1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
গাযওয়াতুল হিন্দ: ভারতে মুসলমানদের যুদ্ধাভিযানের নববী ভবিষ্যৎবাণী
মুহাম্মাদ সায়ীদ
  • ৩ জুন, ২০২৫

আল্লাহ তাআলা ইসলামকে বিজয়ী দ্বীন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাসূল (সা.) কে রিসালাতের দায়িত্ব দিয়েছেন। মক্কার হেরা গুহায় ওহী পাওয়ার পর থেকে রাসূল (সা.) আল্লাহর ওহী নির্দেশিত হিদায়াত-স্তম্ভের উপর দাঁড় করিয়ে এক নতুন পৃথিবী নির্মাণের জন্য দাওয়াতের কাজ শুরু করেছিলেন এবং একই সাথে বিনির্মাণের প্রয়োজনে তিনি গাযওয়া-সারিয়্যাহর মত বৈপ্লবিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন। উদ্দেশ্য একটাই, আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা। রাসূলে পাক (সা.) তাঁর জীবদ্দশায় ইসলামকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য নিজে যেমন চূড়ান্ত প্রচেষ্টা চালিয়েছেন ঠিক তেমনি তাঁর পরেও যেন এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে, সেজন্য তিনি সাহাবায়ে কিরামকে একটি সক্ষম ও কর্মদক্ষ ব্যাটালিয়ন হিসেবে প্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলেছিলেন। এই সংগ্রামমুখর মুবারক ও হিদায়াতমুখী অগ্রযাত্রার অনেক প্রাপ্তিরও ভবিষ্যৎবাণী তিনি প্রদান করে গিয়েছেন; ইয়ামান, শাম, ইরাক, পারস্য, কন্সটান্টিনোপল ইত্যাদি অঞ্চলে মুসলমানদের বিজয়ী হওয়ার সুসংবাদ দিয়ে গেছেন। হুযুরে পাকের এইসব ভবিষ্যৎবাণীর একটি হলো, ভারতে মুসলানদের অভিযান–হাদীসের ভাষ্যে যার নাম ‘গাযওয়াতুল হিন্দ’। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা গাযওয়াতুল হিন্দ বিষয়ে আলোকপাত করব।

গাযওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত বেশ কিছু সহীহ ও দয়ীফ হাদীস রয়েছে। মূখ্যত এই সংশ্লিষ্ট হাদীসগুলোর বর্ণনাকারী সাহাবী দুজন– হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) এবং হযরত সাওবান (রা.)। এই হাদীসগুলোর মাধ্যমে জানতে পারা যায় যে, রাসূলে পাক (সা.) ভারতে মুসলমানদের অভিযানের ভবিষ্যৎবাণী প্রদান করেছেন।

হযরত সাওবান (রা.) বর্ণনা করেছেন-

عَنْ ثَوْبَانَ مَوْلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ( عِصَابَتَانِ مِنْ أُمَّتِي أَحْرَزَهُمَا اللَّهُ مِنَ النَّارِ: عِصَابَةٌ تَغْزُو الْهِنْدَ، وَعِصَابَةٌ.تَكُونُ مَعَ عِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ عَلَيْهِمَا السَّلَام.

-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোলাম হযরত সাওবান (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমার উম্মতের দুটি দলকে আল্লাহ্ তাআলা জাহান্নাম হতে পরিত্রাণ দান করবেন। একদল যারা হিন্দুস্থানের জিহাদ করবে, আরেকদল যারা ঈসা ইবন মারইয়াম (আ.) এর সঙ্গী হবে। (মুসনাদ আহমাদ, হাদীস: ২২৩৯৬, সুনান নাসাঈ, হাদীস: ৩১৭৮)

মুসনাদ আহমাদ এর তাহকীকে আল্লামা শুয়াইব আরনাউত এই হাদীসের সনদকে সহীহ বলেছেন। ইমাম সুয়ূতী জামিউস সগীরে হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। সর্বোপরি, এই হাদীসের ব্যাপারে শাস্ত্রজ্ঞদের অভিমত হলো, এটি সহীহ।

হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) এর বর্ণনায় একটি হাদীসে এসেছে-

 عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ وَعَدَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ غَزْوَةَ الْهِنْدِ فَإِنْ أَدْرَكْتُهَا أُنْفِقْ فِيهَا نَفْسِي وَمَالِي فَإِنْ أُقْتَلْ كُنْتُ مِنْ أَفْضَلِ الشُّهَدَاءِ وَإِنْ أَرْجِعْ فَأَنَا أَبُو هُرَيْرَةَ الْمُحَرَّرُ

