1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
আজকের বাংলাদেশ : ইসলাম, রাষ্ট্র ও সমাজচিন্তা
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

জুলাইয়ের রক্তক্ষয়ী গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ এখন একটি উত্তরণপ্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসানের পর অনুমিতভাবেই দেশে কিছুটা অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বর্তমানে রাজনৈতিক দল, ছাত্রসমাজ, পেশাজীবি, বুদ্ধিজীবী নানা মহলের নানা আকাঙ্খা মিলিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা বিপুল। আইনজ্ঞদের পক্ষ থেকে সংবিধান পুনঃলিখন; কমপক্ষে সংশোধনের দাবি উঠেছে। ইসলামী দলগুলোর পক্ষ থেকেও নানা চাওয়া-পাওয়ার কথা আসছে। নির্বাচনমুখী ইসলামী দল, অর্থাৎ যারা প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশে ‘ইসলামী শাসন’ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখে, তাদেরকে একইসাথে রাষ্ট্র সংস্কারের পরামর্শ ও ‘যৌক্তিক সময়ে’ নির্বাচনের দাবি নিয়ে নিজেদের পক্ষে জনমত গঠন করতে তৎপর দেখা যাচ্ছে। এতকাল একে অন্যের বিরুদ্ধে অবিরাম অভিযোগের তীর দাগা দলগুলোও ভোটের তালাশে একে অন্যের হাত ধরছে। রাজনীতি এমনই। ভোটের রাজনীতিতে যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন। তবে কার প্রত্যাশা কতটুকু পুরোন হবে, তা অবশ্য সময়ই বলে দেবে।

গণতান্ত্রিক ইসলামী দল ছাড়াও আরেকদল ইসলামী তাত্ত্বিকের কাছ থেকে শরীআহ শাসনের জোর আলাপ শোনা যাচ্ছে। যাদের পক্ষ থেকে এধরণের আলাপ আসছে, তাঁরা রাষ্ট্রচিন্তার ক্ষেত্রে প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সমর্থক নন। বরং একটি বৈপ্লবিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে শরীআহ শাসন প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতি। বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে শরীআহ কায়িম বা ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করার আলাপ বাংলাদেশে একদম নতুন নয়। ক্ষীণস্বরে আগেও হতো, আলিম-উলামা নিজনিজ পরিসরে করতেন। তবে আওয়ামীলীগ আমলে এসব আলাপে মানুষ খুব যুৎ পেতো না। গোয়েন্দা সংস্থা গুম করে ফেলবে, সে আশঙ্কার তো ছিলই; সাথে আরেকটি সমস্যা ছিল। তখন কোনো কথা বলার আগে ভাবতে হতো, কথাটি আওয়ামীলীগ কর্তৃক নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ন্যারেটিভের ভেতর ফিট হচ্ছে কি না! কারণ ফিট না হলেই জঙ্গি তকমা গায়ে লাগবে। এখন সময় বদলেছে। মুক্তিযুদ্ধ আজও প্রাসঙ্গিক; তবে চেতনার মার্কেটে মন্দা দেখা দিয়েছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আজ অনেকেই প্রকাশ্যে শরীআহ শাসনের প্রয়োজনীয়তা ও এর রূপকল্প নিয়ে কথা বলছেন। লক্ষ-কোটি মুসলমানের মতো আমারও আকাঙ্খা, আল্লাহর দ্বীন ও আমার নবী e এর জীবনাদর্শ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রতিটি পরিসরে প্রতিষ্ঠিত হোক। আমি বিশ্বাস করি, প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবে না। এজন্য সে পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে, যে পদ্ধতিতে রাসূলুল্লাহ e জাযিরাতুল আরবে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আমার এরূপ ভাবনা নতুন কিছু নয়। আগেও বহুবার বলেছি। আজ শরীআহ ও রাষ্ট্রসংক্রান্ত বর্তমানে যেসব আলাপ হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে কিছু কথা বলব।

ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তার ব্যাপারে মাঝেমাঝে সরলমনা মুসলমানদের মধ্যে এমন বালকসুলভ আবেগের উপস্থিতি দেখতে পাই, মনে হয়, যুগের জটিলতা এরা ঠাহর করতে পারে না। শরীআহ চাই, খিলাফাহ চাই, এই চাই, ওই চাই− যেন কুলকায়েনাত পানদান সাজিয়ে বসেছে আমাদেরকে দেওয়ার জন্য। আবার ইসলামী তাত্ত্বিকদেরকে শুধু শরীআহ শাসনের উপকারিতা ও এর প্রতিষ্ঠাপদ্ধতি নিয়ে আলাপ করতে দেখা যায়। এর মুশকিলাত ও বাংলার আবহমান সমাজ-সংস্কৃতির সাথে এর যে কিছু অনিবার্য দেনদরবার সৃষ্টি হবে, তা নিয়ে খুব একটা কথা শোনা যায় না। এ প্রবন্ধে আমি বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসলামী রাষ্ট্রচিন্তার তিনটি অবশ্যম্ভাবী চ্যালেঞ্জ তুলে ধরব, যা নিয়ে কাজ করা উচিত।

প্রথমত, উসমানী সালতানাতের পতনের পর গত একশ বছরে খিলাফতের আদলে বিশ্বে কোনো শরীআহ রাষ্ট্র কায়িম হয়নি। অনেকে আফগানিস্তানের কথা আনবেন। তবে আমাদের দেশের বাস্তবতায় আফগানিস্তানের উদাহরণ কেন প্রাসঙ্গিক নয়, তা পরে বলছি। উল্টো গত এক শতকে যা হয়েছে, তা হলো, বিশ্বজুড়ে ভাষা ও ভৌগোলিকতার ভিত্তিতে বহু আধুনিক জাতিরাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে বললে ভুল হবে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা এসব জাতিরাষ্ট্র গড়ে দিয়েছে। আধুনিক জাতিরাষ্ট্রগুলো গঠনগতভাবে সেক্যুলার। তাই তারা তাদের নাগরিকদের কাছে ধর্মকে শুধু ‘ব্যক্তিগত বিষয়’ বলেই পরিচয় করিয়ে আসছে। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও এটি হয়েছে। ফলে, বেশিরভাগ মুসলমানের কাছে আজ ইসলামী শরীআর ব্যাপকতা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা নেই। বাংলাদেশের কথাই ধরুন। বিশ্বখ্যাত পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০১৩ সালের এক সার্ভে অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৮২% মানুষ শরীআহ শাসন চায়। যদি জানতে চান, শরীআহ শাসন বলতে এরা কী বুঝে? দেখবেন বেশিরভাগ মানুষ শরীআহ শাসন বলতে বুঝে ‘হুজুরদের শাসন’। দাড়ি-চাঁছা ওবায়দুল কাদেরের পরিবর্তে দাড়িওয়ালা ওবায়দুল কাদের ক্ষমতায় আরোহন করলেই দেশে ইসলামী শাসন কায়িম হয়ে গেছে ভেবে খুশিতে আটখানা হয়ে যাবে, এমন মানুষের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। বেশ থেকে বেশ, মানুষ শরীআহ বলতে বুঝে হাতকাটা, দোররা মারা বা এরকম কিছু শাস্তিবিধান। অথচ শাস্তিবিধান শরীআর একটি অংশমাত্র। শরীআহ যে একটি পরিপূর্ণ জীবনদর্শন, চিন্তা-চাহিদার একটি স্বতন্ত্র মানদণ্ড− তা সিংহভাগ মুসলমানের চিন্তায় অনুপস্থিত। আমাদের মানুষ ইসলামপ্রিয়, এতে সন্দেহ নেই। তবে কোন ইসলাম? একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান, নাকি একটি প্রথাসর্বস্ব অলৌকিক ধর্ম? কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া জবাব সম্ভবত দ্বিতীয়টিই হবে। তার ওপর ইসলামী রাষ্ট্র নিয়ে মানুষের উদ্ভট কল্পনার অন্ত নেই। মানুষ ভাবে, ইসলামী রাষ্ট্র হলে পুলিশ রাস্তায় হেঁটে হেঁটে মানুষের দাড়ির দৈর্ঘ্য-প্রস্ত মাপবে, মেয়েদের জবরদস্তি আবায়া পরাবে, মুখে থার্মোমিটার লাগিয়ে দেখবে রোযা রাখছে কি না! অথচ জোর করে কাউকে ধার্মিক বানানো রাষ্ট্রের দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে না। এর জন্য সামাজিক শিক্ষা ও দ্বীনি তারবিয়ত আছে।

