1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
তাসাওউফের দলীল
মুফতি গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী
  • ৮ মে, ২০২১

عَنْ عُمَرَ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ، قَالَ: “بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ذَاتَ يَوْمٍ، إذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ، شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعْرِ، لَا يُرٰى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ، وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ. حَتَّى جَلَسَ إلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَأَسْنَدَ رُكْبَتَيْهِ إلٰى رُكْبَتَيْهِ، وَوَضَعَ كَفَّيْهِ عَلٰى فَخِذَيْهِ، وَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ أَخْبِرْنِي عَنِ الْإِسْلَامِ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، الْإِسْلَامُ أَنْ تَشْهَدَ أَنْ لَا إلٰهَ إلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللهِ، وَتُقِيمَ الصَّلَاةَ، وَتُؤْتِيَ الزَّكَاةَ، وَتَصُومَ رَمَضَانَ، وَتَحُجَّ الْبَيْتَ إنِ اسْتَطَعْتَ إلَيْهِ سَبِيلًا. قَالَ: صَدَقْتَ. فَعَجِبْنَا لَهُ يَسْأَلُهُ وَيُصَدِّقُهُ! قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِيمَانِ. قَالَ: أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ، وَتُؤْمِنَ بِالْقَدْرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ. قَالَ: صَدَقْتَ. قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِحْسَانِ. قَالَ: أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ. قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنِ السَّاعَةِ. قَالَ: مَا الْمَسْئُولُ عَنْهَا بِأَعْلَمَ مِنَ السَّائِلِ. قَالَ: فَأَخْبِرْنِي عَنْ أَمَارَاتِهَا؟ قَالَ: أَنْ تَلِدَ الْأَمَةُ رَبَّتَهَا، وَأَنْ تَرَى الْحُفَاةَ الْعُرَاةَ الْعَالَةَ رِعَاءَ الشَّاءِ يَتَطَاوَلُوْنَ فِي الْبُنْيَانِ. ثُمَّ انْطَلَقَ، فَلَبِثْنَا مَلِيًّا، ثُمَّ قَالَ: يَا عُمَرُ أَتَدْرِي مَنِ السَّائِلُ؟. قُلْتُ: اللهُ وَرَسُوْلُهُ أَعْلَمُ. قَالَ: فَإِنَّهُ جِبْرِيْلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ”.

-হযরত উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট বসা ছিলাম। এমন সময় ধবধবে সাদা পোশাক ও ঘনকালো চুল বিশিষ্ট একজন লোক আমাদের নিকট উপস্থিত হলেন। তার মধ্যে সফরের কোনো চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছিল না, আর আমাদের কেউও তাকে পরিচয় করতে পারছিলাম না। এমনকি তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকটে বসলেন এবং তার দুই হাঁটুকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দুই হাঁটুর সাথে মিলালেন এবং নিজের দুই হাত তাঁর উরুর উপর রাখলেন আর বললেন: হে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমাকে ইসলাম সম্পর্কে অবগত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ইসলাম হলো, তুমি একথার সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, নামায কায়েম করবে, যাকাত দিবে, রামাদানের রোযা রাখবে এবং বায়তুল্লাহর হজ্জ করবে, যদি তুমি সেখানে পৌঁছতে সমর্থ হও। (উত্তর শুনে) তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন। তার আচরণে আমরা আশ্চার্যান্বিত হয়ে গেলাম যে তিনি প্রশ্ন করছেন আবার সত্যায়নও করছেন।

অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে ঈমান সম্পর্কে অবগত করুন (অর্থাৎ ঈমান কি?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি বিশ্বাস করবে আল্লাহ, তাঁর ফিরিশতাগণ, আসমানী কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ ও আখিরাতের দিনের প্রতি এবং বিশ্বাস করবে তাকদীরের ভালো-মন্দের প্রতি। (উত্তর শুনে) তিনি বললেন, আপনি ঠিক বলেছেন।

অতঃপর তিনি বললেন, আমাকে ইহসান সম্পর্কে অবগত করুন (অর্থাৎ ইহসান কি?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহর ইবাদত করবে যেন তুমি তাঁকে দেখছ। আর যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পাও তাহলে (মনে করবে যে) তিনি তোমাকে দেখছেন।

এরপর তিনি বললেন, আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে অবগত করুন (অর্থাৎ কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে?)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি প্রশ্নকারীর চেয়ে অধিক জানেন না। তখন তিনি (প্রশ্নকারী) বললেন, তাহলে এর নিদর্শনসমূহ সম্পর্কে আমাকে অবগত করুন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, দাসী তার মনিবকে জন্ম দিবে এবং নগ্নপদ, উলঙ্গ শরীর, দরিদ্র, মেষ রাখালদের উঁচু দালান নিয়ে গর্ব করতে দেখবে।