-আবূ হুরাইরা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে হিন্দুস্থানের জিহাদের ওয়াদা দিয়েছিলেন। যদি আমি ঐ যুদ্ধের সুযোগ পাই, তাহলে আমি তাতে আমার জান-মাল ব্যয় করব। আর যদি আমি তাতে নিহত হই, তা হলে আমি শহীদের মধ্যে উত্তম সাব্যস্ত হব। আর যদি আমি ফিরে আসি, তা হলে আমি আবূ হুরাইরা হবো আযাদ বা জাহান্নাম হতে মুক্ত। (সুনান নাসাঈ, হাদীস: ৩১৭৬, মুসনাদ আহমদ, হাদীস: ৭১২৮)

এই হাদীসটি হযরত আবু হুরাইরা (রা.) মারফতে সনদের ভিন্নতা সহ বহু হাদীসগ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। মুহাদ্দিসীনে কিরামের একদল এই রিওয়ায়াতের সনদকে দয়ীফ বলেছেন। আবার কেউ কেউ সহীহও বলেছেন। যেমন শাইখ আহমাদ শাকির তাঁর তাহকীককৃত ‘মুসনাদ আহমাদ’ এর টীকায় বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। তবে এই বর্ণনার সনদগুলো নিয়ে বিভিন্ন কথা থাকলেও, হযরত সাওবান বর্ণিত পূর্বোক্ত হাদীস এবং আরো অন্যান্য বর্ণনা পর্যালোচনাপূর্বক মুহাদ্দিসীনে কিরাম এই মত ব্যক্ত করেছেন যে, গাযওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত রাসূল (সা.) এর ভবিষ্যৎবাণীর হাদীসটি সহীহ।

উল্লিখিত হাদীসগুলোর ভাষ্য হতে পরিষ্কারভাবে বুঝা যায় ‘গাযওয়াতুল হিন্দ’ হবে এবং এই গাযওয়ায় অংশগ্রহণকারীদের ও হযরত ঈসা (আ.) এর সঙ্গীদেরকে আল্লাহ তাআলা ক্ষমা করে দিবেন। কিন্তু হাদীসের ভাষ্যে এটি স্পষ্ট নয় যে, গাযওয়াতুল হিন্দ ও হযরত ঈসা (আ.) সমসাময়িক হবেন। এক্ষেত্রে এখানে দুটো সম্ভাবনা থাকে–

১। এই যুদ্ধ হবে ঈসা (আ.) এর সমসাময়িককালে। যদি তা-ই হয়, তাহলে নিশ্চিত ভাবে বলা যায় গাযওয়াতুল হিন্দ এখনো হয়নি।

২। গাযওয়াতুল হিন্দ হযরত ঈসা (আ.) এর সমসাময়িক হবে না। এই সম্ভাবনাটিকে যদি সত্য ধরে নেয়া হয়, তাহলেও প্রশ্ন থাকে গাযওয়াতুল হিন্দ কি হয়ে গেছে নাকি আগামীতে হবে।

এক্ষেত্রে গাযওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হওয়া বা না হওয়া নিয়ে মুহাদ্দিসীনে কিরামের মোটের উপর ৩টি মতামত পাওয়া যায়।

প্রথম মত

গাযওয়াতু হিন্দ সংঘটিত হয়ে গেছে। যারা এই মতামত ব্যক্ত করেছেন, তাদের দাবি মতে মুআবিয়া (রা.) এর সময়ের ভারত অভিযান, হাজ্জাজ বিন ইউসুফের শাসনামলে মুহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে পরিচালিত অভিযান, সুলতান মাহমুদ গজনভী ও মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযানের মাধ্যমে রাসূল (সা.) এর গাযওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হয়েছে।

ইমাম হাফিয ইবন কাসীর (র.) আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ’ গ্রন্থে  الاخْبَارُ عَنْ غَزْوَةِ الْهِنْدِ (গাযওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ) শিরোনামাধীন আলোচনায় এবং النهاية في الفتن والملاحم নামক গ্রন্থে গাযওয়াতুল হিন্দ সংক্রান্ত হাদীসগুলো উল্লেখপূর্বক রাসূল (সা.) এর ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতা হিসেবে ভারতে ইসলাম প্রচারের প্রারম্ভিক অভিযানগুলোর কথা উল্লেখ করেছেন। ইবন কাসিরের ভাষ্য–

وَقَدْ غَزَا الْمُسْلِمُونَ الْهِنْدَ فِي سَنَةِ أَرْبَعٍ وأربعين في إمارة مُعَاوِيَةَ بْنِ أَبِي سُفْيَانَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ فجرت هناك أمور فذكرناها مبسوطة، وقد غزاها الملك الكبير السعيد المحمود بن شنكنكير صاحب بلاد غَزْنَةَ٢ وَمَا وَالَاهَا فِي حُدُودِ أَرْبَعِمِائَةٍ فَفَعَلَ هنالك أفعالاً مشهورة وأموراً مشكورة وكسر الصنم الأعظم المسمى بسومنات وأخذ قلائده وسيوفه ورجع إلى بلاده سالماً غانماً.

