1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
কুরবানীর ইতিহাস ও প্রয়োজনীয় মাসাইল
ইমাদ উদ্দীন তালুকদার
  • ৫ জুন, ২০২৩

নবী আদম (আ.)। ভূ-পৃষ্ঠে প্রথম মানবের পাশাপাশি পৃথিবীতে আল্লাহর প্রেরিত প্রথম নবী তথা মুক্তির দিশারী। তিনি প্রথম মানুষ হওয়ার কারণে তাকে বলা হয়ে থাকে আদি পিতা বা মানব জাতির পিতা। তখন পৃথিবীতে আদম ও হাওয়া আলাইহিমাস সালামই একমাত্র দম্পতি। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে মানবজাতকে বংশানুক্রমে বৃদ্ধির ইচ্ছা করলেন। নির্দেশ করেন আদম ও হাওয়া (আ.) এর ঔরসজাত সন্তানদের পরস্পর বিয়ের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধিকরণের। আল্লাহ হাওয়া (আ.) এর প্রতি গর্ভে একজন ছেলে ও একজন মেয়ে যমজ দুই সন্তান দান করতেন। একই গর্ভে জন্ম নেওয়া যমজ ছেলেমেয়ে ভাইবোন হিসেবে বিবেচিত হত। এজন্য তাদের মধ্যকার একে অন্যে বিয়ে ছিলো নিষিদ্ধ। বরং পরবর্তী গর্ভের ছেলে বা মেয়ের সাথে বিয়ে হবে। পর্যায়ক্রমে হাওয়া (আ.) এর একই গর্ভে কাবিল ও আকলিমা এবং অন্য গর্ভে হাবিল ও লিওয়াজা জন্মগ্রহণ করেন।1 নিয়মমতো কাবিল লিওয়াজাকে এবং হাবিল আকলিমাকে বিয়ে করবেন। এখানে বেকে বসেন কাবিল। চাইলেন লিওয়াজা নয় বরং তারই সাথে একই গর্ভে জন্ম নেওয়া যমজ বোন আকলিমাকে বিয়ে করতে। এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি হলে ঘটনা আদম (আ.) এর কাছে যায়। কাবিল জেদ ধরায় আদম (আ.) বললেন, উভয়ে কুরবানী দিতে। যার কুরবানী আল্লাহর দরবারে কবূল হবে সেই লিওয়াজাকে বিয়ে করবে। ‘এক্ষেত্রে কবুলের আলামত হলো, আকাশ থেকে অগ্নিশিখা কুরাবানীর পশু বা পণ্য জ্বালিয়ে দিবে।’2 যার কুরবানী জ্বলবে না, তার কুরবানী মকবূল নয়। শেষ নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের আগ পর্যন্ত কুরবানীর এইরূপ বিধান ছিল। হাবিল পশু পালনের কারণে তিনি দুম্বা আর কাবিল কৃষি কাজ করার দরুন কিছু শস্য কুরবানী হিসেবে পেশ করলেন। হাবিলের দেওয়া কুরবানীর পশু দুম্বা আকাশ থেকে বিচ্ছুরিত অগ্নিশিখা এসে জ্বালিয়ে দিল বিপরীতে কাবিলের শস্য রইলো অপরিবর্তিত। কুরবানী কবূলের ফলাফল সেই হাবিলের পক্ষেই থাকলো। এখানেও কাবিল এই ফয়সালা মেনে নিলেন না। অগ্রাহ্য করে হাবিলকে আক্রমণ করেন। হাবিল এই লড়াইয়ে রাজি ছিলেন না। কিন্তু কাবিলের জবরদস্তিমূলক আঘাতে মারা যান হাবিল। আল্লাহ কুরআন কারীমে সূরা মায়িদার ২৭-৩১ আয়াতে তাদের এই ঘটনা বয়ান করেন।3

এভাবে কুরবানী শুরু হয় মানবজাতির প্রথম যুগ থেকেই। কুরবানী আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ত্যাগের নমুনা। এই ধারাবাহিকতা চললো সকল যুগে। প্রতিটি জাতির জন্যই আল্লাহ কুরবানীর রুসম দিয়েছিলেন,

وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَىٰ مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ

-আমি (আল্লাহ) প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর বিশেষ রীতি নির্ধারণ করে দিয়েছি, যেনো তারা এসব পশুর ওপর আল্লাহর নাম নিতে পারে, যেগুলো আল্লাহ রিযিকরূপে প্রদান করেছেন। (সূরা হজ্জ, আয়াত-৩৪)

আজকের কুরবানীর শুরুটা সেই হাবিল-কাবিলের দেওয়া কুরবানীর আসল থেকে। শুরুটা তাদের থেকে হলেও উম্মতে মুহাম্মদীর কুরবানীর ইবাদত কিন্তু ইবরাহীম (আ.) এর প্রিয় সন্তান ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী দেওয়া কেন্দ্রিক পরীক্ষার অনুসরণে। সাহাবীগণ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে কুরবানী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন,

يَا رَسُولَ اللَّهِ، مَا هَذِهِ الْأَضَاحِيُّ ؟ قَالَ : سُنَّةُ أَبِيكُمْ إِبْرَاهِيمَ

-হে আল্লাহর রাসূল! এই কুরবানী কী? তিনি বললেন, এটা তোমাদের পিতা হযরত ইবরাহীমের সুন্নাত।4

নবী ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস আনয়নকারীর নাম মুসলিম রেখেছিলেন। এজন্য তিনি মুসলিম মিল্লাত তথা মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে কুরআনে অভিহিত।5 মুসলিম জাতির পিতা ইবরাহীম (আ.) দীর্ঘদিন কায়মনোবাক্যে আল্লাহর দরবারে চাওয়ার একপর্যায়ে ইসমাঈল (আ.)কে সন্তান হিসেবে পান। তখন বয়স ছিয়াশী।6 মা হাজেরা (আ.)সহ সকলেই পরমানন্দে ঈসমাইল (আ.)কে লালনপালন করতে লাগলেন। ইসমাইল বড় হতে লাগলেন। যখন বাবার সাথে চলাফেরা ও সাহায্য করার মত বয়সে7 উপনীত তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে নবী ইবরাহীমের জন্য বিরাট পরীক্ষার ইশারা আসলো,

فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَىٰ فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَىٰۚ قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ فَلَمَّا أَسْلَمَا وَتَلَّهُ لِلْجَبِينِ وَنَادَيْنَاهُ أَن يَا إِبْرَاهِيمُ قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَاۚ إِنَّا كَذَٰلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ إِنَّ هَٰذَا لَهُوَ الْبَلَاءُ الْمُبِينُ وَفَدَيْنَاهُ بِذِبْحٍ عَظِيمٍ

-অতঃপর তিনি (ইসমাঈল আ.) যখন তাঁর পিতার সাথে চলাফেরার বয়সে উপনীত হলেন, তখন ইবরাহীম তদীয় সন্তানকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, তোমাকে যবেহ করছি। এ বিষয়ে তোমার তীক্ষ্ণদর্শনী অভিমত কী? উত্তরে পুত্র বললেন, পিতা আমার, যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ফেলুন। আল্লাহ চান তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। অতঃপর পিতা ও পুত্র উভয়েই যখন আনুগত্য প্রকাশ করলেন আর পিতা পুত্রকে যবেহ করার জন্য শায়িত করলেন, আমি তখন তাঁকে ডেকে বললাম হে ইবরাহীম তুমিতো স্বপ্নকে সত্যে পরিণত করে দেখালে। আর এভাবেই আমি সৎকর্মপরায়ণদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা এক সুস্পষ্ট পরীক্ষা। আমি তার পরিবর্তে দিলাম যবেহ করার জন্য এক মহান জন্তু। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০২-১০৭)

