Logo
সীরাতে একপলক দৃষ্টিপাত : রাসূল (সা.) এর ইনসাফ
মুহাম্মাদ সায়ীদ
  • ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

শান্তিপূর্ণ একটি মানবসমাজের ভিত্তি হচ্ছে ইনসাফ বা ন্যায়বিচার। যেখানে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে শান্তি, সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য শিকড়সমেত বিস্তৃত হয়। আল্লাহ তাআলা কুরআনে বারবার মানুষকে ইনসাফ বা ন্যায়বিচারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন এবং রাসূল সা. এই নৈতিক আদর্শকে বাস্তব জীবনে প্রতিষ্ঠা করে বিশ্ববাসীর জন্য অবিস্মরণীয় নযির স্থাপন করে গেছেন।

রাসূল সা. এর আগমনের প্রাক্কালে মক্কার জাহিলী সমাজে অন্যায়ের ব্যাপক বিস্তার ছিল। দুর্বল ও গরীব মানুষের ওপর ধনী ও ক্ষমতাবানদের দমন, নারী ও শিশুদের অধিকার হরণ এবং সামাজিক অসাম্য প্রকট রূপ ধারণ করেছিলো। হযরত জাফর ইবন আবী তালিবের বর্ণনায় সে সমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে নিম্নরূপ ভাষ্যে–

كُنا قَوْمًا أهل جاهِلِيَّةٍ، نَعبُدُ الأصنام، ونأكل الميتة، ونأتي الفواحش، ونقطع الأرحام، ونسيء الجوار، يأكُلُ القَويُّ مِنَا الضَّعِيفَ، فكنا على ذلك حتى بعث الله إلينا رسولًا مِنَا. (مسند أحمد)

-আমরা এক অজ্ঞতাকেন্দ্রিক সমাজে বসবাস করতাম। আমাদের ধর্মীয় অনুশীলন সীমাবদ্ধ ছিল মূর্তি-উপাসনায়; আমাদের খাদ্যাভ্যাস গঠিত হয়েছিল মৃত জন্তু ভক্ষণে, আমাদের সামাজিক প্রচলন ছিলো অশ্লীলতা নির্ভর। আত্মীয়তার সম্পর্ক আমরা ছিন্ন করেছিলাম এবং প্রতিবেশীর সাথে আমাদের আচরণ ছিলো শিষ্টাচারবহির্ভূত। আমাদের মধ্যকার শক্তিশালীরা দুর্বলদের গ্রাস করে নিত। আল্লাহ তাআলা আমাদের মধ্য থেকে একজনকে রাসূল হিসেবে পাঠানোর আগ পর্যন্ত আমরা অনুরূপ অবক্ষয়ের মধ্যেই নিমজ্জিত ছিলাম। (মুসনাদ আহমদ, হাদীস: ১৭৪০)

এমন অন্ধকার, যুলম নির্ভর একটি সমাজকে আমূল পরিবর্তন করেছেন রাসূল সা. । সেখানে তিনি ইনসাফ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং সমাজের দুর্বলদের প্রতি সমাজিক সহানুভূতি জাগ্রত করেছেন। তিনি ইনসাফ বা ন্যায়বিচারকে সমাজের অপরাধ ও বৈষম্য রোধের কার্যকর কারগরি হিসেবে গ্রহণ করে পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নবযুগের সূচনা করে গেছেন।

আল্লাহ তাআলা কুরআনে বলেছেন,

إِنَّ اللَّهَ يَأْمُرُكُمْ أَن تُؤَدُّوا الْأَمَانَاتِ إِلَىٰ أَهْلِهَا وَإِذَا حَكَمْتُم بَيْنَ النَّاسِ أَن تَحْكُمُوا بِالْعَدْلِ

-নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দেন যে, তোমরা যেন প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা কর, তখন সে মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক।(সূরা নিসা, আয়াত: ৫৮)

