছিল অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত ও পেট হতে সামান্য উন্নত। উভয় স্কন্ধের মধ্যভাগে অর্থাৎ বিস্তৃত পৃষ্টদেশের মাঝখানে কবুতরের ডিম্বাকৃতি একখন্ড মাংসের উপর অত্যুজ্জ্বল নূরানী অক্ষরে লেখা ছিল ‘মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’। ইতিহাসের পাতায় তাই ‘মুহরে নুবুওয়াত’ নামে খ্যাত।
নবীজির মনোমোহন চেহারার উভয় পার্শ্বের দুটি কর্ণ এত সুন্দরাকৃতি বিশিষ্ট ছিল যেন প্রস্ফুটিত দুটি পুষ্প। তাঁর শ্রবণশক্তি ছিল এত প্রবল যে তিনি শূন্য পাকস্থলীর আওয়াজ পর্যন্ত শুনতে পেতেন। এমনকি দূর আকাশের অতীত (বিশেষ ধরণের ঘর্ঘর শব্দ) পর্যন্ত তার পবিত্র কর্ণকুহরে ধরা পড়ত।
তাঁর মুখের লালা ছিল অতি সুমিষ্ট ও সুগন্ধময় মহৌষধ। পবিত্র হাদীসে বর্ণিত রয়েছে যে, খাইবার যুদ্ধে হযরত আলী (রা.) এর চক্ষু যন্ত্রণা দেখা দিলে নবীজি তাঁর চোখে আপন পবিত্র মুখের লালা সংযোগ করেছিলেন। পবিত্র লালার পরশে তৎক্ষণাৎ চক্ষু বেদনার উপশম ঘটেছিল।
হযরত আনাস (রা.) এর বিশেষ অনুরোধে নবীজি যখন তাঁদের কূপে আপন মুবারক মুখের পবিত্র লালা নিক্ষেপ করলেন সঙ্গে সঙ্গে সেই কুয়ার পানি এত সুগন্ধময় ও সুস্বাদু হয়েছিল যে, কথিত রয়েছে তখনকার যুগে মদীনা শরীফে বর্ণিত কূপের পানিই সবচেয়ে সুস্বাদু ও সুগন্ধময় বলে প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল। অন্য একটি বর্ণনায় আছে যে, একদা নবীজির খিদমতে একপাত্র পানি আনা হলে তিনি এতে এক কুল্লি পানি নিক্ষেপ করতঃ সন্নিকটস্থ একটি কুয়ায় সেই পানিসমূহ ঢেলে দিতে নির্দেশ দান করলেন। নবীজির পবিত্র মুখের লালাসিক্ত বরকতময় পানির ছোঁয়ায় বর্ণিত কুয়ার পানি এত সুমিষ্ট ও সুগন্ধময় হয়ে উঠেছিল যে বহুদিন যাবৎ সেই কূপ হতে বহুমূল্য কস্তুরীর ন্যায় সুগন্ধি বের হয়েছিল।
অন্য আরেক দিনের কথা। নবীজির সমীপে কয়েকটি দুগ্ধ পোষ্য শিশুসন্তানকে হাযির করা হয়েছিল। নবীজি সস্নেহে তাদের মুখে আপন বরকতময় মুখের লালা প্রদান করলে তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণা এমনভাবে বিদূরিত হয়েছিল যে তারা আর সেদিন আপনাপন মাতার দুদ্ধ পর্যন্ত পান করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছিল।
নবীজির জিহবা মুবারক ছিল অতি সুমিষ্ট ও সুশীতল লালাসিক্ত। বর্ণিত রয়েছে যে, একদা নবীজির প্রিয় পৌত্র হযরত হাসান (রা.) অতি তৃষ্ণাকাতর অবস্থায় নবীজির সমীপে উপস্থিত হলে তিনি তার মুখে আপন জিহবাগ্র প্রদান করেছিলেন। বালক হাসান (রা.) আস্তে ধীরে নবীজির পবিত্র জিহবা চোষণ করতঃ ক্ষণিকের মধ্যে এত পরিতৃপ্ত হয়ে উঠলেন যে, উক্ত দিনে তিনি আর কোন পানাহার করতে ইচ্ছা প্রকাশ করেননি।
হযরতের নাসিকা মুবারক ছিল অতি সুন্দর নূরানী আভাযুক্ত অতি লাবণ্যময় মুখমন্ডলের ঠিক মধ্যভাগে যথোচিত উন্নত। অনিন্দ্যসুন্দর নাসিকা তাঁর চন্দ্রবদনের রম্যতা যেন আরও শতগুণ বৃদ্ধি করে রেখেছিল। বর্ণিত রয়েছে যে, হঠাৎ কোন আগন্তুকের দৃষ্টি নবীজির পবিত্র সুন্দর মুখমন্ডলের উপর নিপতিত হলে তাঁর সীমাহীন মান-সম্ভ্রমের চাপে সহসা আগন্তুকের আন্তরাত্মা কেঁপে উঠত। তাঁর পবিত্র নাসিকা রন্ধ্রে পাপাত্মা ও পুন্যাত্মার আমল ধরা পড়ত। তাই বিশুদ্ধ বর্ণনায় আছে যে, নবীজির প্রিয়তম নন্দিনী হযরত ফাতিমা (রা.) নবীজির খিদমতে হাযির হলে তিনি সস্নেহে দাঁড়িয়ে তাঁকে স্বাগত জানাতেন এবং তাঁর পাক ললাট চুম্বন করতঃ অতি আনন্দের সাথে বলতেন, ওহে মা ফাতিমা! আমি তোমার পবিত্র অঙ্গে জান্নাতের খুশবু পাচ্ছি।
