সকল প্রশংসা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের। সালাত ও সালাম আমাদের সরদার সায়্যিদুল মুরসালীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবায়ে কিরাম সকলের প্রতি।
নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণভাবে বিনয়ীদের সরদার ছিলেন। এ সম্পর্কে তাঁর থেকে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও তাঁর স্বীয় মর্যাদা সম্পর্কে অনেক বর্ণনাও এসেছে। এগুলো মূলত দ্বীনেরই অংশ, যা তাঁর জন্য প্রচার করা আবশ্যক ছিল এবং গোপন করা বৈধ ছিল না, যাতে তাঁর উম্মত তাঁর উন্নত মর্যাদা সম্পর্কে জানতে পারে আর তাঁর প্রতি তাদের সম্মান ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। এটা তো দ্বীনের অন্তর্গত বিষয়। তাছাড়া তাঁর কথা তো আল্লাহর পক্ষ থেকে ওহী। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেন: “তিনি আপন প্রবৃত্তি থেকে কোনো কথা বলেন না। তিনি যা বলেন তাতো ওহী, যা তাঁর প্রতি অবতীর্ণ হয়।”
ইমাম শার্আরানী তদীয় ‘আল ইয়াকীত ওয়াল জাওয়াহির’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, শাইখ মুহিউদ্দীন (র.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সংবাদ দিয়েছেন যে, তিনি প্রথম শাফাআতকারী এবং তাঁর শাফাআত প্রথম গৃহীত হবে। তিনি এরূপ সুসংবাদ প্রদান করেছেন এজন্য যে, যখন কিয়ামতের মহান দিনে এক নবীর নিকট থেকে আরেক নবীর নিকট যেতে যেতে মানুষ পেরেশান হবে তখন সেই পেরেশানী থেকে যেন আমরা মুক্ত থাকতে পারি। প্রত্যেক নবীই (সেদিন) বলবেন, নাফসী, নাফসী-হায়, আমার কী হবে? হায়, আমার কী হবে? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (উক্ত হাদীসের মাধ্যমে) আমাদের জানাতে চাচ্ছেন কিয়ামতের সে (ভয়াল) দিনে তাঁর মাকাম কী হবে? যাতে আমরা তাঁর পালা আসা পর্যন্ত স্ব-স্ব স্থানে নিশ্চিন্তে ধৈর্যধারণ করে থাকতে পারি। সেদিন তিনি বলবেন: আনা লাহা, আনা লাহা-আমিই এর (শাফাআতের) যোগ্য, আমিই এর (শাফাআতের) যোগ্য। যার নিকট এ হাদীস পৌঁছেনি কিংবা পৌঁছলেও সে তা ভুলে গেছে সে পেরেশানীর মধ্যে থাকবে এবং এক নবীর নিকট থেকে আরেক নবীর নিকট যেতে থাকবে। পক্ষান্তরে যার নিকট এ বর্ণনা পৌঁছেছে এবং এটা সে কিয়ামত পর্যন্ত আঁকড়ে রেখেছে তার অবস্থা এর বিপরীত হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর প্রতি সালাত ও সালাম, উম্মতের প্রতি তাঁর কতইনা দয়া!
উক্ত হাদীসের শেষে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একথাও বলেছেন যে, এতে আমার কোনো অহংকার নেই। অর্থাৎ আমি নবী ও অন্যান্য সকল আদম সন্তানদের সরদার বলে অহংকার করছি না। এ বর্ণনা দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হলো, আমার সাথে আল্লাহ তাআলার কৃত অঙ্গীকারের আলোকে কিয়ামতের দিনের পেরেশানীতে তোমাদের আশ্বস্থ করা যে, আমিই প্রথম শাফাআত করবো এবং আমার শাফাআতই প্রথম গৃহীত হবে। সুতরাং (দেখা যাচ্ছে) এখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটি উত্তম উদ্দেশ্যে নিজের মহত্ত¡ বর্ণনা করেছেন।
প্রিয়নবীর মর্যাদা সম্পর্কে এরূপ কয়েকটি হাদীস নিম্নে উল্লেখ করা হলো।
পবিত্র বংশধারার অধিকারী
হযরত আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি হলাম মুহাম্মদ ইবন আবদিল্লাহ ইবন আবদিল মুত্তালিব ইবন হাশিম ইবন আবদে মনাফ ইবন কুসাই ইবন কিলাব ইবন মুররা ইবন কা’ব ইবন লুআই ইবন গালিব ইবন ফিহর ইবন মালিক ইবন নদর ইবন কিনানাহ ইবন খুযায়মাহ ইবনে মুদরিকাহ ইবন ইলিয়াস ইবন মুদার ইবন নিযার ইবন মা’দ ইবন আদনান। যখনই মানুষ দুভাগে বিভক্ত হয়েছে তখন আল্লাহ আমাকে তাদের উত্তমভাগে রেখেছেন। আমি আমার পিতা-মাতার মাধ্যমে জন্মগ্রহণ করেছি। জাহিলিয়াতের কোনো কলঙ্ক আমাকে স্পর্শ করেনি। আমি আদম (আ.) থেকে শুরু করে আমার পিতা-মাতার ঘরে জন্মগ্রহণ পর্যন্ত (প্রত্যেক স্তরে) বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে এসেছি; (কোনো যুগে বা কোনো স্তরে) ব্যভিচারের মাধ্যমে নয়। সুতরাং আমি তোমাদের মধ্যে বংশের দিকে সর্বোত্তম, পিতৃপুরুষের দিক থেকেও সর্বোত্তম। (বাইহাকী, দালাইলুন নবুওয়াহ)
তিনি সৃষ্টির শুরু থেকে নবী
