Logo
ফিলিস্তিনে অব্যাহত নৃশংসতা ও বিশ্বরাজনীতির হালচাল
মুহাম্মাদ বিন নূর
  • ২৯ নভেম্বর, ২০২৫

গত অক্টোবরে ট্রাম্পের প্রস্তাবনা অনুসারে কাতার-মিসরের মধ্যস্থতায় স্বাক্ষরিত হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতি চুক্তির কথা পাঠকের নিশ্চয়ই মনে আছে। কাগজে কলমে সে চুক্তি এখনো বহাল আছে, চুক্তি মেনে হামাস তাদের সব ধরনের অভিযান বন্ধ রেখেছে, বন্দি মুক্তি দিয়েছে। কিন্তু ইসরায়েলি নৃশংসতা থেমে থাকেনি এক দিনের জন্যও। গাযা, পশ্চিম তীর তো বটেই, সিরিয়া এবং লেবাননের কিছু অঞ্চলেও এখনও প্রতিদিন ইসরায়েলী হামলা চলমান। এই পরিস্থিতিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দাবি করেছেন, ৩০০০ (হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, তিন হাজার) বছরের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রথম শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তার হস্তক্ষেপে। শত শত ফিলিস্তিনীসহ প্রতিবেশী দেশসমূহের আরবদের অব্যাহত মৃত্যুই যেন তার বিবেচনায় তিন সহস্রাব্দের শান্তি! অথচ কথিত এই চুক্তি বাস্তবায়নের এতদিন পর এখনও গাযায় পর্যাপ্ত মানবিক সহায়তা প্রবেশ করানো সম্ভব হচ্ছে না ইসরায়েলী বাধায়, ধ্বংস্তুপ পরিষ্কার কিংবা সাময়িক আবাসনের ব্যবস্থা করতেও ইসরায়েলী বাধা অব্যাহত। মানবিক সহায়তা যেখানে কোন অবস্থাতেই সীমিতকরণের সুযোগ আন্তর্জাতিক আইনে নেই, সেখানে ইসরায়েল মানবিক সহায়তাকে চুক্তির দরকষাকষির বিষয় বানিয়ে (যা যুদ্ধাপরাধের শামিল) ক্ষান্ত হয়নি, বরং সেই চুক্তিকেও বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে, এবং সে জন্য কোন পরিণতিও ভোগ করতে হচ্ছে না। উলটো হামাসকেই যুদ্ধবিরতি আর শান্তির সবক দেওয়া হচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের কথিত ‘শান্তি প্রস্তাব’ কিছুটা এদিক সেদিক করে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাশ হয়েছে ২৮০৩ নং রেজুলেশন হিসেবে। জাতিসংঘের এই রেজুলেশন অনুসারে ফিলিস্তিনীদের উপর অসংখ্য শর্ত চাপিয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, এতোগুলো ‘যদি-কিন্তু’ শেষে ‘ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে যাওয়া যেতে পারে’, রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হবে এমন কোন কথা নেই। অথচ জাতিসংঘের ঘোষিত অবস্থান হলো দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান, যার বাস্তবায়নে ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আবশ্যিক। অথচ ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন থেকে শুরু করে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের বিষয়ে সে রেজুলেশনে কোন উল্লেখই নেই। সে যাই হোক, ফিলিস্তিনী রাষ্ট্রের কোন নিশ্চয়তা না থাকলেও ফিলিস্তিন কীভাবে পরিচালিত হবে, সে বিষয়ে কিছু অপূর্ণ কথাবার্তা আছে, যা মূলত ট্রাম্পের কথিত শান্তি প্রস্তাবনারই পুনরুল্লেখ বলা চলে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের রেজুলেশন অনুসারে, গাযা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নেতৃত্বাধীন ‘আন্তর্জাতিক বোর্ড অফ পিস’, এই বোর্ডের অধীনে গাযায় মোতায়েন করা হবে একটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাহিনী, যার মূল কাজ হবে গাযা তথা ফিলিস্তিনকে ‘উগ্রবাদী মুক্ত করা’, এবং এই বাহিনী আন্তর্জাতিক বোর্ড অফ পিসের নিকটই জবাবদিহি করবে।

