Logo
হিন্দুত্ববাদ: মুসলিম বিরোধী সহিংসতার তত্ত্ব
মুহাম্মাদ সায়ীদ
  • ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

ইসলাম তার প্রারম্ভিক শতাব্দীতেই ভারতে পৌঁছেছে এবং সাম্য ও ন্যায়ের দাওয়াত ছড়িয়েছে। পরবর্তীতে এখানে মুসলিম শাসন শুরু হয় এবং সাড়ে সাতশো বছরের বেশি সময়ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত থাকে। মুসলিম শাসনামলে ভারত হয়ে উঠে জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যের অনুপম জনপদ। আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও তৎকালীন দুনিয়ায় ভারতের স্থান ছিলো অগ্রসরমান। ১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধে পরাজয়ের মাধ্যমে ভারতে মুসলিম শাসনের পতন ঘটে এবং বৃটিশের উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।মুসলমানরা নিকট অতীতে শাসক শ্রেণি ছিলো বিধায় ব্রিটিশরা মুসলমানদেরকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে সর্বক্ষেত্রে বঞ্চিত রাখে। মুসলমানরাও ভারতের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধারের জন্য নানাবিধ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার ফলে ব্রিটিশ ও মুসলমানদের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। মুসলিম শাসনামলে হিন্দুরা ক্ষমতা কাঠামোর কাছাকাছিই ছিলো, তদুপরি ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারতেও তারা অসমভাবে বাড়তি সুবিধা পেতে থাকে। এসময় হিন্দুরা নিজেদেরকে ভারতের প্রকৃত মালিক হিসেবে আবিষ্কার করতে শুরু করে। তাছাড়া ব্রিটিশের ‘ডিভাইডএ ন্ড রুল’ কৌশলের ফলে হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্বও বাড়তে থাকে। ঔপনিবেশিক ভারতে উগ্র ও মুসলিম বিদ্বেষী হিন্দুদের প্রচেষ্টায় ব্রিটিশ শাসনের প্রায় সবটুকু সময়জুড়ে বহু পর্যায় ও ধাপ অতিক্রম করে হিন্দু শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলাফল হিসেবে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্রকাশ্যে আসে শ্রেষ্ঠত্ববাদ, বর্ণবাদ, দখলদারিত্ব ও সম্প্রসারণবাদের ধারণা সংবলিত ভয়াবহ আগ্রাসি, সহিংস ও অপরবিনাশী এক মতবাদ, Hindutva তথা  ‘হিন্দুত্ববাদ’।

প্রাথমিকভাবে বালগঙ্গাধর তিলক, লালা লাজপত রায় ও পণ্ডিত মদন মোহন মালাভিয়াসহ ভারতের শীর্ষ রাজনীতিবিদদের একাংশ হিন্দু জাতীয় ঐক্যের কথা প্রচার করতে শুরু করেছিলেন। এই সময় হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ধর্মান্তরিত মুসলমানদেরকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনার জন্যও সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদার করে। তবে ১৯২৩ সালে এই হিন্দু জাতীয়তাবাদকে সর্বপ্রথম Hindutva (হিন্দুত্ববাদ) নামে তত্ত্বীয় কাঠামো দেন মহারাষ্ট্রের বিনায়ক দামোদর সাভারকর Hindutva: Who Is A Hindu? গ্রন্থে। পরবর্তীতে হিন্দুত্ববাদের মতবাদ এম. এস. গোলওয়ালকরসহ আরও অনেকের মাধ্যমে প্রচারিত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। হিন্দুত্ববাদ হিন্দুর সংজ্ঞায়ন করেছে, তাদের প্রদত্ত সংজ্ঞায় যারা হিন্দু তাদেরকে ঈশ্বরের মর্যাদা দিয়েছে এবং যারা হিন্দু নয় তাদেরকে নির্মূলের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে, হিন্দুদের ‘পবিত্রভূমির’ ধারণা দিয়েছে এবং যারা ‘বহিরাগত’, তাদেরকে এই ভূমি থেকে বিতাড়নের নির্দেশ দিয়েছে।

হিন্দুত্ববাদ আসলে হিন্দু ধর্ম নয়। হিন্দুত্ববাদ তত্ত্ব মতে এটি হিন্দু ধর্মের চেয়ে প্রশস্ত ধারণা, হিন্দুত্ববাদের একটি অংশ হলো হিন্দু ধর্ম। সাভারকর বলেছেন- Hinduismis only a derivative, a fraction, a part of Hindutva

(হিন্দুধর্ম হিন্দুত্ব থেকে উদ্ভুত, এর একটি অংশ এবং একটি শাখা মাত্র)। হিন্দু কে? এই প্রশ্নের জবাবে হিন্দুত্ববাদ বলে- হিন্দু হচ্ছে সে, যে সিন্ধু নদী থেকে সমুদ্র পর্যন্ত অঞ্চলকে নিজের কেবল পিতৃভূমি নয় বরং পবিত্রভূমি বলে বিশ্বাস করবে।সাভারকর লিখেছেন- AHindu means a person who regards this land of Bharatvarsha, from the Indus tothe seas, as his Fatherland as well as his Holyland—that is, the cradle land ofhis religion.