ঘটনার শুরু হল, ইসমাঈল (আ.) হঠাৎ করে স্বপ্ন দেখতে লাগলেন ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানীর নির্দেশ আসছে৷ পরপর তিনবার স্বপ্ন দেখলেন। ইমাম কুরতুবী (র.) তাফসীরে দিনগুলির বর্ণনা করেন, ইবরাহীম (আ.) তিনবার এ স্বপ্ন দেখেছিলেন। প্রথমবার যিলহজ্জ মাসের আট তারিখে দেখলেন যে, কেউ একজন তাকে তাঁর সন্তানকে কুরবানী করার আদেশ করছেন। তিনি সকালে স্বপ্নের ব্যাপারে চিন্তা করলেন যে, এটা কি আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের পক্ষ থেকে। সেজন্য এ দিনের নাম ‘ইয়াওমুত তারউইয়্যাহ।’ কেননা, তারউইয়্যাতুন অর্থ: চিন্তা-ভাবনা বা ধ্যান করা। দ্বিতীয় রাতে তথা নয় তারিখে আবার অনুরূপ স্বপ্ন দেখলেন এবং বুঝতে পারলেন যে, এটা আল্লাহরই আদেশ। তাই এ দিনকে ‘ইয়াওমু আরাফা’ বলা হয়। কেননা, আরাফা অর্থ: বুঝা, চিনা, পরিচয় পাওয়া। সর্বশেষ দশ তারিখে তিনি কুরবানী করতে উদ্ধত হলেন। আর এ কারণেই এ দিনকে ‘ইয়াওমুন নাহর’ বলা হয়। কেননা, নাহার অর্থ: কুরবানী, যবেহ, রক্ত প্রবাহিত করা ইত্যাদি।8

কারণ নবীদের স্বপ্ন সত্যি হয়। ইবরাহীম (আ.) স্বপ্ন দেখে মনস্থির করলেন নিজের পরম আদরের সন্তানকে কুরবানী করার। রাসূল e বলেন,

إِنَّا مَعْشَرَ الأَنْبِياءِ تَنامُ أَعْيُنِنَا وَلَا تَنامُ قُلُوبُنا

-আমরা নবী শ্রেণি, আমাদের চক্ষু ঘুমায় কিন্তু অন্তর ঘুমায় না।9

স্বপ্নগুলো আল্লাহর নির্দেশনা নিশ্চিত হয়ে ইবরাহীম (আ.) সন্তান ইসমাঈল (আ.) এর সাথে পরামর্শ করলেন। পরামর্শ না, বরং অনুভূতি জানতে চাওয়া। তিনি অনুভুতি জানতে চেয়েছেন, কারণ আন্দাজ করতে পেরছেন, ইসমাইল (আ.) সাধারণ সন্তান নয়, বরং আল্লাহর প্রিয়ভাজন। যার চালচলন ছোটবেলা থেকেই আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যেই। ইসমাঈল (আ.) হৃদয়গ্রাহী জবাব দিলেন,

قَالَ يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُۖ سَتَجِدُنِي إِن شَاءَ اللَّهُ مِنَ الصَّابِرِينَ

-(উত্তরে পুত্র) বললেন, পিতা আমার, যা আদিষ্ট হয়েছেন, তা বাস্তবায়ন করে ফেলুন। আল্লাহ চান তো আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাবেন। (সূরা সাফফাত, আয়াত ১০৪-১০৫)

ইসমাইল (আ.) এর জবাবে ছিলো আনুগত্য। ছিলো খোদার দরবারে নিজেকে তুচ্ছ করে অবনত মস্তকে ধাবিত করার বিনীত বাক্যের সজ্জিত। তিনি বলেন নাই, নিজে ধৈর্যশীল; বরং এই কথাটাই বললেন, তবে নিজেকে ধৈর্য্যশীলের কাতারে নিয়ে। সেখানে ইনশাআল্লাহ তথা যদি আল্লাহ চান তো আমাকে পাবেন বলে আল্লাহর সন্তুষ্টিকে করলেন শর্ত। পিতাপুত্রের আলাপচারিতা শেষে সন্তুষ্টচিত্তে চললেন মীনার দিকে। শয়তান অনেক চেষ্টা করেও তাদেরকে ধোঁকায় ফেলতে পারেনি। সে মীনার জামরায় তিন জায়গাতে ইবরাহীম (আ.) কে কুরবানী না করতে প্ররোচনা দিয়েছিলো। কিন্তু তিনি প্রত্যেক বারেই শয়তানকে সাতটি করে পাথর ছুড়ে নিবৃত করতে সক্ষম হন।10

শয়তানের প্ররোচনা, পিতাপুত্রের মায়ার বন্ধনসহ যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা পেছনে ফেলে ইবরাহীম (আ.) স্বীয় পুত্রকে মাটিতে শুইয়ে দিবেন, ঠিক তখন পুত্র বললেন, বাবা, দয়া করে আমাকে শক্ত করে বেঁধে নিন, যেনো আমি নড়াচড়া না করি, যেনো রক্ত আপনার গায়ে না পড়ে এতে করে আমার মা বেশি ব্যথাতুর হয়ে যাবেন। সহজেই যাতে আমার প্রাণ বের হয় সেজন্য ছুরিটি ধারালো করে নিন। কেননা, মৃত্যু অনেক কঠিন। আমার সালাম মাকে পৌঁছে দিবেন আর চাইলে আমার জামা আমার মাকে দিতে পারেন।11

এমন পরামর্শমূলক কথোপকথন শুনে বুঝা দায় যে পিতা পুত্রের কুরবানীর প্রস্তুতি নিচ্ছেন আর ছেলে নিজেকে তরবারী তলে সঁপে দিচ্ছেন। মনে হয় এ যেন খোশগল্প। ইবরাহীম (আ.) যাতে করে যবেহের সময় সন্তানের চেহারা দেখা না যায়, তাই ইসমাঈল (আ.) কে উপুড় করে শুইয়ে দিলেন।12 যবেহ করতে চেষ্টা করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত হয়ে জিবরাঈল (আ.) আসতে আসতে বলে উঠলেন, ‘আল্লাহু আকবার’। ইসমাঈল (আ.) শুনে বললেন, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার’। ইবরাহীম (আ.) তখন বললেন, ‘আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ’। আল্লাহর এই বড়ত্ব ঘোষণার এই দুআ আল্লাহর দরবারে এমন পছন্দ হল, পরবর্তীতে হজ্জ ও অন্য বিশেষ সময়ে এটা পাঠ করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ওয়াজিব হিসেবে বিধান হয়ে গেল।13 তাকবীর পাঠ করে ইবরাহীম (আ.) যতোই চেষ্টা করেন ইসমাঈল (আ.) এর গলা কাটতে কিন্তু সক্ষম হন না। সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন। আল্লাহ ইবরাহীম (আ.) এর এ কর্মকাণ্ড পছন্দ করেন। ইসমাঈল (আ.)কে যবেহ ব্যতিরেকেই এই কুরবানী কবূল করে নিলেন। আল্লাহ জান্নাতের দুম্বা পাঠিয়ে দিলেন ইসমাঈল (আ.) এর জায়গায়। ইবরাহীম (আ.) দেখেন তার পুত্র নয় বরং একটি উন্নত দুম্বা জবাই হয়ে গেছে। হযরত আদম (আ.) এর পুত্র হাবিল যে দুম্বা কুরবানী করেছিলেন সেই দুম্বাই ইসমাঈল (আ.) এর স্থলে আল্লাহ পাঠিয়ে দেন।14 আল্লাহ পাকের দরবারে এ কুরবানী এতোই মাকবূল হয়েছিলো যে, এ কুরবানীর বিধান পরবর্তী সকল উম্মতের মধ্যে কিয়ামত পর্যন্ত প্রচলন করে দিলেন। আল্লাহ বলেন,

وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآخِرِينَ

-আর আমি পরবর্তী উম্মতের মধ্যে ইবরাহীমের এ সুন্নাতকে স্মরণীয় করে রাখলাম। (সূরা সাফফাত, আয়াত-১০২)