এই আয়াতের আল্লাহ তাআলা প্রদত্ত নির্দেশনা মুতাবিক নবীজি সা. সমাজে ন্যায়বিচারের ভিত্তি স্থাপন করেছেন। বিচার ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বার্থপরতা বা পক্ষপাতের স্থান নেই- তিনি তার শাসনাধীন সমাজকে এই মূলনীতিতে দীক্ষিত করার অব্যার্থ প্রয়াস চালিয়েছেন। সামাজিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে নবীজি সা. এর উদাহরণ ছিল অদৃষ্টপূর্ব। মদীনায় শাসন প্রতিষ্ঠার পর তিনি সমাজের সব স্তরের মানুষের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য সুস্পষ্ট ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে প্রত্যেকের সুরক্ষা ও ন্যায্য সুযোগ নিশ্চিত করেছেন। মদীনার সনদ এই ন্যায়বিচারের চমৎকার সাক্ষ্য বহন করছে।

রাসূল (সা.) এর ন্যায়বোধ ছিলো অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। তিনি সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় ন্যায়বিচারকে এক অপরিবর্তনীয় মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যেখানে ন্যায়বিচারবিরুদ্ধ মানবিক আবেগজনিত দূর্বলতার কোন স্থান ছিলো না। মুসনাদ আহমদের একটি বর্ণনায় আমরা দেখতে পাই, রাসূল e এর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমা (রা.) তার কাছে সামান্য একজন খাদিম পেতে চাইলে, তিনি মেয়ের প্রতি একজন বাবার স্বাভাবিক দরদকে অতিক্রম করে নিজের স্বভাবসুলভ ন্যায়বিচারের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। ঘটনাটি মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হয়েছে এভাবে–

أن رسول الله صلى الله عليه وسلم لما زوّجه فاطمة بعث معه بخميلة ووسادة من أدم حشوها ليف، ورحيين وسقاء وجرتين، فقال عليّ لفاطمة ذات يوم: والله لقد سنوت حتى لقد اشتكيت صدري، قال: وقد جاء الله أباك بسبي، فاذهبي فاستخدميه، فقالت: وأنا والله قد طحنت حتى مجلت يداي، فأتت النبي صلى الله عليه وسلم فقال: ما جاء بك أي بنية؟ قالت: جئت لأسلم عليك، واستحيت أن تسأله، ورجعت، فقال: مافعلت؟ قالت: استحييت أن أساله، فأتيناه جميعا، فقال: علي: يا رسول الله، والله لقد سنوت حتى اشتكيت صدري، وقالت فاطمة: قد طحنت حتى مجلت يداي، وقد جاءك الله بسبي وسعة، فأخدمنا، فقال رسول الله صلى الله عليه وسلم: والله لا أعطيكما وأدع أهل الصفة تطوى بطونهم لا أجد ما أنفق عليهم، ولكني أبيعهم وأنفق عليهم أثانهم، فرجعا. (مسند أحمد)

রাসূলুল্লাহ সা.  যখন হযরত ফাতিমা (রা.) কে হযরত আলী (রা.) এর সঙ্গে বিবাহ দিলেন, তখন তিনি কিছু জিনিস তাদের দিয়েছিলেন। একটি মোটা কাপড়, খেজুরের আঁশ ভর্তি চামড়ার একটি বালিশ, একটি হাতচালিত চাক্কি, একটি পানির মশক ও দুটি কলস দিয়েছিলেন।

একদিন হযরত আলী (রা.) ফাতিমা (রা.)-কে বললেন, আল্লাহর কসম! আমি এতবার পানি তুলেছি যে আমার বুক ব্যথা হয়ে গেছে। আল্লাহ তোমার বাবাকে অনেক যুদ্ধবন্দি দিয়েছেন, তুমি তাঁর কাছে গিয়ে একজন খাদিম চাও। ফাতিমা (রা.) বললেন, আমিও আল্লাহর কসম! এতবার আটা পিষেছি যে আমার হাত ফেটে গেছে।

তখন তিনি নবী সা. -এর কাছে গেলেন। নবী e জিজ্ঞেস করলেন, মেয়ে আমার, কেন এসেছ?

তিনি বললেন, আমি আপনার কাছে সালাম দেওয়ার জন্য এসেছি। (আসল অনুরোধ জানাতে তিনি লজ্জা পেলেন এবং ফিরে গেলেন)।

আলী (রা.) তাকে জিজ্ঞেস করলেন: কী করলে?

