Logo
মালদ্বীপে অন্ধকার ভেদ করে ইসলাম আসলো যেভাবে
মুহাম্মদ জামান আহমদ
  • ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

ইবন বতুতা (র.) ছিলেন একজন বিখ্যাত পর্যটক। তিনি তৎকালীন মনুষ্য অধ্যুষিত প্রায় সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি তার সফরনামায় লিখেছেন, একবার ভ্রমণ করতে করতে তিনি মালদ্বীপে উপনীত হলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন মালদ্বীপের প্রতিটি শহর-নগর-বন্দর আযানের সুমধুর ধ্বনিতে মুখরিত। অবস্থাদৃষ্টে তার মনে হলো,গোটা মালদ্বীপ ভূমিই যেন নামাযের সিজদায় অবনমিত। এ অবস্থা দেখে আল্লামা ইবন বতুতা খুবই বিস্মিত হলেন। কারণ,তার জানামতে কোনো ইসলাম প্রচারক মালদ্বীপে আসেননি। তিনি ভাবতে লাগলেন,কোন ধর্ম প্রচারকের আগমন না ঘটা সত্ত্বেও এখানে ইসলামের আলো ছড়ালো কীভাবে? মহান পরিব্রাজক ইবন বতুতা (র.) তখন সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদেরকে মালদ্বীপের মানুষের ইসলামে দীক্ষিত হওয়া সম্মন্ধে জিজ্ঞেস করলেন। তারা তাকে অতি আশ্চর্যজনক একটি ঘটনা  শোনালেন। তা হলো…

বহু বছর আগে আরবের কোনো এক বাণিজ্য জাহাজ এদিকে যাত্রা করে যাচ্ছিল। ঘটনাচক্রে জাহাজটি তুমুল সমুদ্রঝড়ে পতিত হয় এবং একপর্যায়ে জাহাজটি সমুদ্রে তলিয়ে যায়। সেই ঘটনায় জাহাজের অভিযাত্রী সকলেই মারা যান। কিন্তু একজনমাত্র লোক কোনো এক কাঠখন্ডকে অবলম্বন করে আল্লাহর মেহেরবানীতে বেঁচে যান এবং সাঁতরে এই দ্বীপে এসে আশ্রয় নেন। তিনি ছিলেন এক আরব যুবক। নাম আবুল বারাকাত। তিনি ছিলেন কুরআনের হাফিয। অচেনা অপরিচিত দ্বীপে আবুল বারাকাত কোথায় যাবেন? কে দেবে তাকে আশ্রয়? এখানে তো তার কোনো বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজন নেই। অবশেষে তিনি এক বৃদ্ধার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন। জঙ্গলে কাঠ কেটে তা বিক্রয় করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করলেন। এভাবেই চলছিলো তার অচেনা দ্বীপের নতুন জীবন।

একদিন আবুল বারাকাত বাড়িতে এসে দেখলেন তাকে আশ্রয়দাতা বৃদ্ধা কাঁদছেন এবং তার যুবতী মেয়েটাও অঝোর নয়নে কেঁদে চলেছেন। আবুল বারাকাত কিছু বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলেন- কী হয়েছে? আপনারা কাঁদছেন কেন? বৃদ্ধা বললেন- আজ আমার মেয়ের জীবনের শেষ দিন। সে আজকেই মারা যাবে। আবুল বারাকাত বললেন- তিনি তো দিব্যি সুস্থ্। মারা যাবেন কেন? বৃদ্ধা আঙুল দ্বারা ইশারা করে বললেন- ওই যে দেখুন,মৃত্যু আমাদের সামনে। আবুল বারাকাত তাকিয়ে দেখলেন বাড়ির সামনে রাজার সৈন্যরা দাঁড়ানো। তিনি বললেন, তারা কি আপনার মেয়েকে হত্যা করবে? বৃদ্ধা বললেন- না,ব্যাপারটি তা নয়। আমাদের এই দ্বীপে প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট তারিখে এক সামুদ্রিক বিপদের উদ্ভব হয়। যার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য দ্বীপবাসীদের পক্ষ থেকে একটি যুবতী মেয়েকে সূর্য ডোবার পর সমুদ্র উপকূলে থাকা বিশেষ একটি মন্দিরে রেখে আসতে হয়। পরের দিন সকালে রাজার সৈন্যরা সমুদ্রের কিনারা থেকে ওই মেয়েকে মৃত অবস্থায় নিয়ে আসে। প্রতি বছর লটারির মাধ্যমে যে মেয়ের নাম ওঠে, তাকে ওইখানে পাঠানো হয়। এবছর লটারিতে আমার মেয়ের নাম উঠেছে। তাই আজ রাতে তাকে সমুদ্র উপকূলে পাঠানো হবে। সেখানে তার মৃত্যু অনিবার্য। তাই রাজার সৈন্যরা আমার মেয়েকে নিয়ে যাবার জন্য এসেছে।