হিন্দুত্ববাদ ৩টি মৌলিক লক্ষ্যে কাজ করে। এগুলো হলো- ১. হিন্দুদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা। ২. আফগানিস্তান থেকে শুরু করে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ তথা পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কা এবং এর বাইরে তিব্বত ও মিয়ানমার জুড়ে হিন্দু পরিচয় ও অখণ্ড ভারতের ধারণা দৃঢ় করা। ৩. যারা ধর্মান্তরিত হয়েছে, তাদেরকে হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা। এই লক্ষ্যসমূহ পূরণের জন্য হিন্দুত্ববাদ ‘হিন্দু’ এবং ‘বহিরাগত’ আলাদা করে চিহ্নিত করে। হিন্দুত্ববাদের তত্ত্বঅনুযায়ী ভারতভূমির অভ্যন্তরে উদ্ভূত ধর্মগুলো কাছাকাছি সংস্কৃতির। সে হিসেবে এগুলোকে হিন্দু বলে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু ভারতভূমির বাহির থেকে আগত ধর্মগুলোকে ‘অপর’ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এক্ষেত্রে বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মকে হিন্দু হিসেবে ধরা হবে এবং মুসলিম, খ্রিষ্টান ও ইয়াহুদীদেরকে মনে করা হবে বহিরাগত। এই বহিরাগতদেরকেও হিন্দু হয়ে উঠতে হবে, নতুবা তাদেরকে এই ‘পবিত্রভূমি’তে থাকতে দেওয়া হবে না। হিন্দুত্ববাদের অন্যতম তাত্ত্বিক এম. এস. গোলওয়ালকর বলছেন– হিন্দুস্তানে বসবাসকারী বিদেশি জাতিগুলোকে অবশ্যই হিন্দু সংস্কৃতি এবং ভাষা গ্রহণ করতে হবে, হিন্দু ধর্মকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করতে হবে, এবং হিন্দু জাতি ও সংস্কৃতির গৌরব বৃদ্ধি ছাড়া অন্য কোনো ধারণা লালন করতে পারবে না, অর্থাৎ, তাদের আলাদা অস্তিত্ব হারিয়ে হিন্দু জাতির সাথে একীভূত হয়ে যেতে হবে। অথবা তারা দেশে থাকতে পারে কিন্তু পুরোপুরি হিন্দু জাতির অধীনস্থ হয়ে, কোনো কিছু দাবি করা ছাড়াই, কোনো সুবিধা ছাড়াই এবং এর চেয়েও আরও কম, তারা কোনো অগ্রাধিকার পেতে পারবে না—এমনকি নাগরিক অধিকারও নয়। এছাড়া তাদের জন্য অন্য কোনো গতি থাকা উচিত নয়।

হিন্দুত্ববাদতার দাবীকৃত ভূমিতে বহিরাগতদের স্বকীয়তাসহ অবস্থান করতে দিতে সম্মত নয়। এক্ষেত্রে সে নাৎসিবাদকে অনুসরণ করতে চায়। নাৎসি মডেলে সে উপমহাদেশের অহিন্দু, বিশেষত মুসলিমদেরকে নির্মূলকরার পন্থা অনুসরণ করতে ইচ্ছুক। এম. এস. গোলওয়ালকর বলেছেন- Germanyhas also shown how well-nigh impossible it is for Races and cultures, havingdifferences going to the root, to be assimilated into one united whole, a goodlesson for us in Hindusthan to learn and profit by. (জার্মানী দেখিয়েছে যে, মূলগত পার্থক্য থাকা জাতি এবংসংস্কৃতির জন্য একীভূত এবং একক সত্তায় রূপান্তরিত হওয়া প্রায় অসম্ভব। এটি আমাদের হিন্দুস্তানের জন্য শেখার এবং উপকৃত হওয়ার ক্ষেত্রে একটি ভালো পাঠ)

