মেডিভেল ইন্ডিয়ায় মুঘল যুগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। অধিকাংশ মুঘল সম্রাট ছিলেন সেমি-লিবারেল, যারা ধর্মীয় অনুশাসনের তুলনায় রাজ্য পরিচালনা ও অন্তঃর্দ্বন্দ্বে বেশি সময় অতিবাহিত করেছেন। কেউ কেউ ধর্মীয় সংস্কার চালু করলেও সেগুলো আকবরের ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’র মতো ভ্রান্ত পথ গ্রহণ করেছিল। ঠিক এই জায়গাটায় এসে সকলের থেকে আলাদা হন সম্রাট আওরঙ্গজেব আলমগীর বা বাদশাহ আলমগীর। তিনি ছিলেন ধর্ম পালনে সচেষ্ট, একজন মুমিন মুসলিম। ঠিক এই কারণটিই তাঁকে এতো সংখ্যক মানুষের কাছে খারাপ বানিয়েছে। অন্য ধর্মের মানুষের উপর যুলম করার মিথ্যা অপবাদের বোঝা নিয়ে তিনি নিজেই মাযলূম হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। বিশেষত, কট্টরপন্থি রাজপুত,মারাঠা হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর তাঁর অত্যাচারের কাহিনী পুরো ভারতবর্ষে সমাদৃত, যার অধিকাংশই মিথ্যা, বানোয়াট এবং ঐতিহাসিকদের নিকট ভিত্তিহীন। গত ১৪ই ফেব্রুয়ারি মারাঠা বীর ছত্রপতি সম্ভাজীর জীবনচরিতের উপর নির্মিত চলচ্চিত্র “ছাবা” প্রকাশিত হয়। যেখানে আওরঙ্গজেবকে একজন নির্দয়,উন্মাদ ও অত্যাচারী মুসলিম শাসক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এর ফলে,ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে নতুন করে মুঘল বিদ্বেষ জন্ম নেয়। হিন্দুরা ক্রোধের বশবর্তী হয়ে বিভিন্ন জায়গায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর আক্রমণ করে। এমনকি,ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) এমপি উদয়নরাজ ভোঁসলে,সম্রাটের কবর পর্যন্ত মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন।এখনপ্রশ্ন থেকেই যায়- আওরঙ্গজেব কি সত্যিই ভিন্নমতাবলম্বীদের প্রতি হিংস্র ছিলেন? নাকি ইতিহাসের নিরিখে মহান এই নেতাকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে?
প্রথমেই জানা আবশ্যক,মারাঠা সাম্রাজ্যের আবির্ভাবের ইতিহাস। মুঘলদের ভারতবর্ষ অধ্যুষিত করার পরপরই,হিন্দু নেতৃস্থানীয়রা হয়ে উঠেন মুঘল রাজাদের অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। রাজপুত নেতাদের সাথে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, অনেক সম্রাট রাজপুত কন্যাদেরকে বিবাহ করেন। তাছাড়া সম্রাট হুমায়ুন থেকে শুরু করে স্বয়ং আওরঙ্গজেবের সময়ে এসেও হিন্দু নেতারা মুঘল প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। এমনকি তাদের মনসবদারীও ছিলো অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে,মুঘল সাম্রাজ্যের বিশাল বিস্তৃত সময়কালে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার তেমন বড় কোন হদিস মিলে না, কিছু ছোটখাটো ঘটনা ব্যতিরেকে। আসল বিপত্তি ঘটে সম্রাট শাহজাহানের আমলে। বিজাপুরের সেনাপতি ছিলেন শাহজী ভোঁসলে। তাঁরই ঘরে জন্ম নেন শিবাজী। তাঁর মা জীজাবাঈ ছিলেন কট্টোর হিন্দুত্বমনা। এর বদৌলতে শিবাজী ছোট থেকেই মুসলিম ও মুঘল বিরোধী মানসিকতা নিয়ে বড় হন। হিন্দু-মুসলিম শান্তিতে বসবাস করলেও তীব্র সাম্রাজ্যবাদী মনোভাবের জন্য তিনি মুঘলদের সাথে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হন। তিনি শাহজাহান পুত্রদের বিরোধিতার সময়,সুযোগ বুঝে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিদ্রোহের মাধ্যমে মারাঠা সাম্রাজ্য গঠন করেন এবং নিজেকে “ছত্রপতি” উপাধি দান করেন। ১৬৫৮ সালে আওরঙ্গজেব ক্ষমতায় আসার পরেই মারাঠাদের নতুন এই চ্যালেঞ্জ মুকাবিলা করতে বাধ্য হন।