বৃদ্ধার মুখে এ বেদনাদায়ক ঘটনা শুনে আবুল বারাকাত বললেন, আজ আপনার মেয়েকে সেখানে পাঠাবেন না। আজ রাতে আমিই যাবো সেই মন্দিরে। দেখি, সেখানে কী হয়! প্রয়োজনে আপনার মেয়ের পরিবর্তে আমার জান দিয়ে দিবো। রাজার সৈন্যরা যাতে বুঝতে না পারে, তাই আপনার মেয়ের পোশাক আমাকে পরিয়ে দিন। আমিই আজ তাদের সাথে যাবো ইনশাআল্লাহ। উল্লেখ্য যে, আবুল বারাকাতের বয়স ছিলো খুবই কম। তাঁর দাড়ি-গোফ তখনও গজায়নি। কাজেই রাজার সৈন্যদের কাছে তার মেয়েলি বেশ ধরা পড়ার আশঙ্কা ছিলো না। বৃদ্ধা আবুল বারাকাতকে নির্ঘাত মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দিতে কোনক্রমেই রাযী হচ্ছিলেন না। আবুল বারাকাত তাকে বুঝালেন যে, তিনি মুসলমান। মুসলমানগণ আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কাউকে ভয় করে না। জীবন ও মৃত্যু একমাত্র মহান আল্লাহর হাতে। আল্লাহর হুকুম না হলে কেউ তাকে মারতে পারবে না। তাছাড়া তিনি হাফিযে কুরআন। তার বিশ্বাস, কুরআন শরীফের বরকতে আল্লাহ তাআলা তাকে হিফাযত করবেন। শেষ পর্যন্ত আবুল বারাকাতের অত্যাধিক পীড়াপীড়িতে বৃদ্ধা রাযী হলেন এবং তাকে মেয়ের পোশাক পরিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করলেন। অতঃপর রাজার সৈন্যরা তাকে সমুদ্রের উপকূলস্থ সেই মন্দিরে রেখে চলে এলো।

আবুল বারাকাত সেখানে যাওয়ার পর উত্তমরূপে উযূ করে নামায আদায় করলেন। এরপর পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। ক্রমে রাত গভীর হতে লাগলো। চারদিক নিস্তব্ধ। প্রকৃতি নিদ্রার কোলে ঢলে পড়লো। নির্ঘুম জেগে রইলো তিনটি প্রাণ। যাদের চোখে নিদ্রার চিহ্নমাত্র ছিল না। সেই তিনজনের একজন হলেন আরব যুবক আবুল বারাকাত। যার চোখ ছিলো সমুদ্রের দিকে আর বুকে ছিলো ঈমানের বল। আরেকজন হলেন সেই গরীব বৃদ্ধা মহিলা, যার অন্তর আরব যুবকের চিন্তায় অস্থির। আর তৃতীয় যে প্রাণটি জেগে রইল, সে হলো বৃদ্ধার যুবতি কন্যা। আরব যুবকের চিন্তায় সে অনবরত কেঁদেই চললো। হাফিয আবুল বারাকাত অন্ধকার রাতের এই নিস্তব্ধ পরিবেশে সমুদ্রের কিনারস্থ সেই ভয়াল মন্দিরে বসে অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শী সুরে কুরআন শরীফ তিলাওয়াত করে যাচ্ছিলেন। কেননা এ সংকটকালীন মূহূর্তে সকল অপশক্তির মুকাবিলায় কুরআনই তার অমোঘ হাতিয়ার।

