সেই শান-শওকত আর নেই তাদের। খাকি শার্ট, খাকি হাফপ্যান্ট, মাথায় টুপি, কোমরে বেল্ট, হাতে মোটা লাঠি-হাঁটবার সময় একেকজনের মনে হত যেন ব্রিটিশ- ভারতের ছোট লাট। অবশ্য নামে ছোট লাট নয় চৌকিদার। কিন্তু সেদিন গেছে। এখন সেই ছোট লাটদের মাথায় টুপি নেই, পরনে প্যান্ট নেই, কোমরে বেল্ট নেই। থাকবার মধ্যে আছে বনেদি আমলের সেই খাকি হাফ শার্টটা। তাও জোড়াতালি দেওয়া। কখনো হঠাৎ শার্টের দিকে নযর পড়লে বিগত দিনগুলোর কথা মনে করে তারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। শুধু বাইরের লেবাস নয়, তাদের ভেতরটাও পোকায় কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। বেতন পায় না দু তিন মাস। বউ-বাচ্চা নিয়ে একেক জনের বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্ট। জাফর চৌকিদারেরও। জমি-জিরাত নেই তার। একটি গাই আছে। সের দুয়েক দুধ দেয়। দুধ বেচে যা পায় তা দিয়ে কোনোমতে দিন গুযরান হয়। তাই গাইটাকে স্নেহ করে নিজের সন্তানের মতো। মাঝে মাঝে বউকে বলে, গাইডার দিকে একটু নযর রাখিস রাফিয়া।
রাফিয়া বলে, রাখুম।
সেও গাইটাকে জাফরের মতোই ভালোবাসে। সবদিন ভাত রাঁধা হয় না, হলেই চাল ধোয়া পানি আর ফ্যান মিশিয়ে একটা বড় গামলায় করে গাইটার মুখের কাছে ধরে। এতটুকু ফ্যান-পানি! খেতে দেরি হয় না। রাফিয়ার মনে হয়, আরো অনেক খেতে পারত। তার বুকের ভেতরে যন্ত্রণার একটা ঢেউ ওঠে। খড়ও নেই একমুঠো। বড় দুর্দিন যাচ্ছে। নিজেরাও উপোস করে আছে কাল থেকে। রশির বাঁধন কিভাবে যে খুলে ফেলেছিল বাছুরটা! সব দুধ খেয়ে ফেলেছে। রীতিমত খাওয়া-দাওয়া নেই গাইটার। নইলে বিকেলে কিছু দুধ পাওয়া যেত। রাফিয়া বাঁশপাতা, এটা ওটা এনে দেয় গাইটাকে, কিন্তু তাতে এতবড় জিনিসটার পেট ভরে না কিছুতেই।
রাফিয়া বলে, একটা কাজ কর।
-কী?
-বিকেলে তো তোমার কাজ নেই। মাঠ থাইক্যা কিছু ঘাস কাইট্যা আন। গাইডারে খাওয়াও। ওডা না খাইলে আমরাই বা খামু কী?