মোদ্দাকথা হলো, এ দেশের মানুষের কাছে ইসলাম এখনও কিছু বিশ্বাস, প্রাত্যহিক ইবাদত ও রিচুয়ালের ওপরে উঠতে পারেনি। ইসলাম এখনও গতানুগতিক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, এমনকি প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতির বিকল্প হিসেবেও মানুষের সামনে হাযির হয়নি। আমরা হাযির করিনি। তাই প্রথমে মানুষের কাছে দ্বীন ও শরীআহ, এর দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ও ব্যাপ্তিকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। অন্তত একটি প্রজন্ম তৈরি করা উচিত, যাদের কাছে ইসলামী শরীআহ প্রচলিত সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিয়মনীতির একটি যৌক্তিক বিকল্প (Viable option) হিসেবে হাযির থাকবে। এটি হয়ে যাওয়ার পর পরবর্তী ধাপে গেলে তা হবে টেকসই। ইসলামী শাসন কেবল প্রতিষ্ঠা করেই তো শেষ নয়, এটিকে টিকাতে হবে। টিকাতে হলে এমন একটি প্রজন্মের সর্বাত্মক সমর্থন লাগবে, যারা জেনেশুনে ইসলামকে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের ইসলামপন্থিরা ধর্মীয়ভাবে একজাতীয় (Homogenized) নয়। এখানে বিভিন্ন মাসলাক ও ঘরানার লক্ষ্যণীয় উপস্থিতি আছে। রাষ্ট্রে শরীআহ শাসন কায়িম করার ক্ষেত্রে প্রশ্ন আসবে, কার শরীআহ কায়িম হবে? কারণ শরীআহ এক হলেও এর ব্যাখ্যায় ভিন্নতা আছে। শরীআহ আইন যেহেতু রাষ্ট্রীয় আইন হবে, তখন শরীআর ব্যাখ্যায় ন্যুনতম একজাতীয়তা তো চাই। নইলে আইন প্রণয়ন হবে কীভাবে? এবার আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ আনছি। আফগানিস্তানে এ সমস্যা এতটা প্রকট নয়। ওখানে প্রায় ৯৯ শতাংশ মানুষ মুসলিম, যার মধ্যে ৮৭ শতাংশ সুন্নী। তালেবানসহ আফগানিস্তানের সুন্নী মুসলমানরা প্রায় সবাই মাযহাবে হানাফী। অন্যরাও আছে, তবে খুব নগণ্য। এটি অন্তত তাদের ইসলামী অঙ্গনকে একজাতীয় করে রেখেছে। দ্বিতীয়ত, আফগানিস্তানে পশ্চিমা সংস্কৃতির এতটা প্রভাব বিস্তার হয়নি, যা ইন্টারনেটের কল্যাণে আমাদের দেশে হয়েছে। তৃতীয়ত, আফগান জাতির সমাজ-সংস্কৃতির মাঝেই ইসলাম গেঁথে আছে। ওই সমাজের রীতি-রেওয়াজ আগে থেকেই ইসলামী। এ বিষয়গুলো তালেবানকে আফগানিস্তানের ক্ষমতা সংরক্ষণ করতে সাহায্য করেছে। এমন নয় যে, ওখানে সব মানুষ তালেবান সমর্থক। তবে একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অবশ্যই আছে। বাংলাদেশে শরীআহ শাসনের আলাপকালে এটি ভাবার প্রয়োজন আছে যে, শরীআর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ন্যুনতম একজাতীয়তা আনা যায় কীভাবে। নইলে শরীআহ শাসন সংক্রান্ত আলাপগুলো কেবল সেমিনারের হাততালি আর ওয়ায মাহফিলের ‘ঠিক কি না’-তে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকবে।

