মধ্যপ্রাচ্যের যে অঞ্চলে আজ পৃথিবীর একমাত্র ইয়াহুদী রাষ্ট্রটি অবস্থিত, মাত্র এক শত বছর পূর্বেও সে অঞ্চলটি ছিল আর দশটি আরব দেশের মতো মুসলিম প্রধান একটি দেশ। তারপর দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ হলো, খেলাফতের পতন ঘটল, পবিত্র ফিলিস্তিনি ভূমির দখল পেল ব্রিটিশরা, এবং আরবদের এই দেশটিতে তারা ইয়াহুদীরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে এ অঞ্চল ছেড়ে চলে গেল।
ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ অঞ্চলে মুসলিমরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ, প্রধান সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল খ্রিষ্টানরা, ইয়াহুদীদের অস্তিত্ব ছিল নামেমাত্র। পূর্ব ইউরোপসহ দুনিয়ার নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ইয়াহুদীদের বসবাস। সেই ইয়াহুদীরা ঠিক কোন কারণে ফিলিস্তিনের ভূমিতেই তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাইল? কেন ইউরোপ ছেড়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে চলে এল? মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশটির সাথে তাদের সম্পর্কই বা কী ছিল?
মূলত বনী ইসরাঈল তথা ইয়াহুদীদের ফিলিস্তিনের প্রতি এত আগ্রহের একটি কারণ তারা নিজেদেরকে এ অঞ্চলের প্রকৃত বাসিন্দা বলে মনে করে। তাদের দাবি, তাদেরকে এ অঞ্চল থেকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়েছে, তাই তারা তাদের হারানো ভূমি ফিরে পেতে নতুন ইসরাইল রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের মূল কথা হলোÑ ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দা ইয়াহুদীরা, আর বর্তমান ইয়াহুদীরা হাজার হাজার বছর পূর্বের সেই ইয়াহুদীদের সরাসরি বংশধর, তাদের মধ্যে অন্য কোন রক্তের সংমিশ্রণ ঘটেনি। আমরা ইয়াহুদীদের এ দুটি দাবির ঐতিহাসিক বাস্তবতা সংক্ষেপে পর্যালোচনা করে দেখব। সেই সাথে ইতিহাসের পরিক্রমায় ফিলিস্তিনে প্রতিষ্ঠিত ইয়াহুদী রাষ্ট্রসমূহ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনাও করব।
বনী ইসরাঈলের পূর্ব পুরুষদের মধ্যে হযরত ইবরাহীম (আ.) সর্বপ্রথম ফিলিস্তিনে বসবাস করতে শুরু করেন। ইবরাহীম (আ.) এর জন্ম হয়েছিল প্রাচীন ব্যাবিলন তথা ইরাকে। আল্লাহর নির্দেশে তিনি তাঁর এক স্ত্রী হাজেরাকে পুত্র ইসমাঈল (আ.)সহ আরব উপদ্বীপের পবিত্র মক্কা নগরীতে রেখে অপর স্ত্রীকে নিয়ে কেনআন নামক এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। কেনআনেরই বর্তমান নাম ফিলিস্তিন। সে সময় কেনআনে এক আরব গোষ্ঠীর বসতি ছিল, যারা খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় সহ¯্রাব্দে আরবের বেদুইন জীবন ছেড়ে কেনআন বা ফিলিস্তিনে স্থায়ী বসতি স্থাপন করেছিল। তারাই ফিলিস্তিনের আদি অধিবাসী।
