২০২৪ সালের জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী প্রেক্ষাপটে জামায়াতে ইসলামীকে দেশের অন্যতম বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উল্লেখ করছেন অনেক রাজনৈতিক বোদ্ধা। সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির পরই জামায়াতকে বড় দল হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস এখন সর্বত্রই লক্ষণীয়। অনেকে আবার জামায়াতকে সংজ্ঞায়িত করেন “সর্ববৃহৎ ইসলামী” দল হিসেবে। বাস্তবিক অর্থে তৃণমূলে এদেশের ইসলামপ্রিয় জনতার সমর্থন বিবেচনায় আরো অনেক দলই জামায়াত থেকে এগিয়ে থাকলেও নিজেদেরকে সর্ববৃহৎ ইসলামী দল হিসেবে উপস্থাপনে দলটি সফল হয়েছে মূলতঃ দেশের সর্বত্র তাদের শাখা থাকার কারণে, যা অন্য কোন ইসলামী রাজনৈতিক দলেরই নাই। নিজেদেরকে সর্ববৃহৎ ইসলামী দল হিসেবে পরিচিত করলেও জামায়াত এই বাস্তবতা নিশ্চিতভাবেই জানে যে সত্যিকার অর্থে এদেশে ধর্মপ্রাণ মুসলমানের বৃহত্তর অংশের ভোট পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
বিএনপি ছাড়া দ্বিতীয় কোন বড় রাজনৈতিক শক্তির শুন্যতার এই সময়ে জামায়াত প্রথম থেকেই সচেষ্ট নিজেদেরকে দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠায়। বক্তৃতায় আর মিডিয়ায় যতই এটা প্রচার হোক, নির্বাচনে যে তারা কেবল নিজেদের কর্মীদের ভোট নিয়ে ভালো করতে পারবে না এই বাস্তবতা থেকেই জামায়াত গত এক বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছিলো একটি বৃহত্তর ইসলামী জোট গঠনের। কিন্তু মওদূদীবাদীদের প্রতি এদেশের উলামায়ে কিরামের শত বছরের অনাস্থার ফলে সে চেষ্টা যে সফল হয়নি তা আমরা সম্প্রতি দেওবন্দী উলামাদের সংগঠন জমিয়ত কিংবা হেফাজত নেতাদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আর সুন্নী উলামারা তো প্রথম থেকেই জামায়াতের রাজনৈতিক সকল উদ্যোগকে নাকচ করে আসছেন। ফলে আগামী নির্বাচনে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের যে বড় দুটি অংশ, অর্থাৎ সুন্নী এবং কওমী, তাদের কারোর সমর্থন ছাড়া জামায়াতের রাজনীতি যে আগের অবস্থানেই থেকে যাবে তা দলটির নীতিনির্ধারকদের কাছে ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। এমতাবস্থায় দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের ফাঁকা জায়গা দখলে মরিয়া জামায়াতের জন্য আর ইসলামী রাজনীতি করার বিশেষ কোন ফায়দা নেই। এই বাস্তবতা থেকেই দলটি ধীরে ধীরে নিজেদেরকে মডারেট রাজনৈতিক দল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে। একটি ইসলামী দলের এভাবে হঠাৎ করে খোলস পালটে ফেলার কসরত তাদের নিজেদের জন্য লজ্জার তো বটেই, অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর জন্যও বিব্রতকর।
