সপ্তাহ দুয়েক আগে আমেরিকার মিডিয়া ব্যক্তিত্ব পিয়ার্স মরগানের সাথে একটি পডকাস্টে অংশগ্রহণ করেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ। মরগান আলবানিজকে প্রশ্ন করেছিলেন, নারী কী? আলবানিজ জবাব দিয়েছেন, “নারী (woman) হচ্ছেন একজন প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোক (adult female)।” সহজ প্রশ্ন এবং সোজাসাপ্টা জবাব। অথচ এই জবাবের কারণে আলবানিজকে ধুয়ে দিয়েছে তথাকথিত প্রগতিশীল মিডিয়া এবং নারীবাদী ও সমকামী বিভিন্ন সংগঠন। বলা হচ্ছে, আলবানিজ জেন্ডার তথা লিঙ্গকে নির্ধারণ (define) করে দিয়েছেন।
অনেকে ভাবছেন, আলবানিজ তো ভুল কিছু বলেননি। কেন তাঁর নিন্দা করা হচ্ছে? এই প্রশ্নগুলো জড়িয়ে আছে জেন্ডার রোল, নারীবাদ ও নৈতিকতার বয়ানে। এই নিবন্ধে আমরা জেন্ডার রোল ও নারীবাদের প্রচলিত বয়ান (narrative) এবং এগুলোর জবাবী বয়ান হাযির করার চেষ্টা করব।
Gender মানে লিঙ্গ এবং Role মানে ভূমিকা। জেন্ডার রোল দ্বারা বুঝানো হয়, পুরুষ ও নারী যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন লিঙ্গের অধিকারী, তাই জৈবিক ও সামাজিক চাহিদা অনুযায়ী সমাজে তাদের ভূমিকাও ভিন্ন ভিন্ন। কিছু কাজ আছে, যা নারী করেন। কিছু কাজ পুরুষ করেন। এসব কাজের মধ্যে কিছু আছে জৈবিকভাবে ধার্য। এতে হেরফের করা বৈজ্ঞানিকভাবে অসম্ভব। যেমন, পুরুষ পিতা হন এবং নারী মা হন। পেটে বাচ্চা ধারণ করা পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার পুরুষের শুক্রাণু ছাড়া নারীর পক্ষে বাচ্চা ধারণ করা অসম্ভব। পুরুষের দাড়ি-গোঁফ গজায়, নারীর গজায় না। গজালেও সেটি হরমোনের সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। পুরুষের কণ্ঠস্বর নারীর চেয়ে ভারি হয়। পুরুষের শারীরিক গড়ন নারীর চেয়ে তুলনামূলক বড় ও মজবুত হয়। আবার কিছু ভূমিকা আছে, যা সামাজিকভাবে ধার্য। যেমন, পুরুষ ঘরের বাইরে এবং তুলনামূলক ভারি কাজ করেন। নারী ঘরের ভেতরে এবং তুলনামূলক হালকা কাজ করেন। এখানে হালকা কাজ বলে নারীর কাজকে আমি ছোট করছি না। কেবল ওজনে হালকা বুঝিয়েছি। এটি সাধারণ নিয়ম। প্রয়োজনে নারীও ঘরের বাইরে কাজ করেন এবং ভারি জিনিসপত্র বহন করেন। জেন্ডার রোল-এর মধ্যে পোশাক, রঙ, ঘ্রাণ, চলা-বলার ধরণ, চাহিদা ও মানসিকতার পার্থক্য সবই আছে। ফিরিস্তি গুনলে সারাদিন গোনা যাবে। তবে মনে হয় না প্রয়োজন আছে। জেন্ডার রোল তথা লিঙ্গের ভিন্নতর ভূমিকা এবং এর যৌক্তিকতার বিষয়টি পাঠক বুঝতে পেরেছেন।
মানব ইতিহাসে শত-সহস্রবার সভ্যতা-সংস্কৃতির গতিপথ পরিবর্তন হলেও জেন্ডার রোল ছিল অপরিবর্তিত ও প্রশ্নাতীত। গত শতাব্দী থেকে জেন্ডার রোলকে প্রশ্নবিদ্ধ করা শুরু হয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন নারীবাদীরা। ৯০’র দশকে জেন্ডার রোল-এর বিরোধিতা বিশ্বব্যাপী শক্ত অবস্থান নিয়েছে। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত World Conference on Women থেকে উত্থাপিত নারীবাদের দাবি এবং এসব দাবির প্রতি জাতিসংঘের অকুণ্ঠ সমর্থনের পর জেন্ডার রোল-এর বিরোধিতা আরও হাওয়া পেয়েছে। তবে কথা বাড়ানোর আগে নারী ও নারীবাদ (Feminism) নিয়ে আলাপ করা জরুরি, যেহেতু নারীবাদ-ই জেন্ডার রোলকে অস্বীকার করছে। নারী কে, এই প্রশ্নের জীববিজ্ঞানভিত্তিক জবাব হচ্ছে, নারী একজন প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীলোক। মানব ইতিহাসে এ ব্যাপারে দ্বিতীয় কোনো রায় পাওয়া যাবে না। তবে নারীবাদ কী, তা বলা সহজ নয়। নারীবাদ নারীদের অধিকার আন্দোলন হলেও এর কোনো সর্বসম্মত সংজ্ঞা আজও নেই। নারীবাদ সময় সময় সাগরের ঢেউয়ের মতো উত্থিত হয়েছে। নারীবাদের প্রথম ঢেউ (First-wave feminism) এসেছিল উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে এবং স্থায়ী ছিল ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত। ওই সময় নারীদের রাজনৈতিক অধিকার ও প্রতিনিধিত্ব ছিল মূল প্রতিপাদ্য। পশ্চিমা বিশ্বে তখনও সমাজের কোনো স্তরে নারীদের অংশীদারিত্ব ছিল না। পশ্চিমা চিন্তকরা নারীকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে দেখতেন। ভোট দেওয়ার অধিকার নারীদের ছিল না। পশ্চিমা নারীরা ছিল নিষ্পেষিত, বোবা। নারীবাদের দ্বিতীয় ঢেউ (Second-wave feminism) ছিল ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত এবং ওই সময়ের প্রতিপাদ্য ছিল নারীদের অর্থনৈতিক অধিকার। কারণ পশ্চিমা বিশ্বে একজন নারীকে একই কাজের বিনিময়ে একজন পুরুষের চেয়ে কম মূল্য পরিশোধ করা হতো। নারীবাদের তৃতীয় ঢেউ (Third-wave feminism) ছিল ১৯৭৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত। তৃতীয় ঢেউ ছিল দ্বিতীয় ঢেউয়ের পরিপূরক। তখনও নারীবাদ কেবল শহুরে শিক্ষিত সাদা নারীদের প্রতিনিধিত্ব করছিল। বাকি বিশ্বের নারীদের অধিকার নিয়ে কথা বলছিল না। তাই তৃতীয় ঢেউয়ে নারীবাদকে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার নারীদের আন্দোলন হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছিল। নারীবাদের প্রত্যেক ঢেউয়ে দুটি বিষয় যুক্ত ছিল। প্রথমটি ছিল লিঙ্গীয় সমতা তথা পুরুষ ও নারীর সম-অধিকার। দ্বিতীয়টি ছিল প্রজননকালীন স্বাস্থ্য বা প্রজননের অধিকার। নারীদের দাবি ছিল, তারা পুরুষ বা পরিবারের ইচ্ছায় বাচ্চা নেবেন না। বাচ্চা কখন নেবেন বা আদৌও নেবেন কি না, এটি তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করবে। সেইসাথে ছিল গর্ভপাতকে বৈধ করার দাবি। এরপর আসে নারীবাদের চতুর্থ ঢেউ (Fourth-wave feminism), যদিও তা ৯০’র দশক থেকেই শুরু হয়েছিল। আজও এই চতুর্থ ঢেউ চলমান। নারীবাদের মধ্যে আছে ডজনখানেক রকমফের। উদার নারীবাদ, মধ্যম নারীবাদ, কট্টর নারীবাদ, ফেমিনাৎসিবাদ, সাংস্কৃতিক নারীবাদ, কৃষ্ণ নারীবাদ, মার্ক্সিস্ট-সমাজবাদী নারীবাদ, ইকো নারীবাদ, ফরাসি নারীবাদ, সমকামী নারীবাদ, বস্তুবাদী নারীবাদ, পোস্ট কলোনিয়াল নারীবাদ– তালিকা চলতেই আছে। চতুর্থ ঢেউয়ের নারীবাদকে I-Feminism (আমি-কেন্দ্রিক নারীবাদ) এবং