কেনআন তথা ফিলিস্তিনে ইবরাহীম (আ.) এর ছেলে ইসহাক (আ.) এর জন্ম হয়। তারপর ইসহাক (আ.) এর ছেলে ইয়াকুব (আ.) এর জন্ম হয়। ইয়াকুব (আ.) এর অপর নাম ছিল ইসরাঈল। তাই তাঁর বংশধরকে বনী ইসরাঈল বলা হয়ে থাকে। ইসরাঈলের সকল ছেলের জন্মও হয়েছিল কেনআন তথা ফিলিস্তিনে। কিন্তু পরবর্তীতে অন্য ভাইদের ষড়যন্ত্রে ইসরাঈল (আ.) এর ছোট ছেলে ইউসুফ (আ.) মিসরে নির্বাসিত হন এবং ঘটনাক্রমে মিসরে তিনি রাজক্ষমতার অংশ হয়ে উঠেন। এরপর তাঁর সাথে আবার বাবা ও ভাইদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ফিলিস্তিনে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিল, সে কারণে ইউসুফ (আ.) এর পরামর্শে বনী ইসরাঈর তথা ইয়াকুব (আ.) ও তাঁর সকল ছেলে ফিলিস্তিন ছেড়ে মিসরে স্থানান্তরিত হন। বনী ইসরাঈল প্রথম বারের মতো ফিলিস্তিন ত্যাগ করে, এবং সেটা অবশ্যই স্বেচ্ছায়; নিজেদের সুবিধার্থে। বনী ইসরাঈলের আবাসস্থল হয় মিসর। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও বাইবেলের বর্ণনা প্রায় একই রকম।
বনী ইসরাঈলের বংশবৃদ্ধি হচ্ছিল মিসরেই। একটা পর্যায়ে হযরত মূসা (আ.) এর আবির্ভাব হলো। মিসরে মূসা (আ.) এর আমলে বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে এক পর্যায়ে বনী ইসরাঈলের উপর নির্দেশ এল হিজরত করার। তখন মূসা (আ.) এর সাথে বনী ইসরাঈল ফিলিস্তিনে হিজরত করে। এ ঘটনা ১২২১ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বনী ইসরাঈলের সকলে মূসা (আ.) এর সাথে হিজরত করেনি, অনেকে তখন মিসরে থেকে যায়। তবে তাদের মূল অংশটি ফিলিস্তিনে চলে যায়। এভাবে দ্বিতীয় বারের মতো ফিলিস্তিনে ইয়াহুদীদের বসতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ফিলিস্তিনে যাওয়ার পর আল্লাহ তাআলা তাদেরকে পবিত্র শহর জেরুজালেমে প্রবেশের নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকৃতি জানায়। বনী ইসরাঈল তখন বলে, জেরুজালেমে প্রবল শক্তিমত্তার অধিকারী এক জাতির বসবাস, তারা সেখানে থাকলে আমরা এ শহরে প্রবেশ করব না। এ সময় তারা মূসা (আ.)কে বলে, “আপনি এবং আপনার রব গিয়ে যুদ্ধ করুন।” তাদের এ অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন, তারা দীর্ঘকাল জেরুজালেমে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে নবী হযরত ইউশা বিন নূনের অধীনে তারা জেরুজালেমে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। তবে সে সময়ও ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দাদের বিভিন্ন নগররাষ্ট্র ছিল। সে সকল রাষ্ট্রকে তারা পরাজিত করতে পারেনি।
বনী ইসরাঈল তথা ইয়াহুদীরা জেরুজালেমে প্রবেশ করলেও তারা একক কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি। তাদের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে মারাত্মক বিভক্তি ছিল। এ অবস্থায় প্রায় সাড়ে তিনশত বছর অতিবাহিত হয়। ইয়াহুদীদের চরম নৈতিক ও ধর্মীয় অবক্ষয় দেখা দেয় এই সময়ে। অবশেষে ফিলিস্তিনের অন্যান্য অ-ইয়াহুদী রাষ্ট্রসমূহের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইয়াহুদীরা নবী শামুয়েল (আ.) এর নিকট একজন রাজা নিয়োগের আবেদন করে। নবী তাদের জন্য তালুতকে রাজা নিযুক্ত করেন। তালুতের অধীনে প্রথম বারের মতো ইয়াহুদীরা শক্তিশালী ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্রের অধিকারী হয়। তালুতের পর হযরত দাউদ (আ.) ও হযরত সুলাইমান (আ.) এর মতো পরাক্রমশালী বাদশাহের অধীনেও তারা ঐক্যবদ্ধ ছিল। এ সময় পুরো ফিলিস্তিনজুড়ে ইয়াহুদীদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও ফিলিস্তিনের আদি বাসিন্দারা ফিলিস্তিনেই বসবাস করছিল। তাদের অনেকে ইয়াহুদী ধর্মগ্রহণ করে, আবার অনেকে নিজেদের পুরনো ধর্মীয় বিশ্বাসের উপরই থাকে।