ফাতিমা (রা.) জবাব দিলেন, আমি লজ্জা পেয়েছি বলতে।

এরপর আলী (রা.) ও ফাতিমা (রা.) একসাথে নবী সা. -এর কাছে গেলেন। আলী (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এত পানি তুলেছি যে আমার বুক ব্যথা করছে। আর ফাতিমা (রা.) বললেন, আমি এত আটা পিষেছি যে আমার হাত ফেটে গেছে। এখন আল্লাহ আপনাকে যুদ্ধবন্দি ও ধন-সম্পদ দিয়েছেন। এসব যুদ্ধবন্দীদের থেকে আমাদেরকে একজন খাদিম দিয়ে দিন।

রাসূলুল্লাহ সা.  বললেন, আল্লাহর কসম! আমি যুদ্ধবন্দীদের কাউকে তোমাদের খাদিম হিসেনে দেব না। আসহাবে সুফ্ফা ক্ষুধায় কাতর হয়ে আছে, তাদের জন্য খরচ করার কিছু আমার কাছে নেই। বরং আমি যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিক্রি করে তাদের ব্যয় নির্বাহ করব।

এটি শোনার পর হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতিমা (রা.) ফিরে গেলেন। (মুসনাদ আহমদ, হাদীস-৮৩৮)

ইনসাফের ব্যাপারে রাসূল সা. এর অনুরূপ দৃঢ়তা সহীহ বুখারীর আরেকটি ঘটনা থেকে দেখা যাক–

عَنْ حُصَيْنٍ عَنْ عَامِرٍ قَالَ سَمِعْتُ النُّعْمَانَ بْنَ بَشِيْرٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا وَهُوَ عَلَى الْمِنْبَرِ يَقُوْلُ أَعْطَانِيْ أَبِيْ عَطِيَّةً فَقَالَتْ عَمْرَةُ بِنْتُ رَوَاحَةَ لَا أَرْضَى حَتَّى تُشْهِدَ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَأَتَى رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنِّيْ أَعْطَيْتُ ابْنِيْ مِنْ عَمْرَةَ بِنْتِ رَوَاحَةَ عَطِيَّةً فَأَمَرَتْنِيْ أَنْ أُشْهِدَكَ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ أَعْطَيْتَ سَائِرَ وَلَدِكَ مِثْلَ هَذَا قَالَ لَا قَالَ فَاتَّقُوْا اللهَ وَاعْدِلُوْا بَيْنَ أَوْلَادِكُمْ قَالَ فَرَجَعَ فَرَدَّ عَطِيَّتَهُ. (صحيح البخاري)

একবার নুমান ইবন বশীর (রা.) মিম্বরের উপর দাঁড়িয়ে বলেছেন যে, আমার পিতা আমাকে কিছু দান করেছিলেন। তখন আমার মাতা আমরা বিনতু রাওয়াহা (রা.) বললেন যে, আমি রাসূলুল্লাহ সা. কে সাক্ষী রাখা ব্যতীত এতে সম্মত নই। তখন তিনি (আমার বাবা) রাসূলুল্লাহ সা. এর নিকট আসলেন এবং বললেন, আমি বিনতু রাওয়াহার গর্ভজাত আমার পুত্রকে কিছু দান করেছি। হে আল্লাহর রাসূল! আপনাকে সাক্ষী রাখার জন্য সে আমাকে বলেছে। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সব ছেলেকেই কি এ রকম করেছ? তিনি বললেন, না। রাসূলুল্লাহ (সা. ) বললেন, তবে আল্লাহকে ভয় কর এবং আপন সন্তানদের মাঝে সমতা রক্ষা কর। নুমান ইবন বশীর (রা.) বলেন, এরপর তিনি ফিরে এলেন এবং তার দান ফিরিয়ে নিলেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস-২৫৮৭)

রাসূলুল্লাহ সা. কেবল যে নিজেই ন্যায়বিচারের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন তা নয়, বরং একে তিনি সামাজিক ভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যও কার্যক্রম চালিয়েছিলেন। সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে বর্ণিত হয়েছে–