আল্লাহ ইবরাহীম (আ.)কে অগ্নিকুণ্ডে পতিত হওয়াসহ অসংখ্য কঠিন ও কষ্টকর পরীক্ষায় ফেলেছিলেন। সবগুলোই ধৈর্য ও আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থাবলে উত্তীর্ণ হন। ইবরাহীম (আ.) এর জীবনে সর্বাধিক কঠিন এক পরীক্ষা ছিলো বৃদ্ধ বয়সে লাভ করা নিজের পুত্র ইসমাঈল (আ.)কে কুরবানী করা। সেক্ষেত্রেও তিনি সফল হয়েছিলেন। বরং আল্লাহ এই ত্যাগের মোহনায় সকল জাতিকে আচ্ছাদিত করে দিলেন। পরবর্তী সবাইকে ইবরাহীম (আ.)কে স্মরণের নেযাম করে দিলেন। এমনকি সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকেও কুরবানীর বিধানে আবদ্ধ করলেন। আল্লাহ নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামকে বলেন,

فَصَلَّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ

-আপনার রবের জন্য নামায পড়ুন এবং কুরবানী করুন। (সূরা কাউসার, আয়াত-২)

আরো ইরশাদ করলেন,

قُلْ إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

-বলুন, আমার নামায, আমার কুরবানী, আমার জীবন ও আমার মরণ সবকিছুই জগতসমূহের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। (সূরা আনআম, আয়াত-১৬২)

এজন্য নবীজি eও কুরবানী দিতেন। সাহাবীদেরকে নির্দেশ দিতেন কুরবানী করার। উম্মতের জন্যেও কুরবানীর বিধান রেখে দিয়েছেন।

ইবরাহীম (আ.) যেভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তাঁর সর্বাধিক প্রিয় বস্তু তথা তাঁর আপন পুত্রকে কুরবানী দিতে প্রস্তুত ছিলেন, তেমনি মুসলমানরা ঈদুল আদহার দিনে নিজের পছন্দের পশু কুরবানীর মাধ্যমে নিজেদের জান-মাল আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার নমুনা প্রকাশ করে থাকেন। এ কুরবানী একটি উদাহরণ। মানুষ আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য তার পছন্দসই সুন্দর পশু ক্রয় করে। অথচ এটিকেই আল্লাহর নামে জবাই করে দেয় কুরবানী হিসবে। নিজে কিছুটা ভক্ষণ করে। বাকিটুকু মানুষকে ভাগ করে দেয়। এই ত্যাগই কুরবানীর শিক্ষা। বান্দা যেকোন কিছু বিসর্জন দিতে পারে তার রবের আনুগত্য করতে। হোক তা তার প্রিয় বস্তু, প্রিয়জন কিংবা নিজের আপন জীবন। হতে পারে রবের সন্তুষ্টির জন্য নিজের জিনিস অন্যকে দান করে কিংবা কোনো কামনার বস্তুর লোভকে সংযত করার মাধ্যমে। মহীয়ান রবের সন্তুষ্টিলাভের জন্যে ত্যাগই হল কুরবানীর ইতিহাসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। মুসলমানরা এই ত্যাগই যুগে যুগে করে এসেছেন কুরবানীর প্রচলিত সুরতে।

কুরবানীর প্রয়োজনীয় মাসাইল

নিম্নে সংক্ষেপে কুরবানী সংক্রান্ত কতিপয় মাসআলা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরছি-

কুরবানী যার পক্ষ থেকে হয়

বালিগ তথা প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন, মুকীম অর্থাৎ মুসাফির নয়, স্বাধীন ও স্বচ্ছল প্রত্যেক মুসলিম যে যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ ফজর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে, তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব।15 নিসাব হলো স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন ভরি। টাকা- পয়সা বা অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে এর মূল্য সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের বাজার মূল্যের সমান হওয়া। আর যদি স্বর্ণ, রৌপ্য বা টাকা-পয়সার কোনোটিই পৃথকভাবে নিসাব পরিমাণ না হয়; কিন্তু এগুলোর সম্মিলিত মূল্য সাড়ে সাত ভরি স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন ভরি রৌপ্যের মূল্যের সমান হয়ে যায় তাহলেও এর মালিকের ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব।16 খেয়াল রাখতে হবে, কুরবানীর নিসাব যাকাতের নিসাবের মতো পুরো বছর থাকা জরুরী নয়; বরং কুরবানীর দিনগুলোর মধ্যে যেকোনো দিন প্রয়োজনের অতিরিক্ত এ পরিমাণ সম্পদ কারো কাছে থাকলে তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব হবে।17

নাবালিগের কুরবানী ওয়াজিব নয়

নাবালিগ শিশু-কিশোর নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হলেও তাদের ওপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে তাদের অভিভাবক যদি নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করেন, তা সহীহ হবে এবং সকলেই সাওয়াবের অধিকারী হবেন।”18

মুসাফিরী হালে কুরবানী

কুরবানীর দিনগুলো তথা যিলহজ্জের ১০-১২ তারিখ যে সফরে থাকবেন, অর্থাৎ ৪৮ মাইল দূরে যাওয়ার নিয়্যাতে নিজ এলাকা থেকে বের হবেন, তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।19 কুরবানীর সময়ের প্রথম দিকে মুসাফির থাকার পর যদি শেষ দিন কুরবানীর সময় শেষ হওয়ার পূর্বে কেউ মুকীম হন, তবে তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হবে। পক্ষান্তরে প্রথম দিন মুকীম ছিলো কিন্তু শেষ দিন মুসাফির হয়ে গেছে এমন ব্যক্তির ওপর কুরবানী ওয়াজিব থাকবে না। অর্থাৎ সে কুরবানী না দিলে গুনাহগার হবে না।20

নওমুসলিমের কুরবানী

কুরবানীর সময়ের প্রথম দিকে অমুসলিম থেকে যদি শেষ দিন কুরবানীর সময় শেষ হওয়ার পূর্বে কেউ মুসলমান হন, তবে নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী এই মুসলিমের ওপরও কুরবানী ওয়াজিব হবে।21

জ্জ আদায়কারীর কুরবানী

হাজীদের ক্ষেত্রে যদি কুরবানীর সময়ে তিনি মুসাফির থাকেন, অর্থাৎ মক্কা শরীফে ১৫ দিনের কম অবস্থানের নিয়্যাত করেন, তখন তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়। তবে যদি মক্কাতে হজ্জ উপলক্ষ্যে ১৫ দিনের বেশি অবস্থানের নিয়্যাত করেন, তবে (নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকার শর্তসাপেক্ষে) তার ওপর কুরবানী করা ওয়াজিব।22 আরেকটি প্রাসঙ্গিক জরুরী বিষয়, হজ্ব পালনকারীরা মীনাতে যে কুরবানী করেন, তা তাদের হজ্জের শুকরিয়াস্বরূপ কুরবানী। সামর্থ্যবান মুকীম অর্থাৎ যিনি মুসাফিরি হালতে নেই, তার ক্ষেত্রে এর দ্বারা কিন্তু তার ওপর শরীআত কর্তৃক নির্ধারিত কুরবানী আদায় হবে না; বরং তাকে সেটিও আদায় করতে হবে। হানাফী ফিকহের কিছু মৌলিক কিতাবে ‘হাজীদের জন্য কুরবানী নেই’ এমন বর্ণনা পাওয়া যায়, তা মুসাফির হাজীদের জন্য প্রযোজ্য। যিনি মক্কা শরীফে ১৫ দিনের বেশি অবস্থানের নিয়্যাতে আছেন, তাকে অবশ্যই ওয়াজিব কুরবানী আদায় করতে হবে।23

কুরবানী আবশ্যক নয় এমন ব্যক্তির কুরবানী

নিসাব পরিমাণ সম্পদ যার নেই, তার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। তবে দুই অবস্থায় শরঈ সামর্থ্যহীন ব্যক্তির উপর কুরবানী ওয়াজিব হবে, ১) কুরবানীর মানত করলে, ২). কুরবানীর নিয়্যাতে পশু ক্রয় করে ফেললে। তবে কুরবানীর নিয়্যাতে ক্রয়কৃত পশুটি যদি মারা যায় তাহলে তাকে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবেনা।24

