আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর ঈসালে সাওয়াব মাহফিলে যাওয়া হয় প্রায় প্রতিবছরই। তবে স্থানিক দূরত্বের জন্য কোনোবারই বিকেলের পূর্বে পৌঁছানো হয়নি মুবারক এই মাহফিলে। আল্লামা ফুলতলী (র.)-এর অন্যতম এক খলীফা, যার সুহবাতে কিছু সময় অতিবাহিত করার সুযোগ হয়েছে তিনি প্রায়ই বলতেন ফুলতলীর ঈসালে সাওয়াব মাহফিলে সকাল সকাল যাওয়া উচিত, দিনের বেলায় বড় ছাহেব (আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী) যে কাজগুলো করেন তা পর্যবেক্ষণ করলে দৈনন্দিন জীবনে উপকৃত হওয়া যায়, তিনি বাদ যুহর যে বয়ান রাখেন তা পুরো উম্মাহর জন্যই দিকনির্দেশনামূলক। মুরিদীন মুহিব্বীনদের একটি বড় অংশ মাহফিলের শুরুর দিকের এই বরকত থেকে বঞ্চিত হন। জীবনে বহুবার তাই দুপুরের পূর্বেই মাহফিলে উপস্থিত হওয়ার লক্ষ্যে তাড়াতাড়ি যাত্রা শুরু করেছি। কিন্তু এই মাহফিলের জনস্রোত প্রতিবারই বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘ জ্যাম ঠেলে কোনোবারই আসরের ওয়াক্তের পূর্বে মাহফিলে উপস্থিত হওয়ার সুযোগ হয়নি। প্রতিবারই দেরি করতাম আর আফসোস করতাম বড় ছাহেবের বাদ যুহরের মজলিসে কবে বসার সুযোগ হবে! আলহামদুলিল্লাহ! এবার সে সুযোগ হয়েছে। যুহরের নামাযের পর বড় ছাহেব আসলেন, নসীহত করলেন, আসহাবে বদরীনের নাম মুবারক, খতমে খাযেগান এবং সর্বশেষ মীলাদ শরীফ পড়লেন। সেখানে বসে যা অনুভব করেছি তাই এখানে তুলে ধরছি যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত পরিসরে-
১.
‘হে ডাল! গাছের সাথে সম্পর্ক রাখো, তারপর বসন্তের অপেক্ষা করো।’
এবার বড় ছাহেবের নসীহতের বড় একটি অংশ জুড়ে ছিলো উপমহাদেশে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মধ্যে বিদ্যমান অল্পকিছু মতবিরোধের ফলে তৈরি দূরত্ব এবং এক্ষেত্রে করণীয়। তিনি তাঁর বয়ানে ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ’ বলা, ইস্তিগাসা ইত্যাদি বিষয়ে উদ্বৃত করলেন উলামায়ে দেওবন্দ ও তাবলীগ জামাআতের সর্বজন শ্রদ্ধেয় উলামাদের লেখনী, পেশ করলেন উপমহাদেশে সকল ঘরানার উলামার সনদের মিলনস্থল শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) কর্তৃক রাসূল e এর ইস্তিগাসা চাওয়ার দলীল। এসব দলীলের পরে তিনি বলেন- ‘হে ডাল! গাছের সাথে সম্পর্ক রাখো, তারপর বসন্তের অপেক্ষা করো।’ একথা তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যেসব হানাফী নবীন অথবা প্রবীণ আলিম নজদের লু হাওয়ার প্রভাবে সবকিছুতে বিদআত খোঁজেন, তাজদীদ করতে চান এবং ফলশ্রুতিতে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়েই চলেন। বিভিন্ন ইলমী সিলসিলার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করলেও নিজে নিজে মুজতাহিদ হওয়ার এবং বিচ্ছিন্ন ফাতওয়া দেওয়ার প্রবণতা আজকাল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়তই লক্ষ্য করা যায়। এ প্রবণতার ফলে উপমহাদেশের হানাফীদের মাঝে সুন্নী ও দেওবন্দী ধারার বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে অধুনা জেগে ওঠা কথিত আহলে হাদীসদের ময়দান দখলের চেষ্টা এবং সম্প্রতি ফিলিস্তিনে জায়োনিস্টদের বর্বরতার মধ্যেও মুজাহিদদের সমালোচনা ও ইয়াহুদীদের সাফাই গাওয়া থেকে একথা প্রমাণিত হয়েছে নজদী- তাইমীদের দ্বারা দ্বীনের, আহলুস সান্নাহ ওয়াল জামাআতের কোনো উপকারের সম্ভাবনা নাই। এমন অবস্থায় ছোট ছোট মতপার্থক্য ভুলে আহলুস সুন্নাহর উলামাদের সহনশীল অবস্থানে থেকে একসাথে কাজ করা এখন সময়ের দাবি। বড় ছাহেব তাই আহলুস সুন্নাহর সাথে নিজেকে নিসবতকারী, হানাফী হিসেবে নিজেকে পরিচয়দানকারী সকল ঘরানার উলামাদের সতর্ক করে দিলেন শিকড় বিচ্ছিন্ন না করার ব্যাপারে, ইশারা করলেন একতার উৎস আকাবিরীনদের দিকে, মদীনার সবুজ গম্বুযের দিকে, যেখানে ফিরে গেলে আমরা সবাই এক হয়ে যাই।
২.
