Logo
ন্যায় ও মানবিকতার দীপ্তশিখা :  নববী যুগের বিচারব্যবস্থা
আহমাদ রায়হান ফারহী
  • ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

ইসলামপূর্ব আরব ছিল অনিয়ম, অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের এক কঠিন অধ্যায়। কোনো একক শাসন বা রাষ্ট্রব্যবস্থা ছিল না। ফলে কোনো সুসংগঠিত বিচারব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। গোত্রই ছিল মানুষের পরিচয়, শক্তি ও নিরাপত্তা। যেহেতু গোত্রীয় শাসন বলবৎ ছিল, গোত্রপ্রধানরাই ছিলেন আইনপ্রণেতা, বিচারক ও বাস্তবায়নকারী। তখন মূলত দুই ধরনের আইন প্রচলিত ছিল। গোত্রীয় আইন ও আন্তর্গোত্রীয় আইন। গোত্রীয় আইন ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত কিংবা সম্মিলিত সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে প্রণয়ন করা হতো। গোত্রের শাসকরা নিজেদের অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতা, অতীত ইতিহাস, সামাজিক রীতি ও মূল্যবোধের আলোকে আইন প্রণয়ন করতেন। গোত্রের অধিবাসীগণ সেটা পালনে বাধ্য থাকতেন।

গোত্রীয় শাসনের বাহিরে পশুপালন, পানির উৎস সন্ধান, তীর্থযাত্রা, বাণিজ্যিক কাফেলার নির্বিঘ্ন চলাচল ও গোত্রীয় সংঘাত নিরসনে কিছু আন্তর্গোত্রীয় আইনও কার্যকর ছিল। এসব আইনের ভিত্তি ছিল আন্তর্গোত্রীয় চুক্তিসমূহ। তবে আইনগুলোর কার্যকারিতা ও প্রয়োগ নির্ভর করত সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আন্তর্গোত্রীয় আইনও কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলত।

আইনের দৃষ্টিতে বিচার করলে তৎকালীন আরব উপদ্বীপ ছিল প্রবল বিশৃঙ্খল ও অরাজক একটি সমাজ। কোনো কেন্দ্রীয় আইন কিংবা ন্যায়নিষ্ঠ বিচারব্যবস্থা ছিল না। মানুষের জীবন, সম্মান ও সম্পদ ছিল চরম অনিরাপদ। ঐতিহাসিকদের মতে, সে সময় আরব ছিল এমন এক সমাজ যেখানে বিচার ছিল শক্তিশালীর হাতে আর দুর্বল ছিল চিরবঞ্চিত।

ঠিক এমন সময় মানবজাতির প্রতি আল্লাহর এক অতুলনীয় অনুগ্রহ রূপে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন ঘটে। তাঁর মাধ্যমে সভ্যতা পেল আলোর পথ, অনুপম আদর্শ ও সত্য-ন্যায়ভিত্তিক ইসলামী বিচারব্যবস্থা। ইসলামী বিচারব্যবস্থার মূলেই রয়েছে মানুষের জীবন, সম্পদ, সম্মান ও বংশপরম্পরার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

আল্লাহ তাআলা মানুষের মধ্যে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে কুরআন নাযিলের অন্যতম উদ্দেশ্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে, নিশ্চয়ই আমি আপনার প্রতি সত্যসহ কিতাব নাযিল করেছি, যাতে আপনি আল্লাহ আপনাকে যা জানিয়েছেন সে অনুযায়ী মানুষের মধ্যে বিচার মীমাংসা করতে পারেন। আর আপনি বিশ্বাসভঙ্গকারীদের সমর্থনে তর্ক করবেন না। (সূরা নিসা, আয়াত: ১০৫)

মক্কায় ঈমান, নৈতিকতা ও মানবিকতার বুনিয়াদ গড়ে ওঠলেও, মদীনায় রাসূল (সা.) এর হিজরতের পর ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামী বিচারব্যবস্থা প্রায়োগিক ভিত্তি পায়। রাসূল (সা.) মদীনার ইসলামী রাষ্ট্রের একাধারে রাষ্ট্রপ্রধান, আইনপ্রণেতা ও বিচারক ছিলেন। বিশেষত আইন প্রণয়ন ও বিচারকার্য সম্পাদনের কাজ তিনিই করতেন। বাস্তবায়নের দায়িত্ব কখনও কখনও অন্যদের অর্পণ করতেন। কেন রাসূল (সা.)-কে বিচারক করা হয়েছিল সে সম্পর্কে ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞরা কিছু কারণ উপস্থাপন করেছেন। যথা:-

১. সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ: কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন সে অনুযায়ী আপনি তাদের মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি করুন এবং যে সত্য আপনার নিকট এসেছে তা ছেড়ে তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবেন না। (সুরা মায়েদা আয়াত: ৪৮)

২. ওহীর মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা: রাসূল (সা.) ছিলেন আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত ওহীর অধিকারী। তাই তাঁর রায় সর্বোচ্চ সত্যনির্ভর ছিল।

৩. নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শ্রেষ্ঠত্ব: মানবতার ইতিহাসে তাঁর মতো চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ণ, নির্লোভ বিচারক আর কেউ ছিলেন না।

৪. সামাজিক স্থিতি ও নেতৃত্ব সুদৃঢ় করা: ন্যায়বিচারই সামাজিক শান্তির মূল। এজন্য রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তাঁর হাতে বিচারের দায়িত্ব থাকা ছিল প্রয়োজনীয়।

৫. তাঁর আনুগত্য ঈমানের অংশ: মুসলমানদের তাঁর প্রতি সম্মান ও আনুগত্যের বিধান বিচারিক সিদ্ধান্তগুলোর বাস্তবায়নকে আরও কার্যকর করে তুলেছিল।

মদীনার ইসলামী সমাজের একটি সাধারণ নিয়ম ছিল- সাহাবীগণ যখন কোনো সমস্যা বা সংকটের সম্মুখীন হতেন অথবা কোনো বিরোধ বা বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা করতেন তখন তারা আল্লাহর রাসুল (সা.) এর কাছে যেতেন। তিনি ওহীর নির্দেশনা ও তাঁর জ্ঞান-প্রজ্ঞার আলোকে তা সমাধান করতেন। রাসূল (সা.) এর বিচারকার্য বিশ্লেষণ করলে দুই ধরনের সিদ্ধান্ত পাওয়া যায়।

১. বিষয়টি সরাসরি মানুষের ঈমান ও ইসলামের সাথে সম্পর্কিত ছিল। এই ধরনের বিষয়ে মহানবী (সা.) সাধারণত ওহীর অনুসরণ করতেন বা ওহীর জন্য অপেক্ষা করতেন। ওহি নাযিল হওয়ার পর, তিনি অন্বেষণকারীদের কাছে আল্লাহর বিধান পাঠ করতেন। এক্ষেত্রে, একজন ‘শরীআত  প্রণেতা’র বৈশিষ্ট্য তাঁর মধ্যে প্রবল ছিল।

২. যেসব বিষয় মানুষের ঈমান ও আমলের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত নয়; বরং সেগুলো পার্থিব জীবনের সাথে বেশি সংশ্লিষ্ট। এই ধরনের বিষয়ে রাসূল (সা.) কখনও কখনও ইজতিহাদ ব্যবহার করতেন। তিনি তাঁর ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করতেন। এই ক্ষেত্রে তাঁর মধ্যে একজন ‘কাযী’ বা বিচারকের বৈশিষ্ট্য প্রাধান্য পেত। প্রথম ধরনের সিদ্ধান্ত মান্য করা মুসলমানদের জন্য সর্বদা বাধ্যতামূলক ছিল। তবে দ্বিতীয় প্রকার সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে রাসূল (সা.) মাঝে মাঝে ছাড় দিয়েছিলেন।

উম্মে সালমা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, তোমরা আমার কাছে বিবদমান বিষয় মীমাংসার জন্য এসে থাকো। আমিও একজন মানুষ। হয়তো তোমাদের কেউ (একপক্ষ) অপর কারো (বিপক্ষের) তুলনায় নিজের যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপনে অত্যন্ত বাকপটু হয়ে থাকবে। আর আমি তো তোমাদের বক্তব্য শুনেই তার ভিত্তিতে বিচারকার্য করি। অতএব, আমি তোমাদের কারও পক্ষে তার ভাইয়ের হকের কোন অংশের ফয়সালা দিয়ে ফেলতে পারি। এ অবস্থায় সে যেন তার কিছুই গ্রহণ না করে। কারণ আমি তাকে জাহান্নামের একটি টুকরা কেটে দিচ্ছি, যা নিয়ে সে কিয়ামতের দিন হাযির হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

ওহীর মাধ্যমে প্রকৃত তথ্য জানার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন মহানবী (সা.) বাহ্যিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে রায় দিতেন? এই প্রশ্নের জবাবে সিরাত প্রণেতারা বলেন, আল্লাহ হয়তো বাহ্যিক প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে রায় দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন যাতে ইহকালীন বিষয় ও পরকালের মধ্যে পার্থক্য বজায় রাখা যায়, পার্থিব শৃঙ্খলা রক্ষা করা যায়, বান্দার ঈমান পরীক্ষা করা যায় এবং তাকে অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ দেওয়া যায়।