-হিজরী ৪৪ সালে মুআবিয়া (রা.) এর শাসনামলে মুসলমানরা ভারতে প্রথম যুদ্ধাভিযান চালিয়েছেন। এরপর সেখানে বেশ কিছু ঘটনা ঘটে, আমরা এসব ইতিহাসের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছি। এরপরে চতুর্থ হিজরী শতকের শেষ দিকে গজনীর মহান শাসক, সুলতান মাহমুদ গজনভী ভারতে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেছেন। সেখানে তিনি গুরুত্ববহ ও কৃতিত্বপূর্ণ অনেক কাজ করেছেন। বিশেষ করে তিনি ‘সোমনাথ’ নামের বিশাল মন্দিরের প্রধান মূর্তিটি ভেঙে চূর্ণ করেন এবং এর গলার হারসমূহ (গহনাদি) ও তরবারীগুলো জব্দ করে সফলভাবে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। (আন নিহায়াহ ফিল ফিতান ওয়াল মালাহিম ১/১৮)

দ্বিতীয় মত

গাযওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হয়নি। কিয়ামতের আগে হযরত ঈসা (আ.) এর সময়ে এই মহাযুদ্ধ সংঘটিত হবে।

এই মতের সমর্থনে কিছু হাদীসও পাওয়া যায়। নুআঈম ইবন হাম্মাদ (র.) এর ‘আল ফিতান’ গ্রন্থে কিছু বর্ণনা আছে, যেগুলোর সনদকে মুহাদ্দিসীনে কিরামের বড় অংশ দয়ীফ বলেছেন। এগুলোতে দেখা যায় রাসূল (সা.) বলেছেন হিন্দুস্তানে একদল যুদ্ধ করবে। আল্লাহ তাঁদের বিজয় দান করবেন। তাঁরা হিন্দুস্তানের রাজাদের শিকল দিয়ে বেঁধে টেনে আনবে। আল্লাহ তাআলা ঐ মুজাহিদদের সকলকে ক্ষমা করে দেবেন। এরপর মুসলিমরা যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে ঈসা (আ.) এর সাথে মিলিত হবে।

তাবে তাবিঈ আরতাত (র.) হতে একটি রিওয়ায়াত নুআঈম ইবন হাম্মাদ তাঁর আল ফিতান গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। এই বর্ণনাটির তাহকীকে মুহাদ্দিসীনে কিরামের কারো কারো সিদ্ধান্ত হলো এটি মাকতূ ও আরতাত পর্যন্ত এর সনদ সহীহ। বর্ণনাটি নিম্নরূপ–

عَنْ أَرْطَاْةَ قَالَ: عَلَى يَدَيْ ذَلِكَ الْخَلِيْفَةِ الْيَمَانِيِّ الَّذِيْ تُفْتَحُ الْقُسْطَنْطِيْنِيَّةُ وَرُوْمِيَّةُ عَلَى يَدَيْهِ، يَخْرُجُ الدَّجَّالُ وَ فِيْ زَمَانِهِ يَنْزِلُ عِيْسَى ابْنُ مَرْيَمَ عَلَيْهِ السَّلَامُ، عَلَى يَدَيْهِ تَكُوْنُ غَزْوَةُ الْهِنْدِ، وَهُوَ مِنْ بَنِيْ هَاْشِمٍ، غَزْوَةُ الْهِنْدِ الَّتِي قَالَ فِيْهَا أَبُوْ هُرَيْرَةَ.