শান্তিপ্রিয় আওরঙ্গজেব শিবাজীকে তার অধীনে আনার জন্য অনেক চেষ্টা করেছিলেন। ১৬৬৫ সালে পুরন্দরের যুদ্ধে শিবাজী পরাজিত হলে,সম্রাটের সাথে ১০ বছরের চুক্তি করেন এবং বিজাপুর অবরোধেও সম্রাটকে সাহায্য করেন যদিও তা ছিল সন্দেহজনক। অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই শিবাজী চুক্তিভঙ্গ করে আবারও বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। জয় সিংহের মধ্যস্থতায় শিবাজীকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের দরবারে ডাকা হয়েছিল। তখন আওরঙ্গজেব তাকে পাঁচ হাজার মনসব দেওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বিদ্রোহী শিবাজী তা নাকচ করে পালান এবং তার বিদ্রোহ চালিয়ে যান। তাছাড়া, শিবাজীর মৃত্যুর পর মারাঠা সাম্রাজ্যের অধিপতি হোন ছত্রপতি সম্ভাজী ভোঁসলে। তাঁর আমলেও সম্রাট কয়েক দফা শান্তিচুক্তির চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।
ইতিহাস বিকৃতির এই প্রলেপ চূর্ণ করে দেয় সম্রাটের হিন্দুনীতি। তাঁর দ্বারা গৃহিত কিছু পদক্ষেপ যা আজ পর্যন্ত ইতিহাসে মানবতা ও শান্তির প্রতীক হিসেবে চর্চা হয়। কিছু বিশেষ পদক্ষেপসমূহ-
• হিন্দুদের মন্দিরের সংস্কারের অনুমতি প্রদান।
• রাজপুত নেতাদের উচ্চ প্রশাসনিক পদে নিয়োগদান।
• হিন্দু কর্মকর্তাদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
• ব্রাহ্মণ ও মন্দিরের জন্য কর মওকুফ এবং জায়গীর দান।
• নির্দিষ্ট অঞ্চলে হিন্দু ধর্মীয় উৎসব পালনের অনুমতি।
• হিন্দু জমিদার ও নেতাদের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখা।
• ধর্মীয় তহবিল তৈরি এবং তা থেকে বিভিন্ন হিন্দু প্রতিষ্ঠানকে সহায়তা।
• হিন্দু ব্যবসায়ীদের জন্য বাণিজ্যিক সুবিধা প্রদান।
• কিছু অঞ্চলে হিন্দু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার অনুমতি।
• হিন্দু আইন ও রীতিনীতি অনুযায়ী বিবাহ ও উত্তরাধিকার ব্যবস্থার অনুমতি।
• হিন্দু ধর্মীয় নেতাদের সম্মান প্রদান এবং কখনও কখনও আর্থিক সহায়তা।
• কৃষিকাজ ও ব্যবসার উন্নতির জন্য হিন্দু কৃষক ও ব্যবসায়ীদের কর রেয়াত।
• হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থ ও সাহিত্য সংরক্ষণে কিছু পদক্ষেপ।
• সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিন্দুদের সাথে সমঝোতার নীতি গ্রহণ।
• যুদ্ধের সময় রাজপুত ও অন্যান্য হিন্দু সেনাদের সহায়তা গ্রহণ।
• ১৬৭৯ সাল থেকে ১৭০৭ সালের মধ্যে সম্রাট মোট ৯৬ জন মারাঠাকে ১০০০ জাট পদের মনসব দান করেন।
তাছাড়া, দারাশিকোর সাথে যুদ্ধকালীন সময়ে হিন্দুদের থেকে প্রাপ্ত সমর্থনের সংখ্যাগত তুলনা করলে দেখা যায়,সম্রাট ৪৫ জন হিন্দু মনসবদারের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ২১ জনের সমর্থন লাভ করেন। যদি তিনি কট্টর হিন্দুদমনকারী হতেন তাহলে কি দারাশিকোর (যিনি ভ্রষ্ট ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী ছিলেন) সমপরিমাণ সমর্থন, হিন্দু নেতাদের থেকে লাভ করতেন?
