1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
কারবালা দিবস : আল্লামা ওজিহ উদ্দিন রামপুরী (র.) এর একটি অভিভাষণ
অনুবাদ: আল্লামা মো. ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
  • ২০ জুলাই, ২০২৫

২৮ অক্টোবর ১৯৮২ ইংরেজি, ১০ মহর ১৪০০ হিজরী, বৃহস্পতিবার ভোর ৮ টায় ভারতের রামপুরস্থ আঙ্গুরীবাগ জামে মসজিদে শহাদায়ে কারবালা ও ইমাম হসাইন (রা.) এর স্মরণে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। খতীবেম আল্লামা ওজীহ উদ্দীন (মুহাদ্দিস রামপুর আলীয়া মাদ্রাসা) কারবালার শহীদদের এই স্মরণ মাহফিলে ভাষণ দেনসম্পাদক

নাহমাদুহু ওয়ানুছাল্লি আলা রাসূলিহিল কারীম, সুধীমণ্ডলী, আজ ১০ মহররম। সায়্যিদুশ শুহাদা ইমাম হুসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের দিন। তাই আজ সর্বত্র শাহাদাতের আলোচনা। হ্যাঁ, তবে কোথাও বিশুদ্ধ পদ্ধতি আবার কোথাও ভুল পদ্ধতিতে। যা হোক, হুসাইনের আলেচনাকে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে।

হুসাইন হলেন, আলী ও ফাতিমা (রা.)- এর আদরের সন্তান, খাতামুন্নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র, ইমাম হাসানের সহোদর, যয়নুল আবিদীনের পিতা। মোটকথা- চতুর্দিক থেকেই তিনি সম্মানিত। এতসব বৈশিষ্টের অধিকারী হুসাইনের জন্য আল্লাহ তাআলা অন্য একটি বিরল বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। যেন আল্লাহ তাআলা হুসাইনকে ডেকে বললেন, আমি তোমাকে উপঢৌকন হিসেবে গ্রহণ করতে চাই। আল্লাহ তাআলা বাণী প্রদান করেছেন, হে মুসলমানগণ। ‘আমি তোমাদের নিরীক্ষণ করব কখনো ভয়ভীতি দ্বারা আবার কখনো ক্ষুধার দ্বারা, আবার কখনো সম্পদ হ্রাস করে। কখনো ফসলের ক্ষতি করে।’ কিন্তু হে মুহাম্মদ e, আপনি বলে দিন আমি পরীক্ষা গ্রহণ করে দেখব কে ধৈর্য্য ধারণ করে, ‘যদি তারা ধৈর্য্য ধারণ করে তবে তাদের শুভসংবাদ দান করুন।’ যে আমার পক্ষ থেকে রয়েছে তাদের জন্য রহমত, আর এরাই হিদায়াতপ্রাপ্ত।

হুসাইনের বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলী সামনে রেখে আমরা দেখতে পাই তিনি বিভুঁই বিদেশে মাটিতে নিপতিত, সর্বস্ব লুণ্ঠিত। অথচ তিনি আল্লাহর হাবীবের দৌহিত্র হযরত আলী ও ফাতিমা (রা.) এর আদরের দুলাল। লক্ষণীয় বিষয় হলো এই যে, ইমাম হুসাইনের উপর পর্যায়ক্রমে আঘাতের পর আঘাত এসেছে। পিতা হযরত আলী (রা.) ইরাকে শাহাদাতবরণ করেন। সকলেরই জানা আছে যে খারিজীদলের ইবন মুলজিম নামক এক নামুরাদী (অবাঞ্ছিত ব্যক্তি) তাকে হত্যা করেছিল। যদিও সে সাবাঈ গোত্রের লোক ছিল, কিন্তু আমরা তাকে নামুরাদী বলেই আখ্যায়িত করব। হযরত আলী (রা.) যে কতবড় ধৈর্যশীল ছিলেন তার শাহাদাতকালীন সময়ের মূল্যবান ভাষণেই এর পরিচয় মিলে। তিনি বললেন, যা কিছু হওয়ার হয়ে গেছে। আমি ঘাতকের হাতে আহত হলাম, যাতনা ভোগ করলাম আল্লাহ তাআলার জন্য। আমি তো নামাযের উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘরে এসেছিলাম। অল্লাহ তাআলা যেন বললেন, হে আলী, তোমার নামায মকবূল। কেননা কারো দাঁড়ানো মকবূল, কারো রুকু মকবূল, কারো সিজদা মকবূল, কিন্তু তোমার প্রাণ আমার কাছে মকবূল।

