পাঁচ দিনের সফরে স্পেনে গিয়েছিলাম। স্পেন ইউরোপের অন্য দশটি দেশের মতো নয়। এই অঞ্চলের সাথে আমাদের আনন্দ-বেদনার সাতটি শতাব্দী জড়িয়ে আছে। তবে ৭১১ খ্রিষ্টাব্দে মহাবীর তারিক ইবন যিয়াদ যে পথ ধরে হিসপানিয়াতে প্রবেশ করেছিলেন, আমি তার ঠিক উলটোদিকে প্রবেশ করেছি। তিনি এসেছিলেন স্পেনের দক্ষিণ দিক থেকে। উত্তর আফ্রিকার সিউটা শহর পেরিয়ে প্রবেশ করেছিলেন জাবাল আত তারিক বা জিব্রাল্টার প্রণালীতে। আমি গিয়েছিলাম স্পেনের উত্তরপূর্ব দিক থেকে, বার্সালোনা হয়ে।
ইতালি থেকে স্পেনের বার্সালোনায় যখন পৌঁছাই, রাত তখন প্রায় দুইটা। খাওয়াদাওয়া করে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে আনজুমানে আল ইসলাহ নেতৃবৃন্দ ও লতিফিয়া ফুলতলী মসজিদের দায়িত্বশীলদের সাথে বার্সালোনা শহরটি দেখতে বের হলাম। তাঁরা বললেন, “প্রথমে রামলায় যাব। রামলায় গিয়ে একবার না হাটলে বার্সালোনায় আসা বৃথা।” গেলাম রামলায়। গিয়ে দেখি রামলা হচ্ছে একটি রাস্তা। হাজার হাজার মানুষ হাঁটছে। কেউ জানে না কেন হাঁটছে। তবে সবাই দায়িত্ব মনে করে হাঁটছে। আশেপাশে প্রচুর দোকানপাট। রামলা দিয়ে হেঁটে চলে গেলাম কাতালোনিয়া স্কয়ারে। বার্সালোনার লোকেরা কাতালান জাতিভুক্ত। এরা স্পেন থেকে আলাদা হওয়ার জন্য প্রায়ই আন্দোলন করে। আর তাদের সমস্ত আন্দোলনের মুক্তমঞ্চ হচ্ছে এই কাতালোনিয়া স্কয়ার। একজন বললেন, “এফসি বার্সালোনা যখন কোনো কাপ জিতে, তখন তাদের খেলোয়াড়রা এখানে এসে বিজয় উদযাপন করে। মেসিও থাকে।” আমি কী বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। নিরাপদ অপশন মনে করে বললাম, সুবহানাল্লাহ!
পরে গেলাম মন্টজুয়িক পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের ওপর চড়তেই নিচের দিকে চোখে পড়ল বার্সালোনা সমুদ্রবন্দর। চোখ আটকে গেল। স্পেন সুন্দর, বার্সালোনা আরও সুন্দর, আর ভূমধ্যসাগরের কিনারা ঘেষা সমুদ্রবন্দরটি তার চেয়ে বেশি সুন্দর। শান্ত গাঢ় নীল জলরাশির বুকে দাঁড়িয়ে আছে সাদা সাদা জাহাজ। একেকটার সাইজ আন্দাজ করা দুরূহ। পণ্য নামানো হচ্ছে। মনে পড়ল, আমাদের রব পবিত্র কুরআনে বলেছেন,
وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنفَعُ النَّاسَ
-(এবং নিদর্শন রয়েছে) সেসব জাহাজে, যা সমুদ্রে মানুষের জন্য উপকারী মালামাল নিয়ে চলাচল করে। (সূরা বাকারা, আয়াত-১৬৪)
সমুদ্রবন্দরে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে চলে গেলাম মন্টজুয়িক ন্যাশনাল প্যালেসে, তারপর সাগ্রাদা ফ্যামিলিয়া ক্যাথিড্রালে। বেশিরভাগই আধুনিক স্থাপনা। কাতালান জাতির লোকেরা এসব স্থাপনায় তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য নিয়ে এসেছে। তবে ওগুলোর ইতিহাস জানি না। ইউরোপের ইতিহাস বলতে আমরা মূলত ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসকেই পড়ি। তাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাস নিয়ে পড়া হয়নি তেমন। তাছাড়া এমনিতেও ইতিহাসের পাতা মূলত রাজা-বাদশারাই দখল করে রাখেন। সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র ইতিহাসের পাতায় তেমন গুরুত্ব পায় না।