-আরতাত রাহিমাহুল্লাহ বলেন, ইয়ামানী খলীফার নেতৃত্বে কন্সটান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) ও রোম বিজয় হবে। তার সময়েই দাজ্জাল আত্মপ্রকাশ করবে। তাঁর যুগেই ঈসা ইবন মারইয়াম (আ.) অবতরণ করবেন এবং তার নেতৃত্বেই হিন্দুস্তানের যুদ্ধ সংঘটিত হবে। তিনি হবেন হাশিমী বংশের লোক। আবূ হুরাইরা (রা.) হিন্দের এই যুদ্ধ সম্পর্কেই (হাদীস) বর্ণনা করেছেন। (আল ফিতান, হাদীস :১২৩৩)

তৃতীয় মত

উলামায়ে কিরামের একদল মনে করেন ভারতবর্ষে ইসলামের জন্য সংঘটিত সবগুলো যুদ্ধকেই গাযওয়াতুল হিন্দ বলা হবে। এই মত প্রদাণকারী অন্যতম একজন আলিম হলেন পাকিস্তানের মুফতী মুহাম্মদ শফী (র.)।

উপরোল্লিখিত মতগুলোকে একটি আরেকটির বিপরীত না দেখে, বরং সবকটিকে গ্রাহ্য করেও গাযওয়াতুল হিন্দের ব্যাপারে মুফীদ ধারণা গ্রহণ করা সম্ভব। রাসুল (সা.) এর ভবিষ্যৎবাণীর সত্যতার প্রশ্নে গাযওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হয়েছে, কিংবা শুরু হয়েছে। ইমাম ইবন কাসীর বা অন্যান্য যারা বলেন যে এটি সংঘটিত হয়ে গেছে, তারা এক্ষেত্রে ১ম দিকের কয়েকটি অভিযানকে উল্লেখ করে থাকেন। ইমাম ইবন কাসীর তার বক্তব্যে মুহাম্মদ ঘুরীর অভিযানের কথা বলেননি, কিন্তু অন্যান্য কেউ কেউ এটির কথা উল্লেখ করেছেন। আবার কতিপয় আলিম হযরত উমর (রা.) এর সময়ের অভিযানকেও এই গাযওয়া সমষ্টির মধ্যে যুক্ত করেছেন। দেখা যাচ্ছে, তারা গাযওয়াতুল হিন্দ হিসেবে এইসব অভিযানের সুনির্দিষ্ট কতিপয়কে গ্রহণ করছেন না, বরং ১ম দিকের অভিযানকেই উদ্দেশ্য করছেন। এতে বুঝা যায়, তারা এটিই বলতে চাচ্ছেন যে আল্লাহর রাসূল (সা.) একটি দল ভারতে যুদ্ধ করবে বলে যে ভবিষ্যৎবাণী প্রদান করেছেন, তা বাস্তবায়িত হয়েছে।

দ্বিতীয় মতের ক্ষেত্রে খুব সহজেই অনুমেয়, সনদের দিক থেকে দুর্বল কিছু বর্ণনা এবং একজন তাবিঈর ভাষ্যে, গাযওয়াতুল হিন্দের মুজাহিদরা ঈসা (আ.) এর সাথে মিলিত হবেন বলা হয়েছে বিধায় এই যুদ্ধ কিয়ামতের পূর্বে সংঘটিত হবে। ইমাম নুআইম ইবন হাম্মাদের আল ফিতানের হাদীসগুলো নির্ভরযোগ্য হলে– যেমনটা কতিপয়কে মুহাদ্দিস বলে থাকেন– সন্দেহাতীতভাবে বলা যায় গাযওয়াতুল হিন্দ সামনে অপেক্ষা করছে।

আমরা যদি অভিজ্ঞতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করি, তাহলে দেখতে পাই ভারতে মুসলমান বিরোধী মনোভাব ও ইসলামবিদ্বেষকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে। আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদ মুসলমানদেরকে প্রতিনিয়ত হত্যাযোগ্য হিসেবে মনোভাব তৈরি করতে চাচ্ছে। তারা মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের ঘাতক হয়ে উঠছে; দাবি করছে ভারতের সবাইকে ‘হিন্দু’ হতে হবে। আজকের ভারতে হিন্দুত্ববাদ দ্বারা উৎসাহিত ইসলামবিদ্বেষ ও মুসলিম-বিরোধী ঘৃণার যে রমরমা অবস্থা, তা শুধু সামাজিক বিদ্বেষে সীমাবদ্ধ নয়—বরং এটি একটি পরিকল্পিত রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ হয়ে উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, এ পরিস্থিতি শুধু আজ সাম্প্রদায়িক সহিংসতাই নয়, বরং একটি পরিকল্পিত গণহত্যার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই আশঙ্কা কতটা বাস্তব তা প্রতিফলিত হয়েছে জেনোসাইড ওয়াচ-এর প্রতিষ্ঠাতার সতর্কবার্তা উচ্চারণে। বছরকয়েক আগে তিনি বলেছেন— We are warning that genocide could very well happen in India (Genocide Watch)। অর্থাৎ, হিন্দুত্ববাদীরা ভারতে একটি মুসলিম গণহত্যার ভিত্তি প্রস্তুত করছে।