হুসাইনের অন্তরে একটি আঘাত হলো পিতা আলী (রা.) এর শাহাদাত, দ্বিতীয়টি হলো ইমাম হাসানের শাহাদাত। ইমাম হাসানকে একাধিকবার বিষ প্রয়োগ করা হলো, শেষবারে এমন ভয়ানক বিষ প্রয়োগ করানো হলো যে তাঁর নাড়িভুঁড়ি খণ্ড খণ্ড হয়ে বের হয়ে আসল। তাই হুসাইনকে ডেকে বললেন, বিষ আমাকে বারবার প্রয়োগ করানো হয়েছে কিন্তু এবারে যে বিষ প্রয়োগ করানো হয়েছে তা এত ভনায়ক যে, আমার বেঁচে থাকার কোনো আশা নেই। যদি কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে আমার মনে কোনো ধারণা পোষণ করে থাকি তবে তা ভুলও হতে পারে শুদ্ধও হতে পারে। যদি শুদ্ধ হয় তবে তার পরিণাম ফল আল্লাহর তরফ থেকে তাকে অবশ্যই ভোগ করতে হবে, যদি আমার ধারণা ভুল হয় তবে নিরপরাধ ব্যক্তিকে ক্ষতি সাধন করে আমি কেন তার উপর যুলম করতে যাব? হুসাইন, তুমি কখনো এর প্রতিশোধ গ্রহণ করবে না কেননা আলী (রা.) ধৈর্য্যধারণ করেছেন। তৃতীয় আঘাত এভাবে আসলো যে- যখন পরিস্থিতি তাঁকে মদীনা ত্যাগ করতে বাধ্য করল, তিনি মদীনা ত্যাগ করে ইরাকের পথে রওয়ানা হলেন। মুসলমানের জন্য বিশেষতঃ মুহাম্মদ মোস্তফা e -এর পরিজনের পক্ষে মদীনা ত্যাগ করা ছিল কিয়ামততুল্য এবং গভীর বেদনাদায়ক।

কিন্তু অবস্থা তাঁকে বাধ্য করল। তিনি মদীনা ত্যাগ করলেন, মদীনা ত্যাগ করার প্রাক্কালে তিনি রাসূলুল্লাহ e-এর রাওদ্বা শরীফের সামনে দাঁড়িয়ে আকুল কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলেন। হুযুরের দরবারে সালাত ও সালাম পেশ করেছিলেন। অন্তরের অবস্থা যে কী হয়েছিল তা বলা মুশকিল। মদীনার গোরস্থান জান্নাতুল বাকীতে হযরত ফাতিমা (রা.) শায়িত। রাসূলুল্লাহ e এর দরবার, মা ফাতিমার কবর পিছনে পড়ে রইল, তিনি এগিয়ে চললেন কারবালার দিকে। পথিমধ্যে সংবাদ পেলেন তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম ইবন আকিল শাহাদাতবরণ করেছেন। শুধু তিনি নন তার দুটি নাবালক সন্তানকেও যবাই করা হায়েছে। হায় ইমাম! মুসলিমের শাহাদাত একটি আঘাত, উপর্যুপরি আরও দুটি আঘাত এবং মুসলিমের দুটি সন্তানের শাহাদাত। মোটকথা- আঘাতের পর আঘাতে মর্মাহত হৃদয় নিয়ে তিনি অবশেষে পৌঁছলেন ফুরাতের তীরে কারবালা প্রান্তরে। শত্রু পরিবেষ্টিত অবস্থায় তিনি তাবুতে অবস্থান করছেন। শত্রুদের সাথে সন্ধির সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্ঠা ব্যর্থ হল। ঘটনাটি সুপ্রসিদ্ধ যে, হুসাইনের শিশু পুত্র আলী আসগর পিপাসা কাতর ওষ্ঠাগতপ্রাণ, হুসাইন শত্রুদের সম্বোধন করে বললেন, যদি দোষ করে থাকি তবে আমি করেছি- আমার এ শিশু সন্তান নিরপরাধ, নিষ্পাপ। অনুত্তরে শত্রুদের পক্ষ হতে একটি তির এসে বিদ্ধ হলো কচি আসগরের বক্ষে। সঙ্গে সঙ্গে শাহাদাতবরণ করলেন আলী আসগর।

