Logo
কথিত শান্তিচুক্তি ও গাযায় যুদ্ধবিরতির ভূতভবিষ্যৎ
মুহাম্মাদ বিন ‍নূর
  • ১০ নভেম্বর, ২০২৫

অবশেষে আবারও গাযায় কথিত ‘শান্তিচুক্তি’ ও যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত হয়েছে, যদিও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর মধ্য দিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার আশা করলেও সেটা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। অক্টোবরের ১০ তারিখ যে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে মিসরের শারম আল-শেখে, কাতার-মিসর-তুর্কির মধ্যস্থতায়,মোটাদাগে সেটা এখনও কার্যকর আছে,যদিও শুরু থেকেই ইসরায়েলী তরফ থেকে বারংবার চুক্তি লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছিল। অক্টোবরের শেষ দিকে ফিলিস্তিনীদের এক ইসরায়েলী নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেলে ইসরায়েল গাযায় বিমান হামলা চালিয়ে শতাধিক গাযাবাসীকে শহীদ করে। এর বাইরে হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযোগ,চুক্তি মুতাবিক হামাস সকল মৃতদেহ ইসরায়েলের হাতে তুলে দেয়নি এখনও,এই অজুহাতে চুক্তি অনুযায়ী মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা দিয়ে আসছে তারা। যদিও গাযার বর্তমান পরিস্থিতিতে সকল মৃতদেহ খোঁজে পাওয়া যে কোন বাহিনীর জন্যই অসম্ভব,তার উপর ইসরায়েল কোনভাবেই ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে মৃতদেহ খোঁজার জন্য পর্যাপ্ত সরঞ্জমাদিও গাযায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। এর ফলে হামাসের জন্য এই কাজ চালিয়ে যাওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়েছে।

সব মিলিয়ে বলা যেতে পারে,গাযায় ইসরায়েলের সর্বাত্মক বর্বর গণহত্যা এখন বন্ধ আছে,একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে ফিলিস্তিনী পক্ষ পুরোপুরি যুদ্ধবিরতি মেনে চলছে,কিন্তু ইসরায়েল তাদের বর্বরতা আসলে এখনো চালিয়েই যাচ্ছে। এই যুদ্ধবিরতিতে জামিনদার হয়েছিল যে তিনটি দেশ—কাতার, মিসর ও তুর্কি তাদের কেউ কেউ এসব লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিলেও কার্যকর কোন পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না। কিন্তু আসলে এই যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ কী? কতটুকু টেকসই হতে যাচ্ছে এই যুদ্ধবিরতি?

এখন অবধি যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপ চলমান। কিন্তু অতীতের যুদ্ধবিরতিসমূহের অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়,পরবর্তী ধাপসমূহ বেশি ভঙ্গুর হয়ে থাকে। এবারে সে সম্ভাবনা আরো বেশি,যেহেতু হামাসের হাতে আর কোন জীবিত বন্দি নেই,তাই হামাসের তরফ থেকে চাপ সৃষ্টি করার কোন অস্ত্র আর অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহ চাইলে এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে ইসরায়েলের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হতো,কিন্তু গত দুই বছরে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে মধ্যপ্রাচ্যের কোন দেশই খুব সক্রিয়ভাবে এমনটা করতে যাবে বলে মনে হয় না। পরবর্তী ধাপে যে বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি মতানৈক্য হবে বলে ধরে নেওয়া যায়। তন্মধ্যে একটি হলো—গাযার ক্ষমতায় কে বসবে,আরেকটি হলো গাযায় হামাসের ভবিষ্যৎ কী হবে।