অতঃপর ঐ ব্যক্তি (প্রশ্নকারী) চলে গেলে আমি (উমর) কিছুক্ষণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট অবস্থান করলাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে উমর, তুমি কি জানো এই প্রশ্নকারী কে? আমি জবাব দিলাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি হলেন জিবরীল (আ.)। তোমাদেরকে তোমাদের দীন শিক্ষাদানের জন্য তিনি এসেছিলেন। (বুখারী ও মুসলিম, মুসলিমের ভাষ্য, বাবু বায়ানিল ঈমান, ইসলাম ওয়াল ইহসান…)

হাদীসের উদ্দিষ্ট অংশ

উপরোক্ত হাদীসে আমাদের উদ্দিষ্ট অংশ হলো, ‘ইহসান’ সম্পর্কিত প্রশ্ন ও তার জবাব। তা হলো-

فَأَخْبِرْنِي عَنِ الْإِحْسَانِ. قَالَ: أَنْ تَعْبُدَ اللهَ كَأَنَّكَ تَرَاهُ، فَإِنْ لَمْ تَكُنْ تَرَاهُ فَإِنَّهُ يَرَاكَ

-(হযরত জিবরাঈল (আ.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলেন) আপনি আমাকে ‘ইহসান’ সম্পর্কে বলুন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করো যেন (ইবাদত করা অবস্থায়) তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। আর যদি তাঁকে দেখতে না পাও তাহলে (মনে নাও) তিনি তোমাকে দেখতে পাচ্ছেন। (মুসলিম)

হাদীসে বর্ণিত ইহসান’ই তাসাওউফ

‘ইহসান’ এর শাব্দিক অর্থ হচ্ছে সুন্দর করা। অর্থাৎ ইবাদতকে এমনভাবে সম্পাদন করা, যা সব ধরনের অমনোযোগিতা বা লোক দেখানো থেকে মুক্ত।

রাসূলুল্লাহ  সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম  ‘ইহসান’ এর সংজ্ঞায় বললেন, তুমি এমনভাবে আল্লাহ তাআলার ইবাদত করো যেন তাঁকে তুমি দেখতে পাচ্ছ অর্থাৎ যদি তুমি আল্লাহ তাআলাকে দেখা অবস্থায় তাঁর সামনে ইবাদত করতে, তাহলে যেরূপ ইবাদত করতে ঠিক অনুরূপ ইবাদত করো। আর তখন ইবাদতে কোনো ধরনের অমনোযোগিতা বা লোক দেখানো বিষয় থাকবে না বরং ইবাদতে মনোযোগ বা একনিষ্ঠতা আবশ্যকীয়ভাবে পরিলক্ষিত হবে। আর যদি তাঁকে তুমি দেখতে নাও পাও তাহলে মনে রাখবে, তিনি তোমাকে দেখছেন।

‘ইহসান’ সম্পর্কিত প্রশ্নটি জিবরাঈল (আ.) ‘ঈমান’ ও ‘ইসলাম’ সম্পর্কিত প্রশ্নের পরে করেছিলেন। এর দ্বারা বুঝা যায় আকীদা-বিশ্বাস বা প্রকাশ্য আমলের পর আরো একটি জরুরী বিষয় অর্জন করা আবশ্যক, যাকে হাদীসের পরিভাষায় ‘ইহসান’ বলা হয়েছে। আর এ বিষয়টিই তরীকতপন্থীগণ সুচারুরূপে সম্পাদন করেন। সারকথা হলো এর নামই তাসাওউফ। সুতরাং হাদীসের মাধ্যমেই তরীকত তথা ইলমে তাসাওউফের বিষয়টি সাব্যস্ত হলো।

বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) ইমাম মালিক (র.) এর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন-

قال الامام مالك رحمه الله من تصوف و لم يتفقه فقد تزندق و من تفقه ولم يتصوف فقد تفسق ومن جمع بينهما فقد تحقق (مرقاة المفاتيح)

-যে ব্যক্তি তাসাওউফের জ্ঞান অর্জন করল, ফিকহর জ্ঞান অর্জন করল না সে যিনদীক্ব; আর যে কেবল ফিকহর জ্ঞান অর্জন করল তাসাওউফের জ্ঞান অর্জন করল না সে ফাসিক। আর যে এর উভয়টিই শিখল সে মুহাক্কিক বা সত্যানুসন্ধানী হলো। (মিরকাত)