ডিজিটাল নারীবাদও বলা হয়। এই সময়ের নারীবাদে ‘আমার দেহ আমার ইচ্ছা’ নামক স্লোগান যুক্ত হয়েছে এবং ডিজিটাল মিডিয়ার মাধ্যমে এটি সমাজে প্রভাব বিস্তার করছে। আজকের নারীবাদের বয়ানের আংশিক পাওয়া যাবে ২০১৫ সালে Vogue ম্যাগাজিনের নির্মিত My Choice নামক শর্টফিল্মে। তাতে একজন ভারতীয় অভিনেত্রী যে কথাগুলো বলেছেন, তার সারাংশ হচ্ছে, “আমার দেহ, আমার চিন্তা, আমার ইচ্ছা। আমি কী পোশাক পরব, তা আমার ইচ্ছা। বিয়ে করব কি না, আমার ইচ্ছা। বিয়ের আগে যৌনসম্পর্ক করব, নাকি বিয়ের বাইরে (স্বামী ছাড়া অন্য কারও সাথে), তা আমার ইচ্ছা। সন্তান নেব কি না, আমার ইচ্ছা। বাসায় কখন ফিরব, তা আমার ইচ্ছা। সমকামী নাকি উভকামী হব, তা আমার ইচ্ছা। তুমি (স্বামী) আমার গয়নার মতো পরিবর্তনযোগ্য। তোমাকে সামান্য সময় ভালোবাসব, নাকি চিরস্থায়ী, তা আমার ইচ্ছা।” কথাগুলো আজকের নারীবাদী বয়ানের আংশিক। কারণ পশ্চিমাবিশ্বে নারীবাদের বয়ান আরও এক ধাপ এগিয়ে গেছে। অপরদিকে সমতার দাবী করলেও নারীবাদ অনেক ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা চায়। উদারতার দাবী করলেও নারীবাদ ভিন্নমত সহ্য করে না। নারীবাদের সমালোচনা করলে male chauvinist pig জাতীয় বিশ্রী গালি খেতে হয়। অনেকেই দাবি করছেন, আজকের নারীবাদ পুরুষের বিনিময়ে (at the expense of man) নারীকে এক কৃত্রিম ক্ষমতা দিতে চায়। এক প্রভাবশালী বুদ্ধিজীবী বলেছিলেন, “পুরুষের শত বছরের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফলে গড়ে উঠা নগর-বন্দর, রাস্তা-ঘাট, দালানকোঠার ওপরে দাঁড়িয়ে আজ নারী প্রতিটি কাজে সম-অধিকার চান।” কথাটি নারীবিদ্বেষী নয়। বরং মানব ইতিহাসের এক রূঢ় বাস্তবতা। আজও উত্তপ্ত রোদ কিংবা ঝড়বৃষ্টিতে ট্রাক থেকে ভারী মাল নামানোর জন্য পুরুষের ডাক পড়ে। যুদ্ধের সম্মুখভাগে পুরুষকেই এগিয়ে যেতে হয়। তবে এতে পুরুষের কোনো অভিযোগ নেই। পুরুষ জানে, সে যখন শহর-বন্দর তৈরি করছে, নারী তখন ঘর সামলাচ্ছে। পুরুষ ঘাম ঝরিয়ে জাতির বর্তমান তৈরি করেছে, আর নারী সন্তান পালনের মাধ্যমে জাতির ভবিষ্যত তৈরি করেছে। এর জন্য পুরুষ নারীকে খোঁটা দেয়নি। রক্ত পানি করা পরিশ্রমে স্ত্রী-সন্তানদের জন্য অন্ন জোগাড় করে পুরুষ কখনও নারীকে বলেনি, তুমি বেকার। পুরুষ জানে, নারী বেকার নয়। নারী সংসার, নারী ঘর, নারীই তো পরিবার। আমি বলছি না দুনিয়ায় সব পুরুষ সুফীসাধক। শত শত বছর ধরে পুরুষের দ্বারা নারী নির্যাতন হয়েছে, আজও হচ্ছে। তাই প্রচলিত একরোখা পুরুষালী বয়ানের বাইরে গিয়ে আমি নারীদের অনেক দাবীকে সমর্থন করি। এজন্য আমাকে নারীবাদী হতে হয়নি। একজন মুসলিম পুরুষ হিসেবে নারীর যথাযোগ্য অধিকারকে আমি সমর্থন করি এবং নারী নির্যাতনকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে দেখি। নৈতিকতার গণ্ডির ভেতরে থাকা সত্ত্বেও অনেক জায়গায় নারীদের ওপর অযথা বিধিনিষেধ চাপিয়ে দেওয়া হয়। নারীর যোগ্যতা ও বুদ্ধিমত্তাকে তুচ্ছজ্ঞান করা হয়। এটি অনুচিত, খুবই অনুচিত। কিন্তু