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ট্রাম্পের অধীনে গাযায় ইসরায়েলের স্বার্থ দেখভালের জন্য একটা আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করা হবে। হামাস এখন অবধি ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া অস্ত্র ত্যাগ করতে রাযি হয়নি, অথচ এই প্রস্তাবের মূল কথাই হচ্ছে হামাসসহ প্রতিরোধযোদ্ধাদের নিরস্ত্রিকরণ। ফলে এই প্রস্তাব বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া গাযায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ইসরায়েলী আগ্রাসন মুকাবিলার কোন বিকল্প নেই, কিন্তু এই আন্তর্জাতিক বাহিনী ইসরায়েলের হামলা প্রতিহত করতে কোন ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারবে কিনা, সে বিষয়ে কোন উল্লেখ নেই। তবে ট্রাম্পের অধীনে থাকা কোন বাহিনী যে ইসরায়েলকে প্রতিহত করতে পারবে না, তা বুঝতে বিশাল ভূরাজনীতি বিশেষজ্ঞ হতে হয় না। তাছাড়া এই বাহিনীতে কোন কোন দেশের বাহিনী থাকতে পারে, সেটাও বিবেচ্য এক্ষেত্রে। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এক্ষেত্রে আগ্রহী হলেও তুর্কি বাহিনীর বিষয়ে ইসরায়েলের তুমুল আপত্তি। অন্যদিকে আজারবাইজানের কথা শুনা যাচ্ছে, এই দেশটি কাগজে-কলমে মুসলিম হলেও বাস্তবে প্রচণ্ড সেক্যুলার এবং ওই অঞ্চলে ইসরায়েলের অন্যতম ঘনিষ্ট মিত্রদেশ।

অবশ্য এসবের বিকল্প হিসেবে ট্রাম্পের ইয়াহুদী জামাতা জারেড কুশনারের প্রস্তাবনা হলো- সেক্ষেত্রে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রিত গাযার শতকরা ৫৩ ভাগ অঞ্চলে পুনর্গঠন করে বেসামরিক ফিলিস্তিনীদের সেখানে পুনর্বাসন করে বাকি ৪৭ ভাগ হামাস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় হামাসকে নির্মূল করতে হবে। কিন্তু এই পরিকল্পনায় কয়েকটি বাধা রয়েছে, ইসরায়েল কিংবা আমেরিকা কোন ধরনের পুনঃনির্মাণের ব্যহ বহন করবে না, তা বহন করতে হবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে। কিন্তু গাযায় ইসরায়েলের কিংবা হামাসের উপস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো পুনঃনির্মাণে অর্থায়ন করবে না বলেই মনে হচ্ছে। সব মিলিয়ে জাতিসংঘের সিকউরিটি কাউন্সিলে পাশকৃত রেজুলেশনের বাস্তবায়নযোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্নবোধক চিহ্ন রয়েই গেছে, তদুপরি এই রেজুলেশন আসলে ফিলিস্তিনের সংকট নিরসনের কোন প্রস্তাবনা নয়, বরং কেবল দখলদার অবৈধ রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জোরদার করার কোশেশ। অবশ্য এই প্রেক্ষাপটেও কাতার এবং তুর্কি লবি কিছুটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতিকে ফিলিস্তিনের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য, যদিও সেটা মোটেও যথেষ্ট নয়।

কাতার এবং তুর্কির খানিকটা প্রচেষ্টা দেখা গেলেও ট্রাম্পের উপর সবচেয়ে বেশি বাস্তব প্রভাব রয়েছে যে দুটি দেশের সেই সৌদি এবং আমিরাতের ভূমিকা হতাশাজনক। আমিরাত তো প্রকাশ্যেই ইসরায়েলের পক্ষে এবং হামাসের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। সৌদির অবস্থানও আমিরাতের কাছাকাছিই বলা চলে। সর্বশেষ সৌদি যুবরাজ এমবিএস যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে জানিয়ে এসেছেন, তার দেশ কথিত ইবরাহীমী চুক্তিতে যোগদানের জন্য আগ্রহী, তবে তার জন্য ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শর্তারোপ করেছেন। বাস্তবে আল-আকসার তুফান না হলে হয়তো ফিলিস্তিনী রাষ্ট্র ছাড়াই এতদিনে সৌদি আরব কথিত ইবরাহীমী চুক্তির আওতায় ইসরায়েলের সাথে প্রকাশ্য কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে ফেলতো, কিন্তু তুফানের পরবর্তী পরিস্থিতিতে সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এতদসত্ত্বেও ট্রাম্পের সাথে বৈঠকে সৌদি যুবরাজের মূল আগ্রহের বিষয় ছিল ট্রাম্পকে কত বেশি খুশি করা যায়, কত বেশি বিনিয়োগের আশ্বাস দিয়ে তার আনুকূল্যের আশ্বাস পাওয়া যায়, ফিলিস্তিন সেখানে গৌণ বিষয়ই ছিল বলা চলে।