নিজেদের মডারেট ডানপন্থী দল হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জামায়াত তাদের দলীয় লোগোতেও পরিবর্তন করেছে অতি সম্প্রতি৷ এই লোগো থেকে তারা বাদ দিয়েছেন “আকিমুদ দ্বীন” অর্থাৎ দ্বীন কায়েম করার কথা, বাদ দিয়েছেন আল্লাহর নামও। দুটি লোগোকে পাশাপাশি রেখে নিরপেক্ষভাবে তাকালে যে কারো মনে হতে পারে কোন এক ইসলামোফোব শক্তির প্রভাবে দলটির নীতিনির্ধারকরা দ্বীনের সকল উপাদানই তাদের লোগো থেকে মুছে দিয়েছেন। এবিষয়ে জামায়াত সংশ্লিষ্টদের ব্যাখ্যা অনেকটা এরকম যে, লোগো একেক সময় একেক রকম হবে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দ্বীন কায়েমই আমাদের লক্ষ্য; এটা মুছে ফেলার মাঝে কোন অসুবিধা নাই। তাদের এই যুক্তি থেকে সামনে আসে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কথা। সে সময় সংবিধান থেকে মহান আল্লাহর প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের কথা বাদ দেওয়া, রাষ্ট্র ধর্ম ইসলাম বাদ দেওয়া এসব নিয়ে দেশ যখন উত্তাল তখন অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন ইসলামকে রাষ্ট্র ধর্ম রেখেই বা কি লাভ? দেশে তো আর ইসলামী শাসন নাই। আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই বা কি লাভ? সংবিধান তো জনগণকে ক্ষমতার উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে। এইসব যুক্তির পরিবর্তে উলামায়ে কেরাম পাল্টা যুক্তি দিয়েছেন এগুলা থাকায় লাভ বা ক্ষতি কি সেটা মুখ্য বিষয় নয়, মুখ্য বিষয় হলো একবার আল্লাহর নাম, আর ইসলামের কথা সংবিধানে উল্লেখ করে আবার তা মুছে ফেলার অর্থ দ্বীনকে তাচ্ছিল্য করা, এটার পিছনে আওয়ামী লীগের অসৎ উদ্দেশ্য আছে। উলামায়ে কেরামের এই যুক্তি তখন জামায়াতও গ্রহণ করে এবং এসব সংশোধনকে কেন্দ্র করে আওয়ামীলীগকে নাস্তিক সাব্যস্ত করে পুরো রাজনৈতিক অঙ্গনকে আস্তিক-নাস্তিক বাইনারিতে বিভক্ত করার প্রয়াস চালায়। দলীয় লোগো থেকে আল্লাহ শব্দ মুছে দিয়ে, দ্বীন কায়েমের কথা মুছে দিয়ে জামায়াতও আসলে আওয়ামীলীগের মতোই দ্বীনকে তাচ্ছিল্যই করেছে। এ কাজের পিছনেও আছে কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারা যাদেরকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে দলটি ক্ষমতার মসনদে বসার স্বপ্ন দেখছে। জামায়াতের কেউ কেউ দাবি করছেন নতুন লোগোর ক্যালিওগ্রাফিতে আল্লাহ শব্দটা আছে। সেক্ষেত্রেও প্রশ্ন থেকে যায় কাদের চাপে তারা তাদের লোগো থেকে আল্লাহ শব্দের সুস্পষ্ট রূপকে একটা গুপ্ত রূপে নিতে বাধ্য হলেন।
