মূল্যবোধের অভাব ঘটেছে সামাজিক অবক্ষয়ে। সমাজ ও দেশ আজ হাজারো সমস্যায় জর্জরিত। দেশের মানুষ দিগ্বিদিক ছুটছে এতটুকু শান্তির আশায়। হিংসা বিদ্বেষ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এ অঞ্চলের আকাশে শান্তির শ্বেত কপোত এখন আর ডানা মেলে উড়ছে না। কেন মানুষ আজ দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে? কেন এ দেশের অভিধান থেকে শান্তি শব্দটি মুছে যাবার উপক্রম হয়েছে? আমরা যদি এর কারণটা বিশ্লেষণ করতে যাই তাহলে দেখা যাবে মূলত আদর্শের অভাব। সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনে আদর্শের অনুপস্থিতি। এটা অবশ্যই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যে চাই আদর্শ মানুষ। যুগে যুগে পৃথিবীতে আনন্দ, শান্তি ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত করেছেন আদর্শবাদীরাই। মুসলমান হিসেবে আমাদের কাছে আদর্শের শ্রেষ্ঠতম দৃষ্টান্ত হচ্ছে মহান আল্লাহর প্রিয়তম হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। তাঁর জীবনী পাঠ করলেই আমরা সত্যিকার আদর্শ কি, আদর্শ কাকে বলে, তা অনুধাবন করতে পারি। আদর্শ হচ্ছে এমন এক প্রহরী যা মানুষকে সৎপথে চলতে শেখায়। ঐক্য, বিশ্বাস, ধৈর্য্য, ও সহনশীলতা আদর্শ ব্যক্তির বৈশিষ্ট্য। আদর্শবান লোকেরাই একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে পারে। মানুষ জীবনকে সুখময়, শান্তিময় করার জন্য, তাদের জীবন চলার পথকে সুগম করার জন্য আদর্শ ব্যক্তির দৃষ্টান্ত অনুসরণ করতে চায়। কারণ আদর্শ ব্যক্তির জীবনে অনেক গুণের সমাহার থাকে। জীবনের সার্বিক কর্মকান্ডে রয়েছে সফলতার অনাবিল স্বাক্ষর। একজন আদর্শবান ব্যক্তির শ্রেষ্ঠ গুণ হলো শিষ্টাচার। শিষ্টাচার বা সৌজন্যেবোধ হলো মানব চরিত্রের অলংকার। যেসব গুণাবলি মানব চরিত্রকে সুন্দর আকর্ষণীয় ও গৌরবান্বিত করে তুলে তন্মধ্যে শিষ্টাচার হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। মানুষের কার্যকলাপে, কথাবার্তায়, আচার-আচরণে যখন ভদ্রতা প্রকাশ পায় তখন তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় শিষ্টাচারের নিদর্শন। জীবন চলার পথে প্রতিটি মানুষ কথাবার্তায়, ভাব বিনিময়ে, লেনদেনে একে অপরের মুখোমুখি হয়। নানাভাবে স¤পৃক্ত থাকে তার সংসার, সমাজ জীবন বা রাষ্ট্রীয় জীবনে। তাই জীবন চলার পথে সৌজন্যবোধের গুরুত্ব অপরিসীম। সুন্দর ব্যবহার দিয়ে মানুষের হƒদয় জয় করা যায়। শিষ্টাচার বর্তমান থাকলে সকল প্রকার স¤পর্কের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় থাকে। সম্প্রীতি না থাকলে বিষাক্ত হয়ে উঠে জীবন। সর্বত্র দেখা দেয় অশান্তি। জীবন থেকে সুখ পালিয়ে যায়। সমাজ জীবনকে বিশৃঙ্খলার দিকে ঠেলে দেয়। ফলে সমাজে সৃষ্টি হয় প্রবল অশান্তি। শিষ্টাচারের অভাব সমাজের জন্যে ক্ষতিকর। চমৎকার আচার আচরণে, বিনম্র ব্যবহারে, সৌজন্যবোধে, ভদ্রতায় উত্তম মানুষের প্রকৃত পরিচয় নিহিত। সামাজিক পরিবেশকে করে শান্তিময়, জীবনকে করে সুন্দর। জাতীয় জীবনে সুনাম ও সমৃদ্ধি আনয়ন করে। ব্যবহার মার্জিত এবং শোভন হওয়া উচিৎ।