الْمَعْرُورَ بْنَ سُويْدٍ قَالَ رَأَيْتُ أَبَا ذَرٍّ الْغِفَارِيَّ وَعَلَيْهِ حُلَّةٌ وَعَلَى غُلاَمِهِ حُلَّةٌ فَسَأَلْنَاهُ عَنْ ذَلِكَ فَقَالَ إِنِّي سَابَبْتُ رَجُلاً فَشَكَانِي إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ لِي النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم أَعَيَّرْتَهُ بِأُمِّهِ ثُمَّ قَالَ إِنَّ إِخْوَانَكُمْ خَوَلُكُمْ جَعَلَهُمْ اللهُ تَحْتَ أَيْدِيكُمْ فَمَنْ كَانَ أَخُوهُ تَحْتَ يَدِهِ فَلْيُطْعِمْهُ مِمَّا يَأْكُلُ وَلْيُلْبِسْهُ مِمَّا يَلْبَسُ وَلاَ تُكَلِّفُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ فَإِنْ كَلَّفْتُمُوهُمْ مَا يَغْلِبُهُمْ فَأَعِينُوهُمْ (صحيح البخاري)

মা’রূর ইবন সুওয়াইদ (র.) বলেছেন, যে একবার আমি হযরত আবূ যার গিফারী (রা.)-এর দেখা পেলাম। তার গায়ে তখন এক জোড়া কাপড় আর তার ক্রীতদাসের গায়েও অনুরূপ এক জোড়া কাপড় ছিল। তাঁকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, একবার এক ব্যক্তিকে আমি গালি দিয়েছিলাম। সে রাসূল সা. এর কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করল। তখন রাসূল সা. আমাকে বললেন, তুমি তার মার প্রতি কটাক্ষ করে তাকে লজ্জা দিলে? তারপর তিনি বললেন, তোমাদের গোলামেরা তোমাদেরই ভাই। আল্লাহ তাদেরকে তোমাদের অধীনস্থ করেছেন, কাজেই কারো ভাই যদি তার অধীনে থাকে তবে সে যা খায়, তা হতে যেন তাকে খেতে দেয় এবং সে যা পরিধান করে, তা হতে যেন পরিধান করায় এবং তাদের সাধ্যাতীত কোন কাজে বাধ্য না করে। তোমরা যদি তাদের শক্তির ঊর্ধ্বে কোন কাজ তাদের দাও তবে এক্ষেত্রে তোমরাও তাদের সহযোগিতা কর। (সহীহ বুখারী, হাদীস-২৫৪৫)

এভাবে নবীজি সা. পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত উদাহরণ স্থাপন করেছেন। তিনি কখনো আত্মীয়স্বজন বা প্রিয়জনকে অন্যায়ভাবে প্রাধান্য দেননি। তিনি স্পষ্টভাবে বলেছেন, যদি তাঁর প্রিয় কন্যা হযরত ফাতিমাও অন্যায় করতেন, তবে তিনি তাকেও শাস্তি দিতেন। বিচার, আইন প্রণয়ন এবং সামাজিক নিয়ম-কানুনের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা ন্যায়পরায়ণতার দিকে লক্ষ্য রাখতেন। কোনো ব্যক্তিগত স্বার্থ, ঘনিষ্ঠতা বা প্রভাবের কারণে কোনো বিধি লঙ্ঘন করার প্রশ্র‍য় তাঁর কাছে ছিলো না। রাসূল সা. এর বিচারপদ্ধতি এত নিখুঁত ছিল যে, তিনি কখনো কোন ব্যাপারে পক্ষপাত প্রদর্শন করেননি। যেকোনো অপরাধের ক্ষেত্রে প্রমাণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়াই ছিলো তার মূলনীতিগত অবস্থান। এর উদাহরণ দেখা যায়, রাসূল e এর সাথে যুল খুওয়াইসারা নামক লোকটির ঔদ্ধত্যপূর্ণ ঘটনায়। মদীনার বাদশাহ, রাসূলুল্লাহ সা. এর সামনে ঐ লোক চরম ধৃষ্টতা দেখালে অপরাজিত বীর খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) কর্তৃক এ-কে হত্যা করার ইচ্ছাপ্রকাশ,  রাসূল সা. কর্তৃক হত্যা না করার যুক্তি, খালিদের পাল্টা যুক্তি এবং পুনরায় রাসূল e কর্তৃক বিপরীত যুক্তি উত্থাপনের ঘটনাটি থেকে রাসূল সা. এর ইনসাফের মূলনীতিগত গভীরতা পরিলক্ষিত হয়। সহীহ বুখারীর ভাষ্যে ঘটনাটি নিম্নরূপ–