পবিত্র কুরআন মাজীদে এসেছে যে, হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন শেষ নবী। আর ইমাম বাগাভী ‘শরহুস সুন্নাহ’ গ্রন্থে হযরত ইরবাদ ইবনু সারিয়া (রা.) থেকে, তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি তখন থেকেই আল্লাহর নিকট শেষ নবী হিসেবে নির্ধারিত যখন আদম (আ.) খামিরের মধ্যে ছিলেন।
তিনি সৃষ্টির মূল
হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন হযরত আদম (আ.) আপন ত্রুটি সম্পর্কে বুঝতে পারলেন তখন বললেন, হে আমার রব, আমি আপনার নিকট হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওসীলা নিয়ে দুআ করছি, আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ তাআলা বললেন, হে আদম, তুমি কিভাবে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে চিনলে? অথচ আমি তাকে সৃষ্টি করিনি? আদম (আ.) বললেন, হে আমার রব, যখন আপনি আমাকে নিজ হাতে সৃষ্টি করলেন, আমার মধ্যে রূহ ফুঁকলেন, তখন আমি মাথা উত্তোলন করে দেখলাম আরশের স্তম্ভে লেখা: লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। তখনই আমি বুঝতে পারলাম যে, আপনি আপনার নামের সাথে আপনার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টির নামই যুক্ত করেছেন। আল্লাহ তাআলা বললেন, হে আদম, তুমি সত্য বলেছ। নিশ্চয় তিনি আমার সবচেয়ে প্রিয় সৃষ্টি। যেহেতু তুমি তাঁর ওসীলা নিয়ে দুআ করেছ সেহেতু আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। যদি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম না হতেন তাহলে আমি তোমাকে সৃষ্টি করতাম না। (বাইহাকী, দালাইলুন নবুওয়াহ; হাকীম, আল মুস্তাদরাক। ইমাম বাইহাকী হাদীসটি সহীহ বলেছেন।)
সর্বদিক থেকে তিনি সর্বোত্তম
হযরত আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমি যুগ পরিক্রমায় আদম সন্তানদের সর্বোত্তম যুগে প্রেরিত হয়েছি। সর্বশেষ আমি এ যুগে আবির্ভূত হয়েছি। (বুখারী)
ইমাম মুসলিম ওয়াসিলা ইবনুল আসকা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) এর সন্তানদের মধ্যে কেনানাকে নির্বাচিত করেছেন, আর বনূ কেনানা থেকে কুরাইশকে নির্বাচিত করেছেন, কুরাইশ থেকে বনূ হাশিমকে নির্বাচিত করেছেন আর বনূ হাশিম থেকে আমাকে নির্বাচিত করেছেন।
ইমাম আবূ নুআইম ও তাবারানী উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে, তিনি জিবরীল (আ.) থেকে বর্ণনা করেন, হযরত জিবরীল (আ.) বলেন, আমি পৃথিবীর পূর্ব ও পশ্চিম ঘুরে বেড়ালাম কিন্তু মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে উত্তম কোনো ব্যক্তি পাইনি এবং বনূ হাশিম থেকে উত্তম কোনো বংশ পাইনি।
তিনি সর্বোত্তম সৃষ্টি
হযরত সালমান ফারসী (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হযরত জিবরীল (আ.) নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এসে বললেন, আপনার রব বলেছেন, আমি ইবরাহীম (আ.) কে খলীল হিসেবে গ্রহণ করেছি আর আপনাকে হাবীব হিসেবে গ্রহণ করেছি। আমি আপনার চেয়ে উত্তম কোনো সৃষ্টিকে সৃষ্টি করিনি। আপনার সম্মান ও মর্যাদা সম্পর্কে অবগত করার জন্য আমি দুনিয়া ও এর অধিবাসীকে সৃষ্টি করেছি। (ইবন আসাকির)
তিনি কুফুর বিনাশকারী ও শেষ নবী
হযরত জুবাইর ইবন মুতঈম (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, আমার অনেক নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি আহমদ (সর্বাধিক প্রশংসাকারী), আমি মাহী (বিনাশকারী), যার মাধ্যমে আল্লাহ কুফুরের বিনাশ সাধন করেন। আর আমি হাশির (একত্রকারী), কিয়ামতের দিন মানুষকে আমার পায়ের কাছে একত্রিত করা হবে। আর আমি আকিব (শেষে আগমনকারী), আমার পরে আর কোনো নবী নেই।
আল্লাহর নামের সাথে তাঁর নামও স্মরণ করা হয়
হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নিশ্চয় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, জিবরাইল (আ.) আমার কাছে এসে বললেন, নিশ্চয় আমার ও আপনার রব আপনাকে বলছেন: হে নবী আপনি কি জানেন, আমি কিভাবে আপনার স্মরণকে সুউচ্চ করেছি। আমি বললাম: আল্লাহই অধিক জানেন। আল্লাহ বললেন, যখন আমাকে স্মরণ করা হয় তখন আপনাকেও আমার সাথে স্মরণ করা হয়। (তাবারানী ও ইবন হিব্বান। ইবন হিব্বান এ হাদীসটি সহীহ বলেছেন)