কথাটা মন্দ নয়। জাফর একটি চটের ছালা ও কাঁচি নিয়ে ঘাসের খোঁজে মাঠের দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু কাজটা যত সহজ সে মনে করেছিল, ক্ষেতের আলে ঘুরে ঘুরে তার মনে হলো, তত সহজ নয়। সারা মাঠে ধান, শীষ বেরুচ্ছে। আলের ঘাস আগেই কারা পরিষ্কার করে ফেলেছে। কিছু কিছু যা আছে, ঘাস কাটতে গেলে ধানের চারাও কিছু কাটতে হয়। কাঁচি চালাতে গিয়ে জাফরের হাত থেমে যায়। সে চৌকিদার। মানুষের জান-মালের হিফাযত করে সে। কাটবে কী করে ঘাসের নাম দিয়ে ধানের চারা। জাফর উঠে দাঁড়ায়। ক্ষেতের আল ধরে হাঁটতে হাঁটতে জাফর তার বউ, বাচ্চা আর গাইটার উপবাসী মুখ দেখে। গাইটার পেট ভরিয়ে না রাখলে তাদের উপবাস ঘুচবে না। তার মুক্তবুদ্ধি সহসা আবার গুলিয়ে যায়। সে একটি ক্ষেতের আলে বসে পড়ে ঘাস কাটবার জন্য। দ্রুত হাত চালায় জাফর আর মাঝে মাঝে উঁকি দিয়ে দেখে, কেউ এল কিনা। আবার উঁকি দিয়েই সে চটের ছালা আর কাঁচিটা ধান ক্ষেতের ভেতরে লুকিয়ে ফেলে। কে একজন আসছে এদিকে। সে মাথা নুইয়ে নুইয়ে দুটো জমি পার হয়ে যায়। তারপর উঠে দাঁড়ায়।
জাফর না? একজন বয়স্ক লোক সে যে জমিটার আলের ঘাস কাটছিল সেখান থেকে জিজ্ঞেস করে।
হ মামু।
নিজের জমির আলের দিকে চেয়ে লোকটি ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, শালাদের কান্ড দেখছো জাফর!
কী?
জাফর এগোয় লোকটির দিকে। আর কডা দিন পরে ধানডা কাটা যাইত। এই ধানডাই শালারা কাইটা নিতেছে।
জাফর দুঃখ করে, এই দেশে কিছু অইত না মামু। নিজের খায়নও চিনে না! এত উপবাস থাইকাও ওদের শিক্ষা অইল না!
লোকটি কথা বলে না। তেমনি ক্রুদ্ধ চোখে আল-পথ ধরে হাঁটতে থাকে।
…
বোঝাটা মাথা থেকে উঠোনে নামিয়ে রেখে জাফর হাঁক দেয়, রাফিয়া!
রাফিয়া বাচ্চা কোলে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। জাফর বলে, আর ঘাস কাটতে যামু না।
যাইবা না কেরে? না, যাব না। লোকজন গালাগালি করে।
এক মুঠো ঘাস হাতে নিয়ে জাফর গোয়ালঘরের দিকে এগোয়, ঘাসের সাথে দুই একটা ধান আছে।
গোয়ালে ঢুকে গাইটা দেখতে না পেয়ে জাফর বলে, গাইটা কই?
রাফিয়া উঠোনে দাঁড়িয়েই বলে, ঘরে নাই?
না।
রশি ছিঁড়া পালাইছে না তো?
গাইয়ের রশিটা হাতে নিয়ে জাফর দেখে। বলে, হ রশি ছিঁড়া পালাইছে।
গোয়ালঘর থেকে বেরিয়ে আসে সে। তার মুখটা বিমর্ষ। ক্লান্তি তার সারা শরীর ঘিরে। খাওয়া-দাওয়া নেই। এরপর সারারাত চলবে পাহারা। তার উপর এইসব ঝুট-ঝামেলা ভালো লাগে না তার। এখন গাইটা খুঁজতে কত জায়গায় যে যেতে হবে তাকে।
রাফিয়া বলে, তুমি বাচ্চাডারে দেইখো। আমি গাইডা খুঁইজা দেখি।
না।
না করছ কেরে?
জাফর কথা বলে না। ঘরের দিকে পা বাড়ায়। রাফিয়া তার পেছনে এগোয়।
বাইরে যাইতে ‘না’ করছ কেরে? রাফিয়া আবার কথাটা উচ্চারণ করে। জাফর বউয়ের চোখের দিকে তাকায়, তোরে আমি বাইরে পাডাইছি কোনোদিন? রাফিয়া চোখ নামায়, না।
তাইলে তুই ঘরে বইয়া থাক। গাই নিজে নিজেই আইব। আর না আইলে আমি নিজেই যামু গাই খুঁজতে।
পারবা তুমি? না খাইয়া অত কাম করছো, তার উপর আবার গাই খুঁজতে পারবা?
তুই খাইছিস?