মায়্যিতের পক্ষ থেকে কুরবানী

মৃতব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা সম্পূর্ণ জায়িয। সামর্থ্যবান ব্যক্তি নিজের মৃত পিতা-মাতা, দাদা-দাদী, উস্তাদ-মুরব্বী, পীর-মাশায়িখের পক্ষ থেকেও কুরবানী আদায় করতে পারেন। মৃত ব্যক্তি মৃত্যুর পূর্বে কোনোরূপ ওসীয়ত না করলে, সেটি নফল হিসেবে গণ্য হবে এবং কুরবানীর গোশত স্বাভাবিক নিয়মে নিজেরা ও আত্মীয়-স্বজনরা খেতে পারবে। আর যদি ওসীয়ত করে যান তবে এর গোশত নিজে খাবেন না; বরং গরীব-মিসকীনদের মাঝে ভাগ করে দিবেন। কেউ চাইলে উম্মতের কোনো নির্দিষ্ট শ্রেণির পক্ষ থেকেও কুরবানী করতে পারেন৷ যেমন, সাহাবা, খুলাফায়ে রাশেদীন কিংবা আহলুল বাইতের পক্ষ থেকেও কুরবানী করা যাবে। রাসূল e তার উম্মতের পক্ষ থেকে কুরবানী করেছেন।25

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করা উম্মতের জন্য মুহব্বতের অন্যতম বহিঃপ্রকাশ। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম নিজে আলী (রা.) কে নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লামের পক্ষ থেকে কুরবানী করতে বলেছেন। এজন্য আলী (রা.)সহ সাহাবাদের অনেকেই এবং সালাফের মধ্যেও রাসূল e এর পক্ষ থেকে কুরবানী করার প্রচলন ছিলো।26

জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করা

যেভাবে মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে ঈসালে সাওয়াবের উদ্দেশ্যে কুরবানী করা জায়িয ঠিক তেমনি জীবিত ব্যক্তির পক্ষ থেকেও তার ঈসালে সাওয়াবের জন্য নফল কুরবানী করা জায়িয। এ কুরবানীর গোশত দাতা ও তার পরিবারও খেতে পারবে। কুরবানী ওয়াজিব এমন ব্যক্তির পক্ষ থেকে কুরবানী করতে চাইলে ঐ ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নতুবা ঐ ব্যক্তির কুরবানী আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী যদি স্ত্রীর পক্ষ থেকে আর পিতা যদি সন্তানের অনুমতি ছাড়াই তাদের ওয়াজিব কুরবানী করেন তাহলে আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নেয়া উত্তম।27

কাযা কুরবানী

কেউ কয়েক বছর কুরবানী না করে থাকে, এখন বিগত বছরগুলোর কুরবানী বর্তমান বছরের কুরবানীর সাথে যোগ করে আদায় করে তাহলে তা আদায় হবে না; বরং এ বছর শুধু এবারের কুরবানী আদায় হবে। এজন্য বিগত বছরগুলির কুরবানী আদায় করতে হলে পশু কিনে তা অথবা তার মূল্য সাদকাহ করে দিতে হবে।28

কুরবানীর সময়

কুরবানীর নির্ধারিত দিন

যিলহজ্জ মাসের ১০ তারিখ সূর্যোদয়ের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত এ তিন দিন কুরবানী করা যায়। তবে ১০ তারিখে কুরবানী করা উত্তম।29

কুরবানী করার সময়

যেসব এলাকাতে জুমুআ ও ঈদের নামায ওয়াজিব তাদের জন্য ১০ই যিলহজ্জ ঈদের নামাযের আগে কুরবানী করা জায়িয নেই। অবশ্য খারাপ আবহাওয়া বা অন্য কোনো শরঈ গ্রহণযোগ্য কারণে যদি প্রথম দিন ঈদের নামায না হয়, তাহলে ঈদের নামাযের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর ১০ই যিলহজ্জ কুরবানী করা জায়িয হবে।30 অন্যদিকে যেসব এলাকাতে জুমুআ ও ঈদের নামায শরীআত মুতাবিক ওয়াজিব নয়, সেসব এলাকাতে ইদের দিন সুবহে সাদিকের পর থেকেই কুরবানী করা যাবে।31 কোনো কারণে দিনে কুরবানী করতে না পারলে ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতে কুরবানী করাও জায়িয আছে। তবে রাতে আলো স্বল্পতার কারণে যবেহ করতে ত্রুটি দেখা দিতে পারে বিধায় যবেহ দিনে করাই উত্তম। আর আলো পর্যাপ্ত থাকলে রাতে যবেহ করতে কোনো অসুবিধা নেই।32

যথাসময়ে কুরবানী করতে না পারা

খামখেয়ালি বসত কিংবা যেকোনো কারণে কুরবানীর নির্ধারিত দিনে কুরবানী করতে না পারে, তাহলে কুরবানীর পশুর সমমূল্য গরীব-মিসকীনকে দান করে দিবে। আর যদি সময়ের পর তা যবেহ করে ফেলে, তবে পুরো গোশত সাদকাহ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর মূল্যের চেয়ে কমে যায়, তবে যে পরিমাণ মূল্য কম হলো তাও সাদকাহ করতে হবে।33 তবে কুরবানীর দিনগুলোতে ইচ্ছাকৃত পশু কুরবানী না করে এর মূল্য সাদকাহ করে দিলে তা আদায় হবে না। কারণ এটা স্বতন্ত্র একটি ইবাদত।

শরীকানা ঈদের কুরবানী

যার ওপর কুরবানী ওয়াজিব, তিনি কমপক্ষে একটি ছাগল কুরবানী করবেন। তাছাড়া চাইলে গরু বা উটও কুরবানী করতে পারেন। ব্যক্তি চাইলে ক্রয়কৃত গরু বা উটে তার সাথে আরো ছয় জনকে শরীক করে সাত জন মিলে কুরবানী করতে পারেন।34 সাহাবী জাবের ইবন আব্দিল্লাহ (রা.) বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ e এর সাথে হজ্জ করলাম। আর (কুরবানীর দিন) একটি উট সাতজনের পক্ষ থেকে এবং একটি গরু সাতজনের পক্ষ থেকে কুরবানী করলাম।35

কুরবানীর সাথে মান্নতের কুরবানী আদায় হবে, আল্লাহর সন্তুষ্টির নিমিত্তে যদি একটি গরু বা উটে সাত ব্যক্তি কারোর নিয়্যাত ওয়াজিব কুরবানীর, কারোর আকীকার, কেউ আবার মান্নতের নিয়তে, মোটকথা নিয়্যাত ভিন্ন ভিন্ন করেন, তবে তাতে সকলের কুরবানীই আদায় হয়ে যাবে। কেননা, প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। উট, গরু বা মহিষ সাতজন মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। তবে কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম (যেমন কেউ একভাগের অর্ধেক, কারো দেড় ভাগ) হলে কারো কুরবানীই কবূল হবে না।36 আবার সাত ভাগে এবং সাতের কম দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় এমন যেকোনো ভাগে কুরবানী করা যায়।37

লক্ষ্যণীয়, শরীকদের কারোর পুরো বা অধিকাংশ আয় যদি হারাম হয় অথবা যদি কেউ আল্লাহর হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কুরবানী না করে কেবল গোশত খাওয়ার মনোবাসনায় কুরবানী করে, তবে কারো কুরবানীই কবূল হবে না।38

পশু ক্রয়ের পর কাউকে শরীক করা

গরু, মহিষ বা উট কেবল নিজে কুরবানীর নিয়্যাতে কেনার পর ধনী ব্যক্তি চাইলে সে পশুতে অন্যকে শরীক করতে পারবে। কিন্তু যদি ব্যক্তি গরীব হয় (অর্থাৎ তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব ছিলো না কিন্তু সে কুরবানী করার নিয়্যাতে পশু ক্রয় করেছে) তবে সে ঐ পশুতে কাউকে শরীক করতে পারবে না।39