তৃতীয়ত, শরীআহ ও রাষ্ট্র নিয়ে আলাপকালে সমাজ ও সামাজিক প্রয়োজনীয়তাকে পাশ কাটিয়ে গেলে হবে না। জেনে রাখা উচিত, রাষ্ট্র সমাজকে সৃষ্টি করে না; উল্টো সমাজ তার প্রয়োজনে রাষ্ট্রকে সৃষ্টি করে। মানুষ যখন একত্রে বসবাস করে, তখন আপনাআপনি একটি সমাজ গড়ে উঠে। প্রত্যেক সমাজের কিছু অলিখিত নিয়মনীতি থাকে, যার দ্বারা সমাজ টিকে থাকে। বাগড়া বাঁধে তখন, যখন কেউ এসব নিয়মনীতি ভঙ্গ করে। প্রশ্ন আসে, কেউ সমাজের নিয়মনীতি ভঙ্গ করলে তার বিচার কে করবে? সমাজের তো সেরকম কোনো ফোর্স নেই, অথোরিটি নেই। সমাজের মানুষ দোষী ব্যক্তির সাথে সামাজিক সম্পর্কচ্ছেদ করতে পারে। কিন্তু এটি তো কোনো যৌক্তিক বিচার নয়। তাছাড়া সমাজের সবাই যদি এক ব্যক্তির ওপর অবিচার করে, তখন ব্যক্তির নিরাপত্তা কে নিশ্চিত করবে? এসব প্রয়োজন মেটানোর জন্য দরকার হয় একটি প্রতিষ্ঠানের, যার শক্তি আছে এবং যা সমাজের কেন্দ্রে অবস্থান করে সমাজের মানুষকে নিরাপত্তা দেবে, বিচার করবে। এ প্রতিষ্ঠানই হচ্ছে রাষ্ট্র। সমাজের ভেতর থেকে সামাজিক চুক্তির মাধ্যমে যে প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে, তা-ই হচ্ছে রাষ্ট্র। বলা হয়, Society is natural and instinctive, and the state is the creation of will and reason. অতএব অবধারিতভাবে, যে সমাজে যে আদর্শ লালিত হয়, সে রাষ্ট্রেও ওই আদর্শের প্রতিফলন ঘটে।

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশের সমাজ কি ইসলামের আদর্শ দ্বারা লালিত? আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো কি ইসলামপন্থিদের দ্বারা প্রভাবিত? আমার মতে, পুরোপুরি নয়। ধর্মীয় কাজ তথা ইমামতী, মাদরাসার শিক্ষকতা, ওয়ায মাহফিল ইত্যাদি বাদ দিয়ে শুধু সামাজিক ক্ষেত্রে বিবেচনা করলে, আমাদের ইসলামী ব্যক্তিবর্গ এখনও সমাজের মূল নিয়ন্তা নন। এখনও সামাজিক পরিসরে হুযুরদের ডাক পড়ে উদ্বোধনী তিলাওয়াত, পরিশেষে মোনাজাত, আকীকা, বিয়ে পড়ানো বা কুলখানি টাইপের কাজে। দুঃখের বিষয়, ইউরোপ-আমেরিকার মতো ধর্মহীন সমাজেও বর-কনেকে বিয়ের জন্য পাদ্রীর কাছে চার্চে যেতে হয়। পাদ্রী কারও বাড়িতে যায় না। অথচ উপমহাদেশের মুসলিম সমাজে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে দেখা যায়, পাঞ্জাবি-টুপি পরা কাজী সাহেব রেজিস্ট্রার খাতা বগলে নিয়ে বিয়ের সেন্টার থেকে সেন্টারে দৌড়াদৌড়ি করছেন। বিষয়টি সমাজে হুজুরদের দুরাবস্থা সুক্ষ্মভাবে জানান দেয়। আমাদের ইমামগণ পাঁচ ওয়াক্তের নামায পড়ানো ছাড়া সারাদিন বেকার বসে থাকেন। না একটি ব্যবসা করেন, না সামাজিক কাজে অংশ নেন। তাই ইমাম কেবল নামাযের ইমাম হয়ে রয়ে যান; সমাজের ইমাম হতে পারেন না। গ্রাম ও আবাসিক এলাকাভিত্তিক যে সামাজিক সংস্থা গড়ে উঠে, খুব কম ক্ষেত্রে তাতে আলিম-উলামার প্রভাব ও নেতৃত্ব থাকে। ইসলামী ব্যক্তিবর্গ সামাজিক কাজ বা কর্মমুখী শিক্ষা গ্রহণেও অমনোযোগী। এর ফলে সমাজে দাড়ি-টুপিওয়ালাদের জনপ্রিয়তা হয়তো আছে, কিন্তু প্রভাব কম। ব্যতিক্রম নেই বলছি না। কিন্তু সেই ব্যতিক্রমও খুব কম। তবে এক্ষেত্রে পীর-মাশাইখের বিষয়টি অনন্য। সমাজে তাঁদের প্রভাব চোখে পড়ার মতো।