গাযার শাসনক্ষমতার বিষয়ে হামাস এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছে যে,তারা নিজেরাও গাযার সরকার পরিচালনার বিষয়ে আগ্রহী নয়। কিন্তু মতভেদের জায়গা হলো হামাসের বিকল্প কে? হামাসসহ ফিলিস্তিনীদের প্রস্তাব হচ্ছে, ফিলিস্তিনী নিরপেক্ষ টেকনোক্রেট সরকার দায়িত্ব পালন করবে,আরব-মুসিলম দেশসমূহ পুরো প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে। অন্যদিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রস্তাবনা হচ্ছে ইরাকের কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সাবেক যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারকে প্রধান করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন কর্তৃপক্ষের হাতে গাযার শাসনভার তুলে দেওয়া। ইসরায়েল অবশ্য শুধু টনি ব্লেয়ার নিয়েই সন্তুষ্ট নয়,তাদের দাবি হচ্ছে এই প্রক্রিয়ায় গাযায় এমন কাউকে মোতায়েন করা যাবে না,যে কি-না ইসরায়েলের নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। এই দাবি থেকে মনে হয়,ইসরায়েল কাতার কিংবা তুর্কির উপস্থিতি মেনে নিতে চাইবে না,যেখানে এই দুটি দেশ মধ্যস্থতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শরীক,ডোনাল্ড ট্রাম্পও বর্তমানে এই দুই শরীকের উপর যথেষ্ট নির্ভর করছেন,এমনকি তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের এবং কাতারী আমির তামিম আল থানির ভূয়সী প্রশংসাও করেছেন বিভিন্ন সময়। বলা হয়ে থাকে,শার্ম আল শেখে চুক্তি সম্পাদনের পর যে শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে ট্রাম্পের পক্ষ থেকে নেতানিয়াহুকে আমন্ত্রণের প্রস্তাব থাকলেও নেতানিয়াহুর উপস্তিতিতে তুর্কি প্রেসিডেন্ট শীর্ষ সম্মেলন বর্জন করবেন,এমন সম্ভাবনার কারণে শেষ পর্যন্ত নেতানিয়াহুকে উপস্থিত করানো সম্ভব হয়নি।

হামাসের ভবিষ্যতের বিষয়ে ইসরায়েলের অবস্থান হলো হামাসকে সম্পূর্ণ নিরস্ত্রিকরণ নিশ্চিত করতে হবে, এবং শীর্ষ নেতাদের নির্বাসনে পাঠাতে হবে। অন্যদিকে হামাসের অবস্থান হলো—পৃথিবীর ইতিহাসে আর দশটি সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামী বাহিনীর মতো তারাও একটি কার্যকর স্বাধীন-সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পরই কেবল নিজেরা অস্ত্র ত্যাগ করবে,আল কাসসাম ব্রিগেডকে স্বাধীন ফিলিস্তিনের সামরিক বাহিনীতে একীভূত করবে। মূলত কাতার এবং তুর্কিয়ের প্রভাবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এক্ষেত্রে কিছুটা শিথিলতা প্রদর্শন করছেন,এখনই হামাসকে অস্ত্র ত্যাগ করতে হবে এমন চাপ দেওয়া থেকে কিছুটা বিরত আছেন বলা চলে। এক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যের সম্মিলিত অবস্থান অনেক ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনতে সক্ষম হতো, কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি স্পষ্টত জানিয়ে দিয়েছে,গাযা উপত্যকাকে হামাস মুক্ত করা না হলে তারা গাজা পুনর্নির্মাণে অংশগ্রহণ করবে না। অর্থাৎ গাযায় ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যার দুই বছর পর এসে সৌদি-আমিরাত প্রকাশ্যে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছে এবং হামাসকে চিরতরে ধ্বংস করার ইসরায়েলী পরিকল্পনাকে বাস্তবায়নে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছে। পুরো গাযা যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমাদের মদদে ইসরায়েলের হাতে ধ্বংস হলেও পুনর্গঠনের দায়িত্ব ট্রাম্প সাহেব মধ্যপ্রাচ্যের ঘাড়েই চাপাতে যাচ্ছেন,তা বলাই বাহুল্য। তুর্কিয়ে,মিসর এবং কাতার এক্ষেত্রে গাযা পুনর্গঠনের জন্য হামাস নিরস্ত্রিকরণের শর্তারোপের বিরোধিতা করলেও বাস্তবতা হচ্ছে তুর্কি কিংবা মিসরের অর্থনৈতিক সক্ষমতা নেই,আর কাতার অন্যতম অর্থায়নকারী রাষ্ট্র হলেও সৌদি-আমিরাতী সহযোগিতা ছাড়া একা কাতারের পক্ষে গাযা পুনর্নির্মাণের ব্যয়ভার বহণ সম্ভব হবে না।