গত বছর এবং এবছরের দুর্গাপূজায় জামায়াত নেতাদের তুমুল আগ্রহ, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং ক্ষেত্রবিশেষে মন্ত্রপাঠ আমাদেরকে পতিত আওয়ামীলীগের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। দুর্গাপূজা আসলেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার নাম করে পুরো দেশে একটা সাজ সাজ রব ফেলে দেওয়ার কাজটা আওয়ামীলীগ নিষ্ঠার সাথে করতো। লীগের এইসব অতি উৎসাহ যে মুসলমানদের স্বকীয়তা নষ্ট করছে এই আওয়াজ তোলে উলামায়ে কিরাম সবসময় মুসলমানদের সাবধান করেছেন। পূজার শুভেচ্ছা বিনিময়ের বিরুদ্ধে জামায়াতের আলিমরাও ফতোয়া দিয়েছেন। কিন্তু সর্বশেষ দুই পূজায় যেভাবে দলটির নেতারা পূজার শুভেচ্ছা জানিয়ে আহ্লাদে আটখানা হয়েছেন এটাকে আমরা জামায়াতের তথাকথিত প্রগতিশীল হওয়ার ডেসপারেট চেষ্টা হিসেবে দেখতে পারি। পূজা কেন্দ্রীক এই বাড়াবাড়ির সমালোচনা করলে জামায়াতের কর্মীরা প্রথমে বলেন আমরা তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করি। নিরাপত্তার জন্য হিন্দুদের নিজেদের লোকজন এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই তো যথেষ্ট বললে জামায়াতের লোকেরাই আবার বলেন হিন্দুরা যাতে নিজেরা মূর্তি ভেঙে অন্যের উপর দায় চাপাতে না পারে এজন্য তারা পাহারা দেন। অতিরিক্ত হেকমতী এই দলের কোনটা যে সত্য কথা আর কোনটা যে ‘হেকমত’ এটা বুঝতে পারা বেশ কঠিন।
হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না হয় করাই হলো, কিন্তু দলটির সকল স্তরের নেতারা এখন যেভাবে ঢালাওভাবে শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানান এটা নিঃসন্দেহে শিরককে উৎসাহ দেওয়ার নামান্তর এবং হারাম। যুগের পর যুগ আওয়ামীলীগকে এ নিয়ে গালমন্দ করার পর এখন যখন জামায়াত এই কাজ করে তখন আমরা দ্বিধায় থাকি যে জামায়াত আসলেই কোন ধরণের দল! জামায়াত আমিরের পূজার শুভেচ্ছা জানানোর ব্যাপারে টেলিভিশনে জামায়াতের জোট সঙ্গী ইসলামী আন্দোলনের এক নেতা ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে যেহেতু হিন্দুরা এদেশেরই নাগরিক তাই রাষ্ট্রের জায়গা থেকে এমন শুভেচ্ছা জানানো যেতেই পারে। এই নেতার কথা শুনলে মনে হবে তারা এবং জামায়াত মনে হয় রাষ্ট্র ক্ষমতায় আছে! জামায়াতের আমীরের পূজার শুভেচ্ছা জানানো, তার দেখাদেখি তৃণমূল জামায়াতের মাঝেও পূজার শুভেচ্ছা বিনিময় চালু হওয়া এবং অন্য একটা ইসলামী দল এটাকে সমর্থন করা এই পুরো দৃশ্যটা ভেবে দেখলেই বুঝা যায় বাংলাদেশে ইসলামী রাজনীতির আলাপ যারা করেন তাদের আদর্শিক ভিত কতোটা নড়বড়ে। এই দলগুলো ক্ষমতায় গিয়ে দ্বীন কায়িমের কথা বলে অথচ ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই কেবল নিজেদের অবস্থানকে সঠিক প্রমাণ করতে উলামায়ে কিরামের সম্মিলিত ফতোয়ার বিরুদ্ধাচারণ করে।