আজকের নারীবাদের যে বয়ান– যেখানে নীতি-নৈতিকতার বালাই নেই। মানবজাতির ভবিষ্যতের প্রতি বিন্দুমাত্র দায়বদ্ধতা নেই। যেখানে পুরুষকে ভাবা হয় শত্রু, পুরুষত্বকে বলা হয় বিষাক্ত– তা কীভাবে সমর্থনযোগ্য? নারীবাদ জেন্ডার রোলকে অস্বীকার করছে। এ ধরণের বিদ্বেষমূলক, অযৌক্তিক এবং অবৈজ্ঞানিক আন্দোলন কি আদৌও নারীদের সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম? আমার মনে হয় না।
এবার আসি ইসলামের প্রসঙ্গে। ইসলাম নারীকে ‘পুরুষের দাসী’ হিসেবে পরিচয় করায়নি, যেভাবে অন্য অনেক মতাদর্শ করেছে। ইসলাম যেমন একজন পুরুষকে ‘আল্লাহর বান্দা’ বলে, একজন নারীকেও তেমনই ‘আল্লাহর বাঁদী’ বলে। ইসলাম পুরুষ সত্তার ভেতরে নারী সত্তাকে ‘গুম’ করেনি। উভয়কে স্বতন্ত্রভাবে পরিচয় করিয়েছে। আল্লাহ বলেছেন, “হে মানুষ, আমি তোমাদেরকে এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদেরকে বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যাতে তোমরা পরস্পর পরিচিত হতে পারো” (সুরা হুজুরাত, আয়াত-১৩)। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক, নেক আমল ও এর প্রতিদান, সামাজিক অধিকার ও মর্যাদার ক্ষেত্রে ইসলাম পুরুষ ও নারী সত্তাকে যথাযথভাবে বয়ান করেছে। আল্লাহ বলেছেন, “যে নেক আমল করে, পুরুষ কিংবা নারী, এবং সে যদি মুমিন হয় তবে আমি তাকে জান্নাতে অনন্ত পবিত্র জীবন দান করব।” (সুরা নাহল, আয়াত-৯৭)। সুরা আহযাবের ৩৫ নম্বর আয়াতে যেখানে পুরুষের ১০টি গুণ বর্ণনা করেছেন, সেখানে নারীর জন্যও ওই ১০টি গুণ বর্ণনা করেছেন। চারিত্রিক প্রসঙ্গে এলে দেখা যায়, চরিত্র রক্ষার জন্য ইসলাম পুরুষকে দৃষ্টি ও লজ্জাস্থান হিফাযত করার আদেশ দিয়েছে, নারীকেও একই আদেশ দিয়েছে। যেহেতু নারীদেহে সৌন্দর্য ও আকর্ষণের মাত্রা অধিক, তাই দৃষ্টি ও লজ্জাস্থান হিফাযতের জন্য নারীকে পোশাকের ক্ষেত্রে অধিক রক্ষনশীল হওয়া, অপ্রয়োজনে গৃহত্যাগ না করা এবং স্বামী ব্যতীত অন্য কারও সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করার আদেশ দিয়েছে। পরপুরুষের সাথে কথা বলার সময় সোজাসাপ্টা কথা বলতে বলা হয়েছে। মূল লক্ষ্য কিন্তু একই– চরিত্র রক্ষা। এ ক্ষেত্রে পুরুষ ও নারীকে কিছুটা ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় চেষ্টা করতে হয়। কারণ ইসলাম পুরুষ ও নারীকে আলাদা সত্তা হিসেবে দেখে। ইসলামে একজন নারী স্বাধীন। তার মত প্রকাশের ক্ষমতা আছে, উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে ভাগ আছে, বিয়ের ক্ষেত্রে মত ব্যক্ত করার অধিকার আছে, বিবাহবন্ধন থেকে বেরোনোর সুযোগ আছে। ইসলামে শিক্ষা অর্জন করা পুরুষের জন্য যেমন জরুরি, নারীর জন্যও জরুরি। পুরুষ যেমন অর্থ উপার্জন করতে পারে, নারীও পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, শিক্ষা অর্জন ও অর্থ উপার্জনের লক্ষ্য কী? যদি লক্ষ্য হয় কেবল নিজের খায়েশকে চরিতার্থ করা, তাহলে নারীবাদের ‘আমার ইচ্ছা’ নামক বয়ান সঠিক। আর যদি লক্ষ্য হয় মানব সমাজের বিনির্মাণ, সুষ্ঠু পরিচালনা ও ভবিষ্যত প্রজন্মের যথাযথ সুরক্ষা, তাহলে নারীবাদের বয়ান সঠিক নয়। মূল বিষয় হচ্ছে লক্ষ্য নির্ধারণ করা।