আরব নেতাদের নিকট ফিলিস্তিন গৌণ বিষয়ে পরিণত হলেও মার্কিন রাজনীতিতে অবশ্য ফিলিস্তিন বেশ শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। এর আগে কমলা হ্যারিসের পরাজয়ের পিছনেও ফিলিস্তিনে গণহত্যায় তার দলের ভূমিকার দায় যে অনেকাংশে ছিল, সেটা অনেকেই স্বীকার করেন। সর্বশেষ নিউ ইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ফিলিস্তিন যেন আরো শক্তিশালী আকারে হাযির হয়েছে। ডেমক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই নির্বাচনে জোহরান মামদানি ছাড়া আর  সকল প্রার্থীই ছিলেন ইসরায়েলপন্থী, পার্টির শীর্ষ নেতৃত্বের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জোহরান মামদানিকে সেই প্রাথমিক নির্বাচনে আটকানো সম্ভব হয়নি। শেষ পর্যন্ত প্রাথমিক নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থী কুওমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মূল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এই নভেম্বর মাসে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নিজ দলের প্রার্থীকে বাদ দিয়ে ডেমক্রেটিক দলছুট স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করেন কেবর ফিলিস্তিনপন্থী মামদানিকে হারানোর জন্যে। দলমত নির্বিশেষে পুরো আমেরিকার ইসরায়েলপন্থী বিলিয়নিয়ার এবং রাজনীতিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টাকে হারিয়ে মামদানি নির্বাচিত হন। মার্কিন রাজনীতিতে জায়োনিস্ট প্রভাবকে এতোটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে এর আগে আর কোথাও পড়তে হয়নি, সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও জায়োনিস্ট তহবিল তরুণ মামদানির কাছে হার মানে।

বিভিন্ন ইস্যুতে মামদানির অবস্থান নিয়ে সমালোচনার সুযোগ থাকলেও, ইসরায়েলের বাইরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ইয়াহুদীদের শহর খ্যাত নিউ ইয়র্কে প্রকাশ্যে ইসরায়েলের গণহত্যার সমালোচনাকারী মেয়র নির্বাচিত হওয়া নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক ঘটনা। ইতিপূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এরকম প্রকাশ্যে ইসরায়েলী লবির বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের মানে ছিল রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি, কিন্তু মামদানি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে মার্কিন রাজনীতিতে বইছে উলটো হাওয়া। বহু রাজনীতিবিদ এখন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিচ্ছেন যে, আমরা আইপ্যাক (সবচেয়ে প্রভাবশালী ইসরায়েলী লবি) থেকে কোন ধরনের অর্থ সহযোগিতা নিচ্ছি না, অর্থাৎ এখন রাজনৈতিক ক্যারিয়ার নিরাপদ রাখার জন্য ইসরায়েল থেকে দূরত্ব বজায়ের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে, অথচ এই কিছুদিন আগেও পরিস্থিতি ছিল ঠিক বিপরীত। নির্বাচনে বিজয়ী জোহরান মামদানি তার রাজনৈতিক শত্রু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতে গিয়েও নিজের অবস্থান থেকে একটুও বিচ্যূত হননি, উলটো ট্রাম্পের পাশে দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আমি বিশ্বাস করি ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে এবং আমাদের (মার্কিন) সরকার সে গণহত্যার অর্থায়ন করছে। ইসরায়েলকে এই প্রথম কেউ সম্ভবত ট্রাম্পের মুখের উপর গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করলো। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনমত যেভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তাতে রাজনীতিবিদদের মধ্যে এমন সাহস তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ঘটনাই বটে।

সর্বোপরি, আল-আকসার তুফান শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ব জনমত ফিলিস্তিনের মযলুম জনগোষ্ঠীর পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে, ইতিহাসে এই প্রথম সংখ্যাগরিষ্ঠ মার্কিন জনগোষ্ঠী ইসরায়েলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে, এসবই ফিলিস্তিনীদের সংগ্রামের জন্য ইতিবাচক। যদিও আল-আকসার তুফানের শহীদ আর আহতদের সংখ্যা, বাস্তুচ্যূত অসহায় বনী আদমের পরিস্থিতি বিবেচনায় এ অর্জন খুবই সামান্য, তবু এমন ছোট ছোট অর্জনই ফিলিস্তিনীদের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করবে, এই প্রত্যাশা করি।

ফেইসবুকে আমরা...