সুলাইমান (আ.) এর ইন্তিকালের পর ইয়াহুদীরা আবার দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। তখন ফিলিস্তিনের উত্তরাংশে সামুরিয়াকে রাজধানী করে গঠিত হয় ইসরাঈল রাষ্ট্র, দক্ষিণ অঞ্চলে জেরুজালেমকে রাজধানী করে গড়ে উঠে ইয়াহুদিয়া রাষ্ট্র। খ্রিষ্টপূর্ব ৭২১ অব্দে উত্তরাঞ্চলের ইসরাইল রাষ্ট্রটি অ্যাসিরিয়ান রাজা সারগুনের হাতে বিলুপ্ত হয়। রাজা অসংখ্য ইয়াহুদীকে ফিলিস্তিন থেকে বের করে দেন। তখনও দক্ষিণাঞ্চলের ইয়াহুদিয়া রাষ্ট্রটির অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ব্যাবিলনের বিখ্যাত রাজা বখতে নসর খ্রিষ্টপূর্ব ৫৯৮ অব্দে জেরুজালেম দখল করে নিলে এ রাষ্ট্রটিরও পতন হয়। কয়েক বছর পর বখতে নসর পুরো ইয়াহুদিয়া রাষ্ট্রটি ধ্বংস করেন, এ সময় জেরুজালেম শহরও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। বিপর্যয় নেমে আসে ইয়াহুদীদের উপর। বহু ইয়াহুদী নিহত হয়, আবার অনেককে ফিলিস্তিনের বাইরে নির্বাসিত করা হয়।
খ্রিষ্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দে পারস্যের রাজা সাইরাসের হাতে ব্যাবিলনে পতন হয়। রাজা সাইরাসের আনুকূল্যে অনেক ইয়াহুদী আবার ফিলিস্তিনে ফিরে আসতে সক্ষম হয়। ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনে ফিরে আসলেও সেখানে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় গ্রিকদের। তারও অনেক পরে ইয়াহুদীদের আহ্বানে রোমানরা ফিলিস্তিন দখল করে ইয়াহুদী করদ রাজা নিযুক্ত করে। ইয়াহুদীদের এই শাসনামলে ফিলিস্তিনে নবী হযরত ঈসা (আ.) এর জন্ম হয়।
৬৪-৬৬ খিষ্টাব্দের দিকে ইয়াহুদীরা রোমানদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিদ্রোহ করে। রোমানরা কঠোর হস্তে ইয়াহুদীদেরকে দমন করে। বিভিন্ন বর্ণনায় দেখা যায়, এ সময় ৬৭ হাজার ইয়াহুদীকে রোমানরা ক্রীতদাসে পরিণত করে। অনেককে আফ্রিকায় নির্বাসন দেয়, আবার অনেককে রোমে নিয়ে যায়। রোম থেকে এসকল ইয়াহুদী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আধুনিক ইসরাঈল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ইয়াহুদীরা আর ফিলিস্তিনে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, রোমানরা বিদ্রোহ দমন করার পর সকল ইয়াহুদীকে কিন্তু ইসরাঈল থেকে বের করে দেয়নি। যে সকল ইয়াহুদী তখনও ফিলিস্তিনে ছিল, তাদের অনেকেই পরবর্তীতে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে। এছাড়া বনী ইসরাঈলের ফিলিস্তিনে প্রবেশের পূর্ব থেকে যেসকল জনগোষ্ঠী ফিলিস্তিনে বসবাস করছিল, তারাও ফিলিস্তিনেই বসবাস করতে থাকে। সর্বোপরি এ সময় থেকে ফিলিস্তিনে খ্রিষ্টানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। পরবর্তীতে ফিলিস্তিনে খ্রিষ্টানদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.) এর আমলে সন্ধি চুক্তির মাধ্যমে মুসলমানরা ফিলিস্তিন জয় করে। এরপর থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্ব পর্যন্ত (ক্রুসেডের কয়েক বছর বাদ দিয়ে) পুরো ফিলিস্তিন মুসলিমদের অধীনে শাসিত হয়েছে।