আওয়ামীলীগের মতো সেক্যুলার দল যখন পূজা নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি করতো তাতে এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ আহত হলেও তা মোটামুটি সহনীয় ছিলো কারণ সবাই জানতো এরা মুসলমান হলেও সেক্যুলারিজমে বিশ্বাসী। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দাড়ি টুপিওয়ালাদের, আলখেল্লাওয়ালাদের পূজা কেন্দ্রীক কর্মযজ্ঞ এদেশে একেবারেই ব্যতিক্রম ঘটনা। পূজা কেন্দ্রীক হুযুরদের অতি মাতামাতির মতো একটি দৃষ্টিকটু, দ্বীনি রুচিবিরুদ্ধ এবং ঈমানী গাইরতের সাথে সাংঘর্ষিক চর্চা এদেশে ধীরে ধীরে নরমালাইজ হচ্ছে কয়েকটি ইসলামী দলের ক্ষমতাকেন্দ্রীক রাজনীতির মোহের ফলে। বলা বাহুল্য এইসব দলের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। সহচেয়ে ভয়ংকর ব্যপার হলো এসব করতে গিয়ে যখন তারা সীমালঙ্ঘন করেন সেটাতেও তারা অনুতপ্তবোধ করেন না। ২০২৪ সালের দুর্গাপূজার মন্ডপে জামায়াতের রুকন স্তরের এক বড় নেতা যখন মন্দিরে উলু ধ্বনির সাথে মন্ত্রপাঠ করলেন, সকলের সমালোচনার মাঝে জামায়াতের এক্টিভিস্টরা প্রচার করলো ওই নেতা বিশাল বড় স্কলার, এটা তার ভুল নয়, যারা বিরোধিতা করছে তারা হিংসুক। ছাত্র শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি যখন টিভি পর্দায় ফতোয়া দিলেন অস্থায়ীভাবে মূর্তি বানানো জায়িয তখনো তার পক্ষে অন্ধভাবে দাঁড়ালো জামায়াতের সকল এক্টিভিস্ট। এরকম আদর্শ বিচ্যুতি ধরিয়ে দিলে সোশ্যাল মিডিয়ার বট বাহিনীর নোংরা আক্রমণের শিকার হতে হবে এটা এখন মোটামুটি সকলেই বুঝে গেছেন। ফলে জামায়াতকে সমালোচনার মাধ্যমে নাসীহা করার সদিচ্ছা আছে এমন মানুষও ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। জামায়াতের সমালোচনা মুক্ত সাইবার স্পেইস আদতে দলটিকে একটি অহংকারী নির্বোধের দলে পরিণত করছে।
জামায়াতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্টতই বুঝা যাচ্ছে যে তারা নানান বিদেশি শক্তি এবং এদেশের ডীপ স্টেটের সাথে এক ধরণের সেটেলমেন্টে যাওয়ার সর্বোত চেষ্টা জারি রেখেছে। প্রতিনিয়ত পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠক আমাদেরকে সে ইঙ্গিতই দেয়। অথচ দলটি আবার নিজেদেরকে সব সময় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হিসেবে জাহির করে। বিভিন্ন এমব্যাসির সাথে ঘনঘন বৈঠক, দলীয় লোগো থেকে দ্বীন কায়িমের মুহকাম আয়াত মুছে ফেলা, ইসলামী রাজনীতি করলেও শরীআ কায়িম করা আমাদের উদ্দেশ্য নয় বলা, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি এসবই স্পষ্ট করছে জামায়াত আসলে বিভিন্ন মহলকে সন্তুষ্ট করতে মরিয়া। নানা মহলকে নিজেদের আস্থায় নিয়ে আসার কাজ আওয়ামীলীগ করতো, বিএনপিও করে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে বিএনপি এমনকি আওয়ামীলীগকেও দলীয় আদর্শের বিকৃতি ঘটাতে হয়নি। নিজেদের আদর্শের ব্র্যাণ্ডিং করেই তারা অন্যদের আস্থা অর্জন করার চেষ্টা করে। অথচ জামায়াত বিদেশি শক্তি, এদেশের ডীপ স্টেট, কালচারাল এস্টাব্লিশমেন্ট এবং আরবান মিডলক্লাসের আস্থা অর্জন করার মানসে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে যে আদর্শের প্রচার করছিলো তা থেকে সরে গিয়েছে। ইসলামের নামে এতোদিন