এ প্রসঙ্গে শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) اشعة اللمعات গ্রন্থে উল্লেখ করেন,

بدانكه بنائے دين وكمال آن بر فقه و كلام وتصوف است و اين حديث شريف بيان اين ہر سہ مقام كرده اسلام اشارت  به فقه است كه متضمن بيان اعمال واحكام شرعيه است وايمان اشارت باعتقادات كه مسائل اصول كلام اند واحسان اشارت به اصل تصوف است كه عبادت از صدق توجه الي الله است وجميع معاني تصوف كه مشائخ طريقت بآن اشارت كرده اند راجع بهمن معني است وتصوف وكلام لازم يكديگراند كه ہيچ يكے بے ديگر تمام نه پزيرد چرا كه كلام بے تصوف و تصوف بے فقه نه بنند زيرا كه حكم الهي بے فقه شناخته نه شود و فقه بے تصرف تمام نشود وزيرا كه عمل بے صدق توجه تمام نه پزيرد وهر دو بے ايمان صحيح نگردد بر مثال روح وجسد ہيچ كدام بے ديگر وجود نگیرد و كمال نه پزيرد (اشعة اللمعات :٤١-٤٢)

-জেনে রেখো যে, ধর্মের ভিত্তি ও পূর্ণতা হচ্ছে ইলমে ফিকহ, ইলমে কালাম ও ইলমে তাসাওউফ। এই হাদীসে উল্লিখিত তিনটি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। ইসলাম শব্দ দ্বারা ইলমে ফিকহ উদ্দেশ্য; কেননা এতে আমল এবং আহকামে শরীআত অন্তর্ভুক্ত। ঈমান শব্দ দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে আকীদা-বিশ্বাস যা কালাম শাস্ত্রের বিষয়বস্তু। আর ইহসান শব্দের দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে তাসাওউফ। যার অর্থ খাঁটি মনে আল্লাহ তাআলার দিকে তাওয়াজ্জুহ বা মনোনিবেশ করা। তরীকতের শাইখগণ যে সকল বক্তব্য পেশ করেছেন তার সারকথা হলো এই ইহসান। তাসাওউফ ও কালাম শাস্ত্র একে অপরের সাথে জড়িত। একটি ছাড়া অপরটি পরিপূর্ণ হয় না। এর কারণ হলো কালাম শাস্ত্র ছাড়া তাসাওউফ এবং তাসাওউফ ছাড়া কালাম শাস্ত্র অর্থহীন। কেননা খোদায়ী বিধিবিধান ফিকহ ব্যতীত জানা যায় না; আর তাসাওউফ ব্যতীত ইলমে ফিকহ পরিপূর্ণ হয় না। আবার কোন আমলই একনিষ্ট তাওয়াজ্জুহ বা খাঁটি নিয়ত ছাড়া পরিপূর্ণ হয় না। আর উভয়ের মধ্যে কোনোটিই ঈমান ব্যতীত বিশুদ্ধ হয় না। (আশিয়্যাতুল লুমআত)

তাসাওউফ দ্বীনের অংশ

তাসাওউফ দ্বীনের অংশ। অংশকে বাদ দিলে পূর্ণ বস্তুর অনুপস্থিতি অপরিহার্য হয়ে যায়। সুতরাং তাসাওউফকে অস্বীকার করলে দ্বীনকে অস্বীকার করা অপরিহার্য হবে।

হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) বলেন, তিনটি উদ্দেশ্যে আল্লাহ তাআলা নবীগণকে পাঠিয়েছেন; তা হলো ১. আকীদা শুদ্ধকরণ, ২. আমল শুদ্ধকরণ ও ৩. ইখলাস তথা আন্তরিকতা শুদ্ধকরণ-

وقد تكفل بفن الاول اهل الوصول من علماء الامة و قد تكفل بفن الثاني فقهاء الامة فهدي الله بهما اكثرين و قد تكفل بفن الثالث الصوفية رضوان الله عليهم (التفهيمات الالهية)

-বিশ্বাস বা আকীদা সংশোধনের দায়িত্ব নিয়েছেন উলামায়ে উসূল বা নীতিশাস্ত্রবিদ আলিমগণ, আমল সংশোধনের দায়িত্ব ফকীহগণের এবং ইখলাস তথা আন্তরিকতা সংশোধনের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেছেন সূফী বুযুর্গগণ।