ফিলিস্তিনের সাথে ইয়াহুদীদের ঐতিহাসিক সম্পর্ক মোটামুটি এতটুকুই। এখানে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। প্রথমত: বনী ইসরাঈলের বহু আগে থেকেই ফিলিস্তিন অঞ্চলে কেনআনী আরবসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বসবাস ছিল। তারা এবং বনী ইসরাঈলের অনেকেই ধর্মান্তরিত হয়ে প্রথমে খ্রিষ্টান এবং পরবর্তীতে এসকল ইয়াহুদী-খ্রিষ্টানদের অধিকাংশই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে মুসলিম হয়েছেন। ফলে ফিলিস্তিনের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম ও সংখ্যালঘু খ্রিষ্টানরা ফিলিস্তিনের আদি জনগোষ্ঠীসমূহেরই উত্তরাধিকার। ফিলিস্তিনি ভূমির প্রতি এদের দাবি কোনভাবেই বনী ইসরাঈলের চেয়ে কম নয়।
দ্বিতীয়ত: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যেসকল ইউরোপীয় ইয়াহুদী ফিলিস্তিনে আসতে শুরু করে, এদের বেশির ভাগই দুই হাজার বছর পূর্বে ফিলিস্তিন থেকে বিতাড়িত ইয়াহুদীদের বংশধর নয়। (বংশধর হলেও দুুই হাজার বছর পর পূর্বপুরুষদের ভূমি দাবি করার কোনো যৌক্তিকতা নেই।) জন হপকিন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক অ্যারন হায়েকের এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ইউরোপীয় ইয়াহুদীরা (বর্তমানে মোট ইয়াহুদীদের ৯০ শতাংশই ইউরোপীয়) ফিলিস্তিনি বনী ইসরাঈলের বংশধর নয়, তাদের অধিকাংশের শরীরে ককেশাস অঞ্চলের রক্তধারা বইছে, বাকীরা রোমান ও গ্রিকদের বংশধর।
এ গবেষণার সমর্থন পাওয়া যায় মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনায়ও। মুসলিম ঐতিহাসিকদের বর্ণনামতে, ককেশাস অঞ্চলের খারাজ রাজ্যের রাজা ও তার সভাসদবর্গ কোনো এক স্বপ্নের কারণে ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে রাজার অনুকরণে রাজ্যের সাধারণ মানুষও ইয়াহুদী ধর্ম গ্রহণ করে। আধুনিক নৃতাত্ত্বিক গবেষণার আলোকে বলা যায়, অধিকাংশ ইয়াহুদী সেই ককেশাসের খারাজ রাজ্যের অধিবাসীদের বংশধর, বনী ইসরাঈলের নয়।
এখানে আরো উল্লেখ্য যে, তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক স্লোমো স্যান্ড তার লেখা দুটি বেস্টসেলার বই দ্য ইনভেনশন অব জুয়িশ পিপল ও দ্য ইনভেনশন অব দ্য ল্যান্ড অব ইসরাঈল-এ দাবি করেছেন, বর্তমানে যে সকল মুসলিম ফিলিস্তিনি রয়েছেন, তারাই মূলত আদি বনী ইসরাঈলের ধর্মান্তরিত বংশধর। অর্থাৎ, রোমানদের হাতে ক্ষমতা হারানোর পর যেসকল বনী ইসরাঈল ফিলিস্তিনে ছিলেন, তাদের পরবর্তী বংশধররাই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। এদের অনেক মধ্যখানে খ্রিষ্টধর্মও গ্রহণ করেছিলেন। তাছাড়া খোদ ঈসা (আ.)ও ফিলিস্তিনেরই সন্তান। ফলে মুসলিম ও খ্রিষ্টানরাই যে আদি-ফিলিস্তিনি, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
উপরের আলোচনা থেকে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, আধুনিক ইয়াহুদীরা বনী ইসরাঈলের সরাসরি বংশধর নয়, এবং ফিলিস্তিনি ভূমির সাথে ঐতিহাসিকভাবে তাদের কোন ধরনের সম্পর্ক নেই। বনী ইসরাঈলের অধিকাংশ উত্তরপুরুষ বর্তমানে খ্রিষ্ট অথবা ইসলাম ধর্ম অনুসরণ করে। ফলে ইয়াহুদীদের পূর্বপুরুষের ভূমিতে ফিরে আসার যে দাবি তারা করছে, তা সর্বৈব মিথ্যা।