রাতে বার্সালোনার ফুলতলী ইসলামিক সেন্টারে মাহফিল ছিল। মাহফিল শেষে প্রায় আড়াইটার দিকে আমরা সবাই একত্রে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গীদের দাবী ছিল, সমুদ্রে নাকি হু হু বাতাস। গিয়ে দেখি গরমে গা পুড়ে যাচ্ছে। একজনকে দেখলাম এদিকে ওদিকে কী জানি খুঁজছেন। জিজ্ঞেস করলাম, কী খুঁজেন ভাই? বললেন, “বাতাস ভাই, বাতাস।” পরদিন দুপুরের ফ্লাইটে চলে এলাম রাজধানী মাদ্রিদে।
স্পেনের রাস্তাঘাট প্রশস্ত। অত্যাধুনিক স্থাপনার ভিড়েও প্রকৃতি তার নিজের জায়গা দখল করে আছে। প্রচুর গাছগাছালি। তবে পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় রাস্তা উঁচু নিচু। রাতে মাদ্রিদের আল ইসলাহ মসজিদে মাহফিল ছিল। পরদিন মাদ্রিদ শহর ঘুরে দেখলাম। প্রথমে গেলাম জিরো পয়েন্ট, পুরো স্পেনের মধ্যবিন্দুতে। এরপর প্লাসা এস্পানিয়া, রয়াল প্যালেস, রেতিরো পার্ক দেখা হলো। রেতিরো পার্কের লেকে নৌকা ভ্রমণ আমার জন্য সবচেয়ে বেশি আনন্দময় ছিল। তবে এই নৌকা ভ্রমণকে আমাদের দেশের বন্যায় বিস্তৃত হাওড়ে নৌকা ভ্রমণের সাথে তুলনা করলে অপরাধ হবে। বিষয় যখন পানি ও নৌকা ভ্রমণ, তখন কেউ বাংলাদেশের আশেপাশেও আসতে পারবে না। পরদিন চলে গেলাম কর্ডোভা শহরে। বিশাল বড় এক মাইক্রোবাস নিয়ে আমরা ৯ জন মানুষ চললাম মুসলমানদের গৌরব, প্রাপ্তি ও হাহাকার মেশানো শহর কর্ডোভার দিকে।
কর্ডোভাকে আমি কীভাবে তুলে ধরব বুঝতে পারছি না। পাওয়া ও না পাওয়ার গল্প বলা গেলেও পেয়ে হারানোর গল্প সহজে বয়ান করা যায় না। সূক্ষ্ম একটি ব্যথা কোথায় জানি বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কর্ডোভায় পৌঁছার পর বারবার মনে হচ্ছিল, শহরটি এত দমবন্ধ কেন! পরে বুঝতে পেরেছি, শহর নয়, আমার স্মৃতি দমবন্ধ হয়ে গেছে। কত গৌরবের কর্ডোভা আমাদের, আজ পড়ে আছে এক প্রকার অসহায় অবস্থায়।
৭১১ সালে মাত্র সাত হাজার সৈন্যের ছোট্ট একটি বাহিনী উত্তর আফ্রিকা থেকে জিব্রাল্টার প্রণালী হয়ে আইবেরিয় উপদ্বীপে এসে পৌঁছেছিল। দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মহাবীর তারিক ইবন যিয়াদ। হিস্পানিয়ার রাজা রডারিকের অপশাসনে ত্যক্তবিরক্ত খ্রিস্টান ও ইয়াহুদীরা মুসলিম বাহিনীকে সহায়তা করেছিল। জিব্রাল্টারে পৌঁছে সবগুলো জাহাজ পুড়িয়ে দিয়েছিলেন তারিক। সৈন্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, “তোমাদের সামনে শত্রু, পেছনে সমুদ্র, হাতে খোলা তরবারি।” সাত হাজার সৈন্যকে আটকানোর জন্য রডারিক এক লক্ষ সেনা প্রেরণ করেছিল। কিন্তু শাহাদত যাদের আজন্ম লক্ষ্য, সংখ্যা তাঁদের কাছে গৌণ। আল্লাহ ওই যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেছিলেন। কিছুদিন পর তারিকের সাথে এসে যুক্ত হন আফ্রিকার গভর্নর মূসা ইবন নুসায়ের। দুই বীরের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরবর্তী তিন বছরে প্রায় পুরো হিস্পানিয়া মুসলমানদের অধীনে চলে এসেছিল।
আন্দালুস দুনিয়াকে কী কী দিয়েছে, তা লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। অন্ধকারে ডুবে থাকা কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইউরোপের সামনে ধর্মশিক্ষা, দর্শন, শিল্প, সাহিত্য, ইতিহাস, সংস্কৃতি, চিকিৎসা ও স্থাপত্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে আন্দালুস। গ্রিক দর্শনকে পুনরায় যিন্দা করেছে আন্দালুস। ইবন আরাবীর মতো সুফী দার্শনিক, ইবন হাযামের মতো ফকীহ, ইবন রুশদের মতো দার্শনিক, আব্বাস ইবন ফিরনাসের মতো বিজ্ঞানী, যারকাওয়ী ও ইবন