তাই সমাজ ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইসলামী ব্যক্তিবর্গ, উলামা-মাশাইখ, ইমাম, ইসলামী রাজনীতিবিদ ও দাঈদের প্রভাব বৃদ্ধি করলে একসময় সে প্রভাব রাষ্ট্রেও বিস্তার করবে। এমন নয় যে, সমাজকে প্রভাবিত করলে রাষ্ট্র আপনাআপনি প্রভাবিত হয়ে যাবে। এর জন্য আলাদা করে চেষ্টা করতে হবে, সেটি গণতান্ত্রিক হোক কিংবা বিপ্লবী। তবে যদি সমাজ ইসলাম ও ইসলামপন্থিদের দ্বারা প্রভাবিত থাকে, তাইলে রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করা সহজ ও টেকসই হবে।

এই যে তিনটি চ্যালেঞ্জের কথা বললাম−মানুষের কাছে শরীআর ব্যাপকতাকে স্পষ্ট করার মাধ্যমে একটি প্রকৃত ইসলামী প্রজন্ম তৈরি করা, ন্যুনতম ধর্মীয় একজাতীয়তা নিশ্চিত করা এবং ইসলামকে সমাজের প্রভাবক শক্তি হিসেবে হাযির করা−এগুলো নিয়ে প্রথমে কাজ করতে হবে। এছাড়া আরেকটি সামাজিক সূত্র মনে রাখতে হবে যে, একটি সমাজে নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব হুট করে পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু ‘সিস্টেম’ হুট করে পরিবর্তন হয় না। হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশে ক্ষণিকের জন্য নেতৃত্ব বা কর্তৃত্বের শূন্যতা দেখা দিয়েছে সত্য, কিন্তু দেশের সিস্টেমে শূন্যতা আসেনি। দেশের রাজনীতির সিস্টেম ছিল গণতন্ত্র, এখনও তা-ই আছে। অর্থনীতি ছিল ধনতন্ত্র বা পুঁজিবাদ, এখনও তা-ই আছে। আমাদের সামাজিক চিন্তা, আমাদের খাসলত আগে যা ছিল, এখনও তা-ই আছে। দেশে একটি স্বৈরাচারবিরোধী গণঅভ্যুত্থান হয়েছে; আমূল পরিবর্তনকারী বিপ্লব হয়নি। তাই ইসলামপন্থিদের এটি মনে করার কারণ নেই যে, নেতৃত্বের শূন্যতায় কেউ তাঁদেরকে এনে বসিয়ে দেবে। না, এক গণতান্ত্রিক সরকারের পরিবর্তে আরেক গণতান্ত্রিক সরকারই আসবে। ইসলামপন্থিদেরকে নিজেদের মতাদর্শ কায়িম করতে হলে সমাজের প্রচলিত সিস্টেমকে ধীরে ধীরে পরিবর্তন করতে হবে, এরপর রাষ্ট্রগঠন তাঁদের জন্য সহজ হবে। এর আগে জোরপূর্বক নিজের মতাদর্শ (সেটি যত ভালো হোক) চাপিয়ে দেওয়ার চিন্তা করাও বিপদজনক। চাপিয়ে দেওয়া কোনো কিছু মানুষ বেশিদিন সহ্য করে না। শেখ হাসিনার শাসনামল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