এক কথায় নবীজির আপাদমস্তক ছিল মহিমাময় খোদার বিচিত্র কলমে আঁকা নূরের ছবি। তাই নূরের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করা যেমন দুষ্কর, ঠিক তেমনি নূর নবীজির পবিত্র নূরী বদনের যথাযথ ব্যাখ্যা করার দাবি করাও চরম ধৃষ্টতার নামান্তর মাত্র।
নূরনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর অপূর্ব সুন্দর আচার আচরণ
স্বভাবতঃ নবীজি অত্যন্ত ভাবুক ও চরম লাজুক ছিলেন। ছোটবেলা হতে তিনি অতি নীরবে নির্জনে বসে পরম প্রভুর ধ্যান করতে ভালোবাসতেন। বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে তাঁর সেই ধ্যান-ধারণাও ক্রমশঃ বেড়ে চলল। তাই হযরত খাদিজা (রা.) এর পানি গ্রহণের পর তিনি হেরাপর্বতে নির্জন কন্দরে পরম প্রভুর আরাধনায় অতি গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করলেন। কঠোর তপস্যা ও চরম সাধনার পরে অবশেষে তিনি বর্ণিত গিরিগুহায় ধ্যানরত অবস্থায় প্রকৃত সত্যের সন্ধান লাভ করলেন। পবিত্র নবুওয়াত ও রিসালতের মহাদায়িত্ব নবীজির উপর অর্পিত হলো। কিন্তু খোদাপ্রেমে প্রেমাতুর নবীজির ধ্যানধারণার কোনো পরির্তন ঘটল না বরং তাঁর পবিত্র অন্তরের সুপ্ত প্রেমানল শত সহস্র শিখায় প্রোজ্জল হয়ে উঠল। বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি পরবর্তী জীবনে নানারূপ ইবাদত ও রিয়াযত তথা নামাযরূপী আরাধনার মাধ্যমে সারারাত্রি জাগ্রত থেকে পরম রবকে স্মরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। এককথায় সদা সর্বদা খোদাতাআলার প্রেমে বিভোর থেকে কায়মনোবাক্যে পরম রবের উপাসনা করতে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন।
নবীজি অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন ও অতি সত্যপরায়ণ ছিলেন। ফলে পাপে-তাপে নিমজ্জিত অন্ধযুগের জনমানবের কাছেও তিনি ‘আমীন’ ও ‘সাদিক’ নামে পরিচিত ছিলেন। ‘আমীন’ শব্দের অর্থ বিশ্বস্ত ও ‘সাদিক’ শব্দের অর্থ সত্যবাদী।
নবীজি অত্যন্ত ধৈর্যশীল, চরম দয়ালু ও অতি ক্ষমাশীল ছিলেন। তাঁর অতুলনীয় সহনশীলতা, অনুপম দয়া ও অনন্ত ক্ষমাগুণের নানা অপূর্ব কাহিনী ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ এখানে দুএকটি ঘটনা উল্লেখ করা হচ্ছে।