কুরবানীর পশুতে শরীক কেউ মারা গেলে

শরীকানা কুরবানীর ক্ষেত্রে কোনো শরীক যদি যবেহ দেওয়ার পূর্বে মারা যান, তবে ওয়ারিশদের কেউ অনুমতিক্রমে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করতে পারবেন। তা নাহলে মৃতব্যক্তির কুরবানীর জন্য প্রদত্ত টাকা ওয়ারিশদেরকে ফিরিয়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে।40

কুরবানীর পশুর সাথে আকীকা

এটি নিয়ে অনেকে ফিতনা করছেন। জায়িয নয়, কুরবানী হবে না ইত্যাদি কঠিন বক্তব্য আসছে। নির্ভরযোগ্য বক্তব্য হলো, কুরবানীর গরু বা উটের সাথে সন্তানের আকীকা দেওয়া যায়। তবে এটি আকীকার একটি জায়িয সুরত হলেও উত্তম নয়; বরং উত্তম হলো সন্তানের জন্মের সপ্তম দিনে ছেলে সন্তান হলে তার জন্য দুটি ছাগল আর কন্যা হলে তার জন্য একটি ছাগল আকীকা করা। রাসূলুল্লাহ e বলেছেন, যার সন্তান জন্মগ্রহণ করে উত্তম হলো তার জন্য আকীকা করা। পুত্র সন্তানের জন্য সমমানের দুটি ছাগল আর কন্যাসন্তানের জন্য একটি ছাগল।41

যদি কারোর ঘরে সদ্য ভূমিষ্ট কোনো সন্তানের বয়স সাতদিন হয় কুরবানীর দিন, তখন সে কুরবানীর সাথে আকীকার নিয়্যাত করে তবে সাধারণত জায়িয। কেননা, আকীকাও আল্লাহ প্রদত্ত সন্তানের নিআমতের শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে নৈকট্যার্জনের জন্য করা হয়ে থাকে।42 জ্ঞাতার্থে বলা যাচ্ছে, উলামায়ে কিরাম কুরবানীর গরু বা উটের সাথে আকীকার নিয়্যাতকে জায়িয বলেছেন। উল্লেখিত কুরবানীর দিনের সাথে কাকতালীয় মিল ছাড়া ইচ্ছাকৃত আকীকা প্রলম্বিত করে কুরবানী পর্যন্ত নেওয়া উত্তমতার বিপরীত। বরং উত্তম হলো আলাদা করে ছাগল বা অন্য পশু দিয়ে আকীকা করা।

পশুর ক্ষেত্রে শর্তাবলী

কুরবানী শুদ্ধ হওয়ার জন্য শর্তগুলো সম্পর্কে আলোচনা করা হলো।

গৃহপালিত পশু হওয়া

কুরবানী অবশ্যই গৃহপালিত চতুস্পদ জন্তু যেমন: গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা হতে হবে। গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্য পশু যেমন হরিণ, বন গরু, নীল গাই ইত্যাদি এবং পাখি, মোরগ বা মাছ দ্বারা কুরবানী করা যাবে না।43

পূর্ণ বয়সী হওয়া

পশুর বয়স পূর্ণ না হলে কুরবানী জায়িয হবে না। এক্ষেত্রে উটের বয়স কমপক্ষে ৫ বছর, গরু ও মহিষের বয়স ২ বছর আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বার বয়স কমপক্ষে ১ বছর হতে হবে। তবে ভেড়া বা দুম্বা যদি ৬ মাসের বেশি ও ১ বছরের কিছু কম বয়সের হয়; কিন্তু দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয়, তবে তা দিয়েও কুরবানী হবে। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবল ভেড়ার ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় দিয়েছেন।44 এজন্য ছাগলের বয়স কোনোভাবেই ১ বছরের কম হতে পারবে না।45

পশু ত্রুটিযুক্ত না হওয়া

এমন পশু যার দুটি চোখই নষ্ট হয়ে গেছে বা এক চোখ পুরো নষ্ট, সে পশু দ্বারা কুরবানী জায়িয নয়।46 পশু সুস্থ হতে হবে। অসুস্থ পশু, যা যবেহের জায়গা পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারে না, তা দ্বারা কুরবানী হবে না।47 যে পশুর এক পা খোড়া তা মাটিতে রাখতে পারে না; বরং তিন পায়ে চলে তা দ্বারা কুরবানী জায়িয হবে না। দাঁতের ক্ষেত্রে একটি দাঁতও নেই বা এতো বেশি দাঁত পড়ে গেছে যে, ঘাস বা খাদ্য চিবাতে পারে না, এ পশুও কুরবানীর অযোগ্য। শিং গোড়া থেকে ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সে পশু দ্বারা কুরবানী জায়িয নয়। তবে যে পশুর শিং ফেটে গেছে বা অর্ধেক ভেঙ্গে গেছে বা জন্ম থেকে শিং উঠেই নি সে পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়িয আছে।48 লেজ বা কোনো কান অর্ধেক বা তার বেশি কাটা সে পশু দ্বারা কুরবানী হবে না। আর যদি অর্ধেকের বেশি থাকে তবে জায়িয। অনুরূপ জন্মগতভাবে যদি কান ছোট হয় তবে সমস্যা নেই। কিন্তু যদি জন্মগতভাবে কান একেবারেই না থাকে তবে তা দ্বারা কুরবানী হবে না।49 বন্ধ্যা পশুর ক্ষেত্রে কুরবানী জায়িয আছে।50 পাগল পশু যদি স্বাভাবিক ঘাস পানি খায় বা মাঠে চরে বেড়ায় তবে তা দ্বারা কুরবানী জায়িয আছে। তবে এমন পাগল যে, খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়, তখন জায়িয হবে না।51 গর্ভবতী পশু দ্বারা সাধারণ কুরবানী করা জায়িয আছে। যবেহের পর যদি বাচ্চা জীবিত পাওয়া যায় তবে সেটাও যবেহ করতে হবে। কিন্তু বাচ্চা প্রসবের সময় আসন্ন হলে সে পশু কুরবানী করা মাকরূহ।52 খাসীকৃত পশু দ্বারা কুরবানী জায়িয; বরং খাসীকৃত ছাগল দ্বারা কুরবানী উত্তম।53 কোনো পশু যদি চর্মরোগের কারণে একেবারেই দূর্বল হয়ে পড়ে তবে তা দ্বারা কুরবানী জায়িয হবে না। স্বাস্থ্য ভালো থাকলে জায়িয হবে।54 এক অণ্ডকোষ বিশিষ্ট পশু দ্বারা কুরবানী হবে। আর যে পশুর পুরুষাঙ্গ কাটা থাকায় সংগম করতে অক্ষম বা বয়স বেশি হওয়ায় বাচ্চা জন্ম দিতে পারে না, তার দ্বারাও কুরবানী করা যাবে।55 পায়খানা খেতে অভ্যস্থ পশু দ্বারা কুরবানী করা জায়িয হবে না। তবে উটকে ৪০ দিন, গরু-মহিষকে ২০ দিন আর ছাগল-ভেড়াকে ১০ দিন বেঁধে রেখে স্বাভাবিক খাবার দিলে কুরবানী করা জায়িয আছে।56

পশু চুরি হলে, হারিয়ে গেলে বা মারা গেলে

পশু যদি চুরি হয়ে যায়, হারিয়ে যায় বা মারা যায় তবে কুরবানীদাতা ধনী হলে অর্থাৎ তার ওপর কুরবানী ওয়াজিব হলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। আর গরীব হলে যার ওপর ওয়াজিব নয় তদস্থলে আরেকটি কুরবানী করতে হবে না। ক্রয়কৃত পশু হারিয়ে যাওয়ার পর যদি আরেকটি কেনা হয় এবং পরে হারানোটা পাওয়া যায় তাহলে কুরবানীদাতা গরীব হলে (ওয়াজিব নয় তবু কুরবানীর নিয়্যাতে পশু ক্রয় করেছে এমন) দুটি পশুই কুরবানী করতে হবে। আর ধনী হলে দুটোর যেকোনো একটি কুরবানী করলেই হবে।57 পাঁচ ব্যক্তি পাঁচটি ছাগল ক্রয় করে এক জায়গায় রেখে দেওয়ার পর দেখা গেলো একটি ছাগল মারা গেছে। এখন কারটা মারা গেছে সেটা যদি নির্ধারণ করা না যায় তবে বাকী চারটা বিক্রি করে প্রাপ্ত মূল্য দিয়ে নতুন করে পাঁচটা ছাগল ক্রয় করে এক অপরকে পশু জবাই করে দিতে বলবে এবং পরস্পর দাবি ছাড়িয়ে নেবে।58

