একটা সময় ছিলো যখন আমাদের ঘরে ঘরে বিরাজ করতো দ্বীনি পরিবেশ। ফজরের মোহনীয় স্নিগ্ধতা আমাদের স্পর্শ করতো। মুয়াযযিনের ‘আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম’ আমাদের হৃদয়কে প্রশান্ত করতো, সেই প্রশান্ত হৃদয় ছুঁটে যেত মসজিদ পানে। আধো-আলোয় পড়া নামায দিয়ে শুরু হতো নিত্যদিনের কার্যক্রম। সকালবেলায় পবিত্র কুরআনের ধ্বনিতে মুখরিত থাকতো প্রতিটি ঘর। কচিকাঁচারা ঘুম থেকে উঠে যেত সূর্য ওঠার আগেই মক্তবে যাবে বলে। সূরা ইয়াসীন পড়ে পড়ে গৃহিণী-কিষাণীরা তৈরী করতেন পরিবারের সকালের নাশতা। সবুজ ঘাসের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা মেঠোপথে চাষিরা ছুটতেন লাঙল নিয়ে কৃষিকাজে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর কবিতার মতোই ‘সকালবেলার পাখি’ হতে চাইতেন সকলেই।
সেই দিনগুলো এখন আমাদের থেকে অতীত হয়ে গেছে। প্রযুক্তির আড়ম্বরে আমরা ঝুঁকেছি ডিজিটালাইজেশনের আলোকচ্ছটায়। বিদ্যুতের আলোর ঝলকানি আমাদের কাছ থেকে রাতকে কেড়ে নিয়েছে। আমরা এখন দিন থেকে বেশি রাতনির্ভর হয়ে পড়েছি। প্রযুক্তি আমাদের ঘরে প্রবেশ করেছে ঠিকই, কিন্তু আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে দ্বীনি পরিবেশ। পবিত্র কুরআনের বদলে সকালবেলায় আমরা ঝুঁকি ফেইসবুকে।
সম্প্রতি দেশে গ্যাস ও জ্বালানি সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদন চরমভাবে ব্যাহত হওয়ায় লোডশেডিং প্রকট আকার ধারণ করেছে। সরকার খুঁজছে এর থেকে পরিত্রাণের উপায়। ইতোমধ্যে সরকার বেশকিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করেছে। যদিও পদক্ষেপ নিতে গিয়ে দুর্নীতির উপর নযর না গিয়ে মসজিদের এসির দিকে নযর পড়া দুঃখজনক। আমাদের ঘরে ঘরে একসময় হারিকেন বা কুপিই ছিলো একমাত্র আলোর উৎস। লোডশেডিং সেই সময়ে কিছুটা হলেও আমাদেরকে ফিরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু লোডশেডিং আমাদেরকে দ্বীনি পরিবেশসমৃদ্ধ ফেলে আসা অতীতেও নিয়ে যেতে পারে। সেটা কিভাবে হতে পারে? বিদ্যুৎ সংকট নিরসনের কার্যকরী একটি পদক্ষেপেই আছে এর সম্ভাবনা। এজন্য সরকারকেই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
সরকার অফিসের সময়কে বর্তমান সময়ের চেয়ে এগিয়ে নিয়ে আসতে পারে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি সময়ের ছকে বাঁধতে পারে। বর্তমানে অফিসের সময় হলো ৯টা-৫ টা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ৯টা-৩টা বা ১০টা-৪টা পর্যন্ত পাঠদান চলে। ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যক্রম শুরু হয় ১০-১১ টার দিকে,চলে রাত অবধি। অফিস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সময়কে যদি সরকার একযোগে ৬টা-১টা কিংবা ৭টা-২টা পর্যন্ত চলমান রাখে বাধ্যতামূলকভাবে, তাহলে সংশ্লিষ্ট চাকুরীজীবি ও শিক্ষার্থীরা একদিকে যেমন ভোরের স্নিগ্ধতার পরশ পাবেন তেমনি ঘরে ঘরে আবারো দ্বীনি পরিবেশ ছড়িয়ে পড়বে। সকালের সজীবতা নিয়ে সকলেই তাদের দিনের কার্যক্রম শুরু করতে পারবেন। ওদিকে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ১০টা-৭টা পর্যন্ত সময়ে যদি নিয়ে আসা যায় তাহলে অফিস, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের যে ত্রিমুখী বিদ্যুতের চাহিদা বিদ্যমান রয়েছে সেটা অনেকাংশেই কমে আসবে। অফিস-আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম যখন শেষপর্যায়ে তখন শুরু হবে বাণিজ্যের হাঁকডাক। সবকিছু শেষ হবে দিনের আলোতেই। এতে যানজট নামক এদেশীয় প্রাচীন সমস্যার কিছুটা বিলুপ্তি ঘটবে।
প্রবাদ আছে- ‘কান টানলে মাথা আসে’। সরকার যদি এ ধরনের দূরদর্শী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তাহলে সকালে তাড়াতাড়ি ওঠার স্বার্থে হলেও রাতে সকলেই তাড়াতাড়ি বিছানা গ্রহণ করবেন সাদরে। শুধুমাত্র যে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের ক্ষেত্রেই এমন উদ্যোগ ভালো ফলাফল বয়ে আনবে এমন নয় বরং আমাদের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা দূরীকরণে এই পদক্ষেপ টনিকের মতো কাজ করবে। দিনের কার্যক্রম দেরিতে শুরু হওয়ার ফলে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমোতে যাওয়ার যে অনীহা, এর ফলে তৈরি হওয়া বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা থেকেও আমরা মুক্তি পাবো। বিজ্ঞানও আমাদেরকে রাতে তাড়াতাড়ি ঘুমানোর ব্যাপারে উৎসাহিত করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। আমাদের বর্তমান প্রজন্মের রাতজাগার যে আসক্তি এসব উদ্যোগের ফলে অনেকাংশেই তা কমে আসবে।
আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সকালকে দিনের অন্যান্য সময়ের চেয়ে যথেষ্ট গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বিদেশ-বিভুঁইয়ে আমরা যখনই আমাদের বন্ধু কিংবা স্বজনকে তাদের কর্মঘণ্টা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি তখন তারা ভোর হওয়ার সাথে সাথে কাজে বেরিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। অথচ আমাদের দেশে কর্মঘণ্টা শুরুই হয় দুপুর গড়াতে শুরু করলে। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এতে একদিকে আমরা যেমন কাজকর্ম কিংবা পড়াশোনার জন্য প্রচুর সময় পাবো তেমনি কায়িক কিংবা মানসিক পরিশ্রমের পরে যে অবসরের প্রয়োজন রয়েছে সেটাও আমরা যথাযথ পাবো। মোটকথা, সকাল-বিকাল-রাত; এই তিনটি সময়ই ফিরে আসবে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যথাযথভাবে।
সরকারের কাছে বিনীত আহবান জানাই, বর্তমান প্রজন্মকে বাঁচাতে, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে জনগণকে সুখী করতে, বিদ্যুতের সংকট নিরসনে আমাদের জন্য এ ধরনের কার্যকর ও সময়োপযোগী উদ্যোগই হতে পারে নিয়ামক শক্তি। আমরা যদি কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘সকালবেলার পাখি’ হতে পারি, তাহলে দেশ যেমন লোডশেডিং থেকে মুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রাখে তেমনি দ্বীনি আলোয় আবারো আলোকিত হবে আমাদের ঘর, সংসার ও দেশ। চলুন, সরকারি পদক্ষেপের বাইরেও আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়েও এমন কিছুর সাথেই অভ্যস্ত হই।