সম্রাটের হিন্দুদের প্রতি দয়ার নিদর্শন স্বরূপ দুটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বর্ণনা করা যায়। একবার আওরঙ্গজেবের সেনাপতির এক ব্রাহ্মণের কন্যার রূপে মোহিত হয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেন এবং এক মাসের মধ্যে জোর করে বিয়ে সম্পন্ন করার কথা জানান। ব্রাহ্মণ আতঙ্কিত হয়ে সম্রাট আওরঙ্গজেবের শরণাপন্ন হন। সম্রাট তাকে আশ্বস্ত করে জানান, নির্ধারিত দিনে তিনি নিজেই উপস্থিত থাকবেন। নির্ধারিত সময়ের আগেই আওরঙ্গজেব একা ব্রাহ্মণের বাড়িতে উপস্থিত হন এবং তার জীর্ণ ঘরে সারারাত ইবাদত করে কাটান। পরদিন সেনাপতি বর বেশে উপস্থিত হলে ব্রাহ্মণ সম্রাটের শেখানো মতো তাকে সেই ঘর দেখিয়ে দেন, যেখানে সম্রাট অবস্থান করছিলেন। সেনাপতি ঘরে প্রবেশ করতেই দেখতে পান সম্রাট আওরঙ্গজেব খোলা তরবারী হাতে প্রস্তুত। সাহসী সেনাপতি ভয়ে কাঁপতে থাকেন এবং অবশেষে লজ্জা ও ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। এই দৃশ্য দেখে ব্রাহ্মণ সম্রাটের পায়ে লুটিয়ে পড়েন এবং কন্যার সম্মান রক্ষার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সম্রাট বলেন, এটা আমার কর্তব্য। আমি দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি, এটাই আমার আনন্দ।
আরেকবার,বেনারসের শাসনকর্তা সম্রাট আওরঙ্গজেবকে একটি গোপন পত্রে প্রস্তাব দেন যে, বেনারসের ব্রাহ্মণদের উপাসনায় হস্তক্ষেপ করা হোক, যাতে মানুষ ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তবে আওরঙ্গজেব এই প্রস্তাব নাকচ করে দেন।জবাবে তিনি লেখেন যে, প্রজাদের উপকার সাধন এবং সব সম্প্রদায়ের উন্নতি সাধনই তার দৃঢ় উদ্দেশ্য। তিনি নির্দেশ দেন, কোনো ব্যক্তি অন্যায়ভাবে ব্রাহ্মণদের কাজে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না বা তাদের ওপর হামলা চালাতে পারবে না। ব্রাহ্মণরা যেন তাদের ধর্মীয় কাজে পূর্বের মতো যুক্ত থাকতে পারে এবং সাম্রাজ্যের স্থায়িত্বের জন্য সুস্থ মনে প্রার্থনা করতে পারে।
আর মন্দির ভাঙা, জিযিয়া পুনর্বহাল এবং সম্রাটের আপন ভাইয়ের সাথে যুদ্ধ করাকে যেভাবে ন্যক্কারজনক দেখানো হয়,তা সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেই তার যথার্থ উত্তর পাওয়া যায়। প্রথমত, কিছু হিন্দু পণ্ডিতদের আশ্রয়ে ভারতবর্ষের কিছু মন্দিরে বিদ্রোহ, রাষ্ট্রদ্রোহ এমনকি ভুল হিন্দুত্ববাদ শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। তার খবর পেয়ে সম্রাট, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব রক্ষার্থে ধর্ম প্রচারের নাম করে, বিদ্রোহ ছড়ানোর কেন্দ্রগুলোকে ধ্বংস করেন। শীর্ষস্থানীয় পণ্ডিত রিচার্ড এম. ইটনের লেখা ‘মন্দির অপবিত্রকরণ এবং ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্র’ নামক প্রবন্ধে তা সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন।তাছাড়া এখানে তিনি ভেঙে দেওয়া মন্দিরের সংখ্যা নিয়ে হিন্দুদের করা ছলচাতুরীরও রহস্যভেদ করেছেন। বলা হয়, সম্রাট হাজারখানেক মন্দির ভেঙেছেন কিন্তু এম. ইটনের মতে,এ সংখ্যা ডজনখানেকের মতো হবে। এমনকি ১৯৪৬ সালে ভারতের পঞ্চম ও ষষ্ঠ শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক হিসেবে রচিত-হিন্দুস্থান প্রেস (১০,রমেশদত্ত স্ট্রিট কলকাতা) থেকে মুদ্রিত গ্রন্থে আছে- জোর করিয়া মন্দির ভাঙ্গিয়া মসজিদ নির্মাণের উদ্দেশ্যেই যদি আওরঙ্গজেবের থাকত,তবে ভারতে কোন হিন্দু মন্দিরের অস্তিত্বই বোধ হয় আজ দেখা যেত না। সেই করা তো দূরের কথা,বরং বেনারস,কাশ্মীর ও অন্যান্য স্থানের বহু হিন্দু মন্দির এবং তৎসংলগ্ন দেবোত্তর ও ব্রক্ষ্মোত্তর সম্পত্তি আওরঙ্গজেব নিজের হাতে দান করে গিয়েছেন। সে সকল আজো পর্যন্ত বিদ্যমান। দ্বিতীয়ত, আকবর তাঁর আমলে জিযিয়া কর রহিত করেছিলেন,কিন্তু সম্রাট আওরঙ্গজেব তা পুনরায় চালু করেন। মূলত জিযিয়া কর টার্মটি অনেকটা আধুনিক যুগের ট্যাক্স বা খাজনার মতোই। মুসলমানরাও তা আদায় করতেন। সেটা যাকাত আদায় করে হোক অথবা উশর আদায়ের মাধ্যমেই হোক। তাছাড়া বিবিধ কারণে তখন রাষ্ট্রে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয় তা কাটিয়ে উঠতেও জিযিয়া করের প্রয়োজন ছিল। অতএব, জিযিয়া করকে ধর্মীয় বৈষম্যের দৃষ্টিতে না দেখে বরং সম্রাটের রাষ্ট্র পরিচালনার প্রজ্ঞা হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
সর্বশেষে,সম্রাট আওরঙ্গজেব তাঁরই ভাই দারাশিকোর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হয়েছিলেন বিশেষত ধর্মীয় কারণে, কেবলই সিংহাসনলাভের জন্য নয়। মূলত দারাশিকোর ব্যাপারে মুরতাদ হওয়ার বা আকবরের ভ্রান্ত ‘দ্বীন-ই-ইলাহী’ দ্বারা প্রভাবিত হওয়াত অভিযোগ ছিল। আর আওরঙ্গজেব ছিলেন শাইখ আহমাদ সিরহিন্দি মুজাদ্দিদে আলফে সানী (র.) এর মতাদর্শে দীক্ষিত। তাই, তিনি তার ভাইয়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং এটাও বলা হয় যে তিনি তাঁর বৃদ্ধ পিতা শাহজাহানের উপর অত্যাচার করেছিলেন। অথচ তিনি, দারা কর্তৃক প্রভাবিত পিতাকে আগ্রার লাল কেল্লায় সসম্মানে নযরদারির মধ্যে রাখেন।তাঁর পর্যবেক্ষণ এতটাই নিবিড় ছিল যে, শাহজাহান যাতে তার শ্রেষ্ঠ কীর্তি তাজমহল দেখতে পারেন তাও সম্রাট নিশ্চিত করেছিলেন।
ফিরে আসা যাক মারাঠাদের প্রসঙ্গে। শিবাজীর মৃত্যুর পর সম্ভাজী সিংহাসনে আরোহণ করেন। অতঃপর,সম্রাট আবার মুঘল-মারাঠা সম্পর্ক স্থিতিশীল করতে তৎপর হন কিন্তু এবারও তিনি ব্যর্থ হন। অতএব,সম্রাট আবারও তাঁদের দমন করতে বাধ্য হন। অথচ শিবাজীর জীবদ্দশায়,তার পুত্র সম্ভাজী ভোঁসলে ক্ষমতার লোভে পিতার বিরোধিতা করেন। তিনি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পক্ষের অন্যতম সেনাপতি দিলার খানের হয়ে যুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। সম্রাটের পক্ষ থেকে তাকে সাত হাজার জাটের পদমর্যাদাও দান করা হয়। মুঘল-মারাঠা বিরোধ ছিলো মূলত সাম্রাজ্য বিস্তার নিয়ে, এককভাবে ধর্মীয় বিরোধ ছিল না। এটাকে ধর্ম যুদ্ধের আখ্যা দেওয়া নিতান্তই সত্যের অপলাপ। মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রি ট্রুশকে তাঁর “আওরঙ্গজেব- দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ” বইয়ে লিখেছেন যে, “ব্রিটিশদের শাসনের সময় তাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ জনগোষ্ঠীকে ‘বিভাজন আর শাসন করো’ নীতির আওতায় ভারতে হিন্দু বর্ণবাদী ধারণা উস্কে দেওয়ার কাজটি করেছিলেন যেসব ইতিহাসবিদরা, তারাই মূলত, আওরঙ্গজেবের এমন একটি ইমেজ তৈরির জন্য দায়ী।”