কুরবানীর পশু থেকে উপকার গ্রহণ

কুরবানীর পশু নির্দিষ্ট করার পর তা থেকে উপকার নেয়া, যেমন হাল চাষ করা, তাতে আরোহণ করা বা এর দুধ দোহন করে খাওয়া ইত্যাদি জায়িয নেই। যদি এগুলো করা হয় তবে এর সমমান মূল্য আল্লাহর পথে দান করে দিতে হবে।59

কুরবানীর পশু বচ্চা প্রসব করলে

কুরবানীর পশু যদি কুরবানীর পূর্বে বাচ্চা প্রসব করে তবে ঐ বাচ্চা যবেহ না করে জীবিত সাদকাহ করে দিতে হবে। তা নাহলে বাচ্চাকেও কুরবানী করে গোশত সাদকাহ করে দিতে হবে।0

কুরবানীর পশু যবেহের পদ্ধতি

কুরবানীর পশু নিজে যবেহ করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও যবেহ করানো যাবে। যবেহের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেয়া জায়িয। তবে কোনোভাবেই পশুর কোনো অংশ পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না। যবেহের সময় কুরবানীদাতা যবেহের স্থানে উপস্থিত থাকা সাওয়াবের। তবে জরুরী নয়। যদি নেককার পুরুষ না পাওয়া যায় এমন পরিস্থিতিতে মহিলারা কুরবানী করতে পারবেন। এই পরিস্থিতিতে মুসলিম নেশাখোর, পাগল, বোবা এবং নাবালিগ যদি যবেহের নিয়ম-কানুন জানে তবে তাদের দ্বারা কুরবানী করানো জায়িয।61 কোনোভাবেই ভোতা অস্ত্র দিয়ে পশু যবেহ করা যাবে না। এতে পশু কষ্ট পায়। তাই যবেহের পূর্বে অবশ্যই অস্ত্র পরীক্ষা করে নিতে হবে যে যথেষ্ট ধার আছে কিনা।62 প্রতিটি আমল নিয়্যাতের ওপর নির্ভরশীল। কুরবানী করার পূর্বেও এর নিয়ত করে নিতে হবে। শুধু মনে মনে নিয়ত করলেই যথেষ্ট। মৌখিকভাবে উচ্চারণ আবশ্যক নয়। আবার পশু ক্রয়ের সময়ই কুরবানীর নিয়্যাত করলেও হয়ে যাবে।63 কুরবানীর পশুকে মাটিয়ে শুইয়ে রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে নিতে হবে, যাতে তা খুব বেশি নড়াচড়া করতে না পারে। প্রয়োজনে যবেহের সময় হাটু দিয়ে পশুকে চাপ দিয়ে রাখা যাবে। সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি হল, পশুকে দক্ষিণ দিকে মাথা ও উত্তর দিকে পা দিয়ে শুয়াবে। তারপর মাথা ও পাকে পশ্চিম দিকে কাৎ করবে। এভাবে কুরবানী করবে। যেহেতু বাংলাদেশীদের কিবলাহ পশ্চিম দিকে। যবেহের সময় যবেহকারী কিবলামুখী হয়ে যবেহ করবে। এটা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ। বিনা ওজরে কিবলামুখী না হয়ে কুরবানী করা গুনাহের কাজ । এসময় অন্য পশুর সামনে যবেহ না করা উচিৎ। যবেহের জন্য প্রয়োজনে অন্য পশু থেকে কুরবানীর পশুকে কিছুটা দূরত্বে নিয়ে যাওয়া উত্তম।64

যবেহের সময় বিসমিল্লাহ ও তাকবীর বলা

যবেহের সময় যবেহকারী এবং এ কাজে সহায়তাকারী সকলেই উচ্চ আওয়াজে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলবেন।65 যবেহ করার সময় উচ্চ আওয়াজে বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার বলা সুন্নাত।66 আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, রাসূল e কুরবানীর সময় দুম্বা যবেহ করার সময় বলেন,

بسم الله اللهم تقبل من مُحَمَّدٍ وَآلِ مُحَمَّدٍ وَمِنْ أُمَّةٍ مُحَمَّدٍ

-আল্লাহর নামে যবেহ করছি। হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মদ ও তার পরিবারের এবং তার উম্মতের পক্ষ থেকে কবূল করে নিন।67

এখানে তাকাব্বাল মিন এর পর যার পক্ষ থেকে কুরবানী তাদের নাম মনে মনে বলা যায়। জবাইয়ের সময় যাদের পক্ষ থেকে কুরবানী করা হচ্ছে তাদের প্রত্যেকের নাম নেওয়া অত্যাবশ্যক নয়। তবে নাম নেওয়া উত্তম। মহিলাদের কুরবানীর ক্ষেত্রে স্বামী বা পিতা যে কারো নামের নিসবতে বলা যাবে। অর্থাৎ অমুকের কন্যা অমুক বা অমুকের স্ত্রী অমুক এভাবে বলা যাবে। তাছাড়া যবেহের সময় নিম্নের দুআ পাঠ করা সুন্নাত,

اَللَّهُمَّ إِنِّي وَجَّهْتُ وَجْهِيَ لِلَّذِي فَطَرَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ عَلَى مِلَّةِ اِبْرَاهِيْمَ حَنِيفًا وَمَا أَنَا مِنَ الْمُشْرِكِينَ – إِنَّ صَلَاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَايَ وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ – لَا شَرِيكَ لَهُ وَبِذَٰلِكَ أُمِرْتُ وَأَنَا مِنَ الْمُسْلِمِينَ – بِسْمِ اللهِ اَللهُ اِكِبَر – اَللَّهُمَّ مِنْكَ وَ لَكَ

উচ্চারণ- ইন্নি ওয়াজ্জাহতু ওয়াজহিয়া লিল্লাযি ফাতারাস সামাওয়াতি ওয়াল আরদা আলা মিল্লাতি ইবরাহীমা হানিফাও ওয়া মা আনা মিনাল মুশরিকীন। ইন্না সালাতী ওয়া নুসুকী ওয়া মাহইয়ায়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামিন। লা শারিকা লাহু ওয়া বি-যালিকা উমিরতু ওয়া আনা মিনাল মুসলিমীন। বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা মিনকা ও লাকা।68

পূর্ণাঙ্গ যবেহ করা

পশুর শ্বাসনালী, খাদ্যনালী ও তার দু’পাশের দুইটি রক্তবাহী মোটা রগ—এই চারটি রগ কাটতে হবে। কমপক্ষে তিনটি কাটলেও এর গোশত খাওয়া হালাল হবে, নতুবা হারাম হবে। উক্ত চারটি রগের পর সম্পূর্ণ গলা কেটে ফেলা মাকরূহ। কুরবানীর পশুর চারটি রগ বা কমপক্ষে তিনটি রগ কেটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করতে হবে। কোনো রকম একটু আঘাত করে বা তিনটির কম রগ কেটে ফেলে রাখা জায়িয নেই। এর অর্থ হলো পশুকে সঠিক পদ্ধতিতে যবেহ না করে কোনো রকম আঘাত করে ফেলে রাখা এবং মৃত্যুর অপেক্ষা করা।69 উটের ক্ষেত্রে নহর করবে। নহরের পদ্ধতি হলো। উটটি তিন পায়ের উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সম্মুখের বাম পা বাঁধা থাকবে। তার বুকে ছুরি চালিয়ে দিতে হবে।70 যবেহের পর পশু পুরোপুরি নিস্তেজ না হওয়ার পূর্বেই চামড়া খসানো বা অন্য অঙ্গ কেটে নেওয়া মাকরূহ। পশুকে ঘাড়ের উপর থেকে যবেহ করলে তা খাওয়া হারাম হয়ে যাবে। তবে প্রাণ বের হওয়ার পূর্বে যদি নালীগুলো কেটে দেওয়া যায়, তবে জায়িয হবে।71