এতদসত্ত্বেও, উনিশ শতকের শেষের দিকে ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফিলিস্তিনের কর্তৃত্ব তখন উসমানী খলীফাদের হাতে, তারা ইয়াহুদীদের এ উদ্যোগ বুঝতে পেরে আগে থেকেই সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শুরু করেন। ইয়াহুদীদের জায়নবাদী আন্দোলন প্রতিষ্ঠারও বহু আগে, ১৮৭১ সালে উসমানীরা ফিলিস্তিনের ৮০ শতাংশ ভূমিকে রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ঘোষণা করে, যাতে ইয়াহুদীরা কোনোভাবেই ফিলিস্তিনের ভূমি ক্রয় করে সেখানে ঘাটি গাড়ার সুযোগ না পায়। ১৮৮৩ সালে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ফিলিস্তিনে ইয়াহুদী বসতি প্রতিরোধে আরো কঠোর ভূমিকা গ্রহণ করেন, ফিলিস্তিনে ইয়াহুদীদের জমি ক্রয় নিষিদ্ধ করেন, এবং ফিলিস্তিনের কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলসমূহ সরাসরি তাঁর অধীনে নিয়ে আসেন। এরই মধ্যে ১৮৯৩ সালে জায়োনিস্টদের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডে। উসমানীদের সক্রিয়তাও আরো বৃদ্ধি পায়। ১৯০০ সালে সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ ইয়াহুদীদের অপতৎপরতা রোধে আইন জারি করেন যে কোনো বহিরাগত ইয়াহুদী ফিলিস্তিনে ৩০ দিনের বেশি অবস্থান করতে পারবে না।
১৯০১ সালে জায়নবাদী আন্দোলনের নেতা থিওডোর হার্জল সুলতান আব্দুল হামিদের নিকট প্রস্তাবনা পেশ করে যে, ফিলিস্তিন তাদেরকে দিয়ে দেওয়া হোক। এর বিনিময়ে তারা উসমানীদের সকল বৈদেশিক ঋণ শোধ করে দেবে। উসমানী খেলাফত তখন বৈদেশিক ঋণের ভারে জর্জরিত ছিল। তা সত্ত্বেও সুলতান আব্দুল হামিদ এ প্রস্তাবনা প্রত্যাখ্যান করেন। পরের বছর আবার একই প্রস্তাব পেশ করা হলে সুলতান জানিয়ে দেন, “ফিলিস্তিন আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, এটি খেলাফতের অধীন সকল জনগণের। আমরা এটি রক্তের বিনিময়ে অর্জন করেছি। আমরা যেভাবে অর্জন করেছি, কেবল সেভাবেই (অর্থাৎ রক্তের বিনিময়ে) আমরা এটি বিসর্জন দিতে পারি। ”
১৯০৯ সালে তরুণ তুর্কিরা বিদ্রোহ করে সুলতান আব্দুল হামিদকে ক্ষমতাচ্যূত করে। তরুণ তুর্কিদের আন্দোলনের সাথে অনেক ইয়াহুদী জায়নবাদী সম্পৃক্ত ছিল। সুলতান আব্দুল হামিদ ফিলিস্তিনের ভূমি রক্ষার্থে যেসকল বিশেষ আইন করেছিলেন, আব্দুল হামিদ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সেসকল আইন বাতিল করা হয়। মূলত এরপর থেকে ফিলিস্তিনে ইয়াহুদী বসতি স্থাপনের সুযোগ তৈরি হয়।
এ বিষয়ে সুলতান আব্দুল হামিদ শাযুলী তরীকার শাইখ আবু শামাত মাহমুদকে চিঠি লিখে বিস্তারিত জানান। উল্লেখ্য সুলতান নিজেও শাযুলী তরীকার অনুসারী ছিলেন। ১৯১৩ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের ঐ চিঠিতে সুলতান জানান, ইয়াং টার্ক গ্রুপ তাঁকে ফিলিস্তিনে ইয়াহুদী বসতি স্থাপনের অনুমতি দিতে বলে। তিনি তাদের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করলে তারা তাকে ১৫০ মিলিয়ন ব্রিটিশ স্বর্ণ মুদ্রার বিনিময়ে এ ইয়াহুদী বসতির অনুমতি দিতে বলে। তখন তিনি তাদেরকে জানিয়ে দেন, সারা দুনিয়ার সকল স্বর্ণের বিনিময়েও ফিলিস্তিনের বিষয়ে একটুও ছাড় দেওয়া সম্ভব নয়। মূলত এ কারণেই সুলতান আব্দুল হামিদকে সিংহাসনচ্যুত করা হয়।।
জায়নবাদীরা সুলতান আব্দুল হামিদের পতনের পর নব-উদ্যমে তাদের কার্যক্রম এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী আর্থার বেলফোরের সাথে তারা চুক্তি করে। সে চুক্তি অনুসারে ১৯১৭ সালে বেলফোর সাহেব ঘোষণা দেন, ফিলিস্তিনে ইয়াহুদীদের জন্য একটা জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তখনও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল, ফিলিস্তিন তখনও তুর্কিদের হাতেই ছিল। এরপর ১৯১৮ সালে তুর্কিদের পরাজিত করে ব্রিটিশ বাহিনী ফিলিস্তিন দখল করে। ফলে বেলফোর ঘোষণা বাস্তবায়নের সুযোগ চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে।
ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের হাতে চলে যাওয়ার পর থেকে ইয়াহুদীরা অবাধে ফিলিস্তিনের জমি কিনতে শুরু করে। তাছাড়া সুলতান আব্দুল হামিদ যে সকল জমি নিজের অধীনে রেখেছিলেন, সে জমিগুলোও এই সময়ে ব্রিটিশদের হাতে চলে আসে। এই কয়েক দশকে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইয়াহুদীরা ফিলিস্তিনে এসে বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। ফিলিস্তিনিরা তাদের অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে ইয়াহুদীদের নিকট উচ্চমূল্যে জমি বিক্রি করতে থাকে। ফলে ১৯৪৭ সালের মধ্যেই ফিলিস্তিনের অর্ধেক জনসংখ্যা হয়ে পড়ে ইয়াহুদী এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ভূমিও ইয়াহুদীদের দখলে চলে যায়।
তখনো ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের হাতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে তারা চলে গেলে ফিলিস্তিনে কী হবে না হবে, তা নিয়ে অনেক কথাবার্তা চলছিল তখন। ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘে সিদ্ধান্ত হয় ফিলিস্তিনে একটি আরব রাষ্ট্র হবে, একটি ইয়াহুদী রাষ্ট্র হবে আর জেরুজালেম হবে আন্তর্জাতিক শহর। কিন্তু এসব কেতাবেই থাকে। ব্রিটিশরা ফিলিস্তিন থেকে চলে যাওয়ার মুহূর্তে ১৯৪৮ সালে ১৪ মে ইয়াহুদীদের নেতা ডেভিড বেনগুরিয়ন ইয়াহুদী রাষ্ট্র ইসরাঈল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সে সময়ের প্রায় সকল পরাশক্তি বলতে গেলে কোন ধরনের বিলম্ব না করেই ইসরাইল রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়।
আরবদের পক্ষে ইসরাঈল রাষ্ট্র মেনে নেওয়া কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। ১৯৪৮ সালেই প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৭ ও ১৯৭৩ সালে আরো দুটি যুদ্ধ হয়। এসকল যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের পর ইসরাঈল রাষ্ট্রের ভিত্তি আরও শক্তিশালী হয়। চলতে থাকে জোরপূর্বক ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে ইয়াহুদী বসতি নির্মাণ। এক সময় ১৯৪৮ সালের ইসরাঈল রাষ্ট্রকে মানতে না চাইলেও এখন ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পর ইসরাঈলের যে আয়তন হয়েছে, সেই আয়তনে ইসরাঈলকে মেনে নিয়ে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের কথা বলা হচ্ছে। গাজা ছাড়া পুরো ফিলিস্তিনজুড়ে এখন একের পর এক ইয়াহুদী বসতি স্থাপিত হচ্ছে, উচ্ছেদ করা হচ্ছে ফিলিস্তিনিদেরকে। সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাঈলের এই জবরদখল পশ্চিমাদের চোখে কেবলই ‘আত্মরক্ষা’!
ফিলিস্তিন ইস্যু এখন আর আরবদের নিকট খুব গুরুত্বপূর্ণ নয়। হয়তো বিশ্ববাসীর কাছেও নয়। তবু ফিলিস্তিনিরা লড়ে যাচ্ছে অবিরত, নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন নিয়ে, আল-আকসাকে আর পবিত্র শহর আল-কুদস তথা জেরুজালেমকে স্বাধীন করার স্বপ্ন নিয়ে।