بَعَثَ عَلِيُّ بْنُ أَبِيْ طَالِبٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ إِلَى رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم مِنَ الْيَمَنِ بِذُهَيْبَةٍ فِيْ أَدِيْمٍ مَقْرُوْظٍ لَمْ تُحَصَّلْ مِنْ تُرَابِهَا قَالَ فَقَسَمَهَا بَيْنَ أَرْبَعَةِ نَفَرٍ بَيْنَ عُيَيْنَةَ بْنِ بَدْرٍ وَأَقْرَعَ بْنِ حابِسٍ وَزَيْدِ الْخَيْلِ وَالرَّابِعُ إِمَّا عَلْقَمَةُ وَإِمَّا عَامِرُ بْنُ الطُّفَيْلِ فَقَالَ رَجُلٌ مِنْ أَصْحَابِهِ كُنَّا نَحْنُ أَحَقَّ بِهَذَا مِنْ هَؤُلَاءِ قَالَ فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَلَا تَأْمَنُوْنِيْ وَأَنَا أَمِيْنُ مَنْ فِي السَّمَاءِ يَأْتِيْنِيْ خَبَرُ السَّمَاءِ صَبَاحًا وَمَسَاءً قَالَ فَقَامَ رَجُلٌ غَائِرُ الْعَيْنَيْنِ مُشْرِفُ الْوَجْنَتَيْنِ نَاشِزُ الْجَبْهَةِ كَثُّ اللِّحْيَةِ مَحْلُوْقُ الرَّأْسِ مُشَمَّرُ الإِزَارِ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اتَّقِ اللهَ قَالَ وَيْلَكَ أَوَلَسْتُ أَحَقَّ أَهْلِ الْأَرْضِ أَنْ يَتَّقِيَ اللهَ قَالَ ثُمَّ وَلَّى الرَّجُلُ قَالَ خَالِدُ بْنُ الْوَلِيْدِ يَا رَسُوْلَ اللهِ أَلَا أَضْرِبُ عُنُقَهُ قَالَ لَا لَعَلَّهُ أَنْ يَكُوْنَ يُصَلِّيْ فَقَالَ خَالِدٌ وَكَمْ مِنْ مُصَلٍّ يَقُوْلُ بِلِسَانِهِ مَا لَيْسَ فِيْ قَلْبِهِ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِنِّيْ لَمْ أُوْمَرْ أَنْ أَنْقُبَ عَنْ قُلُوْبِ النَّاسِ وَلَا أَشُقَّ بُطُوْنَهُمْ (صحيح البخاري)

-আলী ইবন আবূ তালিব (রা.) ইয়ামান থেকে রাসূলুল্লাহ সা. এর কাছে এক প্রকার রঙিন চামড়ার থলে করে সামান্য কিছু স্বর্ণ পাঠিয়েছিলেন। তখনও এগুলোতে লেগে থাকা মাটি পরিষ্কার করা হয়নি। আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, রাসূল সা. চার জনের মাঝে স্বর্ণখন্ডটি বণ্টন করে দিলেন। তারা হলেন, উয়াইনাহ ইবন বাদর, আকরা ইবন হাবিস, যায়িদ আল খাইল এবং চতুর্থজন আলকামাহ কিংবা আমির ইবন তুফাইল (রা.)।