‘ভাঙা ঝুপড়িতে যে স্বাদ পেয়েছি কোন অট্টালিকায় তা পাইনি’
বড় ছাহেবের এবারের বক্তৃতা জুড়েও ছিলো সৃষ্টির সেবার প্রতি আহবান। তিনি কোথাও নসীহত করবেন অথচ খিদমাতে খালকের কথা বলবেন না, এ যেন হতেই পারে না। তিনি এতো দরদমাখা হৃদয়ে ইয়াতীমদের, দুস্থজনের সেবার কথা বলেন শুনে যেন মনে হয় যে লোক ইয়াতীমদের প্রতি সদয় হবে না, অসহায়ের সহায় হবে না সে এই সিলসিলায় যতবারই বাইআত করুক না কেন তার কোন উপকারে আসবে না। মুরীদের হৃদয়ে বড় ছাহেব এ বার্তা পৌঁছে দেন যদি তোমরা সত্যিকারার্থে তাসাওউফের এই মহান রজ্জু থেকে উপকৃত হতে চাও, যদি তোমরা রাসূলুল্লাহ e এর আনিত দ্বীনের স্বাদ পেতে চাও তাহলে তোমাদের অবশ্যই খিদমাতে খালকে সম্পৃক্ত হতেই হবে। তিনি যখন সুরমার তীরে কোন ইয়াতীমের ভাঙ্গা ঘরের ভাঙ্গা চাটাইয়ে বসার গল্প করেন তখন নিষ্ঠাবান মুরীদরাও তাদের মনে মনেই হয়তো আশেপাশে এমন ইয়াতীমের সন্ধান করেন, অসহায়ের সন্ধান করেন। পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া ভোগবাদ এবং আমিত্বের মধ্যে মানুষকে আর্ত মানবতার প্রতি আহবান ক্রমশই দূরূহ হয়ে উঠেছে। কিন্তু তিনি যখন বলেন- ‘ভাঙা ঝুপড়িতে যে স্বাদ পেয়েছি কোন অট্টালিকায় তা পাইনি’ তখন তাঁর পরিতৃপ্ত হাসি এবং উজ্জ্বল চোখ দেখে যে কারো মনে এ বিশ্বাস জন্মে যে তার এ কথা নিছক বলার জন্য বলা নয়, বাস্তবেই তিনি অট্টালিকা থেকে ভাঙা ঝুপড়িতে বেশি স্বাদ পেয়েছেন। আর পাবেনই বা না কেন? যে পীরের কোন বাহারী গদি নেই, যিনি অনায়াসেই মুরীদদের সাথে মাটিতে বসে যেতে পারেন, যিনি মযলুম রোহিঙ্গাদের জন্য নব্বই বছর বয়সেও দেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ছুটে বেড়ান তিনি যে শান শওকতের অট্টালিকার পরিবর্তে অসহায়-বঞ্চিতের ভাঙা ঘরে বেশি তৃপ্তি পাবেন এটাই তো স্বাভাবিক।
৩.