একদিকে হিন্দুত্ববাদ নাৎসি মডেলে মুসলিম নিধনের আকাঙ্ক্ষা রাখে, অন্যদিকে ‘জায়নবাদ’ মডেলে এটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের প্রকৃত মালিকানা দাবি করে। জায়নবাদ যেমন ইয়াহুদী শ্রেষ্ঠত্ববাদের এক বহুমুখী ধারণা, যেটি জায়ন পাহাড়কে ঘিরে কেনানের চারদিকের তথাকথিত ‘প্রতিশ্রুত ভূমি’ নিয়ে একটি ইয়াহুদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর, হিন্দুত্ববাদও ঠিক একইভাবে তিব্বত, মিয়ানমার এবংদক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের বিশাল অঞ্চলকে হিন্দুদের ভূমি বলে দাবি করে এবং এর উপর পবিত্রতা আরোপ করে, আর প্রত্যয় ব্যক্ত করে যে হিন্দুরাই হবে এখানকার শাসক। এম. এস. গোলওয়াল তাই বলেছেন- WeHindus came into this land from nowhere, but are indigenous children of thesoil always, from times immemorial and are natural masters of the country. (আমরা হিন্দুরা এই ভূমিতে কোথা থেকে আসিনি, বরং স্মরণাতীতকাল থেকে আমরা সর্বদাই এদেশের প্রকৃত সন্তান, আর আমরাই এ দেশের প্রাকৃতিক শাসক।) নৃতত্ত্বমতে হিন্দুরা আর্য জাতি এবং উত্তর মেরুতে তাদের আদি নিবাস ছিলো, পরে তারা দক্ষিণ দিকে সিন্ধু নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে অভিবাসন করে। সিন্ধু বা হিন্দ নদীর তীরের অধিবাসী হওয়ার দরুন পরবর্তীতে তারা ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত হয়। এই তত্ত্বে হিন্দুত্ববাদ আস্থা রাখতে পারে না। হিন্দুত্ববাদের চাই সুনির্দিষ্ট ভূখণ্ডের দৃঢ় দাবি। বালগঙ্গাধর তিলক ও বিনায়ক দামোদর সাভারকর এই নৃতাত্ত্বিক বয়ানকে অস্বীকার করেননি, কিন্তু হিন্দুত্ববাদের জন্য পুনরুদ্ধারযোগ্য ভূমির প্রত্যয় পাকাপোক্ত করতে গোলওয়ালকর এক অদ্ভুত দাবি করে বসেন। তিনি বলেন হিন্দুরা অভিবাসন করে এই অঞ্চলে আসেনি বরং উত্তর মেরু নিজেই অভিবাসন করে উত্তরে চলে গেছে। তিনি লিখেছেন- It wasnot the Hindus who migrated to that land but the Arctic Zone which emigratedand left the Hindus in Hindusthan.

শুরুর দিকে সাধারণ হিন্দুদের কাছ থেকে হিন্দুত্ববাদ তেমন কোন সাড়া পায়নি। তবে সাভারকরের হিন্দুত্ববাদ তত্ত্ব ও গোলওয়ালকরের হিন্দুত্ত্ববাদী চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়ে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি শুরুতেই ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ লালন করে অগ্রসর হয়েছে। শক্তিশালী মুসলিম শাসক, বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীর (র.) এর আমলের গুপ্তঘাতক সন্ত্রাসবাদী শিবাজীর মারাঠা সাম্রাজ্যের পতাকা ভাগওয়া ধ্বজ (গেরুয়া রঙের পতাকা)-কে নিজেদের পতাকা হিসেবে গ্রহণ করে এবং কর্মীদেরকে শিবাজীর চেতনায় উজ্জীবিত করে। ১৯২৭ সালে সংগঠনটির সদস্য সংখ্যা ১০০ জনে পৌঁছলে এটি প্রথমবারের মত প্রকাশ্যে মুসলিম বিরোধিতা শুরু করে, মসজিদের সামন থেকে ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা বের করার মাধ্যমে। পরবর্তীতে দীর্ঘসময়ব্যাপী আরএসএস-এর নিরবচ্ছিন্ন তৎপরতায় সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে হিন্দুত্ববাদ। আরএসএসের প্রচেষ্টায় জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেমন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক সামাজিক, শিক্ষা সংক্রান্ত, ভাষাগত ও পেশাগত ইত্যাদি ক্ষেত্রে সক্রিয় হিন্দুত্ববাদের আদর্শ লালন করা সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ‘সংঘ পরিবার’ নামে একটি জোট তৈরি হয়। সংঘ পরিবারের অন্তর্গত প্রত্যেকটি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করে, ভারতের বিরাট বৈশ্বিক ডায়াসপোরাকে সংঘবদ্ধ করেহিন্দুত্ববাদের সমর্থন নেয়, দেশটির বিশাল জনসংখ্যার বাজার হারানোর ঝুঁকি নির্দেশ করে আন্তর্জাতিক কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে করায়ত্তে রাখে। এর অন্তর্গত বিভিন্ন থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান আছে, এগুলো হিন্দুত্ববাদকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সহায়তা করে ও একাডেমিয়াকে হিন্দুত্ববাদের অনুকূলে পুনর্বিন্যাস করে। হিন্দুত্ববাদের জন্য কাজ করে এমন দুটি থিংক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান হলো- হিন্দু বিবেক কেন্দ্র ও অল ইন্ডিয়া হিস্ট্রি রিফর্ম প্রজেক্ট। হিন্দু বিবেক কেন্দ্রের প্রধান কাজ হলো হিন্দুত্ববাদকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি দেওয়া, এই মতবাদ সংক্রান্ত উপকরণ ভারতের মধ্যে ও বিদেশে একাডেমিক মহলে পৌঁছানো এবং আন্তর্জাতিক পরিসরে হিন্দুত্ববাদ সংশ্লিষ্ট লেখালেখি ও প্রতিক্রিয়ার উপর নযর রাখা। আর অল ইন্ডিয়া হিস্ট্রি রিফর্ম প্রজেক্ট ভারতীয় ইতিহাসকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে পুনর্লিখন করে ও ভারতের ইতিহাস কে নির্দিষ্ট জাতিয়তাবাদী মতাদর্শের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে উপস্থাপনের জন্য কাজ করে। বর্তমানে এই প্রজেক্টের সাথে জড়িত চরম হিন্দুত্ববাদী শিক্ষাবিদদেরকে ভারতের জাতীয় পাঠ্যক্রম প্রণয়ন সংক্রান্ত দায়িত্বে বসানো হচ্ছে।