আল্লাহর রাসূল (সা.) সাধারণত বাদী ও বিবাদী উভয়ের উপস্থিতিতে রায় দিতেন, যেন উভয় পক্ষের মনে কোনো সন্দেহ না থাকে এবং তারা আত্মপক্ষ সমর্থন করতে পারে। শুধু তাই নয়, বিচারালয়ে অন্যান্য সাহাবীদের উপস্থিতিও অনুমোদিত ছিল, যাতে তারাও শিখতে পারেন এবং পরবর্তী উম্মাহর কাছে তা পৌঁছে দিতে পারেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, অতএব আপনার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে আপনাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর আপনি যে ফয়সালা দিবেন সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়। (সূরা নিসা আয়াত: ৬৫)

দ্রুত বিচার বাস্তবায়ন ছিল নববী যুগের বিচারব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কোনো বিষয়ে রায় দেওয়ার পর তিনি তাৎক্ষণিকভাবে তা বাস্তবায়ন করতেন। তিনি নিজে বিচার বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করতেন; কখনও কখনও অন্যদের ওপর ছেড়ে দিতেন। মহানবী (সা.) অপরাধ প্রমাণের ক্ষেত্রে যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন সেটি ছিল, বাদী প্রমাণ উপস্থাপন করবে এবং আসামী শপথ করবে। অর্থাৎ, যে ব্যক্তি দাবি নিয়ে এগিয়ে আসবে সে দাবির সমর্থনে প্রমাণ পেশ করবে। যদি সে প্রমাণ পেশ করতে অক্ষম হয়, তবে যে ব্যক্তি দাবি অস্বীকার করবে সে শপথ করবে যে, দাবিটি সত্য নয়। রাসূল (সা.) প্রমাণ হিসেবে মানুষের সাক্ষ্যকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সত্য প্রতিষ্ঠায় সাক্ষীর সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করার নির্দেশও দিয়েছিলেন।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্বে ন্যায়বিচারের এক অনন্য উদাহরণ স্থাপন করে গিয়েছেন। তাঁর সময়ের বিচারব্যবস্থা এতটাই ন্যায্য ছিল যে, মুসলিম-অমুসলিম উভয়েরই এর ওপর সমান আস্থা ছিল। কারণ তিনি একজন নিরপেক্ষ বিচারক ছিলেন। তাঁর জীবনের অনেক ঘটনা এর সাক্ষ্য বহন করে।

আনসার গোত্রের বনী উবাইরাকের একজন ব্যক্তি ত্বমা ইবন উবাইরাক, তার প্রতিবেশী কতাদাহ ইবন নোমানের একটি বর্ম চুরি করে আটা ভরা খাপে লুকিয়ে নিয়ে যায়। খাপের ছিদ্র দিয়ে আটা ঝরে পড়তে থাকায় সেই চিহ্ন তার ঘর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পরে সে বর্মটি আরেক ইয়াহুদী জায়িদ ইবন সামিনের কাছে লুকিয়ে রাখে। বর্মের সন্ধান চাইলে ত্বমা শপথ করে বলে সে নেয়নি। কিন্তু আটার চিহ্ন অনুসরণ করে লোকেরা ইয়াহুদীর ঘর থেকে বর্মটি উদ্ধার করে। ইয়াহুদী চাপের মুখে স্বীকারও করে যে ত্বমা তাকে বর্মটি দিয়েছে। এ অবস্থায় ত্বমার স্বপক্ষে তার গোত্রীয় লোকেরা এসে নবীজি (সা.)-কে ইয়াহুদীর বিরুদ্ধে রায় দিতে অনুরোধ করলে, ঘরে বর্ম পাওয়ার কারণে নবীজি (সা.)-এর ধারণাও ইয়াহুদীর প্রতি ঝুঁকে পড়ে। ঠিক তখনই সূরা নিসার ১০৫ নম্বর আয়াত নাযিল হয়। আল্লাহ জানিয়ে দেন সত্য বিচার কী এবং কাকে দোষী গণ্য করতে হবে। ওহীর আলোকে স্পষ্ট হয়, ইয়াহুদী নির্দোষ এবং প্রকৃত চোর ত্বমা ইবন উবাইরাকই। নবীজি (সা.) দ্ব্যর্থহীনভাবে তা ঘোষণা করেন এবং মুসলিম পরিচয়ধারী ত্বমাকে দোষী সাব্যস্ত করেন। (মুসতাদরাকে হাকিম ৪/৩৮৫–৩৮৮; তিরমিযী ৩০৩৬)

ফেইসবুকে আমরা...