‘রাওদা শরীফে উপস্থিত হলে সালাম প্রদান করে দূরে কোথাও গিয়ে মাটিতে বসে যে অনুভূতি পাই তা হৃদয়গ্রন্থীতে মধুর সুর তুলে’
বড় ছাহেব যখন আসহাবে বদরীনের নাম মুবারক পাঠ করছিলেন তখন একে একে সাহাবায়ে কিরামের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনারও অবতারণা করছিলেন। বিলাল (রা.) এর উপর অত্যাচারের কথা, সায়্যিদুশ শুহাদা হামযা (রা.) এর কথা, শুহাদায়ে উহুদের যিয়ারতের ফদীলত, সিদ্দীকে আকবর (রা.) এর কবরে সালাম দেওয়ার নির্দেশনা এসবই তিনি বলছিলেন বদরের বীর সাহাবীদের নাম নিতে নিতে। সাহাবায়ে কিরামের জীবনালেখ্য বলার পাশাপাশি আসছিলো মদীনার ঐতিহাসিক সব মুবারক স্থাপনার কথা, বলছিলেন রাসূলে পাক e এর দরবারে রিসালাতে হাযির হলে সালাত ও সালাম পেশ করার আদবের কথা। রাওদা শরীফের বরকত হাসিলের উপায় হিসেবে বলেছেন- ‘রাওদা শরীফে উপস্থিত হলে সালাম প্রদান করে দূরে কোথাও গিয়ে মাটিতে বসে যে অনুভূতি পাই তা হৃদয়গ্রন্থীতে মধুর সুর তুলে।’ একথা থেকে নিঃসন্দেহে বর্তমান যুগের সেসব মুসলমানরা রাওদা শরীফের সম্মান সম্পর্কে সচেতন হবে যারা সেখানে উপস্থিত হয়েই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একথার মর্ম যে অনুভব করতে পারবে তার জন্য কঠিন হবে দরবারে রিসালাতে গিয়ে ‘রিয়া’র সম্ভাবনা থাকে এমন কোন কাজ করা। যখন বড় ছাহেব বদরের সাহাবীদের নাম পড়ছিলেন তখন মনে হচ্ছিলো বালাই হাওরে বসা লাখো বনী আদম যেন পাক মদীনার যাত্রী, তাই বক্তা যাত্রীদের মদীনার বিবরণ দিচ্ছেন সুনিপুণভাবে, নির্দেশনা দিচ্ছেন সেখানে গেলে কী কী করণীয় তার ব্যাপারে। এ নির্দেশনার পরে তিনি যখন মাওলার দরবারে হাত উঠিয়ে বলেন- ‘মাওলা, আমাদের সবার জন্য মদীনার যিয়ারত কবুল করে নেন’ তখন আর বিশ্বাস হতে বাকি থাকে না তিনি এই কাফেলাকে মদীনার দিকেই টানছেন, রাওদায়ে আতহারে দাঁড়িয়ে বিনীত সালাম পেশ করার যোগ্য করে তুলতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন।
৪.
‘আমাদের হৃদয় একেবারে মুর্দা হয়ে গেছে মাওলা, হৃদয়ে নূরের বাতি জ্বালো’
বড় ছাহেবের খতমে খাযেগান পড়ার ধরণ খুবই স্বতন্ত্র এবং হৃদয়গ্রাহী। এর প্রতিটি বাক্য বলার পরে আল্লাহর এই সীফাতের সাথে সম্পর্কিত কিছু চান, বাংলা ভাষায় হৃদয় থেকে চান, শ্রোতারাও তা বুঝতে পারেন। যেমন- ‘আল্লাহুম্মা ইয়া কাদিয়াল হাজাত, আল্লাহ আমাদের যার যে মাকসাদ আছে তা নেক বানিয়ে দাও এবং পূরণ করে দাও….. আল্লাহুমা ইয়া শাফিআল আমরাদ, হে শিফাদানকারী! আমাদের অসুস্থদের ঘাটে ঘাটে না ঘুরিয়ে তোমার কুদরত থেকে শিফা দাও।’ খতমে খাযেগানের এমন স্বতন্ত্র হৃদয়গ্রাহী পঠন সকল যাকিরীনের মনেই আলোড়ন তোলে, মাওলার দরবারে হাত তোলার আগেই তাঁর দরবারে সমবেত কণ্ঠে যেন নিজেদের কষ্টের ফরিয়াদ করে। খতমে খাযেগানের মাধ্যমে এভাবে সবার মনকে জাগ্রতকরণ কেবল বড় ছাহেবের মাধ্যমেই সম্ভব। খতমে খাযেগানে একেকটি বাক্যের পরে একেক রকম দুআর মধ্যে যখন তিনি বলেন- ‘আল্লাহুম্মা ইয়া হাইয়্যু ইয়া কাইয়্যুম’ তখন আমি কিছুটা দ্বিধায় ছিলাম এবার তিনি কি দুআ করেন। ভেবেছিলাম হয়তো মৃতদের জন্য দুআ করবেন, অথবা হয়তো জীবিতদের দীর্ঘ জীবনের জন্য দুআ করবেন। কিন্তু তিনি দুআ করলেন- ‘আমাদের হৃদয় একেবারে মুর্দা হয়ে গেছে মাওলা, হৃদয়ে নূরের বাতি জ্বালো।’ তখন মনে হলো আমারো তো আল্লাহর কাছে এটাই চাওয়ার ছিলো! যিনি চিরঞ্জীব, যিনি সর্বশক্তিমান তার কাছে দীর্ঘ জীবন চাওয়ার থেকে হৃদয়ের সজীবতা চাওয়াই কি বেশি যৌক্তিক নয়? আমাদের চিরশত্রু শয়তানের প্ররোচনায় আমরা যখন প্রতিনিয়ত পদস্খলিত হই, এভারেস্টস্পর্শী পাপাচারে আমাদের হৃদয় যখন মৃতপ্রায়, আমাদের হৃদয় থেকে যখন খোদাভীতি দূর হয়ে যাচ্ছে, জাহান্নামের ভীতি দূর হয়ে যাচ্ছে তখন সুযোগ পেলেই আল্লাহর দরবারে হৃদয়কে অনুতপ্ত রাখার, ভীত রাখার এবং জীবিত রাখার দুআ করাই তো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বড় ছাহেব এভাবেই যা আমাদের হৃদয়ের গহনে লুকিয়ে থাকে তাই যেন আল্লাহর কাছে একে একে ফরিয়াদ করে বলে যান।
ফুলতলীর ঈসালে সাওয়াব মাহফিলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুরাটা সময়ের অনুভূতি লেখা এতো ছোট পরিসরে সম্ভব নয়। ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.) এর মাযার শরীফের ফাইয, দুস্থজনদের প্রয়োজনীয় উপকরণ বিতরণ, লাখো মানুষের সুশৃঙ্খল শিরনী খাওয়া, উলামায়ে কিরামের বয়ান, হৃদয়গ্রাহী নাশিদ, শেষ রাতের রোনাযারি, মাহফিল আয়োজকদের দক্ষতা সকল কিছু নিয়েই লেখা যায় স্বতন্ত্র সব রচনা। সন্ধ্যার পরে বড় ছাহেবের যিকরের মজলিসের অনুভূতি আরো এক সুদীর্ঘ উপাখ্যান। সেসব কথা হৃদয়ের গহন তলে গোপনই থাক, মুরশিদ আর মুরীদের মাঝেই সীমাবদ্ধ থাক। এবার আমি তৃপ্ত সকালে এবং গভীর রাতে মাযার শরীফ থেকে ফাইয হাসিলের চেষ্টা, মাগরিবের পরে যিকরের মাহফিলের পাশাপাশি যুহরের পরে বড় ছাহেবের নসীহত আর খতমে খাযেগানের মজলিসে বসতে পেরেছি। ফুলতলী থেকে আসার পরে এখনো সে মজলিসের রেশ কাটেনি। সেদিন দুপুরে পেন্ডালের একদম সামনের দিকেই বসেছিলাম। তাই সেই মুবারক চেহারাও দেখেছি প্রাণ ভরে। চোখ বন্ধ করলেই তার সেই চেহারা ভেসে উঠে, বুলন্দ কণ্ঠে শুনতে পাই মুল্লা জামী (র.) এর শের- ‘তারাহহাম ইয়া রাসূলাল্লাহ তারাহহাম।’ হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে মুরশিদের দরবার হতে নিশ্চয়ই আকা আলাইহিস সালামের রহম ও করম ছাড়া খালি হাতে ফিরিনি।