বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আয়তনে ক্ষুদ্র কিন্তু জনসংখ্যায় অষ্টম বৃহত্তর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ। সময়ের আবহে দেশটি বিভিন্ন শাসনের অধীনে ছিল। ব্রিটিশ বেনিয়াদের থেকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত হয়ে বাংলাদেশ পাকিস্তানের অংশ হয় পূর্ব পাকিস্তান নামে। পাকিস্তানের অংশ ছিল দীর্ঘ ২৩ বছর। পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নানাপ্রকার বৈষম্যে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ আশাহত হয়। সর্বপ্রকার বৈষম্যের বিলুপ্তি, পরিপূর্ণ নাগরিক অধিকার, ন্যায্যতা ও একটি স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ একটি দীর্ঘ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান থেকে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়। গত বছরেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে, কিছুদিনের মধ্যে পালিত হবে একান্নতম বিজয় দিবস। স্বাধীনতার অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় পার করেও বাংলাদেশ কি তার প্রত্যাশা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছে?
দেশের সংবিধান অনুযায়ী জনগণই দেশের মালিক এবং তারাই নির্ধারণ করবে দেশ কারা শাসন করবে। জনগণ পূর্ণ চিন্তার স্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাবে। কিন্তু দেশের মানুষ কতটুকু স্বাধীনতার সুফল পাচ্ছে? স্বাধীনতার এত বছর পরও কি মানুষ প্রকৃত অর্থে স্বাধীন? ফ্রিডম হাউজ রিপোর্ট অনুযায়ী, স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৯/১০০, রাজনৈতিক স্বাধীনতায় ১৫/৪০ এবং নাগরিক স্বাধীনতায় ২৪/৬০। যেখানে উন্নত বিশ্বে চাকরি ছাড়া একমাসও কল্পনা করতে পারেনা তাদের সরকার, সেখানে দেশে চাকরিহীন লাখ লাখ বেকার।
দেশ ও জাতির প্রতি প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে নেতৃত্বের অটল অবস্থান যেখানে কাঙ্খিত ছিল, তা যথাযথ না ঘটায় তিন দশকেরও উর্ধ্বকালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক মুক্তি, সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং সামগ্রিক সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি, যেখানে এ সময়কালের মধ্যেই অনেক দেশ অভাবনীয় উন্নতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও সম্মানজনক সহাবস্থানের নীতি অনুসরণ যেখানে কাম্য ছিল, দলের উর্ধ্বে যেখানে দেশ ও জাতির স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান পূর্বশর্ত ছিল, সেখানে পারস্পরিক কোন্দল ও ধ্বংসাত্মক ভূমিকার ফলে আমরা কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়েছি। বারবার আমাদের পেছনে পড়তে হয়েছে; দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে জনজীবন বিপর্যস্থ হয়েছে।
যদি সুশাসন প্রতিষ্ঠা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈদেশিক আগ্রাসন রোধ এবং দ্রব্যমূল্যকে জনগণের নাগালে নিয়ে আসা যায় তবে স্বাধীন দেশের কাঙ্খিত ফল জনগণ ভোগ করতে পারবে।
…
শিক্ষা; একটি ছোট শব্দ হলেও শব্দটি খুবই অর্থবহ। শিক্ষা একটি দেশ ও জাতির অগ্রগতির মূল চালিকাশক্তি। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড- প্রায় সকলেই এই বাক্যটি সম্পর্কে জানেন। কোনো জাতির উন্নয়ন ও মূল্যবোধ গড়ে ওঠা এবং সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া নির্ভর করে তার উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা ও সুসংগঠিত শিক্ষা কাঠামোর উপর। আবার একটি জাতির শিক্ষাব্যবস্থাকে ধ্বংস করার মাধ্যমে জাতির মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া যায়, তার স্বকীয়তা ও আত্মমর্যাদাবোধ লোপ করে দেওয়া যায়, এমনকি বাধাহীন পরাধীনতার শৃঙ্খল পরানো যায়। এজন্য কোন জাতিই তার শিক্ষাব্যবস্থায় অন্যের হস্তক্ষেপ সহ্য করেনা। ভারতীয় উপমহাদেশে দুইশ বছরের পরাধীনতার অন্যতম যন্ত্রণা ছিলো এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পশ্চিমাকরণ, যা এদেশের সচেতন ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষ কখনোই মেনে নেয়নি, বরং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সচেষ্ট হয়েছে, যার ফলশ্রুতিতে একদিন ব্রিটিশরা এই দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল।
দুঃখজনক হলেও সত্য, এই প্রবণতা স্বাধীন বাংলাদেশের শিক্ষাক্রমেও লক্ষ্য করা গেছে বিভিন্ন সময়ে। স্বাধীন বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতা সময়ে সময়ে লক্ষ্য করা যায়। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক সর্বশেষ প্রণীত শিক্ষাক্রম রূপরেখা ২০২০ এর আলোকে প্রস্তুতকৃত পাঠ্যবই পরীক্ষামূলকভাবে ২০২২ সালে দেশের কয়েকটি স্কুল ও মাদরাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে চালু করা হয়। উক্ত পাঠ্যবইসমূহ পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় মূল্যবোধ, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সাথে পাঠ্যবইয়ের অধিকাংশ বিষয়বস্তুর মিল নেই। উদাহরণস্বরূপ ৬ষ্ঠ শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ে ডারউইনের বিবর্তনবাদ, দাড়িবিশিষ্ট মানুষকে ভাল্লুকের সাথে উপমা দেওয়া ও কিছু মুসলিম নামকে হেয় করা হয়েছে। উক্ত বইয়ে বিভিন্ন ধর্মের মন্দির ও কাল্পনিক মন্দিরের ছবি সংযুক্ত করা হলেও মুসলিম সভ্যতার কোন নিদর্শনের বর্ণনা ও ছবি সংযুক্ত করা হয়নি। বিজ্ঞান বইয়ে বিজ্ঞানের সাথে পুরাণের মিল দেখানো হয়েছে। অনুরূপভাবে প্রায় প্রতিটি বইয়েই ইসলামী ও সামাজিক মূল্যবোধকে উপেক্ষা করার প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এ পাঠ্যপুস্তকগুলো আমাদের শিক্ষার্থীদেরকে ভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার দিকে ধাবিত করতে পারে। তাদের চিন্তা-চেতনায় নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্মীয় চেতনা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য লালনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। একটি আত্মবিশ্বাসী, ঐতিহ্য সচেতন ও মূল্যবোধসম্পন্ন প্রজন্ম গঠনে শিক্ষাক্রম থেকে আপত্তিকর বিষয়সমূহ অপসারণ করা আবশ্যক। পাশাপাশি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও ধর্মীয় মূল্যবোধের যথাযথ প্রতিফলন ঘটিয়ে শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করা সময়ের দাবি।