রাফিয়া চমকে উঠে তার কথায়। দৃষ্টি নামিয়ে নীরব থাকে। তার কথাও মনে রাখে লোকটা।
জাফর বলে, তুই না খাইয়া পারলে আমি পারতাম না কেরে? আর তোরে আমি বাইরে যাইতে দিতাম না।
…
গাই খুঁজতে বেরোয় জাফর। পথে একজনের সাথে দেখা।
মামু, আমার গাইডা দেখছ?
না তো।
জাফর হাঁটতে থাকে। কিন্তু সে এত ক্লান্ত যে, তার পা কোথায় পড়ছে ঠিক বুঝতে পারে না। দিনের আলো নিভে আসছে। দ্রæত পা চালায় জাফর। হঠাৎ মৃধা বাড়িতে একজনকে ঢুকতে দেখে সে ডাকে চিনু না?
হ চাচা।
আমার গাইডা দেখছ বাজান?
না।
জাফর আবার হাঁটতে থাকে। মাঠটা একবার ঘুরে আসা দরকার। সেখানে না পেলে লোকের বাড়ি ঘুরে দেখতে হবে। সেখানেও না পেলে খোঁয়াড়ে যেতে হবে। খোঁয়াড়ের কথা মনে হতেই জাফরের ক্লান্তি আরও বেড়ে যায়। কয়েকবারই খোঁয়াড় থেকে ছাড়িয়ে আনতে হয়েছে গাইটাকে। তাও বিনা পয়সায় বারবার খাতির করবে না খোঁয়াড়ওয়ালা।
রাফিয়া বাইরে এসে দাঁড়ায়। রাত অনেক হয়ে গেছে। চারিদিক আঁধারে ছেয়ে আছে। এ সময় একা বাইরে থাকতে তাঁর খুব ভয় করে। তবু সে দাঁড়িয়ে থাকে বাইরে। এখনও ফিরল না জাফর। গাইটা কি খুঁজে পায়নি? নাকি গাইটা খুঁজে না পেয়ে রাতের পাহারায় চলে গেছে? বাচ্চাটা বড় কাঁদছে। গাইটা এলে এক আধটু দুধ দুইয়ে খাওয়ানো যেত বাচ্চাটাকে।
ঘরে এসে সে দরজাটা আটকায়। জাফর বোধ হয় এখন আর আসবে না। ডিউটিতে চলে গেছে। সারারাত চলবে তার পাহারা। দু’একবার এসে রাফিয়ার খোঁজ নেবে। তারপর আবার লোকের বাড়ি বাড়ি ঘুরে পাহারা দেবে। পরের নিরাপত্তার ভার তার উপর। কিন্তু তার দুটো ভাতও খেতে পায় না। চোর ধরতে গিয়ে দু’তিনবার আহত হয়েছে সে। একবার এক চোর ছুরি বসিয়ে দিয়েছিল তার পেটে। ভাগ্য ভালে যে ছুরিটা ঠিক তার পেটে বসেনি, ফসকে গিয়েছিল। যার জন্য তার পেটের চামড়া কিছুটা কেটে গিয়েই নিস্তার পায় সে।
এ মুহূর্তে গাইটার কথা আর মনে হয় না রাফিয়ার। মনে হয়, ভালোবাসায় ভরা একটি মুখের কথা। যে মুখ হারিয়ে গেলে তার বেঁচে থাকার কোনো অর্থই থাকবে না। তার ভেতরটা কেমন করতে থাকে। এ সময় তার আরেকজনের কথা মনে হয়। তিনি তার প্রতিপালক। তার আজীবনের বিশ্বাস, তিনি তাকে খাওয়ান, পরান, বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। তাই তার আর্তি তার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে, হাত তুলে পরওয়ার দিগারের দরবারে। ইয়া আল্লাহ! তুমি সব বালা-মুসিবত থাইকা আমার মানুষটাকে বাঁচাইয়া রাইখো।
(২)
চোরটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে লোকটা চেঁচাতে থাকে, চোর চোর…