সবকিছু মিলিয়ে এটি বলা যায় যে, আগামীর ভারতবর্ষে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এক রোমহষর্ক রণক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছে। এমনকি এই কয়েকদিন আগেও বিশ্ব আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলো এই মর্মে যে, ভারত-পাকিস্তান পূর্ণবিস্তৃত দ্বন্দ্বে জড়ালে বিশ্ব এক ভয়ংকর নিউক্লিয়ার সংঘাত দেখতে যাচ্ছে। সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে পাকিস্তানের উপর ভারতের আক্রমণ মূলত মুসলিম পাকিস্তানের উপর হিন্দু ভারতের আক্রমণ; আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ববাদী ভারতের অভ্যন্তরভাগে এই ব্যাপারটির ট্রান্সলেশন হলো, মুসলমানের উপর হিন্দুর আধিপত্যের প্রদর্শনী। এদিক থেকে দেখলে এটা আর অস্পষ্ট থাকে না যে, এই অঞ্চলের মুসলমান এক কঠিন সংঘাতমুখর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে। এর চূড়ান্ত পরিণতি যে ‘গাযওয়াতুল হিন্দ’ হবে না– এটা নিশ্চিত করে বলার উপায় নাই।

তৃতীয় মতের ক্ষেত্রে বলা যায়, এটা পূর্বোক্ত দুটি মতের সমন্বয় করে। ভারতে ইসলামের জন্য সবগুলো যুদ্ধই রাসূলের বলা গাযওয়া হলে হাদীসের প্রতিপাদ্যের বিশেষীকরণ করা হয় না। আবার একই সাথে এই ব্যাখ্যা রাসূলের ভবিষ্যতৎবাণীর বাস্তবায়নকেও নির্দেশ করে।

গাযওয়াতুল হিন্দ সংঘটিত হয়ে যাওয়া বা ভবিষ্যতে সংঘটিত হওয়ার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা সর্বাধিক জ্ঞাত। তবে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সামনের  দিনে মুসলমানদের কঠিন সময়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর ইঙ্গিত করছে। তবে এ কারণে যে কেবল একটি গাযওয়ার অপেক্ষা করতে হবে, তা ঠিক নয়। বরং এই সময়ে যুদ্ধের যে পরিবর্তিত ও বহুমাত্রিক ধারণা আছে, সেগুলোর মুকাবিলায় প্রস্তুতিগ্রহণসহ মুসলমানদেরকে সামগ্রিক প্রগতির ব্যাপারে বিশেষ মনোযোগী হতে হবে। ইসলাম যে সাম্য ও মানবতার শিক্ষা দিয়েছে, সেগুলোর মাধ্যমে নিজেদের চারিত্রিক উৎকর্ষ সাধনপূর্বক দাওয়াতী কার্যক্রম জোরদার করতে হবে; অন্যায়কে অন্যায় দ্বারা প্রতিহত করার মত প্রতিক্রিয়াশীলতা নয় বরং ক্ষমা ও দয়া প্রদর্শনের মত আখলাকী প্রগতিশীলতার চর্চা করতে হবে।

গাযওয়াতুল হিন্দ রাসূল (সা.) কর্তৃক প্রদত্ত এক ভবিষ্যৎবাণী ও সতর্কবার্তা। তাই এটাকে কেন্দ্র করে ভয়ের ছড়াছড়ি বা রোমাঞ্চের অবতারণা না করে বরং একে ‘হুঁশিয়ারি বার্তা’ হিসেবে গ্রহণ করে হিদায়াতের উপর ইস্তিকামাতের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হতে হবে। মুসলমানরা তাদের ‘ঈমান’কে শক্তির উৎস হিসেবে গ্রহণ করলে যে কোন প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করতে পারে। কবি গোলাম মুস্তফার কাব্যানুবাদে ‘জওয়াব-ই-শিকওয়া’য় আল্লামা ইকবাল আমাদেরকে এই অভয়বাণীই শুনিয়েছেন–

বুলগারগণ আসিছে ধাইয়া তুর্কির পানে- কীসের ভয়?

গাফিলদিগের হুঁশিয়ারি এ যে- যাতে তারা সব সজাগ হয়।

দুঃখ করিছ কেন এ বিপদে? ভাবিছ কেন এ অকল্যাণ?

এই তো তোমার আত্মশক্তি- বলবীর্যের ইমতিহান!

দুশমনদের যুদ্ধ-অশ্ব আসুক-না রণ-হুংকারে,

সত্যের নূর নিভিতে পারে না শত্রুসেনার ফুৎকারে।

ফেইসবুকে আমরা...