হিন্দুত্ববাদ যে ইতিহাস পুনরুৎপাদন করছে, তাতে প্রাচীন ভারতকে দেখানো হয় শান্তি ও সমৃদ্ধির দেশ হিসেবে, যেখানেপুরো পৃথিবী অসভ্য, হিন্দুরা সভ্য এবং তারাই বাকি পৃথিবীকে সভ্যতা শিখিয়েছে। পক্ষান্তরে মধ্য যুগে মুসলিম শাসন ছিলো বর্বর ও মন্দির-প্রতিমা বিধ্বংসী। এই ইতিহাসে বখতিয়ার নালন্দা বিহার ধ্বংস করেন, আওরঙ্গজেব হিন্দু নির্যাতন করেন, মুসলমানরা বহিরাগত ও ভারতের শত্রু। অবশ্য হিন্দুত্ববাদের স্বার্থে এমন ইতিহাস বিকৃতি নতুন কিছু নয়, এটি এই মতবাদের শুরু থেকেই হচ্ছে। নামাযের সময় মসজিদের সামনে গান গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর হিন্দু সাম্প্রদায়িক উগ্রতার যে অতীত ইতিহাস, হিন্দুত্ববাদের তাত্ত্বিক গোলওয়ালকর নিজেদের মতবাদের অনুকূলে সমর্থন হাসিল করার জন্য এটিকে মুসলমান কর্তৃক হিন্দুদের সাধারণ শোভাযাত্রার গান-বাজনা বিরোধিতা হিসেবে দেখিয়েছেন। ফলে এই প্রসঙ্গে তিনি এভাবে উপসংহার টেনেছেন- মসজিদের সামনে গান-বাজনার বিরোধিতা মূলত হিন্দুদের সাথে বিরোধিতায় লিপ্ত থাকার এবং মুসলমানদের নিজেদের মধ্যে স্বাধীন সেল গঠন করার একটি ছুতো মাত্র। এই উপসংহার মুসলমানদেরকে শায়েস্তা করার প্রয়োজনীয়তাকে তীব্রতর করে দেখিয়েছে এবং হিন্দুদেরকে উপলব্ধি করাতে চেয়েছে যে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়োজনে যেকোন মূল্যে এই শত্রুকূলকে নিশ্চিহ্ন করতে হবে। গোলওয়ালকর হিন্দুত্ববাদীদের জাগরণের বর্ণনা দিচ্ছেন, বলছেনদুনিয়াকে দেখতে হবে হিন্দুরা তাদের শত্রুকূলকে নিশ্চিহ্ন করছে— Heis rousing himself up again and the world has to see the might of theregenerated Hindu Nation strike down the enemy’s hosts with its mighty arm.