রাজনীতি করে হুট করে জামায়াতের এই মডারেট হওয়ার খায়িশ থেকে স্পষ্ট হয় ক্ষমতার প্রয়োজনে তারা পুরদস্তুর সেক্যুলার হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী ভারতের কর্তৃত্ববাদী আচরণের ফলে এদেশের মানুষের মাঝে যুগ যুগ ধরেই এন্টি ইন্ডিয়া সেন্টিমেন্ট রয়েছে। পলাতক শেখ হাসিনার পনেরো বছরের শাসনামলে এদেশে ভারতের নগ্ন হস্তক্ষেপের ফলে মানুষের মধ্যে বর্তমানে ভারত বিরোধী মনোভাব স্মরণকালের সর্বোচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এদেশের মানুষের এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে ভোট বাড়ানোর চেষ্টায় জামায়াতের নায়েবে আমীর সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, তিনি চান ভারত বাংলাদেশে ঢুকে পড়ুক, তাহলে তারা নিজেদের প্রমাণ করার সুযোগ পাবেন। ভারতের প্রতি জামায়াতের অন্যতম এই শীর্ষ নেতার উস্কানিমূলক বক্তৃতার পরেই তিনি আবার এক সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেছেন ভারত প্রসঙ্গে বেশি বলে ফেললেন কি না! অর্থাৎ ভারত প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন তা যে লাগামহীন তা তিনি নিজেও জানেন এবং তিনি এ বিষয়ে ভীতও। এই অতি ভারত বিরোধী বয়ানের দুটি দিক হতে পারে। যদি সরল বিশ্বাসে ধরে নেওয়া যায় জনাব তাহেরের এই ভারত বিরোধী মনোভাব একেবারে নির্ভেজাল, এতে কোন ছলচাতুরী নেই, তাহলে প্রশ্ন আসে ভারতকে নিজেদের মাটিতে যুদ্ধের আমন্ত্রণ জানানোর আগে তারা আসলে কি প্রস্তুতি নিয়েছেন। এখনো এদেশের সামরিক, নৌ ও বিমান বাহিনীর শক্তি এতোটা ভঙ্গুর যে ভারত তো দূরের কথা মায়ানমারের সাথে সংঘাতে জড়ানোর মতো পরিস্থিতিও তাদের নেই। শেখ হাসিনার পনেরো বছরে সমরাস্ত্রের কোন আধুনিকায়ন না হওয়ার ফলে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর অবস্থা এখন নিধিরাম সরদারের মতোই। এমন অবস্থায় জামায়াত কীভাবে এদেশের সেকেলে সমরাস্ত্রের আধুনিকায়ন করবে, ভারতের মতো একটা প্রভাবশালী পারমাণবিক শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় তারা অন্যান্য বৃহৎ শক্তির সাথে কীভাবে সামরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে, চীন ও পশ্চিমা বলয়ের মধ্যে সম্পর্কের ব্যালেন্স করে কীভাবে ভারতের সামরিক হুমকি মুকাবিলা করবে এসবের কোন রূপরেখাই জামায়াত এখনো হাযির করতে পারেনি। কোন ধরণের প্রস্তুতি ছাড়াই এরকম একটা ক্ষ্যাপাটে রাষ্ট্রকে বাংলাদেশে হামলা চালানোর উস্কানি দেওয়া স্পষ্টতই তাদেরকে বাংলাদেশ ধ্বংসের জন্য আমন্ত্রণ জানানোর নামান্তর। এদেশের মানুষের ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্টকে কাজে লাগিয়ে ভোটের মাঠে ভালো করার খায়েশে রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে ফেলতে এই জামায়াত নেতা একবারও ভাবেননি।