তখন সহাবীগণের মধ্য থেকে একজন বললেন, এটা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের চাইতে আমরাই অধিক হাকদার ছিলাম। বর্ণনাকারী বলেন, কথাটি রাসূল সা. পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছল। তাই রাসূল সা. বললেন, তোমরা কি আমার উপর আস্থা রাখ না! অথচ আমি আসমানের অধিবাসীদের আস্থাভাজন, সকাল-বিকাল আমার কাছে আসমানের সংবাদ আসছে।

বর্ণনাকারী বলেন, এমন সময়ে এক ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। লোকটির চোখ দু’টি ছিল কোটরাগত, চোয়ালের হাড় যেন বেরিয়ে পড়ছে, উঁচু কপাল বিশিষ্ট, দাড়ি অতি ঘন, মাথাটি ন্যাড়া, পরনের লুঙ্গী উপরে উত্থিত। সে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহ্কে ভয় করুন। রাসূল সা. বললেন, তোমার জন্য আফসোস! আল্লাহ্কে ভয় করার ব্যাপারে দুনিয়াবাসীদের মধ্যে আমি কি অধিক হাকদার নই?

বর্ণনাকারী আবূ সাঈদ খুদরী (রা.) বলেন, লোকটি চলে যেতে লাগলে খালিদ বিন ওয়ালিদ (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি লোকটির গর্দান উড়িয়ে দেব না? রাসূল সা. বললেন, না, হতে পারে সে নামায আদায় করে। খালিদ (রা.) বললেন, অনেক নামায আদায়কারী এমন আছে যারা মুখে এমন এমন কথা উচ্চারণ করে যা তাদের অন্তরে নেই।

খালিদ (রা.) এর এই কথার জবাবে রাসূল e বললেন, আমাকে মানুষের বুক ছিদ্র করে, পেট ফেড়ে দেখার জন্য বলা হয়নি। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৪৩৫১)

ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে রাসূল সা. এর সূক্ষ্মদৃষ্টি এবং আপোষহীনতা উপলব্ধির জন্য আমরা রাসূল সা. এর খাদিম হযরত আনাস (রা.) বর্ণিত একটি ঘটনা দেখতে পারি।

عن أنس بن مالك قال: كان معَ رسولِ اللَّهِ ﷺ رجُلٌ فجاءَ ابنٌ لَهُ فقبَّلَهُ وأجلَسَهُ على فخِذِهِ ثمَّ جاءَت ابنةٌ لَهُ فأجلَسَها إلى جنبِهِ فقالَ: فَهَلّا عدَلتَ بينَهُما (شرح معاني الآثار)

আনাস (রা.) বলেন, একবার রাসূলুল্লাহ e এর কাছে এক ব্যক্তি বসা ছিলেন। এমতাবস্থায় ঐ ব্যাক্তির কাছে তার ছেলে এলো, তিনি তাকে চুমু খেলেন এবং নিজের উরুর ওপর বসালেন। তারপর তার কাছে তার মেয়ে এলো, তিনি তাকে পাশে বসালেন। তখন রাসূলুল্লাহ e তাকে বললেন: তুমি কি তাদের মাঝে সমতা রক্ষা করলে না? (শরহু মাআনিল আসার, হাদীস-৫৮৪৭)

এভাবে রাসূল সা. তাঁর পবিত্র জীবনব্যাপী সামাজিক, পারিবারিক, আইনগত এবং নীতিগত ন্যায়বিচারের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। ন্যায়বিচারকে তিনি ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্রের আদর্শের কেন্দ্রবিন্দুতে স্থাপন করেছিলেন। তিনি ন্যায়কে কেবল একটি তাত্ত্বিক নীতি হিসেবে তুলে ধরেননি, বরং ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করেছেন। প্রিয়জন, কন্যা কিংবা ঘনিষ্ঠ সাহাবী— কারো পক্ষেই তিনি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেননি। বরং সর্বদা সত্য, ন্যায় ও সমতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছেন। ফলাফলস্বরূপ, তাঁর এই ইনসাফভিত্তিক জীবনাচরণ মানবসমাজকে অন্যায়-অবিচার থেকে মুক্তির পথ আবিষ্কার করে দিয়েছে।

ফেইসবুকে আমরা...