বালাগাল উলা বিকামালিহী, কাশাফাদ্দুজা বিজামালিহী, হাসুনাত জামিউ খিসালিহী, সাল্লু আলাইহি ওয়া আলিহী, মাউলা ইয়া সাল্লি ওয়া সাল্লিম দাইমান আবাদা, আলা হাবীবিকা খাইরিল খালক্বি কুল্লিহিমি; শেখ সাদী, ইমাম বুসিরী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মতো নাম জানা-অজানা, এমন অসংখ্য-অগণিত হৃদয়কে শান্ত করা নাত বা শায়িরী, প্রশস্তি যার শানে লিখে অমর হয়ে আছেন রাসূলপ্রেমিক অগণিত শায়ির, মুমিন হৃদয়ের সেই আকাঙ্ক্ষার বাতিক, নূরুম মিন নূরিল্লাহ, পিয়ারা রাসূল, আহমদ মুজতবা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আগমনের মুবারাক মাস রবীউল আউয়াল ফিরে এসেছে আমাদের আঙিনায়। মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে বিশ্ববাসীর জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান উপহার মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবীউল আউয়ালের এক সোনালি প্রভাতে পৃথিবীর সকল আলোকে ছাপিয়ে তাঁর নূরানী আভায় আলোকিত করেছিলেন এই বিশ্বভূখণ্ডকে। যে আলোয় আলোকিত হয়েছিলো রোম থেকে পারস্য, আরব থেকে আযম। পৃথিবী যেন অন্য এক বর্ণিল আলোকচ্ছটায় রঙিন হয়েছিলো। পশু-পাখি, বৃক্ষরাজি, চন্দ্র-সূর্য-তারকারাজি তাদের অব্যক্ত কণ্ঠে গেয়ে উঠলো আনন্দের গান,-আমাদের জাতীয় কবি তাদের সেই গানকেই যেন কলমের কালিতে রূপায়িত করেছেন কবিতার বর্ণিল ছন্দে,
‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদও দোলে।’
তাঁর আগমনে কাঁপন ধরলো সকল যালিমের তখতে। দিশেহারা পথিক খুঁজে পেলো তার হারিয়ে ফেলা পথ। পাপের উল্লাসে মেতে থাকা অপপ্রলাপকারীর মগজ ধোলাই হলো মুহাম্মদী সুধায়। তাঁর আগমনে ঘোড়ার দঁড়িতে গলা পেঁচিয়ে টেনেহিঁচড়ে চলতে থাকা নারী পেলো মুক্তির স্বাধীনতা ও সম্মানের অমীয় সুধা। জন্মের পর যে কন্যাসন্তানের ললাটের নিয়তি ছিলো পাপিষ্ঠ পিতার হাতে জীবন্ত মাটিচাপা, অবলা-অবুঝ সেই কন্যাসন্তানের বাবাকে সেই সন্তানেরই বদৌলতে জান্নাতের মালিক বলে ঘোষণা দিলেন পিয়ারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। আজকের ভোগবাদী সমাজে নারীর স্বাধীনতা, নারী মুক্তি বলে যারা বুলি কপচান, দেয়ালে-দেয়ালে কিংবা বিলবোর্ডের ফ্রেমে তারাই আবার নারীর নগ্নরূপী শামিয়ানা টাঙিয়ে রাখেন, ভোগ-বিলাসিতার পণ্য হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন সম্মানিতা নারীকে। অথচ রাহমাতুল্লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১৫ শতাব্দী আগেই নারীকে সমাসীন করেছেন সম্মানের সিংহাসনে। বিধবা রমনীর মলিন মুখকে করেছেন উচ্ছ্বসিত, পিতার সম্পত্তি থেকে মেয়েকে দিয়েছেন তাঁর প্রাপ্য, স্বামীর কাছে তাকে করেছেন অর্ধাঙ্গী, সন্তানের কাছে মাকে করেছেন বাবা থেকে তিনগুণ সম্মানের অধিকারী। নারী যে সমাজে অপাংক্তেয় নয়, কথার সাথে সাথে কাজের মিছালও তৈরি করেছেন প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
জাতীয় কবি লিখেছেন ‘ইসলাম সে তো পরশ-মানিক তাকে কে পেয়েছে খুঁজি?’ বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হেরার অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে ইসলাম নামক যে আলোর দ্যুতি মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছিয়েছেন সেই দ্যুতি শিখিয়েছে মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখা, ভেদাভেদের ফাঁক-ফোকর থেকে বেরিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাই-ভাই হিসেবে সমাজে অবস্থান করা। সুবিন্যস্ত সেই সমাজ কাঠামোয় থাকবে না কোন দ্বিধা-সংশয়, হানাহানি-হিংসা। দ্বীনের সুমহান আদর্শের পতাকাতলে জড়ো হওয়া মুমিনগণ শুধুমাত্র নিজেদেরকেই নিয়ে ব্যস্ততার প্রহর কাটাবেন না, বরং অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণে উদারনৈতিক তথা পরধর্মসহিষ্ণু হবেন, বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবনভর এই নির্দেশনার প্রদীপ জ্বলন্ত ছিলো।
সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্রব্যবস্থা-অর্থনীতি; প্রতিটি ক্ষেত্রে দুজাহানের বাদশাহর ছিলো স্পষ্টতর নির্দেশনা। দক্ষ হাতের সূক্ষ্মতর বুদ্ধিদীপ্ত বুননে তিনি গড়েছিলেন বিশ্ব-সভ্যতা। সেখানে ছিলোনা আজকের তথাকথিত সন্ত্রাসবাদী চিন্তাধারার পুঁজিবাদ, ছিলো না অসহিষ্ণুতা, বকধার্মিকতার নাগপাশ, কিংবা বিভেদের চিন্তাধারা।
বছর ঘুরে সরওয়ারে কায়েনাতের জন্মের মাহিনা আমাদের মাঝে এসেছে। বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে আদর্শ ও জীবনপদ্ধতি আমাদের মাঝে রেখে গেছেন, আমরা তা প্রায় বিস্মৃত হতে চলেছি। আইয়ামে জাহিলিয়্যাতের ভঙ্গুর সমাজব্যবস্থা মুছে গেছে বিশ্বনবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ম্যাজিকাল আদর্শের প্রভাবে; অনৈতিকতার মরুভূমিকে রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর ভালোবাসা দিয়ে গড়েছিলেন সাজানো সবুজাভ কানন। অথচ আমরা সে সর্বোত্তম আদর্শ ভুলেছি ,আমরা মজেছি ভীনদেশি সংস্কৃতির ছাইপাশে। ভুলেছি বলেই আজ আমাদের নবীকে নিয়েই আমরা শুনি কটুবাক্য, কটুকথা। এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে আমাদেরকে আবার জেগে উঠতেই হবে। উসওয়ায়ে হাসানার ভিত্তিতে সমাজ বিনির্মাণে দ্বীনকে আঁকড়ে ধরতে হবে সাহাবায়ে কিরামের মতো করেই।
আল্লাহর শ্রেষ্ঠ নিআমত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের স্মরণ ও আনন্দের এই ক্ষণে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়াতে পারে শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহ, এই মাহিনায় এক কাতারে এসে সুরে সুর মিলিয়ে যেন গাইতে পারে “ত্বালাআল বাদরু আলাইনা।” এটাই আমাদের প্রত্যাশা।