পবিত্র ইসলাম প্রচারের নিমিত্তে নবীজি তায়িফে উপস্থিত হলে তায়িফবাসীর নির্মম ও নিষ্ঠুর অত্যাচারে তাঁর পবিত্র শরীর যখন রক্তাক্ত, এহেন দারুণ মুহূর্তে পাহাড় পর্বতের ‘মুয়াক্কিল’ (ভারপ্রাপ্ত) ফিরিশতা এসে নবীজির সমীপে অতি বিনীতভাবে নিবেদন করলেন- হে আল্লাহর পিয়ারা হাবীব! যদি আপনি অনুমতি প্রদান করেন, তবে আমি উভয় পার্শ্বের দুটি উঁচু পর্বত উত্তোলন করতঃ বেদ্বীন অত্যাচারীদেরকে ক্ষণিকের মধ্যে পবর্ত বর্ষণে নিষ্পেষিত করে দেওয়ার জন্য খোদাতাআলার তরফ হতে আদিষ্ট হয়ে এসেছি। এখন এদের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শুধু আপনার আদেশ দানের বিলম্ব মাত্র। দয়ার সাগর নবীজি, তিনি তো সহিষ্ণুতার জ্বলন্ত প্রতিমূর্তি, ক্ষমা ধর্মের প্রতিকৃতি, শান্তিকামী তিনি, প্রতিশোধ তাঁর কাম্য নহে। তাই করজোড়ে চরম মিনতির সাথে তিনি পরম রবের দরবারে আরয করলেন- ওহে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিপালক। আমার কাওমকে মার্জনা করে দাও এবং তাদেরকে হিদায়াতের পথ প্রদর্শণ কর। কারণ তারা আমার প্রকৃত মান-মর্যাদা উপলব্ধি করতে পারেনি। অন্য একটি বর্ণনায় আছে- যদিও তারা আমার উপর ঈমান আনেনি, হয়তো তাদের কোন বংশধর আল্লাহ ও তদীয় রাসূলের উপর ঈমান আনতে পারে। সুবহানাল্লাহ! এমন নিদারুন মুহূর্তে এহেন সুবর্ণ সুযোগ হাতে পেয়েও কি কেউ প্রতিশোধ গ্রহণের পরিবর্তে এমন ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শণ করতে পারে, প্রাণনাশে উদ্যত দুশমনদের জন্য কি কেউ এরূপ মঙ্গল কামনা করতে পারে? দয়াল নবী তাই করলেন।
আরেক দিনের কথা। নবীজি নজদ যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পথে এক পশলা বৃষ্টি হয়েছিল। নবীজি আপন সহচরগণ হতে অদূরে একটি নির্জন স্থানে নিজ গাত্রবস্তু উন্মোচন করতঃ রৌদ্রে শুকাতে দিয়ে একাকী অবস্থায় একটি বৃক্ষতলে আরাম করছিলেন। নবীজিকে শায়িত অথচ এমন নিঃসঙ্গ অবস্থায় দেখে একজন শত্রু অতি সন্তর্পনে নবীজির শিয়রে এসে দাঁড়াল। শিকার নিজ হাতের মুঠোয় দেখে সে সানন্দে বিকট অট্টহাসি করতঃ খট করে তার তরবারি কোষমুক্ত করল। তরবারি খোলার শব্দে নবীজির ঘুম ভেঙ্গে গেল। সাক্ষাৎ যমদূতের ন্যায় উলঙ্গ তরবারি হাতে সে নবীজিকে জিজ্ঞেস করল- হে মুহাম্মদ! বলতো আজ তোমাকে কে আমার হাত থেকে রক্ষা করবে? নবীজি অতি নির্ভীকভাবে উর্ধ্বগগণের দিকে চেয়ে উত্তর দিলেন- ‘আল্লাহ’। আকাশ বাতাস তথা চতুষ্পার্শ্বের পাহাড় পর্বত ও তরুলতা হতে শত সহস্র কণ্ঠে সমস্বরে প্রতিধ্বনিত হলো- ‘আল্লাহ’। এক অজানা অতঙ্কের ছোঁয়ায় শত্রুর সর্বাঙ্গ থর থর করে কেঁপে উঠল। ঝনাৎ করে তার হাতের তরবারি মাটিতে পড়ে গেল। তৎক্ষণাৎ নবীজি সেই তরবারি নিজ হস্তে ধারণ করতঃ সহাস্যে তাকে জিজ্ঞেস করলেন- বৎস, বলতো এখন তোমাকে কে আমার হাত হতে রক্ষা করবে? অসহায় শত্রু সভয়ে উপুড় হয়ে নবীজির পা জড়িয়ে ধরে অতি করুণ সুরে উত্তর দিল ‘আপনি’। নবীজির দীল দরিয়ায় ক্ষমার জোয়ার উঠল, তিনি সস্নেহে তাকে পদতল হতে উঠিয়ে অভয়দান করতঃ বললেন- যিনি আমাকে তোমার হাত হতে রক্ষা করেছেন, সেই দয়াময় রবই তোমাকে আমার হাত থেকে রক্ষা করবেন। কারণ তিনি ব্যতিত আর কেউই কাউকেও হত্যা কিংবা রক্ষা করতে সক্ষম নহে (কিছুটা ভিন্নতাসহ হাদীসখানা বুখারী ও মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে)।
নবীজির ক্ষমা ও দয়ার এরূপ লক্ষ লক্ষ কাহিনী নানা গ্রহণযোগ্য কিতাবাদির মধ্যে লিপিবদ্ধ রয়েছে। সীমিত পরিসরে এ প্রবন্ধে বর্ণিত দুটি ঘটনাই যথেষ্ট হবে বলে মনে করি। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খোদাতাআলার উপর অত্যন্ত নির্ভরশীল ছিলেন। আপদে-বিপদে তথা সর্বসময়ে তিনি খোদাতাআলার উপর ভরসা রাখতেন। তাই আরববাসী যখন নবীজির চরম শত্রু, বিশেষতঃ মক্কাবাসী বিধর্মীর দল যখন নবীজিকে প্রাণে মারার জন্য অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠল। স্থানে স্থানে বিধর্মী নেতা কুরাইশদের পক্ষ হতে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হতে থাকল- যে মুহাম্মাদের ছিন্ন মুণ্ড এনে হাযির করতে পারবে, তাকে একশত লাল উট তথা আরো কত কি পুরস্কার দেওয়া হবে। তাই অর্থলোভী পিশাচের দল চারদিকে ওৎ পেতে বসে থাকল। কিন্তু নবীজির নির্ভিক অন্তরে ভয়ের লেশ মাত্র নেই। কারণ আল্লাহ তার সহায় আছেন। তাই নিঃসঙ্গ নবীজি একাকী ঘর হতে বের হয়ে পড়লেন পবিত্র মদীনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ছায়ার মত তার সঙ্গ নিলেন প্রিয়তম বন্ধুবর হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.)। গভীর রাত্রিতে তারা আশ্রয় নিলেন ‘সূর’ নামক পর্বতের নির্জন কন্দরে। ইতিহাসের পাতায় সেই গুহা ‘গারে সূর’ নামে পরিচিত।
নবীজি বর্ণিত গিরি গুহায় আপন অন্তরঙ্গ বন্ধু সহ আশ্রিত। আর তাদের পেছনে ধাওয়া করে আসছে এক সহস্র অশ্বারোহী। জোর কদমে ধপ ধপ শব্দে এগিয়ে আসছে শত্রুর মহা তেজস্বীঘোড়া। আর মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধান, মৃত্যু অনিবার্য দেখে হযরত আবূ বকর (রা.) এর অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তিনি অতি ভয় মিশ্রিত স্বরে নবীজিকে সম্বোধন করে বললেন- আর দেরী নয়, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! অবিলম্বেই আমরা শত্রুর হাতে ধরা পড়ব। কিন্তু নির্ভীক নবীজির চন্দ্রবদনে চিন্তার লেশ মাত্র নেই। তাঁর পবিত্র তনু-মন খোদাতে বিভোর। তিনি তার সহচরকে উত্তর দিলেন ভয় করিওনা নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা আমাদের সঙ্গে আছেন (সূরা তাওবা, আয়াত-৪০)। সুবহানাল্লাহ! কী অপরূপ ভরসা। কেমন অবর্ণনীয় ‘তাওয়াক্কুল’। ধেয়ে আসা শত্রু থমকে দাঁড়াল। শিকার নাগালের ভিতরে দেখে আরোহী শত্রু সরোষে কষাঘাত করল ঘোড়ার পিঠে। শব্দ উঠল ‘কচাৎ, কচাৎ’। আঘাতের চোটে জোর পদক্ষেপ করতে চাইল তেজস্বী ঘোড়া। কিন্তু এর চারটি কদম হঠাৎ দেবে গেল কঠিন প্রস্তরময় ভূমিতে। ঘোড়াটি অনড়। তার সর্বাঙ্গ অসাড় ও নিস্পন্দ। সভয়ে আরোহী নিচে অবতরণ করল। এক অজানা ভয়ে তার সারা অঙ্গ থরথর করে কাঁপতে লাগল। হাঁটু পেতে করজোড়ে যেই নবীজির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা তথা তার প্রাণ ভিক্ষা চাইল, সহাস্য বদনে দয়াল নবীজি তাকে মার্জনা করলেন। সুতরাং আর কাউকে এই সংবাদ জ্ঞাপন করবে না প্রতিশ্রুতি দিয়ে অতি ভয়-বিহবল অন্তরে নবীজির চরম শত্রু পুনরায় ঘোড়ায় চড়ে তার বাড়ির দিকে ফিরে চলল। যথাসময়ে নবীজি তাঁর অনুচরসহ নির্বিঘ্নে আপন গন্তব্য পথে রওয়ানা হলেন। নবীজি অত্যন্ত বিনয়ী ছিলেন। বর্ণিত রয়েছে যে, একদা কোনো এক ব্যক্তি নবীজির সমীপে কোন একটি আবেদন নিয়ে আসল। কিন্তু সে নবীজির অতুলনীয় রূপলাবণ্য ও অনুপম মান-সম্মান দর্শন করতঃ ভয়ে জড়সড় হয়ে এক অজানা আতঙ্কে থর থর করে কাঁপতে লাগল। নবীজি তার এমন অবস্থা দেখে সস্নেহে তাকে নিজের পাশে বসিয়ে বললেন, বৎস তুমি আমাকে ভয় করছ কেন? সত্য কথা বলতে আমি একজন মাতার সন্তান যিনি দুই বেলা বিনা ব্যঞ্জনে মাত্র শুষ্ক রুটি আহার করতেন।
