মুসলিম দুনিয়ায় কতকগুলো দিবস ও কতকগুলো রজনী অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালিত হয়। শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ১৫ তারিখের রাতে পালিত হয় শবে বরাত। শাবান মাস হিজরী সনের অষ্টম মাস। এই মাস মাহে রামাদান মুবারকের পূর্ববর্তী মাস হওয়ায় এর গুরুত্ব অপরিসীম। এই মাস রামাদান মাসের একমাস সিয়াম পালন করার প্রস্তুতি গ্রহণ করার মাস। এক তথ্যে জানা যায়, ২য় হিজরীর ১৪ শাবান দিবসে রামাদান মাসের একমাস সিয়াম পালন করার নির্দেশ সম্বলিত ওহী আল্লাহ তাআলা নাযিল করেন। এছাড়াও এ তারিখেই কিবলাহ পরিবর্তন করে মক্কার বাইতুল্লাহমুখী হয়ে নামায পড়ার হুকুম নাযিল হয়েছিল। মদীনা মুনাওয়ারার উপকণ্ঠে আজও যে মসজিদে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযরত অবস্থায় কাবামুখী হয়ে নামায পড়ার নির্দেশ সম্বলিত ওহীপ্রাপ্ত হয়েছিলেন সে মসজিদ রয়েছে, যার নাম মসজিদে কিবলাতাইন অর্থাৎ দুই কিবলার মসজিদ। শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাবসানের সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভূত হয় যে রাত সেটাই শবে বরাত। শবে বরাতকে আরবীতে বলা হয় লাইলাতুল বারাআত। এর অর্থ নিষ্কৃতির রাত, মুক্তির রাত। একে ভাগ্য রজনীও বলা হয়। কুরআন মাজীদের সূরা দুখানে লাইলাতুল মুবারকের উল্লেখ আছে। মনে করা হয়, এই লাইলাতুল মুবারকের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আল্লাহ জাল্লা শানুহু ইরশাদ করেন,
إِنَّا أَنزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُّبَارَكَةٍ ۚ إِنَّا كُنَّا مُنذِرِينَ- فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ -أَمْرًا مِّنْ عِندِنَا ۚ إِنَّا كُنَّا مُرْسِلِينَ
-আমি তো তা নাযিল করেছি এক মুবারক রজনীতে, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয় আমার আদেশক্রমে। (সূরা দুখান, আয়াত ৩-৫)
হাদীস শরীফে এই রাতকে বলা হয়েছে লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান অর্থাৎ মধ্য শাবানের রাত। হাদীস শরীফে আছে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-
إذا كانَ ليلةُ النِّصفِ من شَعبانَ، فقوموا ليلَها وصوموا نَهارَها، فإنَّ اللَّهَ يَنزلُ فيها إلى سماءِ الدُّنيا، فيقولُ: ألا من مُستَغفرٍ فأغفِرَ لَهُ، ألا مِن مُسترزقٌ فأرزقَهُ ألا من مُبتلًى فأعافيَهُ ألا كذا ألا كذا، حتّى يطلُعَ الفجرُ
-মধ্য শাবানের রাত এলে সেই রাতে নামায আদায় করবে এবং দিবসে রোযা রাখবে।
আল্লাহ তাআলা এদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকেই পৃথিবীর নিকটবর্তী আসমানে অবতীর্ণ হন। ঘোষণা হতে থাকে, কোনো ক্ষমা প্রার্থী কি নেই যাকে আমি ক্ষমা করতে পারি? কোনো জীবিকা প্রার্থী কি নেই যাকে আমি জীবিকা দান করতে পারি? কোনো বিপন্ন ব্যক্তি কি নেই যাকে আমি ত্রাণ করতে পারি? এমনকি কেউ নেই? এমনকি কেউ নেই? এমনকি কেউ নেই? এইভাবে ফজর পর্যন্ত ঘোষিত হতে থাকে। (ইবনু মাজাহ, হাদীস নম্বর ১৩৮৮)