মানুষের সাথে ব্যবহার সম্পর্কে সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর একটি অত্যন্ত মূল্যবান হাদীস রয়েছে। সেটি হচ্ছে, ‘ভালো ব্যবহারের বিনিময়ে ভালো ব্যবহার এটার নাম ভালো ব্যবহার নয়। মন্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভালো ব্যবহার এটাই ভালো ব্যবহার।’ শক্রর সঙ্গে সবসময় ভাল ব্যবহার করলে সে একদিন বন্ধুতে পরিণত হবে। মৃত্যুর পরে যে মানুষ সাধারণ মানুষের হৃদয়ে অম্লান হয়ে থাকে সেটা হচ্ছে তার ব্যবহার। সুন্দর নির্মল ব্যবহার মৃত্যুর পরেও মানুষকে স্মৃতিতে অম্লান করে রাখে। অন্যের ব্যবহারে নিজে বিরক্ত হয়ে থাকলে ধরে নিতে হবে নিজের ব্যবহারেও অন্যরা আঘাত পায়। অশোভন, অমার্জিত, অশালীন ব্যবহারে আমরা ক্রোধ প্রদর্শন করি। ভুলেও সেরকম ব্যবহার করতে নেই। নির্দয় ব্যবহার সহনশীল লোকেরও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটায়। অনেক সময় অন্যায় ব্যবহারকে বিভিন্ন কারণে সহ্য করে নিতে হয়। এতে অনেক সময় কারো ক্ষতি হয়ে যায়। ভালো ব্যবহার করতে গেলে ছোট ছোট স্বার্থ ত্যাগ করতেই হয়। ধনী এবং গরীবের সাথে আমরা কিভাবে ব্যবহার করব তার একটি ইংগিত দিয়েছেন আমাদের বড়পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র.)। তিনি বলেছেন, ধনীর সঙ্গে আত্মমর্যাদা বজায় রেখে কথা বলবে এবং দরিদ্রের সাথে আত্মমর্যাদা ভুলে কথা বলবে। তোমার স্বাভাবিক ব্যবহার ও বিনয় অকৃত্রিম হতে হবে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) বলেছেন, আল্লাহর সৃষ্ট জীবের সাথে সৎ ব্যবহার করলে যে পরিমাণ খোদার সন্তুষ্টি লাভ করা যায় তা আর কোন পন্থায় সম্ভব হয় না।
সংসার জীবন পালন করতে গিয়ে অনেক সময় পরিবারের সদস্যদের একে অপরের সাথে ভুল বোঝাবুঝি হয়। শ্রদ্ধাভাজন ও স্নেহভাজনের ব্যবধানও রাগের মাথায় অনেকই অমার্জিত, অশালীন ব্যবহার করতে কার্পণ্য করে না। মানুষের সাথে ব্যবহার সম্পর্কে সাবধানবাণী উচ্চারণ করে ডা. লুৎফর রহমান বলেছেন, মানুষের সঙ্গে নিষ্ঠুর ব্যবহার করে যে খোদার সঙ্গে প্রেম করতে চায় তার বুদ্ধি কম। হযরত ওমর (রা.) বলেছেন, মানুষের পরিচয় ব্যবহারে, মানুষ আত্মীয় হয়ে উঠে ঘনিষ্ঠতায়। আমরা অনেক গুণে গুণান্বিত হলেও আমাদের অনেকের মধ্যে ব্যবহারে সৌন্দর্য নেই। আমাদের শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মোহা¤মদ মোস্তফা (স.) বলেছেন, তোমাদের মধ্যে যারা বিনয়ী, ভদ্র ও অমায়িক তারাই আমার নিকট সর্বাপেক্ষা প্রিয়। তাই সমাজ তথা দেশের সার্বিক কল্যাণের জন্যে অহংকার এবং হিংসা পরিত্যাগ করে স্বীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আমাদেরকে আরও মনোযোগী হতে হবে। অন্যের সাথে উত্তম ব্যবহারে সমাজে আসবে শান্তি, আসবে সফলতা।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক