রাসূলুল্লাহ ইহজগত থেকে বিদায় নেওয়ার পর এই উম্মাতকে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে আসতে হয়েছে। দুই-চারদিনের নয়;দেড় হাজারের বছরের ইতিহাস আমাদের। এই দীর্ঘ ইতিহাসে অপ্রতিরোধ্য বন্যার মতো এগিয়ে যাওয়া দিগবিজয়ী সব অভিযান এবং রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যকে পরাজিত করার মতো সাফল্য যেমন আছে;ফাঁকে ফাঁকে আছে কিছু বিফলতা,কিছু আফসোস,কিছু ফিতনা,যা উম্মাহর হৃদয়পটে স্থায়ী দাগ কেটে গেছে। কিছু বিফলতা,কিছু ফিতনা উম্মাতের নির্দিষ্ট এক অংশকে আক্রান্ত করেছে,কিছু আক্রান্ত করেছে পুরো উম্মাহকে। বিফলতা ও ফিতনার সেই বেদনাবিধুর ইতিহাস থেকে কয়েকটি পাতা আজ খুলছি। ইতিহাস বয়ান করা উদ্দেশ্য নয়;উদ্দেশ্য হচ্ছে,অগণিত জোয়ারের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের ইতিহাসে যেসব ভাটা এসেছিল,সেগুলোর সাথে তরুণ পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
এক. আল-ফিতনাতুল কুবরা
৩য় খলীফা উসমান (রা.)-এর শাহাদতের মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে সিফফিনের যুদ্ধ পর্যন্ত ব্যাপ্ত এক মহা-ফিতনা। রাসূলুল্লাহ এই যুদ্ধের ব্যাপারে বলে গেছেন-
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تَقْتَتِلَ فِئَتَانِ عَظِيمَتَانِ وَتَكُونُ بَيْنَهُمَا مَقْتَلَةٌ عَظِيمَةٌ وَدَعْوَاهُمَا وَاحِدَةٌ
কিয়ামত সংঘটিত হবে না, যতক্ষণ না (আমার উম্মাতের) বড় দুটি দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হবে। তাদের মধ্যে ভয়াবহ লড়াই হবে। আর উভয়ের দাবি হবে একই। (সহীহ মুসলিম,১৫৭)
উসমান (রা.)-এর শাহাদাতের পর এমন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে আলী (রা.) উম্মাতের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, যখন সবার মনে উসমান (রা.)-এর শাহাদাত নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ। আলী (রা.) চেয়েছিলেন বিশৃঙ্খলা স্তিমিত করে উসমান-হত্যার বিচার করবেন। উম্মুল মু‘মিনীন আয়িশা সিদ্দীকা (রা.) এ ব্যাপারে খলীফাকে চাপ দিতে থাকেন। তাঁর সাথে যুক্ত হন তালহা (রা.) এবং যুবাইর (রা.)। ওদিকে সিরিয়ার গভর্নর মুআবিয়া (রা.) উসমান-হত্যার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিলেন। আলী (রা.) বিষয়টি সমাধান করার জন্য সিরিয়ায় রওয়ানা হন। পথিমধ্যে আয়িশা (রা.)-এর নেতৃত্বাধীন একটি বাহিনীর সাথে আলী (রা.)-এর বাহিনীর সাক্ষাৎ ঘটে এবং কিছু গুপ্ত মুনাফিকের ষড়যন্ত্রের দরুন বিক্ষুব্ধ জনতার মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়,যাতে কয়েক হাজার মুসলমান প্রাণ হারান। যুদ্ধে আলী (রা.)-এর দল বিজয়ী হয় এবং আয়িশা (রা.)-কে সসম্মানে তাঁর বাসস্থানে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সিরিয়ার অদূরবর্তী সিফফীনে পৌঁছে খলীফা আলী (রা.) মুআবিয়া (রা.)-এর সাথে পরিস্থিতি প্রশমনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তিনি খলীফার কথায় রাযী হননি। ৩৭ হিজরী সনে সিরিয়ান বাহিনী আলী (রা.)-এর বাহিনীর ওপর হামলা করে। ৫ দিনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অন্তত ৬০-৬৫ হাজার মুসলমান প্রাণ হারিয়েছিলেন। যুদ্ধে আলী (রা.)-এর বিজয়ের পাল্লা ভারী থাকলেও সিরিয়াবাসীর সুকৌশলের দরুন যুদ্ধটি প্রায় বিনা ফলাফলে সমাপ্ত হয়। এ সংক্রান্ত ইতিহাসের খুটিনাটি অধ্যয়নের জন্য ইতিহাসের কিতাব আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ দ্রষ্টব্য। আল-ফিতনাতুল কুবরা শত-শত সাহাবীসহ হাজারও মুসলমানের মৃত্যুর কারণ হয়েছে,খিলাফাতে রাশিদার সূর্য অস্তমিত করেছে এবং উম্মাতের ঐক্যে চিরস্থায়ী ফাটল ধরিয়েছে। এরপর মুসলমানদের ভৌগোলিক,সামরিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক তথা সভ্যতাগত উন্নতি ঘটলেও “আল-খিলাফাতু আলা মিনহাজিন নুবুওয়্যাহ”র সেই অস্তমিত আফতাব আমাদের পূর্ব দিগন্তে আর উদিত হয়নি।
দুই. ইউরোপ থেকে দুইবার ফেরত আসা
ইউরোপ থেকে ফিরে আসা বলতেই আমরা আন্দালুসিয়া থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের ইতিহাসকে মনে রেখেছি। অথচ আন্দালুসিয়ায় যতদিন মুসলমানরা ছিলেন,সেটি আমাদের ইতিহাসের অন্যতম উৎকর্ষের সময় ছিল। আন্দালুসিয়া থেকে বিতাড়ন ছাড়াও মুসলমানরা আরও দুইবার ইউরোপ বিজয়ের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে এসেছেন। ইতিহাসের এই পাতাগুলো যখন খুলি,তখন বিষয়টি যেন আমার জন্য ‘ব্যক্তিগত’ কষ্টের কারণ হয়ে যায়। সম্ভবত এজন্য যে,আমি আজ ইউরোপে বসবাস করছি।
সাড়ে তিন বছর হতে চলল ইউরোপে আছি। বহুদেশ ঘুরেছি;দেখেছি বহু ব্যস্ত নগরী। ফ্রান্সের প্যারিস মহানগরী থেকে আড়াই-তিনশো কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত তুর শহর। বেশ ক’বার প্যারিস যাওয়া হলেও তুর যাইনি কখনও। তুর শহর আমার কাছে এক বিষাদের নাম। ৭১১ খ্রিস্টাব্দে মহাবীর তারিক ইবন যিয়াদ আইবেরিয়ান পেনিন্সুয়ালায় প্রবেশ করার পর বহু সফল অভিযানের মধ্য দিয়ে ৭২০ খ্রিস্টাব্দে পুরো আন্দালুসিয়া (স্পেন-পর্তুগাল) মুসলমানদের হাতে চলে আসে। কিন্তু অভিযান থামেনি। উত্তর-পূর্বদিকে ইউরোপের গভীরে প্রবেশ করে মুসলমানরা ফ্রান্সে চলে যান। ৭৩২ সালের ১০ অক্টোবর আন্দালুসিয়ার গভর্নর আব্দুর রহমান গাফিকীর নেতৃত্বে মুসলিম সেনাদল চার্লস মার্টেলের নেতৃত্বাধীন ফ্রাঙ্ক (বর্তমান ফ্রান্স) সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। যুদ্ধের ময়দান ছিল তুর শহর। এই যুদ্ধে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে পশ্চিম ইউরোপে মুসলমানদের বিজয়াভিযান চিরতরে থেমে যায়। ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড গিবনের মতে,এই যুদ্ধে খ্রিস্টানদের বিজয়ের ফলেই ইউরোপের ভেতরে মুসলমানদের প্রবেশ আটকে যায়। আজও ভাবি,তুর যদি এতটা বেদনা লিখে না দিত,আমাদের ইতিহাসের গতি হয়তো অন্যরকম হতে পারত।
দ্বিতীয়বার মুসলমানরা ফিরে আসেন অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা শহর থেকে, ১৬৮৩ খ্রিস্টাব্দে। অটোমান (উসমানী) সুলতান সুলেমানের নেতৃত্বে ১৫২৯ সালে প্রথমবার ভিয়েনা অভিযান হয়। হাঙ্গেরি জয় করে মধ্য ইউরোপের দিকে অগ্রসর হলেও প্রতিকূল আবহাওয়া ও দীর্ঘ সরবরাহ লাইনের কারণে ভিয়েনা বিজয় করা তখন সম্ভব হয়নি। দ্বিতীয়বার (এবং এটিই গুরুত্বপূর্ণ) অটোমানরা ভিয়েনা অবরোধ করেন ১৬৮৩ সালে। গ্র্যান্ড উজির কারা মোস্তফা পাশা বিশাল অটোমান বাহিনী নিয়ে ভিয়েনা ঘিরে ফেলেন। প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও,পোল্যান্ডের রাজা জন সোবিয়েস্কির নেতৃত্বে গঠিত খ্রিস্টান জোট বাহিনী ১২ সেপ্টেম্বর, ১৬৮৩ সালে কুখ্যাত ভিয়েনা যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজিত করে। এই পরাজয় ইউরোপে মুসলিম অগ্রযাত্রার অবসান ঘটায়। মুসলিম ও খ্রিস্টান শক্তির মধ্যে দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতার এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত,যার ফলশ্রুতিতে অটোমান সাম্রাজ্য রক্ষণাত্মক অবস্থানে চলে যায় এবং ধীরে ধীরে ইউরোপে তাদের প্রভাব হ্রাস পেতে থাকে। আমি ভিয়েনার সেই জায়গা পর্যন্ত গিয়েছি, যেখানে মুসলিম বাহিনী ১৬৮৩ সালে অবরোধ করেছিল৷ বারবার ভেবেছি,আল্লাহ আমাদের তাকদীরে ভিন্ন কিছু লিখেছিলেন। নইলে ৭৩২ বা ১৬৮৩ একটিতে অন্তত বিজয় লাভ করলেও আজ ইউরোপ মুসলমানদের হাতে থাকতে পারত।
তিন. মঙ্গোলদের আক্রমণ
রাসূলুল্লাহ সতর্ক করে বলেছেন-
وَاتْرُكُوا التُّرْكَ مَا تَرَكُوكُمْ
অর্থাৎ-তুর্কদের থেকে দূরে থাকো,যতক্ষণ তারা তোমাদের থেকে দূরে থাকে। (সুনান আবূ দাঊদ, ৪৩০২)
উক্ত হাদীসে তুর্ক দ্বারা ককেশীয়,মঙ্গোলীয় ও মধ্য এশিয়া অঞ্চলের নমেডিক জাতিগুলো উদ্দেশ্য হতে পারে। এসব এলাকায় তাতার,মঙ্গোল ও বিভিন্ন ‘তুর্ক’ জাতিভুক্ত মানুষ বাস করত। মঙ্গোলিয়ার সেনাপতি চেঙ্গিস খান এসব এলাকা বিজয় করে মঙ্গোল,তাতার ও বিভিন্ন তুর্ক গোত্রকে একত্রিত করে বিশাল একটি Turco-Mongol বাহিনী বানিয়েছিলেন৷ প্রসঙ্গত বলে রাখি,তুর্ক জাতিভুক্ত বহু গোত্র (যেমন উঘুজ,তিমুরিদ) পরবর্তীতে ইসলাম কবূল করেছিল এবং তাদের বংশধররা সেলজুক, সাফাভী,অটোমান (উসমানী) ও মোগল প্রমুখ শানদার ইসলামী সালতানাতের জন্ম দিয়েছিল।
১৩শ শতাব্দীতে মধ্য এশিয়ার খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য একটি বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ মুসলিম সাম্রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল। ১২১৮ সালে চেঙ্গিস খান কূটনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপনের লক্ষ্যে খাওয়ারিজমে একটি প্রতিনিধিদল পাঠান। কিন্তু খাওয়ারিজমের সুলতান আলাউদ্দীন মুহাম্মদ চেঙ্গিস খানের দূতদের হত্যা করেন,যা মঙ্গোলীয় রীতিতে ঘোরতর অপমানজনক ও যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য ছিল। এর প্রতিক্রিয়ায় ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান এক বিশাল বাহিনী নিয়ে খাওয়ারিজম আক্রমণ করেন। বুখারা, সমরকন্দ ও হেরাতের মতো ঐতিহ্যবাহী শহর ধ্বংস করা হয়। মঙ্গোলদের ক্ষিপ্রতা,নিষ্ঠুরতা ও আধুনিক কৌশলের সমন্বয়ে পরিচালিত আক্রমণ ও ব্যাপক অগ্নিসংযোগের ফলে প্রায় দেড় কোটি মুসলমান প্রাণ হারান। ১২২১ সালে মঙ্গোলরা মার্ভ ও নিশাপুর শহরদ্বয় ধ্বংস করে এবং ইতিহাসের পাতা থেকে খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। হারিয়ে যায় মুসলিম বিশ্বের এক বৃহৎ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ইসলামী সভ্যতার বহু গুরুত্বপূর্ণ নগরী ধ্বংস হয়,শিক্ষা,কলা ও স্থাপত্যের অপূরণীয় ক্ষতি হয়।
খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য ধ্বংসের পর মঙ্গোল বাহিনীর অভিযান চলতে থাকে। ১২৫৮ সালে চেঙ্গিস খানের নাতি হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে। মঙ্গোলদের হাতে বাগদাদে সংঘটিত হয় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ, যাকে মুসলিম ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হিসেবে গণ্য করা যায়। বাগদাদ আক্রমণের প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী ছিল যে,মনে হয়েছিল অপ্রতিরোধ্য বন্যার মতো অগ্রসরমান এই উম্মাহ ১২৫৮ সালে এসে থমকে গিয়েছিল। বাগদাদ তখন আব্বাসী খিলাফতের রাজধানী ও ইসলামী সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিকিৎসা ও দর্শনের প্রধান কেন্দ্র ছিল। হালাকু খান পারস্য জয় করার পর বাগদাদের দিকে অগ্রসর হয়। ওদিকে কূটনৈতিক দুর্বলতা ও সামরিক প্রস্তুতির অভাবে বাগদাদ মঙ্গোলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়। ১২৫৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মঙ্গোলরা শহরে প্রবেশ করে কয়েকদিন ধরে ব্যাপক গণহত্যা, লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ২০-২৫ লক্ষ মানুষ নিহত হন,সভ্যতার সরঞ্জাম ক্ষতিগ্রস্থ হয়,বিখ্যাত গ্রন্থাগার ‘বাইতুল হিকমাহ’ জ্বালিয়ে দিয়ে হাজারো অমূল্য পাণ্ডুলিপি টাইগ্রিস নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। খলীফা মুসতাসিম বিল্লাহকে নির্মমভাবে শহীদ করা হয় এবং এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ওপর আরবদের শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে। যদিও নিশ্চিতভাবে এই ঘটনাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে কি না জানার সুযোগ নেই, তবুও এই ঘটনার পরোক্ষ ইঙ্গিত হাদীসে পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ বলেছেন-
لَا تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تُقَاتِلُوا التُّرْكَ صِغَارَ الْأَعْيُنِ حُمْرَ الْوُجُوهِ ذُلْفَ الْأُنُوفِ كَأَنَّ وُجُوهَهُمُ الْمَجَانُّ الْمُطْرَقَةُ
অর্থাৎ-কিয়ামত সংঘটিত হবে না,যতদিন না তোমরা ‘তুর্ক’ জাতির সাথে যুদ্ধ করবে,যাদের চোখ ছোট,চেহারা লাল,নাক চ্যাপ্টা এবং মুখমণ্ডল পেটানো চামড়ার ঢালের মত। (সহীহ বুখারী,২৯২৮)
বহু উলামার মত হচ্ছে,এখানে ‘তুর্ক’দ্বারা মঙ্গোলদের প্রতি ইঙ্গিত হতে পারে।
চার. মুসলিম বিশ্বে ইউরোপীয় উপনিবেশ
ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদ ছিল মুসলিম উম্মাহর ইতিহাসে এক গভীর সংকট ও রূপান্তরের যুগ। এই সময়কালে মুসলিম ভূখণ্ডের প্রায় সবটুকু এলাকা (কেবল তুর্কি ব্যতীত) ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর দখলে চলে যায়। পর্তুগিজ,ডাচ,ব্রিটিশ,ফরাসি,ইতালীয় ও রুশ সাম্রাজ্যবাদীরা ধারাবাহিকভাবে মুসলিম অঞ্চলসমূহে সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে। ১৯ শতকে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যকে বিলুপ্ত করে সরাসরি উপনিবেশ গঠন করে। একই সময়ে মিশরে ব্রিটিশ হস্তক্ষেপ মুসলিম দুনিয়ায় তাদের প্রভাব আরও দৃঢ় হয়। ফরাসিরা ১৮৩০ সালে আলজেরিয়া দখল করে এবং পরে তিউনিসিয়া ও মরক্কোতে উপনিবেশ স্থাপন করে। লিবিয়া চলে যায় ইতালির দখলে। দুর্বল অটোমান সাম্রাজ্য ধীরে ধীরে তার প্রাদেশিক অঞ্চলগুলো ইউরোপীয়দের হাতে হারিয়ে ফেলে। রুশ সাম্রাজ্য মধ্য এশিয়ার মুসলিম দেশগুলো দখল করে নেয় এবং ইসলামী শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক চর্চার উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায় দীর্ঘমেয়াদে উপনিবেশ স্থাপন করে। সাম্রাজ্যবাদীরা মুসলিম সমাজে আধুনিক শিক্ষা,প্রশাসনিক কাঠামো ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা প্রবর্তনের নামে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করে তোলে,যার ফলে ঐতিহ্যবাহী ইসলামী প্রতিষ্ঠান ও নেতৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে। মুসলমানদের মধ্যে বিভাজন;ভাষা,জ্ঞান ও সংস্কৃতির ওপর পশ্চিমা আধিপত্য এবং আধুনিকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো পশ্চিমা তত্ত্বগুলোও এই উপনিবেশের দান। উপনিবেশ থেকে মুক্তি পেতে যে কত রক্তের সাগর বয়ে গেছে,তার হিসাব নেই। এরচেয়েও বড় সমস্যা হচ্ছে,চলে যাওয়ার সময় সাম্রাজ্যবাদীরা রেখে গেছে জাত্যভিমানে ঠাসা কিছু তথাকথিত স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র,আর চিরতরে কবর দিয়ে গেছে ‘এক উম্মাহ’ নামের চেতনাটি,যেটি স্বয়ং রাসূলুল্লাহ আমাদেরকে দিয়েছিলেন। ফলাফল হচ্ছে,আজ এসব মুসলিম রাষ্ট্রের হীনমন্য নেতারা পশ্চিমাদের সাথে হাত মিলিয়ে একে অন্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। রাসূল বলেছেন-
إِنَّمَا أَخَافُ عَلَى أُمَّتِي الْأَئِمَّةَ الْمُضِلِّينَ، وَإِذَا وُضِعَ السَّيْفُ فِي أُمَّتِي لَمْ يُرْفَعْ عَنْهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
অর্থাৎ-আমি আমার উম্মাতের পথভ্রষ্ট নেতাদের ব্যাপারে শঙ্কিত। আমার উম্মাতের মধ্যে একবার যখন তরবারী চালিত হবে,কিয়ামত পর্যন্ত তারা এ থেকে বিরত হবে না। (সুনান আবূ দাঊদ,৪২৫২)
দীর্ঘ উপনিবেশের ফলে উম্মাহর মধ্যে যে তীব্র বিভেদ ও হীনমন্যতা তৈরি হয়েছিল,তা প্রকটভাবে দেখা গেছে গত দুই বছর ধরে চলমান গাযা আগ্রাসনে। ইসরায়েলের গাযা আগ্রাসন দেখিয়ে দিয়েছে যে, ইচ্ছা করলে পৃথিবীর চোখের সামনে লাখো মুসলমানকে মেরে ফেলা যায়। উপরিউক্ত কোনো পরাজয় ও ফিতনা উম্মাতের অন্তস্থ দুর্বলতাকে এতটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়নি,যতটা গাযা গণহত্যা দেখিয়েছে।
পরিশেষে একটি তিক্ত সত্য বলে লেখাটি শেষ করতে চাই। আমাদের দ্বীন পবিত্র;কিন্তু আমাদের ইতিহাস মানবিক। আমাদের ইতিহাসে অফুরন্ত আধ্যাত্মিক ও মানবিক গুণের সমাবেশ যেমন ঘটেছে; এখানে মানবিক দুর্বলতার উপস্থিতিও আছে। ভবিষ্যত কর্মপদ্ধতি নির্ধারণের জন্য সফলতার সাথে সাথে বিফলতা ও বেদনার ইতিহাসও আমাদের মূল্যায়ন করা উচিত।