শবে বরাত একটি মুবারক ও পুণ্যময় রাত। এ রাত হেলায় কাটিয়ে না দিয়ে সারারাত জেগে থেকে ইবাদত-বন্দেগী করার নির্দেশ রয়েছে। ১৪ তারিখ দিবসে এবং ১৫ তারিখ দিবসে রোযা রাখা অশেষ সাওয়াবের কাজ। ১৪ তারিখ সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে শবে বরাত শুরু হয় এবং সূর্য না উঠা পর্যন্ত এ রাতের সৌকর্য, মাধুর্য এবং মাহাত্ম্য বিরাজ করে। ফরয ইবাদত তথা মাগরিবের নামায, ইশার নামায, ফজরের নামায মসজিদে যেয়ে জামাআতের সঙ্গে আদায় করার পাশাপাশি এ রাত প্রচুর পরিমাণে নফল ইবাদত, যেমন- বেশি বেশি নফল নামায আদায় করা, তরীকতের নিয়মানুযায়ী যিকর-আযকার করা, দুরূদ শরীফ পাঠ করা, আল্লাহ জাল্লা শানুহুর মহান দরবারে ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত গোনাহ খাতার জন্য ক্ষমা চেয়ে কান্নাকাটি করা তথা তাওবা-ইস্তিগফার করা, কুরআন মাজীদ তিলাওয়াত করা উচিত।
তরীকতে তাওবার ফায়য নামক একটি অনুশীলন রয়েছে। বিসমিল্লাহসহ ৩ বার সূরা ফাতিহা, দশবার সূরা ইখলাস, এগারো বার দুরূদ শরীফ, সাতবার আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ে সাওয়াব রিসানী করার পর কলবের দিকে খেয়াল করে নিয়ত করতে হয়। আমি আমার কলবের দিকে মুতাওয়াজ্জাহ আছি। আমার কলব পীর ছাহেব কিবলাহর কলবের ওসীলায় আল্লাহ তাআলার আরশ মুবারক থেকে তাওবার ফায়য আমার কলবে আসুক। হযরত আদম (আ.) এর তাওবা নসীব আমাকেও এনায়েত করুন। এরপর মনে মনে নিজের গোনাহ খাতার কথা চিন্তা করে رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنفُسَنَا وَإِن لَّمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِينَ পড়তে হয়। মৃত পিতা-মাতা, পীর, উস্তাদ, আত্মীয়-স্বজন এবং সকল মুমিন-মুমিনাত ও মুসলিমীন-মুসলিমাতের জন্য সাওয়াব রিসানী করা এবং কবর যিয়ারত করা উচিত, এ রাত দুআ কবূলের রাত। এ রাত আল্লাহ জাল্লা শানুহুর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য হাসিল করার রাত।
মধ্য শাবানের এই রাতটি সম্পর্কে বেশ কয়েকখানা হাদীস রয়েছে এবং প্রতিখানা হাদীসে এ রাতের ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। এ রাতে এক বছরের হায়াত, মউত, রিযক, দৌলত প্রভৃতি নির্ধারিত হয় তথা তাকদীর নির্ধারিত হয় ও লিপিবদ্ধ করা হয়। কুরআন মাজীদে বর্ণিত লাইলাতুল মুবারকাহ ও হাদীস শরীফে বর্ণিত মধ্য শাবানের রাতকে বলা হয় শবে বরাত বা লাইলাতুল বারাআত। কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফের বর্ণনার আলোকেই এর নামকরণ পরবর্তীকালে শবে বরাত হয়েছে বলে জানা যায়।
একটি হাদীস থেকে জানা যায়, হযরত আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) কে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يَنْزِلُ لَيْلَةَ النِّصْفِ مِنْ شَعْبَانَ إِلَى السَّمَاءِ الدُّنْيَا فَيَغْفِرُ لأَكْثَرَ مِنْ عَدَدِ شَعَرِ غَنَمِ كَلْبٍ
আল্লাহ তাআলা শবে বরাতের রাতে দুনিয়ার আকাশে অবতীর্ণ হন অতপর বনু কালবের ছাগল সমূহের পশম থেকে আরো বেশি পরিমাণ বান্দাহকে মাফ করে দেন। (তিরমিযী, হাদীস নম্বর ৭৩৯)
মধ্য শাবানের এ রাত তথা শবে বরাত হেলায় কাটিয়ে দেওয়া উচিত নয়। এ রাতে পটকা ফোটানো, কবর আলোকসজ্জা করা গোনাহের কাজ। এর থেকে বিরত থাকা কর্তব্য, শরীআত অনুযায়ী ইবাদত-বন্দেগী করা কর্তব্য। এ রাত ধনী-নির্ধন, শহুরে-গ্রামীণ সবার কাছে প্রাণস্পন্দনের সুরভি বিলাতে আবির্ভূত হয় প্রতি বছর।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই মুবারক রাতটিকে যেন আমরা অপসংস্কৃতির চর্চা ও বিদআতের আবরণে আচ্ছাদন করে এর ফযীলত থেকে নিজেদেরকে বঞ্চিত না করি। আমাদের সবসময়, সর্বক্ষণ স্মরণ রাখতে হবে আমার সালাত, আমার ইবাদত-বন্দেগী, কুরবানী, আমার জীবন এবং আমার মরণ সবকিছুই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জন্য।