জনাব তাহেরের এই বক্তব্য এবং পরে ভীত হয়ে সাংবাদিককে “বেশি বলে ফেললাম কিনা” জিজ্ঞাসার সবচেয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা এটা যে, ভারতীয়দের সাথে কোন না কোন মাধ্যমে জামায়াতের এক ধরণের বুঝাপড়া আছে। এই বুঝাপড়ার কারণেই জামায়াত ভারত নিয়ে যথেচ্ছা বক্তব্য দিয়ে ভোটব্যাংক বাড়ানোর ব্ল্যাঙ্ক চেক পেয়েছে এবং এর বিপরীতে পতিত স্বৈরাচার আওয়ামীলীগের পুনর্বাসনে গোপন সম্মতি দিয়েছে। আওয়ামীলীগকে পুনর্বাসনে জামায়াত যে সম্মতি দিয়েছে এটা আমার সন্দেহ নয়, বরং দেশের মূল ধারার অনেক মিডিয়ার দাবি। এই দাবির পিছনে শক্ত প্রমাণক হিসেবে হাযির হয় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের কোন কার্যক্রম প্রতিহত করতে যেখানে বিএনপি, এনসিপি জোরালো ভূমিকা রাখে জামায়াত সেখানে একেবারেই নিষ্ক্রিয় ভূমিকায় থাকে। ভারতের সাথে জামায়াতের বুঝাপড়ার যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে এটা এদেশের মুক্তিকামী জনতার প্রতি জামায়াতের বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবেই চিহ্নিত হবে। আওয়ামীলীগ স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতকে মিত্র হিসেবে প্রকাশ্যে গ্রহণ করেছে, কিন্তু জামায়াত যেভাবে বক্তৃতায় বিরোধীতা কিন্তু পর্দার আড়ালে আঁতাত এর নীতি গ্রহণ করেছে এই নীতির ফলে তারা নিজেরা লাভবান হলেও ভয়াবহ বিপদে পড়বেন তাদের ভারত বিরোধীতার সাথে সরল বিশ্বাসে স্বর মিলানো সাধারণ নাগরিক ও এক্টিভিস্টরা।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে এখন পর্যন্ত জামায়াতের রাজনীতির হরেক রঙ দলটির চরম নীতিহীনতার চিত্রই আমাদের সামনে উন্মোচিত করে। দলটি যখন নিশ্চিত হয়েছে ইসলামপন্থীদের ভোট তারা খুব একটা পাবে না তখন বিরুদ্ধমতের ইসলামপন্থীদের মসজিদ-মাদরাসা দখল এবং খানেকা-মাযারে আক্রমণে উস্কানির কাজ তারা নিয়মিতই করে যাচ্ছে। বিপরীতে শহুরে মধ্যবিত্তদের আস্থা অর্জনের আশায় নিজেদের লিবারেল হিসেবে প্রমাণের ডেস্পারেট চেষ্টাও তারা করে করছেন। দলটির এমন রঙ পরিবর্তন এবং ইসলামপন্থীদের উপর চড়াও হওয়ার প্রবণতা ক্ষমতার সংস্পর্শে আরো ভয়াবহ রূপ নেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। বর্তমান প্রেক্ষাপটে জামায়াতের রাজনীতির সবচেয়ে বড় হিপোক্রেসি এটাই যে তারা একদিকে শহুরে মধ্যবিত্ত এবং বিভিন্ন প্রেশার গ্রুপের কাছে নিজেদের লিবারেল হিসেবে উপস্থাপনের চেষ্টা করছেন আবার অন্যদিকে তাদের এমপি প্রার্থীরা গ্রামে গঞ্জে, ওয়ায মাহফিলে প্রচার করছেন জামায়াতকে ভোট দেওয়া মানেই ইসলামের পক্ষে ভোট দেওয়া। এই দ্বিচারিতা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তথাকথিত ইসলামী রাজনীতির অসারতাই স্পষ্ট করছে। দাড়িপাল্লায় ভোট দিলে জাহান্নামে না যাওয়ার গ্যারান্টি, দাড়িপাল্লায় ভোট দেওয়া কুরআনকে