হিন্দুত্ববাদীরাশিক্ষাব্যবস্থাকে অবলম্বন করে হিন্দুত্বের প্রচার ঘটানোর জন্য বিশেষ কর্মপন্থাঅবলম্বন করেছে। এই উদ্দেশ্যে গোলওয়ালকরের নেতৃত্বে ১৯৪৬ সালে  প্রতিষ্ঠা করা হয় ‘গীতা মডেল স্কুল’ নামে কিছু বিদ্যালয়। ১৯৪৮ সালে সরকার এইস্কুলগুলোকে নিষিদ্ধ করে। এরপর ১৯৫১ সালে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল জন সংঘেরপ্রথম সম্মেলনেই ঘোষিত হয়েছিলো হিন্দুত্ববাদীসংস্কৃতিকে ধারণ করে এমন শিক্ষাব্যবস্থা প্রণয়নই হবে দলের প্রধানতম কর্মসূচি। এর ফলে আরএসএস দেশের বিভিন্নঅঞ্চলের গড়ে তোলে ‘অখিল ভারতীয় শিক্ষা সংস্থান’, যা ‘বিদ্যাভারতী’ নামে পরিচিত। সারা ভারতজুড়ে বিদ্যাভারতীর অধীনেরয়েছে প্রায় ১৩ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,এগুলোতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৩৩ লাখ। এই বিশালসংখ্যক শিক্ষার্থীকে প্রবল ঐকান্তিকতার সাথে হিন্দুত্ববাদে দীক্ষিত করা হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত সযত্নে হিন্দুত্ববাদ সংশ্লিষ্ট কসরতে অভ্যস্ত করা হচ্ছে। অন্যদিকে ১৯৪৯সালে হিন্দুত্ববাদীরা প্রতিষ্ঠা করেছিলো ‘অখিল ভারতীয়বিদ্যার্থী পরিষদ’। ৭৬ বছর ধরে এই পরিষদটি সক্রিয় রয়েছে।বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৬০ লক্ষ। এই বিরাট সংখ্যাক কর্মী বাহিনী ভারতের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে মুসলিম বিরোধী ঘৃণা ছড়ানো, দাঙ্গাসৃষ্টি, হিজাব বিরোধী ক্যাম্পেইন ও হিজাব পরিহিতা শিক্ষার্থীদের হেনস্তায় অব্যাহতভাবে তৎপর রয়েছে। ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায় মুসলিমবিদ্বেষের ব্যাপারে নোয়াম চমস্কি বলেছেন- The assault istaking other forms as well, including a general attack on independent thoughtand the educational system primarily directed against Muslim victims, but bynow expanding beyond. (এই অত্যাচার অন্যান্য রূপও ধারণ করছে, এরমধ্যে রয়েছে স্বাধীন চিন্তায় সাধারণ আক্রমণ। আর শিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রাথমিকভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, বরং এটি এখন আরো দূর সীমায় সম্প্রসারিত হচ্ছে।)

হিন্দুত্ববাদতত্ত্ব অনুযায়ী যেহেতু বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্ম সমরূপ ‘হিন্দু’ সংস্কৃতির ধর্ম, তাই এই ধর্মগুলোকে হিন্দুত্ববাদের প্রতিবিশ্বস্ত করে তুলতে সংঘ পরিবার বহুবিধ সাংগঠনিক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এর ফলস্বরূপ ভারতে এখন জৈন অনুসারীরা নিচু শ্রেণির হিন্দুতে পরিণত হয়েছে, আর বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীরা হয়ে গেছে হিন্দু ধর্মেরই উপধারার মত। শিখদেরব্যাপার একটু ভিন্ন। ১৯৮৬ সালে আরএসএস শিখদেরকে হিন্দুত্ববাদীবানাতে ‘রাষ্ট্রীয়শিখ সংঘ’ প্রতিষ্ঠাকরে। কিন্তু আরএসএসের পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে ‘শিখরা মূলত হিন্দু’ বলে ঘোষণা করলে, ২০০৪ সালে শিখদের ঊর্ধ্বতনধর্মীয় কর্তৃপক্ষ ‘অকাল তখত’ রাষ্ট্রীয় শিখ সংঘকে শিখ ধর্ম বিরোধী বলে ঘোষণা জারি করে, যা এখনও বলবৎ রয়েছে। এদিকে শিখদের রাজনৈতিক কন্ঠস্বর ‘আকালি শিরোমনি দল’ দীর্ঘসময় ধরে আরএসএসের সাথে সম্পৃক্ত ছিলো। আরএসএসের সাথে এর আদর্শিক দ্বন্দ্ব খুব একটা নেই, তবে দলটি রাজনৈতিক দ্বন্দে ২০২০ সালে আরএসএসের প্রধানতম রাজনৈতিক দল বিজেপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাছাড়া শিখদের জন্য স্বাধীনরাষ্ট্র ‘খালিস্তান’ প্রতিষ্ঠার দাবি করে শিখদের একটি অংশ। এরা হিন্দুত্ববাদকে ঘৃণা করে, তবে এই অংশ শিখদের মধ্যে সংখ্যালঘু। সবকিছু মিলিয়ে হিন্দুত্ববাদের জন্য শিখদেরকে হিন্দুত্বে একীভূত করা এখনও কিছুটা জটিল। মুসলমানদের মধ্যেও হিন্দুত্ববাদ প্রচারের জন্য সংঘ পরিবারের বিশেষ কার্যক্রম চলমান। ২০০২ সালে আরএসএসের মাধ্যমেপ্রতিষ্ঠা পায় মুসলিম রাষ্ট্রীয় মঞ্চ (National Front of Muslims)। এই সংগঠনটি মুসলমানদেরকে আরএসএসের প্রতি অনুগত করা, গরু যবাই নিষিদ্ধ করা, ‘বন্দেমাতরম’ সংগীতকে গ্রহণযোগ্য বলে প্রচার করা, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা সংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ আর্টিকেল বাতিল করা, কাশ্মীরে অমরনাথ যাত্রার জন্য স্থান বরাদ্দের দাবি সমর্থন করা, নরেন্দ্র মোদির পক্ষে নির্বাচনি প্রচারণা চালানো, যোগ ব্যায়ামকে নামাযের মত বলে দাবি করে এটিকে হালাল করার মত বহুবিধ হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডা বাস্তবায়ন করে চলছে।

মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুত্ববাদের জিঘাংসা অত্যন্ত লোমহর্ষক। মুসলিম নিধনের জন্য হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবারের বহুবিধ সুপরিকল্পিত ম্যাকানিজম রয়েছে, যারা ভারতে ইসলাম ও মুসলমানদেরকে ভিতর-বাহির সবদিক থেকে নির্মূল করতে কাজ করে যাচ্ছে। এর একটি উদাহরণহচ্ছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ (VishvaHindu Parishad), সংক্ষেপে যাকে ভিএইচপি বলা হয়। এই সংগঠন ধর্মান্তরিতদের হিন্দু ধর্মে ফিরিয়ে আনা, বেনারসের জ্ঞানবাপী মসজিদ (যাকে হিন্দুরা বলে কাশী) ও উত্তরপ্রদেশের শাহী ঈদগাহ (যাকে হিন্দুরা বলে  মথুরা) সহ বিভিন্ন মসজিদকে মন্দিরে রূপান্তরের পরিকল্পনা করা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে গণহত্যার উদ্দেশ্যে দাঙ্গা সৃষ্টি করা, মুসলমানদেরকে জমি কিনতে বাধা দেওয়া, ‘গোরক্ষা’ আন্দোলনের নামে গরু যবাই করতে বাধা দেওয়ার মত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে। ভিএইচপির যুব শাখা ‘বজরঙ দল’ এবং নারী শাখা ‘দুর্গা বাহিনী’, এই দুটি শাখার কর্মীদের মাধ্যমে ভিএইচপি অত্যন্ত নিখুঁতভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলা করে।মুসলিমদেরকে আক্রমণ করার ক্ষেত্রে টার্গেট এরিয়া অভিমুখে বজরঙ দলের সন্ত্রাসীরা মিছিল বের করে এবং দুর্গা বাহিনীর নারীরা মিছিলের সামনে থাকে। তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে তাদের এলাকায় ঢুকে পড়ে, এতে মুসলিমরা কোনো ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখালে নারীদের উপর আক্রমণ হয়েছে বলে পেছন থেকে বজরং দলের সন্ত্রাসীরা নারী-শিশু নির্বিশেষে মুসলমানদের উপর নৃশংস আক্রমণ শুরু করে। এছাড়াও ভারতে প্রতিনিয়ত মুসলিম বিরোধী দাঙ্গাগুলো রাজনৈতিকভাবে হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা মদদপুষ্ট হয়। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে ব্যর্থ হওয়ার পর জনতোষণমূলক রাজনীতির অংশ হিসেবে আরএসএসের পরিকল্পনায় বিজেপি নেতারা রাম জন্মভূমি উদ্ধার আন্দোলন শুরু করলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। অবশ্য এর আগেও একাধিকবার হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। যেমন ১৯৮৩’তে আসামের নেলিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সরকারি মতে ১,৮১৯, বেসরকারি হিসেবে ৩,০০০ বাঙালি মুসলমানকে হত্যা করা হয়। এবং সেদিনের গণহত্যার ৮০ শতাংশই ছিল নারী ও শিশু। ১৯৮৯ সালে বিহারের ভাগলপুরে ভিএইচপির মুসলিম বিদ্বেষী স্লোগানকে কেন্দ্র করে একতরফা উস্কানিতে সৃষ্টদাঙ্গায় ১০০০ জন মুসলিম ও ১০০ হিন্দু নিহত হয়। ১৯৯২-৯৩ সালে মুম্বাইয়ে একতরফা সংখ্যালঘু হত্যা ও লুটপাট চালায় আরএসএস ও বজরঙ দল, এতে নিহতের সংখ্যা ছিলো ৯০০ জন। ২০০২ সালে নরেন্দ্র মোদীর প্ররোচনায় গুজরাটে গণহত্যা সংঘটিত হয়, এতে নিহত হয় অন্তত ২ হাজার জন, যার বেশিরভাগই মুসলিম। আরো ২৫০০ জনের বেশিলোক আহত হয়েছে এবং নিখোঁজ হয়েছে ২২৩ জন। ২০০৭ সালের অক্টোবরে রাজস্থানের আজমীরে খাযা মঈনুদ্দীন চিশতীর দরগায় আরএসএস বোমা হামলা চালায়। বজরঙ দল ও শ্রীরাম সেনা নামের সংগঠন দুটি ২০০৮ সালে কর্ণাটকের ম্যাঙ্গালোরে খ্রিষ্টানসম্প্রদায়, চার্চ ও তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালায়। ২০১৮ সালের মে মাসে হায়দারাবাদের মক্কা মসজিদে পাইপ বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে আরএসএস ও বজরঙ দলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সন্ত্রাসীরা দিল্লিতে মুসলমানদের উপর হামলা করে। ২০২০ সালের দিল্লি দাঙ্গায় ৫৩ জন নিহত হয়।বিশ্বজুড়ে নিন্দিত উল্লিখিত ঘটনাগুলো ছাড়াও প্রতিনিয়ত ভারতে হিন্দুত্ববাদের সহিংসতায় মুসলমানদের প্রাণ যাচ্ছে, ধ্বংস হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন মসজিদ, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনা। এই নৃশংসতাথেকে ভারতের খ্রিষ্টানরাও রেহাই পাচ্ছেন না, যদিও এর হার মুসলমানদের চেয়ে অনেক কম। লাগাতার ৩ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারের আমলে চরম বর্ণবাদী হিন্দুত্ববাদের দ্বারা প্ররোচিত মুসলিম নিধনযজ্ঞ দিনের পর দিন তীব্রতর হচ্ছে। রাজনীতি পর্যবেক্ষকরা বলছেন ২০১৯ সালে কাশ্মীর সম্পর্কিত রাষ্ট্রীয় নীতির পরিবর্তন, ২০১৯ সালের শেষ নাগাদ নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন, এবং ২০২০ সালেরফেব্রুয়ারিতে দিল্লি দাঙ্গা— এই তিনটি পরস্পর আন্তসম্পর্কিত ঘটনাহিন্দুত্ববাদের চরম আস্ফালন এবং ভারতীয় মুসলমানদের ভয়াবহ পরিণতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। এডলফ হিটলার জার্মানের বিরাট সংখ্যক ইয়াহুদীদেরকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দম আটকিয়ে হত্যা করার আগে চেয়েছিলেন ‘লাস্ট সলিউশন’। বছর কয়েক পূর্বে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতও ‘শেষ সমাধান’ চেয়েছেন। তাহলে কী তারা ভারতে মুসলিম নিধনের পরিকল্পনা করে এগুচ্ছেন? ভারতে হিন্দুত্ববাদ-প্ররোচিত ইসলামোফোবিয়া ও মুসলিমবিরোধী প্রচারণার যে বাড়বাড়ন্ত দশা, তাতে রাজনীতি ও সমাজতত্ত্ব বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন হিন্দুত্ববাদীরা একটি গণহত্যা ঘটানোর চেষ্টা করছে। ভারতের পরিস্থিতিদৃষ্টে জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা ড. গ্রেগরিস্ট্যান্টন বলেছিলেন- Weare warning that genocide could very well happen in India. (GenocideWatch ওয়েবসাইট)।