হঠাৎ আক্রমণে চোরটা হতভম্ব হয়ে যায়। তারপর পেছনে তাকিয়ে লোকটাকে দেখবার চেষ্টা করে। কিন্তু লোকটা এমনভাবে তাকে জাপটে ধরেছে যে ভালো করে সে মুখই ফেরাতে পারে না।
এখন কৃষ্ণপক্ষ। ঘুটঘুটে অন্ধকার। চারিদিকে সীমাহীন নীরবতা। চাঁদ উঠবে আরও একটু পরে। অন্ধকার গাঢ় হওয়াতে চোরটা আশ্বস্ত হয়। বাতি নিয়ে লোকজন আসবার আগে অথবা চাঁদ উঠবার আগে যেভাবেই হোক তাকে লোকটার হাত থেকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক।
চোরটা তার গায়ের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে এবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু প্রতিপক্ষ এত শক্তিশালী যে সে কিছুতেই তার হাত ছাড়াতে পারে না। হৈ চৈ শুনে পাড়ার লোকজন দৌঁড়ে আসে। লোকটার কণ্ঠস্বর শুনে তারা চোরের অবস্থান বুঝে নিয়ে এলোপাথাড়ি মার চালায় চোরের উপর। কিছুক্ষণের মধ্যে নিস্তেজ হয়ে পড়ে চোরটা। ছাড়া পাবার চেষ্টা বাদ দেয় সে। আত্মসমর্পণের ভাব এখন তার।
কিন্তু তাতেও তার কোনো লাভ হয় না। কিল, ঘুষি, লাথি, লাঠির বাড়ি চলে সমানে। চোরটা লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।
বাতি, বাতি বলে চেঁচাতে থাকে লোকজন।
চোরটাকে চেনবার লোভ সবার মনে। প্রথমে একটি লণ্ঠন নিয়ে আসে একজন। তারপর আসে আরও অনেকে। কে একজন একটি বাতি চোরের মুখের কাছে নিয়েই চমকে ওঠে, এ্যাঁ।
হারু খোঁয়াড়ওয়ালা চট করে তার খোঁয়াড়টার দিকে তাকায়। জাফর চৌকিদারের গাইটা বাঁধা আছে খোঁয়াড়ের ঠিক দরজার কাছে। গাইটা চেয়ে আছে এদিকে। অনেকগুলো বাতির আলোয় এখন জায়গাটার অন্ধকার ঘুচে গেছে। আলোর কিছুটা অংশ পড়েছে খোঁয়াড়ের মুখে।
গাইটার মুখ আধো আলোয় আধো অন্ধকারে। গাইটার মুখের আলোকিত অংশের দিকে তাকিয়ে হারুর মনে হয়, এর চোখ দুটি যেন জ্বলজ্বল করছে। কাছেই একটি খড়ের গাদা। হারু খোঁয়াড়ওয়ালা ঠিক বুঝতে পারে না, কেন এর চোখগুলো জ্বলছে। খাবারের লোভে, নাকি তার মনিব জাফর চৌকিদারের জন্যে- যে তাকে চুরি করে খোঁয়াড় থেকে ছাড়িয়ে নিতে এসে ধরা পড়েছে এবং বেদম মার খেয়ে এখন অজ্ঞান অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে।
হারুর দৃষ্টি ঘুরে গিয়ে জাফরের উপর পড়ে। যেন ঘুমিয়ে আছে জাফর। একটি অবুঝ শিশুর মতন। যার দুঃখ নেই, অভাব নেই, অভিযোগ নেই। জাফরের সব কথা হারু জানত। এখন এসব মনে করে তার ভেতরটা বড় কাঁদতে থাকে। হু হু করে কাঁদবার ইচ্ছেও হয় তার। কিন্তু এখানে এখন অনেক লোকের ভীড়। তাই কাঁদবার যো নেই। আর এজন্য হারুর মাথাটা হঠাৎ গরম হয়ে ওঠে। একজনের কাছ থেকে একটি লাঠি নিয়ে পাগলের মতো সে এলোপাথাড়ি লাঠি চালায় জনতার উপর, এই শালারা, ভাগ।