ফিরে আসি ইসলামের প্রসঙ্গে। ইসলামে জেন্ডার রোল স্পষ্টভাবে নিরূপিত। ইসলামে পুরুষ ও নারী উভয়ের দায়িত্ব, কর্মক্ষেত্র, অধিকার ও মর্যাদা আলাদা। কমবেশির প্রশ্ন নয়; কেবল আলাদা। উভয়ের সামাজিক গণ্ডি আলাদা, পবিত্রতা অর্জনের ধরণ আলাদা, নামাযের কাতার আলাদা। পোশাক থেকে নিয়ে রঙ ও ঘ্রাণের ব্যবহারেও পুরুষ ও নারীর জন্য ইসলামের বিধান আলাদা। ইসলামে নারী পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট নন। সৃষ্টিগতভাবে উভয়ের মর্যাদা সমান। যখন এক পুরুষ ও এক নারী মিলে পরিবার গঠন করে, যার লক্ষ্য হচ্ছে মানব সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখা এবং ভবিষ্যত প্রজন্মকে যথাযথভাবে গড়ে তোলা, তখন পুরুষ ও নারীকে ভিন্ন ভিন্ন ভূমিকা পালন করতে হয়। ইসলামে পরিবারের প্রধান হচ্ছেন পুরুষ। তার দায়িত্ব পরিবারের ভরনপোষণ ও বহিঃস্থ নিরাপত্তা। নারীর দায়িত্ব পরিবারের অন্তঃস্থ শৃঙ্খলা ও সন্তান পালন। এসব মৌলিক দায়িত্বের কথা পবিত্র কুরআনে সুন্দরভাবে বর্ণিত হয়েছে। তবে স্বামী ও স্ত্রী মূল দায়িত্বের অতিরিক্ত দায়িত্বও পালন করতে পারেন। সাংসারিক দায়িত্ব ও নৈতিক বিধানকে বহাল রেখে একজন নারী যদি উচ্চশিক্ষা অর্জন করে নেন, তাতে প্রশংসা ব্যতীত অন্য কিছুর সুযোগ নেই। বাইরের কাজের পর একজন পুরুষ যদি ঘরের কাজে স্ত্রীকে সহযোগিতা করেন, সেটি খুবই প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য। রাসূলুল্লাহ e-কে আমরা ঘরের কাজে সহযোগিতা করতে এবং আয়িশা সিদ্দীকা (রা.)-কে দেখি অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হতে দেখেছি। মোটকথা, ইসলাম নারী ও পুরুষকে পরস্পরের বিপরীতমুখী হিংসাত্মক অবস্থানে দাঁড় করায়নি, যেমনটি করছে আজকের নারীবাদ। ইসলাম সমাজের কল্যাণার্থে নারী ও পুরুষকে পরস্পরের সহযোগী ও সম্পূরক হিসেবে দেখে।
জেন্ডার রোলকে অস্বীকার করার পর নারীবাদ এখন জেন্ডার তথা লিঙ্গকেই অস্বীকার করে বসেছে। বলা হচ্ছে, পুরুষাঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করলে কেউ পুরুষ কিংবা স্ত্রীলিঙ্গ নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেই কেউ নারী হয় না। পুরুষ না নারী হবে, এটি ব্যক্তির ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে এবং এটি চাহিদামতো পরিবর্তন করা যায়। লিঙ্গ পরিবর্তন করার জন্য অপারেশনের প্রবণতা বাড়ছে। অনেক দেশে এ ধরণের অপারেশনকে আজ বৈধতা দেওয়া হয়েছে। যেখানে ১৮ বছরের নিচে মানুষ ভোট দিতে পারে না এবং অনেক দেশে ২১ বছরের নিচে কেউ এক প্যাকেট সিগারেট কিনতে পারে না, সেখানে ১২-১৩ বছরের বাচ্চারা ইচ্ছামত সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করিয়ে যাচ্ছে। মা-বাবা কিছু বললে উলটো তাদেরকে আইনি জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। তবে এখন