নবীজি অতি সহজ অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। সারা আরবের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে নবীজি দীন-দরিদ্রের ন্যায় আপন পবিত্র পরিবারসহ দিনের পর দিন উপবাসে থাকতেন। সামান্য সাধারণ বস্ত্র পরিধান করতেন নিজের ছিন্ন বস্ত্র নিজে সেলাই করতেন। আপন পবিত্র হস্তে নিজ বকরি দোহন করতেন। নিজের ব্যবহৃত জুতা নিজেই মেরামত করতেন। ছোটদেরকে আদর এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতেন। একদা তিনি উপস্থিত জনমণ্ডলীকে উদ্দেশ্য করে বললেন- যে ব্যক্তি ছোটদেরকে আদর এবং বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শন না করে সে আমাদের দলভুক্ত বা আমাদের অনুগামী নয়।
দীন দুঃখীদেরকে তিনি অত্যন্ত ভালোবাসতেন। অতিথিদের পরিচর্যা, অসুস্থদের শুশ্রুষা, বিধবাদের সেবা এবং অভাবগ্রস্থদের দুঃখ মোচন ইত্যাদি সৎকর্মের মধ্যে তিনি সদা সর্বদা লেগে থাকতেন। গরীব দুঃখীদেরকে তিনি অতি মুক্ত হস্তে দান করতেন। বর্ণিত রয়েছে যে, হুনাইন যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর নবীজি মাত্র একদিনের মধ্যে গণীমতের পাঁচ লাখ দিরহাম ও অজস্র সম্পদ গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করেছিলেন। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে, উক্ত দিন দিবাগত রাতে নবীজি আপন পরিবারসহ উপবাসেই ছিলেন। এককথায় নশ্বরজগতের ধন দৌলত এবং ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ-শান্তির প্রতি নবীজির মোটেই লক্ষ্য ছিল না। তিনি সবসময় পরকালের চিন্তায় চিন্তিত এবং আল্লাহর প্রেমে বিভোর থাকতেন।
তাই সর্বগুণে গুণান্বিত এই মহান গুণমণির পবিত্র সুন্দর চরিত্রের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেছেন- হে আমার পিয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ! নিশ্চয়ই তুমি অতি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত (সূরা আল কালাম, আয়াত-০৪)। এবং সারা বিশ্ববাসীকে সম্বোধন করে পরম রবের বাণী বিঘোষিত হয়েছে- হে বিশ্ববাসী! নিশ্চয়ই নবীজির পবিত্র সুন্দর জীবনাদর্শের মধ্যে নিহিত রয়েছে তোমাদের জন্য আদর্শ জীবন যাত্রার চরম সুন্দর নিদর্শন। (সূরা আহযাব, আয়াত-২১)
অতএব, হিংসায় উন্মত্ত পৃথিবীকে আজ ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে বাঁধতে হলে নবীজির পবিত্র সুন্দর জীবনাদর্শের পর্যালোচনা করে তাঁর অপূর্ব সুন্দর আচার-আচরণের প্রতিচ্ছবি সারা বিশ্ববাসীর সম্মুখে তুলে ধরতে হবে। তবেই অশান্ত দুনিয়ার বিক্ষুদ্ধ সাগরে ভাসমান মানবমণ্ডলীর জীবন শান্তি-সুখের মনমাতানো সৌরভে ভরে ওঠবে। অনাবিল প্রেমের ডোরে বাঁধা যাবে বিশ্ববাসীকে।