হিন্দুত্ববাদ স্বঘোষিতভাবে সম্প্রসারণবাদী (Expansionist)। তাই এটি কেবল ভারতে সীমাবদ্ধ না থেকে এই মতবাদের দাবীকৃত ‘পবিত্র ভূমি’র সবখানে ছড়িয়ে পড়তে সচেষ্ট। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও ঘোষিত প্রকাশ্য হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সমূহের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক দ্যা ডিপ্লমেটের ওয়েবসাইটে The Rise of the BJP’s Hindutva Ideology inBangladesh নিবন্ধে বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালে বিজেএইচএম বা হিন্দু মহাজোট গঠনের মাধ্যমে এ দেশে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের শিকড় জন্মেছে এবং তখনই ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানের প্রচলন হয়েছে। এরপর থেকে এই সংগঠন নিরবচ্ছিন্নভাবে এ দেশে তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। ২০২০ সালে বিজেএইচএম দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়, প্রভাস-পলাশ এবং গোবিন্দ প্রামাণিকের নেতৃত্বাধীন দুটি গ্রুপ। দলটির দুই গ্রুপই হিন্দুত্ববাদকে নিজেদের আদর্শ বলে স্বীকার করে। হিন্দু মহাজোটের এক নেতার মতে ভারতের হিন্দুত্ববাদের প্রতীক, যেমন ‘জয়শ্রীরাম’ স্লোগান, ক্রুদ্ধ হনুমানের ছবি, রামনবমীর মতো অনুষ্ঠান এবং লাভ জিহাদের মতো ইস্যুগুলো বাংলাদেশে জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে ২০২২ সাল থেকে। ২০২৩ সালে জাতীয় হিন্দু ছাত্র মহাজোট বাংলাদেশে নিজেদের প্রথম হিন্দুত্ববাদী (হিন্দুত্ববাদের অনুসারী) ছাত্রসংগঠন হিসেবে পরিচয় দেয়। হিন্দু ও হিন্দুত্ববাদ রক্ষা করাই তাদের লক্ষ্য বলে জানায় এই মহাজোট। এ জোটের নেতারা দাবি করেছেন, হিন্দুত্ববাদ তাঁদের আদর্শ ও ‘জয়শ্রীরাম’ তাদের স্লোগান, কিন্তু তারা বিজেপির সঙ্গে সংযুক্ত নন। বিজেএইচএমের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন  রনি রাজবংশী ২০২৩ সালে মহাখালী স্বয়ংসেবক ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) নামে একটি সংগঠন করেন। স্বেচ্ছাসেবক অর্থে সংস্কৃত ‘স্বয়ংসেবক’ শব্দটি ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী আরএসএস ব্যবহার করে। তবে তিনিও দাবি করেন, আরএসএসের সাথে তাদের কোন যোগাযোগ নেই। চলতি বছর ২০২৪ সালে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হিন্দুত্ববাদের স্বঘোষিত সমর্থক বিজেএইচএমের প্রবাস-পলাশ অংশের ছাত্র-যুবকর্মীরা গঠন করেছে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ ও পরবর্তী সময়ে সনাতন জাগরণ মঞ্চ।