আর লিঙ্গ পরিবর্তনের জন্য অপারেশন করা লাগে না। যেহেতু এখন লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করতে হয় না, তাই কে কোন লিঙ্গ, তা জিজ্ঞেস করা যায় না। একজন পুরুষ চাইলে সকালে পুরুষের টয়লেটে এবং বিকালে নারীদের টয়লেটে যেতে পারে। কারণ সে হয়তো সকালে নিজেকে পুরুষ এবং বিকালে নারী ভাবছে। কেউ যদি তার লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ করে দেয়, তাহলে সেটি ওই ব্যক্তির দোষ। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এই ‘দোষ’ করেছিলেন। এই হচ্ছে ঘটনা।
নারীবাদ এতটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যে, তারা প্রচলিত পরিভাষায় কথাও বলতে পারছে না। ইংরেজিতে পুরুষের ক্ষেত্রে He এবং নারীর ক্ষেত্রে She ব্যবহৃত হয়। নারীবাদ যেহেতু লিঙ্গ নির্ধারণ করার বিপক্ষে, তাই তারা হি-শি কোনোটিই বলতে পারে না। ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলে। ওদিন এক ফোরামে একজন নারীবাদী বলছেন, “এত শতাংশ গর্ভধারণকারী ব্যক্তিকে (Pregnant people) এই এই সমস্যা সহ্য করতে হয়।” সঞ্চালক কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “গর্ভধারণকারী ব্যক্তি (Pregnant people) মানে কি মা?” ওই নারীবাদী প্রতিবাদ করে বললেন, “মা কেন বলছেন? হয়তো তারা নিজেদেরকে মা কিংবা এরকম কোনো নির্ধারিত লিঙ্গ দিয়ে পরিচয় দিতে চায় না। তাই মা নয়, বলা উচিত গর্ভধারণকারী ব্যক্তি।” এরকম বহু উদাহরণ রয়েছে। বলা হয়, অমুক আসমান থেকে পড়ে খেজুর গাছে আটকে গেছে। অর্থাৎ এক ঝামেলা থেকে বের হয়ে আরেক ঝামেলায় জড়িয়ে গেছে। নারীবাদ আজ আসমান থেকে পড়ে খেজুর গাছে নয়; খেজুরের বাগানে আটকে গেছে। তারা নিপীড়নমূলক পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েছিল। প্রথমদিকে করেছিলও। কিন্তু আজকের নারীবাদ এতটাই বখে গেছে যে, পুরুষ ও নৈতিকতা বিরোধী কিছু অযৌক্তিক বয়ান ছাড়া তাদের হাতে আর কিছু নেই। নারীবাদের ভাষায়, নারীদের সাফল্য কি? সংসারের সম্রাজ্ঞী থেকে নেমে গিয়ে ডিসকোর পতিতা হওয়া? ঘরে-বাইরে কাজের অত্যাধিক চাপে শরীর-স্বাস্থ্য খারাপ করা? বিয়ে, স্বামী, সন্তান বাদ দিয়ে যৌবনে সুযোগসন্ধানী পুরুষের সাথে সখ্য করা আর বার্ধক্যে একাকি ধুকে ধুকে মরা? নাকি সেক্স চেঞ্জ অপারেশন করিয়ে পরে হতাশায় ভুগে আত্মহত্যা করা? এছাড়া আর কী দিতে পেরেছে এই নারীবাদ?
নৈতিকতা তথা ভালো-মন্দ, ন্যায়-অন্যায়ের একটি সুনির্দিষ্ট এবং স্থায়ী মানদণ্ড থাকা প্রয়োজন, যেভাবে ইসলামের আছে। ভালো-মন্দ যদি প্রত্যেক মৌসুমে পরিবর্তন হয়, তাহলে তো মানব সমাজ ফাংশন করতে পারবে না। আজকের নারীবাদ প্রমাণ করেছে যে, তাদের কাছে নৈতিকতার কোনো মানদণ্ড নেই। ভালো-মন্দ তাদের কাছে সাময়িক এবং আপেক্ষিক বিষয়। কেবল নারীবাদ তো নয়। পশ্চিমা বিশ্বে গজিয়ে উঠা সবগুলো বাদ বা ইজমের অবস্থাও একই। তাই এসব বাদকে খায়েরবাদ বলে মানব সমাজের সমস্যা সমাধানকল্পে ইসলামের দ্বারস্থ হওয়া কি অধিক যৌক্তিক নয়?