গভীর রাতে হঠাৎ করে সমুদ্রের দিগন্ত থেকে বিশাল আকৃতির এক ভয়ংকর দৈত্যের উদ্রেক হলো। দৈত্যটি ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে মন্দির অভিমুখে আসতে লাগলো। হাফিয আবুল বারাকাত আরও জোরে জোরে কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। মন্দিরের কাছাকাছি এসে দৈত্যটি থেমে গেল। অনেক চেষ্টা করেও কুরআন তিলাওয়াতের কারণে দৈত্যটি সামনে অগ্রসর হতে পারছিল না। অবশেষে ভয়ংকর দৈত্যটি হার মানলো। সে যে পথে এসেছিলো, সে পথেই ফিরে গেলো। আবুল বারাকাত কুরআন তিলাওয়াত করেই বাকি রাত কাটিয়ে দিলেন।

সকাল হলো। রাজার সৈন্যরা মেয়েটির লাশ নেওয়ার জন্য মন্দিরে এসে তারা তো হতভম্ব! সেখানে কোনো লাশ নেই। কোনো যুবতি মেয়েও নেই। তার পরিবর্তে সেখানে রয়েছে অচেনা যুবক আবুল বারাকাত। তারা তাকে রাজার দরবারে নিয়ে গেল। আবুল বারাকাত রাজার নিকট সমস্ত ঘটনা খুলে বললেন। তখন রাজা নিশ্চিত হওয়ার জন্য বৃদ্ধা ও তার মেয়েকে ডেকে আনলেন। তারা রাজার কাছে ঘটনাটির সত্যায়ন করলেন। আবুল বারাকাত রাজাকে বললেন- আমি যা করেছি, তা আমার ধর্ম ইসলামের শিক্ষার তাকীদে করেছি। এটা আমার প্রতি বৃদ্ধার ইহসানের সামান্য বদলা মাত্র। সব শুনে রাজা সীমাহীন অবাক হয়ে বললেন- হে যুবক! এতো বড় বিপদের সামনে তুমি একাকী দাঁড়ালে কীভাবে? যুবক বললো- আমি একা ছিলাম না, আমার সাথে আমার আল্লাহ ছিলেন। আর আমার হাতিয়ার ছিলো মহান আল্লাহর কালাম পবিত্র কুরআন। রাজা জিজ্ঞেস করলেন- তুমি ভয় পাওনি কেন? যুবক বললো- মুসলমান একমাত্র আল্লাহকে ছাড়া আর কাউকে ভয় পায় না। জীবন ও মৃত্যুর মালিক একমাত্র মহান আল্লাহ। এরপর রাজা বললেন- তুমি কি আগামী বছরও এভাবে একা ওখানে যেতে পারবে? যুবক দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিল- ইনশাআল্লাহ একাই যেতে পারবো। রাজা তখন অতি আবেগের সাথে বলে উঠলেন- যদি তুমি পারো, তাহলে আমরা সবাই ইসলাম গ্রহণ করবো।

এরপর পরবর্তী বছর নির্ধারিত তারিখে আরব যুবক আবুল বারাকাত একা একা সেই মন্দিরে গেলেন এবং সারারাত সেখানে কুরআন তিলাওয়াত করে কাটালেন।  আল্লাহর রহমতে সকাল বেলা সহী-সালামতে ফিরে আসলেন। এরপর থেকে সে বিপদ আর কখনও মালদ্বীপে আসেনি। তখন রাজা ও তার দরবারের সবাই ইসলাম গ্রহণ করলেন। অতঃপর সেই রাজ্যের মানুষ দলে দলে ইসলামে দীক্ষিত হলেন। এভাবেই একটিমাত্র ঘটনার প্রেক্ষিতে হাফিয আবুল বারাকাতের হাত ধরে ক্রমান্বয়ে মালদ্বীপের সকল মানুষ ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আসার সুযোগ লাভ করেন।

ফেইসবুকে আমরা...