আমার মতে, ইসলামপন্থি, ইসলামী তাত্ত্বিক ও দাঈদের সামনে এখন চারটি মূল কাজ। প্রথম কাজ হচ্ছে, দাওয়াতী মেজাযে ইসলামী শরীআহ, এর দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, চাহিদা ও ব্যাপ্তিকে মানুষের কাছে তুলে ধরা। আম মানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য জুমআপূর্ব আলোচনা ও ওয়াযের ময়দান উপযুক্ত। আবার ইন্টেলিজেন্সিয়াকে আকৃষ্ট করতে বই ও ম্যাগাজিন প্রকাশ করা, সভা-সেমিনারের আয়োজন করা এবং সর্বোপরি অনলাইন এক্টিভিজম জরুরি। মনে রাখা উচিত, একটি আদর্শ কেবল আম মানুষের কাছে জনপ্রিয় হলেই রাষ্ট্রে সেটি প্রতিষ্ঠিত হবে না, যতক্ষণ না সমাজের ব্রেইন ট্রাস্ট তথা বুদ্ধিজীবীদের একাংশকে আকৃষ্ট করা যাবে। শেষপর্যন্ত রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এরাই নিয়ে থাকে। একইসাথে কিছু বিশেষায়িত মাদরাসা ও ইন্সটিটিউট গড়ে তুলা উচিত, যেখানে প্রথাগত কারিকুলামের বাইরেও ক্লাসিক ইলম শিক্ষা দেওয়া হবে। দ্বিতীয় কাজ হচ্ছে, ইসলামী ব্যক্তিবর্গকে ব্যাপকভাবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করা। উদাহরণস্বরূপ, ফেনীসহ কয়েকটি জেলায় এবারের বন্যায় ইসলামী ব্যক্তিত্বরা যেভাবে মানুষের সাহায্যে এগিয়ে গেছেন, তাতে সমাজে ইসলামপন্থিদের কতবড় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁরা মানুষের বিশ্বাস জয় করতে পেরেছেন। যুগ যুগ ধরে মানুষের বিপদে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার কারণেই পীর-মাশাইখ সমাজে তাঁদের প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছেন। এভাবে সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থায় ইসলামী ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। একইসাথে সুদ ও প্রতারণামুক্ত, ইনসাফভিত্তিক সমবায়ী ব্যবসায় মনোযোগী হওয়া উচিত। এতে ইসলামী অর্থনীতির কার্যকারিতা মানুষের সামনে ফুটে উঠবে। তৃতীয় কাজ হচ্ছে, ইসলামী দল, গ্রুপ, ফোরাম ইত্যাদির মধ্যে বেসিক কিছু বিষয়ে নেতৃত্বের পর্যায়ে একটি বুঝাপড়া নিশ্চিত করা। এজন্য মাঝেমধ্যে একত্রে সেমিনার ও গবেষণাপত্র প্রকাশ করা যেতে পারে। এছাড়া তরুণ ইসলামী এক্টিভিস্টদের জন্য অত্যাবশ্যক কাজ হচ্ছে বুযুর্গ উলামা-মাশাইখের সাথে যোগাযোগ রাখা, তাঁদের সুহবত নেওয়া এবং তাঁদের হিকমতকে কাজে লাগানো। এর সুদুরপ্রসারি ফায়দা আছে। চতুর্থ কাজ হচ্ছে, ইসলামী রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা করা। যারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ইসলামী রাজনীতি করতে চান, তাঁদেরকে আন্তরিকতার সাথে মাঠে রাজনীতি করা উচিত। যদিও এটিকে আমি ইসলাম প্রতিষ্ঠার শ্রেষ্ঠ পথ মনে করি না, তবুও এটি সাময়িকভাবে প্রয়োজনীয়, তাতে সন্দেহ নেই। তবে এক্ষেত্রে নিজের আদর্শের সাথে আপস করা যাবে না। কোনোভাবেই কোনো সেক্যুলার দলের লেজুড়বৃত্তি করা যাবে না। সেক্যুলার দলের লেজুড়বৃত্তি করে অকালে নষ্ট হয়ে গেছে, এমন ইসলামী দলের উদাহরণ উপমহাদেশে ভুরিভুরি। সর্বোপরি আমাদেরকে মনে রাখতে হবে যে, আজ শরীআহ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা মানেই দুনিয়ার উল্টো চলা। দুনিয়াতে যাদের সিস্টেম চলছে, তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা। কাজটি সহজ নয়। এর জন্য চাই ঈমানের জোর, ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, ত্যাগের মানসিকতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। তাহলে হয়তো ভবিষ্যতে সাফল্য দেখা যাবে।

ফেইসবুকে আমরা...