অবশ্য পুনর্নির্মাণ বহু দূরের বিষয়,গাযার শাসনভার কাদের হাতে থাকবে এবং হামাসের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে,এই দুই প্রশ্নে চলমান যুদ্ধবিরতি যে কোন সময় ভেঙে যাওয়ার মতো পরিস্থিতির আশঙ্কাই এখন সবচেয়ে বেশি। এক্ষেত্রে কাতার এবং তুর্কি কিছুটা হলেও ফিলিস্তিনী স্বার্থের বিষয় মাথায় রাখার চেষ্টা করবে হয়তো— অন্ততপক্ষে নিজেদের কোন ধরনের ক্ষতির সম্ভাবনা যতক্ষণ তৈরি হবে না ততক্ষণ অবধি,মিসর নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে হামাসসহ সকল ফিলিস্তিনীর গাযায় বসবাসের নিশ্চয়তা চাইবে,অন্যথায় গাযাবাসী মিসরে আশ্রয় নিয়ে সে অজুহাতে ইসরায়েল যে আবার মিসর আক্রমণ করবে, তা তো বলাই বাহুল্য, কিন্তু সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে ইসরায়েলের স্বার্থ বাস্তবায়নে এবং হামাসকে চিরতরে ধ্বংস করতে যে কোন অবস্থান গ্রহণ করবে বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের কট্টরপন্থীদের মধ্যে তো সব সময়ই যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাযায় আবার হামলা চালানোর পক্ষে জোরালো অবস্থান রয়েছে। এর আগে হামাসের হাতে থাকা বন্দিদের কারণে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে যুদ্ধবিরতির পক্ষে যে চাপ ছিল,সকল জীবিত বন্দির মুক্তির পর আর সে চাপও থাকবে না বলেই প্রতীয়মান।

ফলে খুব সংক্ষেপে বলা যেতে পারে, কাতার, মিসর ও তুর্কি চাইবে হামাস গাযায় থাকা সত্ত্বেও যেন যুদ্ধবিরতি অব্যাহত থাকে,গাযা পুনর্নির্মাণ সম্ভব হয়,অন্যদিকে ইসরায়েলের পক্ষে সৌদি ও আরব আমিরাত যে কোন মূল্যে হামাসকে নির্মূল করতে চাইবে,প্রয়োজনে ইসরায়েলী আগ্রাসন পুনরায় শুরু করার বিষয়েও তাদের মৌন সম্মতি থাকবে। এই পরিস্থিতিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপরই নির্ভর করবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। ট্রাম্পের উপর ইহুদিবাদীদের প্রভাব অত্যন্ত শক্তিশালী,তার জামাতা নিজে জায়নবাদী ইয়াহুদী এবং বলা চলে হোয়াইট হাউসের ভিতরে ইসরায়েলের স্বার্থ দেখভালের দায়িত্ব পালন করেন, এতদসত্ত্বেও সাম্প্রতিক পরিস্তিতিতে ট্রাম্প মধ্যপ্রাচ্যে তার নিজের স্বার্থের সাথে ইসরায়েলী স্বার্থের সংঘাতের আশঙ্কা করছেন,সেই আশঙ্কা থেকেই ইদানীং তুর্কি প্রেসিডেন্টের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে কাতারী-তুর্কি লবি অব্যাহত কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের স্বার্থকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর সক্ষমতা যে দেশগুলোর রয়েছে,তাদের গাদ্দারির কারণে সেটা পুরোপুরি কার্যকর হবে না,তা বলাই বাহুল্য।

এই পরিস্থিতিতে গাযায় চলমান কথিত যুদ্ধবিরতি (যে যুদ্ধবিরতির মধ্যেই ইসরায়েল শত শত ফিলিস্তিনীকে হত্যা করতে পারে) মোটেও কোন টেকসই যুদ্ধবিরতি বলে মনে হচ্ছে না। ট্রাম্পের মর্জির উপর এ যুদ্ধবিরতির কার্যকাল নির্ভর করবে,মার্কিন প্রশাসন যতক্ষণ ইসরায়েলের উপর চাপ অব্যাহত রাখবে,ততক্ষণ সর্বাত্মক বোমা হামলা হয়তো শুরু হবে না,কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের তরফ থেকে ইসরায়েলের উপর চাপ খানিকটা হ্রাস পেলেই পুনরায় পুরো দমে ইসরায়েলী বর্বরতা শুরু হবে,তা মোটামুটি নিশ্চিত। তাছাড়া এই সংকটের মূল যে কারণ, সেই ইসরায়েলী ঔপনিবেশ ও দখলদারিত্বের অবসান না হলে গাযা তথা ফিলিস্তিনে কোন স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব নয়,তা সকলেরই জানা। অথচ ট্রাম্পের প্রস্তাবনায় এই মূল সংকট নিরসনের জন্য কোন প্রস্তাবনাই নেই। ফলে এই যুদ্ধবিরতি দিনশেষে মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক দৌড়ঝাঁপের উপলক্ষ্য হয়েই থাকার সম্ভাবনাই বেশি,ইতিহাসের পাতায় এটি ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা নেহায়েতই অনুল্লেখ্য।

ফেইসবুকে আমরা...