জুলজুলের মতো চিকিৎসক বিশ্বকে উপহার দিয়েছে আন্দালুস। আন্দালুসের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে ইউরোপের তরুণরা রেনেসাঁ ও রেফোরমেশনের মতো আন্দোলন সফল করেছিল। আর সেই আন্দালুসের প্রধান কেন্দ্র ছিল কর্ডোভা। একাদশ শতাব্দী থেকে স্পেনে মুসলিম শাসন কমজোর হতে শুরু করে। ১৪৯২ সালে সর্বশেষ গ্রানাডার পতনের পর হিস্পানিয়ায় মুসলমানদের সোনালি যুগ সমাপ্ত হয়েছিল। কি যে ভয়াবহ ছিল সে সময়টি! গণহত্যা, গণবিতাড়ন ও জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ কিছুই বাদ দেয়নি ওরা। মুসলমানদেরকে জাহাজে ভরে উত্তর আফ্রিকার সাগরপাড়ে নিয়ে এসে জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আন্দালুসের ওই সোনালি যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্মৃতিচিহ্ন হয়ে আছে কর্ডোভা মসজিদ। ৭৮৫ সালে আন্দালুসের প্রথম উমাইয়া আমীর আবদুর রাহমান ইবন মুআবিয়া ইবন হিশামের শাসনামলে এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এরপর বহুবার সংস্কার ও পরিবর্ধনের ফলে মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের এক যুগান্তকারী স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে দাঁড়ায়। ১২৩৬ সালে ‘রিকনকোয়েস্তা’ আন্দোলনের সময় খ্রিস্টানরা মসজিদটি দখল করে ক্যাথিড্রাল বানিয়ে দেয়। আজ মসজিদের ভেতর নামাজ নিষিদ্ধ, কোণায় কোণায় মূর্তিতে ঠাসা। বাইরের সুদৃশ্য সেহেন জুড়ে আছে ঝর্ণা ও গাছগাছালি। অষ্টম শতাব্দীর মিনারাত জানিয়ে দিচ্ছে ফেলে আসা সোনালি অতীতের কথা। ভেতরে প্রবেশ করে আমরা কেউই চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমাদের মসজিদের এই হাল! এখানে বসে ইমাম কুরতুবী তাফসীরের দারস দিতেন। এখানে বসে বাকী ইবন মাখলাদ, ইয়াহইয়া ইবন ইয়াহইয়া হাদীসের দারস দিতেন। আজ শূন্য মেহরাবটি পড়ে আছে একজন ইমামের অপেক্ষায়।
মসজিদের আকার-আকৃতি ও নকশা প্রায় হুবহু মিলে যায় তুর্কী আমলের মসজিদে নববী ও মিশরের আমর ইবনুল আস মসজিদ এবং আল আযহার মসজিদের সাথে। মসজিদের প্রতিটি কোণা ও নতুনভাবে নির্মিত বৃহদাংশ এখন ক্যাথিড্রালে পরিণত হয়েছে। যেদিকে তাকাই, শুধু খ্রিস্টান সংস্কৃতির বিকৃত রূপই চোখে পড়ে। যতক্ষণ ভেতরে ছিলাম, ততক্ষণ সিকিউরিটি আমাদের ওপর কড়া দৃষ্টি রেখেছে, যেন নামাজে না দাঁড়াই।
বের হয়ে এসে দাড়িয়েছি আন্দালুসের ওয়াদি আল কাবীর নদীর কিনারে। মুসলিম স্পেনের শেষ স্মৃতিচিহ্নের অন্যতম একসময়ের খরস্রোতা এই নদীটি আজ প্রায় মরে যাচ্ছে। মহাকবি আল্লামা ইকবাল এসেছিলেন এই নদীর পারে। বলে গেছেন, “কাবীর নদীর স্রোত, তোর কিনারে দাঁড়িয়ে কেউ একজন অন্য এক যুগের স্বপ্ন দেখছে।”
যুহরের নামাযের জন্য সারা কর্ডোভা খুঁজে খুঁজে একটি মসজিদ বের করেছি। নাম, আন্দালুসিদের মসজিদ। ছোট্ট এই মসজিদে আমরা জামাআতে নামায আদায় করেছি। প্রতিটি তাকবীরের সাথে আন্দালুসকে হারানোর আক্ষেপ ও ফিরে পাওয়ার বাসনা মিশে যাচ্ছিল।
কর্ডোভা থেকে ফিরে এসেছি ওদিনই। পরদিন স্পেন থেকেও চলে এসেছি। কিন্তু কর্ডোভা মসজিদের ওই বেদনাবিধুর চাহনি হৃদয়ে গেঁথে আছে। ওই মিনারাত, ওই দেয়ালের রঙ, ওই ছাদের নকশা, ওই সারিবদ্ধ পাথরের স্তম্ভ, ওই শূন্য মেহরাব আমাকে অপরাধী বানিয়ে দিয়েছে। জানি না, কর্ডোভা মসজিদ ব্যর্থ এই উম্মাহকে কভু ক্ষমা করবে কিনা।