আঘাতের পর আঘাতে জর্জরিত ইমাম হুসাইন। ইমামের বিগ্রহ যাতনা অব্যাহত ধারায় চলতে থাকলো। তাবুগুলি ভূলুণ্ঠিত হলো। আল্লাহ যেন বললেন, হুসাইন! বস্তুনির্মিত তাবুগুলি ধ্বংস হয়ে গেল, তোমার পার্থিব সম্পদ লুণ্ঠন করা হলো, কিন্তু তোমার জন্য নির্ধারিত জান্নাত তো কেউ লুণ্ঠন করেনি। তুমি আমার সান্নিধ্যে আসবে- সে আগমন হবে কতইনা জৌলুসপূর্ণ। জান্নাতে হুর অভ্যর্থনা জ্ঞাপণ করবে তোমাকে- ফিরিশতাকুল নিয়ে যাবে তোমায় এগিয়ে। হুসাইন তোমার সর্বস্ব লুণ্ঠন করা হয়েছে। তুমি নিঃশেষ হয়ে গেলে আমিতো সবকিছুরই প্রত্যক্ষদর্শী। হাদীস শরীফে উল্লেখ করা হয়েছে শহীদগণের আত্মা নীলবর্ণের পাখির মধ্যে অবস্থান করবে, এবং জান্নাতে যথেচ্ছ ভ্রমণ করে চলবে। আল্লাহ তাআলা শহীদগণকে সাম্বোধন করে বলবেন, হে শহীদ, তোমার কোনো আকাঙ্ক্ষা থাকলে আমার সমীপে নিবেদন কর, তাঁরা উত্তরে বলবেন, পরওয়ারদেগার, আমাদের আকাঙ্ক্ষার বস্তু আর কী হতে পারে? তুমি আমাদের জান্নাত দান করেছ, অবস্থানের সকল সামগ্রী দান করেছ, অবস্থানের জন্য দান করেছ আরশের নিচে পিঞ্জরা। আমরা তোমার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়ে যারপর নাই আনন্দিত। দয়াময় আল্লাহ, আমরা চাই যদি তুমি আমাদের পুনর্জীবন দান কর, তবে আমরা পুনরায় তোমার জন্য প্রাণ বিসর্জন দিব, আবার যদি জীবিত কর আবার প্রাণ দিব। রাসূলুল্লাহ e বলতেন, আমার ইচ্ছা যেন আমি আল্লাহর পথে শাহাদাতবরণ করি, পুনরায় জীবিত হই, পুনরায় শাহাদাতবরণ করি পুনরায় শহীদ হই, পুনরায় শাহাদাতবরণ করি, পুনরায় শহীদ হই, পুনরায় শাহাদাতবরণ করি। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে মৃত্যু কষ্টদায়ক। মৃত্যুর নাম শুনেই লোক ভয় পায়। কিন্তু আল্লাহর খাস বান্দাগণ মৃত্যুকে মোটেও ভয় করেন না। মৃত্যু তাদের উপর আসুক বা তারা মুত্যুর উপর পতিত হন তা তাদের জন্য শঙ্কাজনক নয়। কেননা তারা মৃত্যুকে মহামিলনের একটি সেতুবন্ধ মনে করেন, মৃত্যু বন্ধুকে বন্ধুর সান্নিধ্যে পৌঁছে দেয়। রাসূল e-এর এক সাহাবিয়া ছিলেন, তাঁর নাম ছিল সুমাইয়া। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে কাফিরদের হাতে আটকা পড়েন। কাফিরেরা বলল, তুই ইসলাম গ্রহণ করলি! আমরা এবারে দেখবো তুই ইসলাম ত্যাগ কর। সুমাইয়া বললেন, তোমরা আমাকে অত্যাচার কর, মারপিট কর, কোনো অবস্থায়ই আমি মুহাম্মদ e-এর ধর্ম ত‍্যাগ করবো না। আমি সাক্ষ্য প্রদান করছি যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবূদ নেই, মুহাম্মদ e আল্লাহরই রাসূল। ইহা শ্রবণে তারা তাঁকে অত্যাচার আরম্ভ করল। প্রচন্ড রোদ্রে তাঁকে দাঁড় করিয়ে রাখল, উত্তপ্ত বালুর উপর শুইয়ে রাখল। এতো অত্যাচারে নিষ্পেষিত হয়েও তাঁর মনে একটি আশা ছিল যেন তিনি নবী করীম eকে দেখেন। সংবাদ শুনে নবী করীম e সেখানে গিয়ে দেখলেন সুমাইয়া নির্যাতিতা। তখন তাকে সম্বোধন করে বললেন, হে সুমাইয়া! তুমি ধৈর্য্যধারণ কর। সুমাইয়া বললেন, আমি আপনার দর্শন লাভে সন্তুষ্ট। কাফিররা তাঁকে অব্যাহতি দিল না, শেষ পর্যন্ত তাকে শহীদ করল। ইসলামের সর্বপ্রথম শহীদ হচ্ছেন তিনি। মেয়েদের মর্যাদা পুরুষের তুলনায় কম, কিন্তু মেয়েলোক যদি চায় তবে তার মর্যাদাকে উন্নীত করতে পারে। প্রথম যিনি ইসলাম গ্রহণ করেন তিনি হচ্ছেন হযরত খাদীজা (রা.), প্রথম যিনি শাহাদাতবরণ করেন তিনি হচ্ছেন সুমাইয়া (রা.)। প্রথম ইসলাম গ্রহণের মর্যাদা ও প্রথম শাহাদাতের মর্যাদা যদি কেউ লাভ করে থাকেন, তারা মেয়েরাই করেছেন। আল্লাহ তাআলা সুমাইয়াকে পরীক্ষা করেছেন। অনুরূপভাবে খাদীজা, ফাতিমা, আয়িশা, যাইনাব ও ইমাম হুসাইন (রা.) কেও পরীক্ষা করেছেন। চিন্তার কথা হুসাইন (রা.) যখন শহীদ হন যাইনাবের অবস্থা তখন কীই-বা হয়েছিল। ভাইহারা সর্বস্বহারা হয়ে তিনি অন্তরের ভাষায় বললেন- আল্লাহ! এ তোমারই মেহেরবাণী।

