Logo
গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির সমস্যা
মুহাম্মাদ হুসাইন
  • ১১ নভেম্বর, ২০২৫

পৃথিবীব্যাপী ইসলামিক স্কলারদের মধ্যে যারা গণতন্ত্রকে হারাম বা কুফরী মনে করেন না, তারা সবাই এই যুক্তিই দেন যে গণতন্ত্রের ভিত্তিতে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা অর্জন করবে এবং পরবর্তীতে তারা ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। রশিদ রিদা, আবুল আলা মওদূদী কিংবা হাসান আল বান্না থেকে ইউসুফ কারযাবী, মালিক বেননাবী থেকে হাসান তুরাবী কিংবা রশিদ ঘানুসী এরা সবাই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছেন গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা অর্জনের মাধ্যমে। অবশ্য তাদের সবার কাছে ‘গণতন্ত্র’র একহারা কোন রূপ ছিলো এমন নয়। তারা বিভিন্নজন বিভিন্নরূপ গণতন্ত্রের প্রস্তাব করেছেন। তবে সামগ্রিকভাবে এই মতবাদের প্রতি আনুগত্য অটুট রেখেই তারা ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আশা করেছেন। এর ফলাফল কী, সেটি আমরা আজকের মুসলিম বিশ্বের দিকে নযর দিলেই দেখতে পাই। গণতন্ত্রের উপর ভর করে স্পষ্ট ইসলাম বিদ্বেষ বা কুফরের বিরুদ্ধে যখন ইসলামপন্থীরা লড়াই করে, এরকম ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফলাফল এসেছে। এর উদাহরণ তুরস্ক। কিন্তু মোটাদাগে মুসলিম জনবহুল দেশে গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির বেলায় এটিই সত্য যে, এ ধরণের রাজনীতি দশকের পর দশক ধরে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আশ্বাস দিয়ে তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয়েছে। কেবল এটুকুই নয়, বরং এ ধরনের রাজনীতির ক্ষেত্রে বেখেয়ালভাবে গণতন্ত্রের ঘেরাটোপে আটকে ইসলামের জন্য এমন কিছু ক্ষতি বয়ে আনা হয়, যেগুলো এর লাভের দিককে ম্লান করে দেয়।
গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির ফায়দা কী? এই প্রশ্নের উত্তরে যে বিষয়টি তর্কাতীতভাবে বলা যায় তা হলো, এ ধরণের রাজনীতি ইসলাম বিরোধী চিন্তা ও মতাদর্শকে চাপের মধ্যে রাখে। তবে এটিও সত্য যে গণতন্ত্র নির্ভর ইসলামী রাজনীতিই ইসলাম বিরোধীতাকে কোনঠাসা করার একমাত্র উপায় নয়, বরং এটি আরো বহু উপায়ের একটি উপায়। কিন্তু গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে অবস্থান করেই যেহেতু এধরনের রাজনীতির চর্চা হয়, তাই সিস্টেম্যাটিকালি এটি একটি দেশে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য বেশ কিছু সংকট নিয়ে আসে।
গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এক বা একাধিক প্রতিযোগী থাকে এবং বিরোধীপক্ষের বিরোধিতার ধারণাও থাকে। যারা ইসলামী রাজনীতি করেন, তারা নিজেদের সাথে ইসলামকে যে ধরণের ভাষিক-ব্যঞ্জনায় জড়ান, তাতে তারা মুখে না বললেও এটি প্রকাশ পায় যে তাদের বিরোধী পক্ষ অ-ইসলামী। এ ধরণের রাজনৈতিক কৌশলের প্রশ্র‍য়ে ভুল ধারণার উপর নির্ভর করে রাজনীতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরকে ‘ইসলামী’ ও ‘অ-ইসলামী’ হিসেবে বর্গভুক্ত করার সামাজিক মনোভাব তৈরি হয়। মাঠপর্যায়ে এ বিষয়টির যে প্রভাব পড়ে, সেটির রূপ অত্যন্ত বীভৎস হয়ে থাকে। যেমন রাজনীতির সাথে জড়িত কোন ইসলামী দল যেকোন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে তাদের দলীয় কাজ করতে পারবে। তাঁর হক আছে, সে ইসলামিক। কিন্তু সাধারণ রাজনৈতিক দল ঘেঁষা লোক তাবলীগ বা দাওয়াতে ইসলামির কাজের জন্যও মসজিদে আলোচনা করতে দাঁড়ালে বাঁধার মুখে পড়বে। এর কারণ ঐ ভ্রান্ত সামাজিক মনোভাব। সে ইসলামী রাজনীতির লোক নয়, বিধায় সে অ-ইসলামী। একটি মুসলিম জনবহুল দেশে এধরনের বিভাজন ইসলামী ভ্রাতৃত্ববোধকে নড়বড়ে করে দেয় এবং ইসলামকে কেন্দ্র করে একধরনের কৃত্রিম ও অনর্থক মানসিক দ্বৈরথ তৈরি করে।
আবার, ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত দলগুলোর নিজস্ব মাসলাকগত ধারণা থাকে। অল্পবিস্তর পার্থক্যসহ প্রতিটি মাসলাকই ইসলামের খিদমতে নিয়োজিত থাকে। কিন্তু গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ইসলামী রাজনৈতিক একটি দল যখন কোন মাসলাককে তার ভোটের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে, তখন সে এই মাসলাক ও এর আওতাধীন দ্বীনি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও হুমকি হিসেবে দেখে, বিরোধিতা করে ও বিলুপ্ত করে দিতে চায়। এতে শেষমেশ ইসলামেরই ক্ষতি হয়। গণতান্ত্রিক কাঠামোতে ইসলামী রাজনীতির এ এক ক্ষতিকর দিক। অধুনা একটি ইসলামী রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপে সিলেটের কানাইঘাটে পুলিশের মাধ্যমে ইফতার মাহফিল বন্ধের চেষ্টা, বিয়ানীবাজারে কওমি উলামায়ে কিরামের সম্মেলন বন্ধ করা কিংবা এই একই দলের কর্মী-সমর্থকদের মাধ্যমে ফেঞ্চুগঞ্জে কুরআন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান দারুল কিরাত বন্ধ করে দেওয়ার মধ্যে গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির নেতিবাচক এই দিকটির করুণ বাস্তবতা দেখতে পাওয়া যায়। হ্যাঁ, এই ধরনের কাজ ইসলামী রাজনীতির সাথে জড়িত নয় এমন দলও করতে পারে। কিন্তু তারা এমন কিছু করলে সেটাকে ‘ইসলামী’ আচ্ছাদনে ঢেকে দিতে পারে না, যা ইসলামী কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারে। এখানেই মূল পার্থক্য।
ইসলামে মুসলমানদের ভ্রাতৃত্ববোধ, একে অন্যের দোষ গোপন করে পরস্পর সংশোধনের নসীহত করা, মুসলিমদের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা, একে অন্যের ছিদ্রান্বেষণ না করা ইত্যাদি যেসব মূল্যবোধ রয়েছে, সেগুলোকে অলঙ্ঘিত রেখে গণতন্ত্রের কাঠামোতে ইসলামী রাজনীতি করা অসম্ভব। কারণ বিরোধী দলের ছিদ্রান্বেষণ করে তাদের দোষত্রুটি ফাঁস করা গণতন্ত্রে খুব স্বাভাবিক রাজনৈতিক চর্চা। সুতরাং ইসলামী রাজনীতিও এই চর্চার ব্যতিক্রম কিছু করতে পারে না। ফলে এখানে ইসলামী রাজনীতি ইসলামী মূল্যবোধের ঘাতক হয়ে ওঠা অবধারিত।
গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতির একটি প্রধান বিজ্ঞাপন হলো ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা বা শরীআহ আইন চালু করা। সাধারণ মানুষকে এই ধরনের আশ্বাস দেওয়া হলেও এটা অনেকটাই প্রতারণাধর্মী প্রতিশ্রুতি। বিদ্যমান বিশ্বব্যবস্থার অধীনস্ততা স্বীকার করে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা আদৌ যে সম্ভব নয়– বৈশ্বিক একাডেমায়ায় এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা নতুন নয়। সেসব বাদ দিয়েও আমরা বাস্তবতা পর্যবেক্ষণ করলে দেখতে পাই গণতান্ত্রিক রাজনীতির মাধ্যমে পৃথিবীর কোথাও ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। ইসলামী রাজনীতির একজন উল্লেখযোগ্য তাত্ত্বিক রশিদ ঘানুশির দল ‘আন নাহদা’র নেতৃত্বাধীন জোট তিউনিসিয়ায় সরকার গঠন করেছিলো। সংসদে দলের কিছু এমপি শরীআহ আইন প্রণয়নের প্রস্তাব করলে রশিদ ঘানুসি এটি সমর্থন করেননি। রশিদ ঘানুসির বক্তব্য ছিলো– ‘আন নাহদার চেয়ে তিউনিসিয়া গুরুত্বপূর্ণ’। গণতন্ত্রের মাধ্যমে ইসলামী রাজনীতি করে জনগণকে ইসলামী হুকুমতের যে স্বপ্ন দেখানো হয়, তা যে বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা ও বৈশ্বিক রাজনীতির কারণে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, এই ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।
আরেকটি বিষয় হলো গণতন্ত্রে ভোটপ্রাপ্তির জন্য চটকদার ও প্ররোচক বাগাড়ম্বরের যে প্রচলন, ইসলামী রাজনীতি এটা থেকেও আলাদা থাকতে পারে না। তারা তাদের রাজনীতিকে ‘রাসূলের রাজনীতি’ বা এই অর্থের এমনসব কথা বলে, যা অত্যন্ত অদূরদর্শী ও বিপজ্জনক। বিপজ্জনক এজন্য যে, ইসলামী রাজনীতি প্রচলিত রাজনীতি থেকে মৌলিকভাবে পৃথক না হওয়ায় তাদের বলা রাসূলের রাজনীতি বিদ্যমান রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থায় প্রতিশ্রুত পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হতে বাধ্য। এতে করে তাদের দেখানো ভুল স্বপ্নে বিভোর হওয়া জনতার সহসা স্বপ্নভঙ্গের ঘটনা ঘটবে, যেরকমটা গত শতকে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও ঘটেছিলো।
ইসলামে রাজনীতির একান্ত নিজস্ব ও স্বকীয় ধারণা হলো খিলাফত-ইমারত। তবে এটি ক্ষমতাকেন্দ্রে পদরেখা অঙ্কনে স্বপ্নাতুর অর্বাচীনদের উপস্থাপিত ‘খণ্ডিত’ খিলাফত থেকে আলাদা; একটি স্বতন্ত্র বিশ্বব্যবস্থা। সমাজ ও রাষ্ট্রে সামগ্রিক দাওয়াতের মাধ্যমে খিলাফত-ইমারত ধারণাকে জনপরিসরে পরিচিত করে তোলা এবং এ ব্যাপারে জনসমর্থন সৃষ্টি করার মাধ্যমে ইসলামী মৌলিক রাজনীতির দিকে অগ্রসর হওয়া সম্ভব। প্রচলিত গণতান্ত্রিক ইসলামী রাজনীতিকে ‘ইসলামের রাজনীতি’ নয়, বড়জোর একটি সাময়িক সার্ভাইভাল স্টেপ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু ইসলামের মৌলিক ও প্রকৃত রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে আড়াল করে ইসলামের মোড়কে প্রচলিত রাজনীতি করে এটাকেই আবার ‘ইসলাম’ হিসেবে চিত্রায়ণ সন্দেহাতীতভাবে প্রতারণা। এ ধরণের রাজনৈতিকতার অপরিশীলিত চর্চা অল্প লাভের বিপরীতে ইসলামী রূহানিয়্যাত, দ্বীনি মূল্যবোধ এবং মুসলিম জনবহুল দেশের ইসলাম কেন্দ্রিক জাতিগত অখণ্ডতার জন্য অভিশাপ বয়ে আনে।

ফেইসবুকে আমরা...