ইতিহাসের ভিত্তিহীন কিছু উদ্ধৃতির ভিত্তিতে একজন মহান ব্যক্তিকে কোটি কোটি জনগণের কাছে খারাপভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্যদিকে সম্ভাজী ভোঁসলে, যাকে হিন্দুরা পূজা পর্যন্ত করেন, তার চরিত্র নিয়ে ঐতিহাসিকদের বর্ণনা আরো জঘন্য। তাঁর সমরনীতি কতটুকু বর্বর ছিল তার এমন বর্ণনা পাওয়া যায় যে, সম্ভাজী অভিযানের সময় তার নেতৃত্বে মারাঠা সৈন্যরা বেসামরিক নাগরিকদের উপর গণহত্যা এবং গণধর্ষণের মতো নৃশংসতা চালাতো। এবং জানা যায়,পরবর্তীতে যখন তিনি মুঘলদের হাতে বন্দি হন এই যুদ্ধাপরাধের কারণেই সম্রাট তাকে মৃত্যুদণ্ড দান করেছিলেন। সম্ভাজীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইতিহাসবেত্তারা বলেন, একজন ব্রাহ্মণের স্ত্রীর সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করার কারণে সম্ভাজীকে পানশালায় বন্দি করা হয় এবং এই কারণে,স্বয়ং শিবাজীই তাঁকে ত্যাগ করেছিলেন।
ইতিহাস এমনই হয়। একজনের বিবরণের বিপরীতে আরেকজনের বিবরণ থাকবেই।এটাই ইতিহাসচর্চার ধর্ম। কিন্তু তাই বলে পক্ষ-বিপক্ষের শতশত ঐতিহাসিক দলীল থাকার পরেও তিন শতাব্দীর বেশি সময় আগের একটা দ্বন্দ্বের কারণে, কোন একটি নির্দিষ্ট জাতির উপর অত্যাচার-নিপীড়নের মাধ্যমে প্রতিশোধ নেওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। এটার পেছনে আছে ভারতবর্ষের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। ভারতের বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিজেপি বা ভারতীয় জনতা পাটি হিন্দু জাতীয়তাবাদ মতাদর্শী একটি দল। ১৯৮০ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ীর হাত ধরে এই দলের পথচলা শুরু। যদিও প্রতিষ্ঠার ২০ বছরের মাথায়ই তৎকালীন শক্তিধর দল ভারতীয় কংগ্রেসকে পরাজিত করে বিজেপি-নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট বা এনডিএ। কিন্তু,২০০২ সালের গুজরাটে মুসলিম গণহত্যার তীব্র প্রতিক্রিয়া স্বরূপ তার পরের নির্বাচনেই এনডিএ এর ভরাডুবি ঘটে। পরবর্তীতে ২০১৩ সালের মুজাফফরনগর দাঙ্গার বদৌলতে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দলটি আবার ক্ষমতায় আসে। তবে এবার মোদি, গুজরাট দাঙ্গার ফল দেখে তার দলের মোটিভ পাল্টান। হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের ছায়ায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের ব্লাসফেমি করা এবং মুসলিম-হিন্দু দাঙ্গা লাগিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের ভোট আদায় করার পরিকল্পনা করে মাঠে নামেন। এরপর থেকে বিজেপির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির পদ্ধতি এমন হয়ে দাঁড়ায় যে দলটির নির্বাচনী ইশতাহারে এমন কিছু প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, যার প্রত্যেকটাই মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাস অথবা বিস্তৃত ইতিহাসে আঘাত হানে। যার মধ্যে সিএএ আইন,এনআরসি আইন, বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির নির্মাণ, গো রক্ষা আইন সহ কাশ্মীরের মুসলিমদের উপর সেনাবাহিনী দ্বারা নিপীড়ন অন্যতম। বিজেপির মুসলিম বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা ছড়ানো এবং হিন্দু যুবকদের মুসলিম বিদ্বেষী ও কট্টর তৈরিতে অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে মিডিয়া কাজ করে। যার প্রভাবে গত দশকে খোদ বিজেপি সরকারের অর্থায়নে কয়েক ডজন ইতিহাস-বিকৃত চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলে, চলচ্চিত্রগুলোর মূল ভিত্তিই ছিল ইসলামের বিরোধীতা করা, প্র্যাক্টিসিং মুসলিমদের জঙ্গিবাদী আখ্যা দেওয়া এবং পাকিস্তানের ঘোর বিরোধিতা করা। এমনকি প্রায়শই প্রধানমন্ত্রী মোদিকে এসব চলচ্চিত্রের ঢালাও প্রচার করতে দেখা গেছে। যেমন, ২০২৩ সালের “দ্য কেরেলা স্টোরি” নামক চলচ্চিত্র মুসলিমদের মধ্যে বিশাল ক্ষোভের সৃষ্টি করে। কাশ্মীরের হিন্দু পণ্ডিতদের উপর নির্যাতনের ডকুমেন্টারি চলচ্চিত্র “দ্য কাশ্মীর ফাইলস” এবং অন্যান্য। সাম্প্রতিক সময়ে আগুনে ঘি ঢালা চলচ্চিত্র “ছাবা” ও এই প্রোপাগান্ডারই একটি অংশ। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, ইতিহাস বিকৃতির দায়ে “ছাবা” চলচ্চিত্রের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি রুপির মানহানি মামলা পর্যন্ত দায়ের করা হয়েছিল মারাঠা সেনাপতি গানোজি ও কানোজি শির্কের বংশধরদের পক্ষ থেকে। এসব প্রোপাগান্ডামূলক চলচ্চিত্র ভারতে খুব বেশি প্রভাব ফেলে।“দ্য হিন্দু” পত্রিকার বরাতে জানা যায়, ছাবা চলচ্চিত্রে দেখানো সম্ভাজীর উপর সম্রাট আওরঙ্গজেবের বর্বরতার দৃশ্য দেখে, কেউ উত্তেজিত হয়ে সিনেমা হলের স্ক্রিন ভেঙে ফেলছেন তো কেউ কেউ সম্ভাজীর দুঃখে কাঁদতে কাঁদতে হল ছেড়েছেন। বাচ্চা থেকে শুরু করে সবার উপরেই এই চলচ্চিত্র প্রভাব ফেলেছে।
এখন সমস্যা হলো, যাদের ক্ষোভ থেকে সাধারণ বস্তু নিরাপদ নয় তাদের কাছ থেকে মুসলিমরা, যাদেরকে অন্ধভক্ত হিন্দুরা সম্রাট আওরঙ্গজেবের উত্তরাধিকারভাবে তারা কীভাবে নিরাপদে থাকবে? যা হওয়ার ছিল তাই হলো। ২০১৩ সালের মোজাফফরনগর দাঙ্গার পরিণামে, শেষ ২০১৪ সালে হিন্দুরা বয়ান তুলেছিল, যে দিল্লির আওরঙ্গজেব রোডের নাম পাল্টে অন্য কারো নামে করার।ঠিক হলোও তাই। নাম পরিবর্তন করে রাখা হলো আবুল কালাম রোড। কয়েক বছরের ব্যবধানে ২০১৭ সালে পাঠ্যবই থেকে মুঘল সাম্রাজ্যের ইতিহাসও কাটছাঁট করে একবারে নামমাত্র করে ফেলা হলো। নতুন করে সংযোজন করা হলো মারাঠা বীরদের কল্পকাহিনী। সম্প্রতি ভারতের লোকসভায় বিজেপি এমপি নরেশ মাশকে, সম্রাট আওরঙ্গজেবের কবর ভেঙে ফেলার দাবি তুলেছেন। তার মতে আওরঙ্গজেব হিন্দু ধর্ম ও জাতীয়তাবাদের শত্রু ছিলেন তাই তার কবর ভেঙে ফেলা উচিত। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তা বাস্তবায়ন করে ফেলাও হবে। তাছাড়া, এর প্রভাবে ভারতীয় মুসলিমদের উপর নির্যাতন বেড়েছে কয়েকগুণ। পবিত্র রামাদান মাসের সময়ে বিভিন্ন মসজিদে হামলা, তারাবীহ নামাযের সময় কয়েকশত লোক একত্রিত হয়ে “জয় শ্রীরাম” স্লোগান দেওয়া, হোলি খেলার জন্যে মসজিদে জুমুআর নামায বন্ধ করে দেওয়া, লাউড স্পিকার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞাসহ আরো অনেক নির্যাতন। এতসব অত্যাচারের শেষ কোথায়? ২০ কোটি মুসলমানকে বাঁচাতে আরেকজন মুহাম্মদ বিন কাসিম, সুলতান মাহমুদ কিংবা কুতুবুদ্দীনের আবির্ভাব আর কতদূর? কবে আসবে আমাদের সেই সময়? কবে হবে আমাদের গাযওয়া?