ভোট দেওয়া, দাড়িপাল্লায় ভোট না দিলে ঈমান চলে যাবে, যারা জামায়াতের বিরোধীতা করে এরা ইসলামের দুশমন, জামায়াতের প্রার্থীর সাথে রাসূলুল্লাহ e এর তুলনা এসবই এখন মাঠে ময়দানে নিয়মিত শোনা যাচ্ছে। ভোটের রাজনীতিতে নির্দিষ্ট দলের বিরুদ্ধে গেলে তাকফির আর পক্ষে থাকলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি, এই প্রচারণার সাথে খারেজিয়তের মিল কতটুক তা ভেবে দেখা প্রয়োজন। যেদেশের সিংহভাগ মানুষই মুসলমান এবং নির্বাচনে বেশিরভাগ প্রার্থীও মুসলমান, সেদেশে কোন এক গোষ্ঠী যদি নিজেদের ইসলামের পক্ষে বলে প্রচারণা চালায় তাহলে অন্য একটি বিপুল সংখ্যক মুসলমান রাজনৈতিক গোষ্ঠীকে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে অইসলামী ট্যাগই দেওয়া হয়। নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলে বিপুল সংখ্যক মুসলমানকে অইসলামী ট্যাগ দেওয়া উম্মাহর মাঝে বিভাজনের নামান্তর। বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে কেউই ক্ষমতায় গিয়ে পরিপূর্ণ রূপে কোরআন এবং সুন্নাহভিত্তিক দেশ চালাবে এই ওয়াদা না করে, কীভাবে তাদের শাসন পদ্ধতি অন্য সাধারণ দলগুলো থেকে বেশি “ইসলামী” হবে এর কোন রূপরেখা না দিয়ে কেবল পোশাক এবং ভাষার জোরে নিজেদের প্রতীকে ভোট দেওয়া ফরজ বলে প্রচার করা দ্বীন ইসলামকে ব্যবহার করে স্বার্থসিদ্ধি ছাড়া কিছুই নয়। এই কাজটিই জামায়াত সহ অন্যান্য তথাকথিত ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলো করে যাচ্ছে।
নিকোলো ম্যাকিয়াভেলি তার বিখ্যাত গ্রন্থ দ্য প্রিন্স এ বলেছেন শাসনকর্তাকে হতে হবে ছলচাতুরী পূর্ণ, যেখানে সকল কথা ও কাজের উদ্দেশ্য হবে নিজের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করা। তার এই প্রস্তাবনা থেকেই ম্যাকিয়াভেলিয়ান ক্যারেক্টার বলে রাজনীতিতে একটা ধারণার জন্ম লাভ করে। জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা মওদূদী যে দ্বীন কায়িমের স্বার্থে হিকমতের কথা বলেন এর সাথে ম্যাকিয়াভেলিয়ান ক্যারেক্টারের তেমন কোন ফারাক নাই। উভয় চিন্তাই আসলে ক্ষমতা প্রাপ্তি এবং সুসংহত করতে মিথ্যা বলা, ধোঁকা দেওয়া এবং স্যাবোটাজ করাকে এক রকম বৈধতা দেয়। জামায়াতের বর্তমান রাজনীতি ম্যাকিয়াভেলিয়ান পলিটিক্স-এর টেক্সটবুক উদাহরণ। ইসলামকে কেন্দ্র করে জামায়াতের এই ম্যাকিয়াভেলিয়ান পলিটিক্স এদেশের মুসলমানদের ঐক্য বিনাশের কারণ হয়েছে যুগের পর যুগ। বর্তমানে একই সাথে ইসলামিস্ট এবং লিবারেল সাজার প্রবণতা বাংলাদেশে নির্বাচনের আগে বা পরে নতুন আরেকটি মওদূদীবাদী রাজনৈতিক সত্ত্বার আবির্ভাবের প্লট তৈরি করছে। নতুন মওদূদীবাদী সত্ত্বার আবির্ভাবের সাথে সাথে বর্তমান জামায়াত হয়ে উঠবে লিবারেল মওদূদীবাদী আর নতুনরা হবে কনজার্ভেটিভ মওদূদীবাদী, দ্বীনি পরিমণ্ডলে আবির্ভূত হবে নতুন আরেকটি ফেরকা।