সুমাইয়ার করুণ অবস্থা দর্শনের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ e স্বশরীরে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। হুসাইনের করুণ অবস্থা দর্শনের জন্য জান্নাত হতে রাসূলুল্লাহ e এবং ফাতিমা (রা.) এসেছিলেন। তাই কষ্টের বিনিময়ে তিনি লাভ করেছিলেন এক অনুপম আনন্দ। রাসূলুল্লাহ e বাণী প্রদান করেছেন- শাহাদাতবরণের সময় শহীদগণ পিপীলিকার দংশনের ন্যায় কষ্ট অনুভব করে।

হযরত হাসান, হুসাইন, ফাতিমা, আয়িশা, খাদীজা, উম্মে হাবীবা, উম্মে সালমা, সুফিয়া, যাইনাব (রা.) তারা সকলেই তো ছিলেন মুহাম্মদ মোস্তফা e-এর বাগানের ফুল, যে বাগানের মালী ওয়ালী স্বয়ং তিনিই।

আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের অন্তরে আহলে বাইত, সাহাবা, আউলিয়া ও আম্বিয়ায়ে কিরামগণের মুহব্বত দান করেন এবং তাদের স্নেহ মমতার বদৌলতে আমাদেরকে উত্তম আমল করার তাওফীক দান করেন। আমীন।

 

মুরশিদে বরহক আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী কর্তৃক অনূদিত হয়ে মাসিক পরওয়ানা জুলাই ১৯৯২ সংখ্যায় ছাপানো হয়। পাঠক ও সময়ের চাহিদা বিবেচনায় লেখাটি পুনঃমুদ্রণ হলো।-সম্পাদক

ফেইসবুকে আমরা...