পশুর গোশত, চামড়া ও অন্যান্য অংশের বিধান

এ সংক্রান্ত সংশ্লিষ্ট আলোচনা নিম্নরূপ-

পশুর যে অঙ্গ খাওয়া হালাল এবং য হালাল নয়

হালাল পশুর দেহের সাতটি অঙ্গ খাওয়া জায়িয নেই, সেগুলি হলো প্রবাহিত রক্ত, পুরুষাঙ্গ, স্ত্রী অঙ্গ, অণ্ডকোষ, লালাগ্রন্থী, মূত্রথলি এবং পিত্ত থলি। কেননা, আল্লাহ পাক ইরশাদ করেছেন, তিনি (মুহাম্মদ সা.) তাদের জন্য যাবতীয় পবিত্র বস্তু হালাল ঘোষণা করেন আর অপবিত্র বস্তুকে ঘোষণা করেন হারাম। আর এই সাতটি অঙ্গকে সুস্থ্য রুচি অপবিত্র বিবেচনা করে তাই সেসব হারাম। এ সাতটি অঙ্গের মধ্যে প্রবাহিত রক্ত হারাম। আর বাকী ছয়টি অঙ্গ মাকরূহ তাহরিমী। উল্লিখিত অঙ্গগুলোব্যতীত পশুর বাকী সমস্ত অঙ্গ খাওয়া জায়িয। উল্লেখিত অঙ্গগুলোর ব্যাপারে শরীআত কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আছে। এতদ্ব্যতীত অন্য অঙ্গ হারাম বলা জায়িয নেই।72

পশুর গোশত বণ্টন ও ভক্ষণ

কুরবানীর গোশতকে তিনভাগ করে একভাগ গরীব-মিসকীনকে, একভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া আর একভাগ নিজের পরিবারের জন্য রেখে দেওয়া উত্তম। অবশ্য যদি পরিবারের বিশেষ প্রয়োজনে পুরোটা নিজের পরিবারের জন্য রেখে দেয় তাতেও অসুবিধা নেই। যদিও তা কুরবানীর ত্যাগের ক্ষেত্রে আদর্শ নয়।7  শরীকানা কুরবানী হলে শরীকদের মাঝে পাল্লা দিয়ে ওজন করে গোশত ভাগ করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোনোভাবেই অনুমান করে ভাগ করা যাবে না। যদি কারো অংশ কম হয় তবে কারো কুরবানীই কবূল হবে না। কুরবানীর গোশত হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়িয আছে।74 কেউ চাইলে কুরবানীর গোশত তিনদিন বা তার চেয়ে বেশি দিন জমিয়ে রাখতে পারবে, তা জায়িয আছে। কুরবানীদাতার জন্য নিজ কুরবানীর পশুর গোশত দিয়ে ঐদিনের খাবার শুরু করা সুন্নাত।75

গোশত, চর্বি ও হাড় বিক্রি করা ও চামড়ার বিধান

কুরবানীর পশুর গোশত, চর্বি বা হাড় বিক্রি করা জায়িয নেই, করলে পুরো মূল্য সাদকাহ করে দিতে হবে। কুরবানীর চামড়া চাইলে নিজে ব্যবহার করতে পারবে। চামড়া কাউকে হাদিয়া দেওয়া বা কোনো দ্বীনি কাজে ব্যবহৃত করাও জায়িয আছে।76

 

১. মুহাম্মদ ইবন আহমাদ কুরতুবী (৬৭১হি.), আল জামিউ লি আহকামীল কুরআনিল কারীম, (দারুল কুতুবিল মিসরিয়া, কায়রো, দ্বিতীয়প্রকাশ: ১৩৮৪ হি.) : ৬/১৩৪; আল্লামা বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫ হি.) উমদাতুল কারী ফী শারহিল বুখারী, (আল মাকতাবাতুশ শামেলা সংস্করণ) : ২৩/১৩৮

২. আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-حَتَّى يَأْتِيَنَا بِقُرْبَانِ تَأْكُلُهُ النَّارُ যতক্ষণ না সে এমন কুরবানী নিয়ে আসে, যাকে আগুন ভক্ষণ করে। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৮৩)

৩. আবূল ফিদাহ ইসমাঈল ইবন কাসীর, (৭৭৪ হি.), তাফসীরুল কুরআনিল আযীম (তাফসীরু ইবন কাসীর), দারু তায়্যিবা, বৈরুত, প্রকাশকাল: ১৪২০ হি.) : ৩/৮৩; ইসমাঈল ইবন মুস্তাফা আল ইস্তাম্বুলী (১১৩৭ হি.), তাফসীরু রুহিল বায়ান, দারু ইহইয়াইত তুরাসিল আরাবী : ১/৩০৪

৪. আবূ আব্দিল্লাহ মুহাম্মদ ইবন আব্দিল্লাহ আল হাকিম আন নিসাপুরী (৪০৫ হি.), আল মুসতাদরাক আলাস সাহীহাইন, দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, প্রকাশকাল: ১৪১১ হি. : ৩৪৬৭; মুসনানাদু আহমদ: ১৯২৮৩; সুনান ইবনি মাজাহ ৩১২৭

৫. সূরা হজ্জ-৭৮

৬. তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৭

৭. এ সময় ইসমাঈল (আ.) এর বয়স ছিলো সাত বছর। (জালালাইন ৮/৪০১), কোনো বর্ণনায় বয়স তেরো বছর। ইবন আব্বাস রাদ্বিইয়াল্লাহ আনহু বলেন, তখন তিনি বালিগ হন এবং নামায-রোযা আদায় করতেন। (তাফসীরে কুরতুবী: ১৫/৯৯)

৮. তাফসীরে কুরতুবী: ১৫/১০২

৯. কানযুল উম্মাল: ৩১৯৯০। ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, নবীদের স্বপ্ন ওহী।-তিরমিযী: ৪০৫৩

১০. তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮; মুসনাদু আহমাদ, আলামুল কুতুব, প্রথম প্রকাশ: ১৪১৯ হি. : ২৭০৭, মুহাম্মদ ইবন জারীর তাবারী, জামিউল বায়ান ফী তাবীলিল কুরআন, মুয়াসসাসাতুর রিসালা, প্রথম প্রকাশ: ১৪২০ হি. : ২১/৭৮। ইবরাহীম (আ.) এর এই আমলটি পরবর্তীতে হজ্জ পালনকারী মুসলমানদের জন্য ওয়াজিব করে দেওয়া হয়।

১১. আল্লামা ইবন জারীর তাবারী রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইসমাঈল (আ.) এর পরনে সাদা পোষাক ছিলো আর কাফনের কোনো পোষাক ছিলো না। তাই তিনি পিতাকে বললেন, বাবা আপনি আমার জামা খুলে রেখে দিন। তা দিয়ে আমার লাশের কাফন পরাতে পারবেন।-তাফসীরে তাবারী: ২১/৭৮, তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮, তাফসীরে কাশশাফ: ৪/৫৫

১২. তাফসীরে তাবারী: ২১/৭৮, তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮

১৩. তাফসীরে কুরতুবী: ১৫/১০২, তাফসীরে কাশশাফ : ৪/৫৫

১৪. তাফসীরে ইবন কাসীর: ৭/২৮

১৫. ফাতাওয়ায়ে শামী ৯/৫২১, বাদাইউস সানাঈ ৫/৯৫, আল বাহরুর রাইক ৮/৩৪৭

১৬. ফাতাওয়ায়ে তাতার খানিয়া ১৭/৪০৫, আল মুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫

১৭. বাদাইউস সানাঈ (শামেলা সংস্করণ) : ১০/২৫০, ফাতাওয়ায়ে শামী: ৬/৩১২

১৮. বাদাইউস সানাঈ (শামেলা সংস্করণ)  ১০/২৫২; সুনান আবূ দাউদ ৪৪০০

১৯. বাদাইউস সানাঈ: ১০/২৫২, আদ দুররুল মুখতার ৫/৩১৫

২০. বাদাইউস সানাঈ ৪/১৯৬, আদ দুররুল মুখতার ৬/৩১৯

২১. বাদাইউস সানাঈ ৪/১৯৬, আদ দুররুল মুখতার ৬/৩১৯

২২. বাদাইউস সানাঈ ৪/১৯৫, ইলাউস সুনান 27/2৩৫, বাজলুল মাজহুদ ১৩/ ৪৭

২৩. বাদাইউস সানাঈ ১০/২৫২

২৪. বাদাইউস সানাঈ ৫/৯২

২৫. ফাতওয়ায়ে শামী ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫২

২৬. আবূ দাউদ ১৪৯৫, ২৭৯২

২৭. ফাতাওয়ায়ে শামী ৬/৩২৬, কাযীখান ৩/৩৫২; আবূ দাউদ ১৪৯৫, ২৭৯২

২৮. আদ দুররুল মুখতার ৫/২২৬

২৯. মুয়াত্তা মালেক: ১০৪২, বাদাইউস সানাঈ‘: ১০/২৫৯; মুয়াত্তা মালেক:১০৪২, বাদাইউস সানাঈ: ১০/২৫৯

৩০. আদদুররুল মুখতার: ৬/৩১৮; সহীহ বুখারী: ৫২২৫, ৫২৪২

৩১. ফাতাওয়ায়ে শামী ৫/২০২

৩২. আদদুররুল মুখতার ৬/৩২০, বাদাইউস সানাঈ ৪/২২৩

৩৩. আদদুররুল মুখতার ৬/৩২০, বাদাইউস সানাঈ ৪/২০২

৩৪. কাযীখান ৩/৩৪৯, বাদাইউস সানাঈ ৪/২০৭

৩৫. সহীহ মুসলিম: ৩২৪৯

৩৬. শারহুন নাবাবী, দারু ইহইয়াউত তুরাসিল আরাবী, বৈরুত: ২৪/৪৫৫; রাদ্দুল মুহতার আলা দুররিল মুখতার, (শামেলা সংস্করণ) : ২৬/২৫৮; বাদাইউস সানাঈ‘ ৪/২০৭

৩৭. বাদাইউস সানাঈ ৪/২০৭

৩৮. বাদাইউস সানাঈ ৪/২০৮, কাযীখান ৩/৩৪৯

৩৯. বাদাইউস সানাঈ ৪/২১০, কাযীখান ৩/৩৫০, আল মাবসূত: ১৪/১৯০।

৪০. বাদাইউস সানাঈ ৪/২০৯, কাযীখান ৩/৩৫১

৪১. সুনান আবু দাউদ: ২৮৪৪

৪২. রাদ্দুল মুহতার আলা দুররিল মুখতার, (শামেলা সংস্করণ) : ২৬/২৫৮

৪৩. সূরা হজ্জ ৩৪; বাদাইউস সানাঈ‘ ৪/২০৫, কাযীখান ৩/৩৪৮

৪৪. আবূ দাউদ: ২৮০১

৪৫. সহীহ মুসলিম: ৫১৯৪, মিরকাতুল মাফাতীহ: ৩/১০৭৯, বাদাইউস সানাঈ‘ ৪/২০৫, কাযীখান: ৩/৩৪৮

৪৬. বাদাইউস সানাঈ ৪/২১৪, কাযীখান: ৩/৩৫২

৪৭. বাদাইউস সানাঈ ৪/২১৪, আলমগীরী: ৫/২৯৭

৪৮. বাদাইউস সানাঈ ৪/২১৬, আলমগীরী: ৫/২৯৭

৪৯. আবূ দাউদ: ২৮০৫, কাযীখান: ৩/৩৫২, আলমগীরী: ৫/২৯৭, মিরকাতুল মাফাতীহ: ৩/১০৮৪

৫০. রদ্দুল মুহতার: ৬/৩২৫

৫১. বাদাইউস সানাঈ ৪/২১৬

৫২. রদ্দুল মুহতার: ৫/২৮১, কাযীখান ৩/350, আবূ দাউদ: ২৮২৯

৫৩. আবূ দাউদ: ২৮২৯, আল মাবসূত: ১৪/১৭৫, ফাতহুল কাদীর: ৮/৪৯৮, মাজমাউল আনহুর: ৪/২২৪

৫৪. রদ্দুল মুহতার ৫/২৮০, আল মাবসূত: ১৪/১৭৬

৫৫. এমদাদুল ফাতওয়া: ৩/৪৭২, রদ্দুল মুহতার ৫/২৮১

৫৬. সুনান দারা কুতনী: ৪৮১৬, রদ্দুল মুহতার: ৬/৩২৫, বাদাইউস সানাঈ‘ ৪/২১৬, রদ্দুল মুহতার ৫/২৮১

৫৭. কাযীখান: ৬/৩৪৭, বাদাইউস সানাঈ‘ ৪/১৯৯

৫৮. বাদাইউস সানাঈ ৪/২১৬

৫৯. নাইলুল আওতার ৩/১৭২, কাযীখান: ৩/৩৫৪, আল মাবসূত: ১৪/১৮৯

৬০. রদ্দুল মুহতার ৬/১৭২, কাযীখান ৩/৩২৩

৬১. মুস্তাদরাকে হাকিম ৭৫২৪, বাদাইউস সানাঈ ৪/ 220, আল মাবসূত ১৪/২০০, কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫, মাজমাউল আনহুর ২/৮

৬২. মুসলিম: ৫১৬৭, মুসলিম: ৫২০৩

৬৩. বাদাইউস সানাঈ (শামেলা সংস্করণ) : ১০/২৮৬, হাশিয়াতু দুররিল মুখতার: ৬/৩১২

৬৪. বুখারী : ৯১২, মুসলিম: ৫১৬৭, বাদাইউস সানাঈ‘ ৪/১৮৮

৬৫. সূরা আনআম: ১১৮

৬৬. সুনান আবূ দাউদ ২৭৯৭

৬৭. মুসলিম: ৫২০৩

৬৮. সুনান আবি দাউদ, হাদীস-২৭৯৫

৬৯. আলমগীরী ৪/৯২, বাদাইউস সানাঈ ৫/৪১, আবূ দাউদ, ২৮২৮, মিরকাতুল মাফাতীহ: ৬/২৬৫৬

৭০. সূরা হাজ্জ: ৩৬

৭১. বাদাইউস সানাঈ 8 / 220, বাদাইউস সানাঈ ৪/২২৩, বাদাইউস সানাঈ‘ ৫/৮০।

৭২. মাজমাউল আনহুর (শামেলা সংস্করণ) : ৯/৩৪৫, বাদাইউস সানাঈ (শামেলা সংস্করণ): ১০/২৪০, মাজমাউল আনহুর (শামেলা সংস্করণ): ৯/৩৪৫, সুনানুল কুবরা লিল বাইহাকী: ২০২১৬, সুনান দারা কুতনী: ২০৬৬

৭৩. বাদাইউস সানাঈ ৪/২২৪

৭৪. আদদুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১, এলাউস সুনান: ১৭/২৭০, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া ৫/৩০০

৭৫. বাদাইউস সানাঈ ৪/২২৪, আল বাহরুর রাইক ৮/৩২৬, মুসনাদে আহমদ ১৬২৫৬, আল বাহরুর রাইক ২/১৬৩, আদদুররুল মুখতার ২/১৭৬, সূরা হজ্জ-২৮

৭৬. বাদাইউস সানাঈ ৪/২২৫, আলমগীরী: ৫/৩০১, আদদুররুল মুখতার: ২/১৭৬

ফেইসবুকে আমরা...