দ্যা ডিপ্লোম্যাটে প্রচারিত উল্লিখিত উপাত্তগুলো বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনায় মোটেই যথেষ্ট নয়। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা ভারতপন্থি সরকারের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের কার্যক্রম যে অত্যন্ত জোরদার ও কৌশলপূর্ণহতে পারে, এটি সহজেই অনুমেয়। রাষ্ট্রদোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার হওয়া চিন্ময় দাসকে ছাড়িয়ে নিতে আদালত প্রাঙ্গনে জড়ো হয়ে বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা ও চরম নৃশংসতার সাথে রাষ্ট্রের আইনজীবীকে হত্যা করার মত ঘটনা থেকে বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের অবস্থা আন্দাজ করা যায়। হিন্দুত্ববাদ আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত নিজেদের ‘পবিত্র ভূমি’ বলে দাবি করে। এক্ষেত্রে যেহেতু মুসলিমদেরকে তারা বহিরাগত বিবেচনা করে ও তাদের বিনাশ কামনা করে, তাই মুসলিম দেশগুলোতে তাদের কার্যক্রম চালানো হিন্দুত্ববাদের তত্ত্বীয় আকাঙ্কা বিবেচনায় বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং ভারতের অভ্যন্তরে হিন্দুত্ববাদের এমন সুসময়ে এই অঞ্চলে, এবং মূখ্যত বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদের কার্যক্রম কৌশলপূর্ণভাবে বেশ জোরদার হয়েছে, এমন ধারণা করা মোটেই অমূলক হবে না। এমতাবস্থায় এই ভয়াবহ ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসি মতবাদের ব্যাপারে সচেতন হওয়া জরুরি। হিন্দুত্ববাদ কেবল মুসলিমদের জন্য আগ্রাসি নয়,বরং এটি খোদ হিন্দু ধর্মের মূলধারার জন্যও বিপজ্জনক মতবাদ। (দ্রষ্টব্য: Bunchof Thoughts by M. S. Golwalkar)। সুতরাং এই ভয়াবহ মতবাদের ব্যাপারে রাষ্ট্র থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ে বহুমাত্রিক দূরদর্শিতা না দেখালে, একে প্রশ্রয় দিলে পরিণাম হিসেবে বিরাট মাশুল গুণতে হবে।

তথ্যসূত্র:

১.Hindutva Who Is AHindu?, Vinayak Damodar Savarkar

২.We or Our Nationhooddefined, M. S. Golwalkar

৩.উগ্র হিন্দুত্ববাদ ধর্মীয় বিদ্বেষের নগ্ন নযির, আসাদ পারভেজ

৪.ConceptualizingIslamophobia in India bySheheen Kattiparambil (আর্টিকেল)

৫.Displacing andDisciplining Muslims in India’s Burgeoning HinduRashtra by Audrey Truschke (আর্টিকেল)

ফেইসবুকে আমরা...