তাসাওউফ দেহে আত্মার মতো

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) আরো বলেন,“ইসলামে তাসাওউফ দেহে আত্মার ন্যায়”। তিনি বলেন,

والذي نفسي بيده هذا الثالث ادق المقاصد الشرعية مأخذا و اعمقها مهتدا و هو بالسنة الي سائر الشرائع بمنزلة الروح من الجسد و بمنزلة المعني من اللفظ- (التفهيمات الالهية)

-সেই সত্তার কসম, যার কব্জায় আমার প্রাণ, এই তৃতীয় শাস্ত্রটি শরীআতের উদ্দেশ্যের উৎস হিসেবে খুবই সূক্ষ্ম এবং হিদায়াত হিসেবে খুবই গভীর। তাই সকল শরীআতের জন্য এই শাস্ত্রের মর্যাদা দেহের আত্মা এবং শব্দের জন্য অর্থ স্বরূপ। (তাফহীমাত)

ইখলাস ও ইহসান নামে অভিহিত তৃতীয় এই শাস্ত্রটি সমগ্র শরীআতের প্রাণ ও আত্মা। আত্মা ছাড়া যেমন দেহ অর্থহীন অনুরূপ ইখলাস ব্যতীত আকাঈদ ও আমল অর্থহীন। আর এরই অপর নাম তাসাওউফ। তাসাওউফ ব্যতীত না শরীআত জীবিত থাকতে পারে, না দ্বীন নিরাপদ থাকতে পারে। শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (র.) বিষয়টি পরিষ্কার করে দিয়েছেন।

তাসাওউফ শারঈ ইলমের স্বতন্ত্র শাখা

عن جابر رضي الله عنه قال قال رسول الله صلي الله عليه وسلم العلم علمان فعلم في القلب فذلك العلم النافع وعلم علي اللسان فذلك حجة علي الله علي ابن ادم – رواه الدارمي والمنذري

وفي رواية العلم علمان فعلم ثابت في القلب وعلم في اللسان فذلك حجة علي عباده (رواه الديلمي والبيهقي)

-হযরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইলম দুই প্রকার। এক প্রকার ইলম অন্তরে প্রতিষ্ঠিত থাকে যা উপকারী ইলম। অপর প্রকার ইলম জিহ্বায় যা আদম সন্তানের দলীল। (হাদীসখানা দারিমী ও মুনযিরী বর্ণনা করেছেন)

বর্ণিত হাদীসের ব্যাখ্যায় মুল্লা আলী কারী (র.) বলেন,

قد يحمل الاول علي علم الباطن والثاني علي علم الظاهر (مرقاة المفاتيح)

-প্রথম প্রকার ইলম হচ্ছে ইলমে বাতিন আর দ্বিতীয় প্রকার ইলম হচ্ছে ইলমে যাহির।

প্রকৃতপক্ষে ইলমে বাতিনই হচ্ছে ইলমে তাসাওউফ।

 

তাসাওউফের আবশ্যকতা ও উপকারিতা

হযরত কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (র.) সূরা তাওবারوما كان المؤمنون لينفروا كافة  আয়াতের তাফসীর প্রসঙ্গে তাফসীরে মাযহারীতে তাসাওউফের গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরেন এভাবে-

واما العلم اللدني الذي يسمون اهلها بالصوفية الكرام فهو فرض عين لان ثمراتها تصفية القلب عن اشتغال بغير الله تعالي واتصافه بدوام الحضور وتزكية النفس عن رذائل الأخلاق من العجب والكبر والحسد وحب الدنيا والكسل في الطاعات وإيثار الشهوات والرياء والسمعة وغير ذلك وتجليتها بكرام الاخلاق من التوبة والرضا بالقضا والشكر علي النعماء والصبر علي البلاء وغير ذلك- ولا شك ان هذه الامور محرمات وفرائض علي كل بشر اشد تحريما من معاصي  الجوارح واهم افتراضا من فرائضها فالصلوة والصوم وشيء من العبادات لايعبأ بشيء منها ما لم تقترن بالاخلاص والنية- (التفسير المظهري)

-ইলমে লাদুন্নী অর্জনকারী ব্যক্তিদেরকে সূফী বলা হয়ে থাকে। আর ইলমে লাদুন্নী অর্জন করা ফরযে আইন। এই শাস্ত্রের ফল হচ্ছে গায়রুল্লাহর যিকর থেকে অন্তরকে পরিশুদ্ধ রাখা, অন্তরকে সার্বক্ষণিক উপস্থিত রাখা, মন্দ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তথা অহংকার, অহমিকা, হিংসা, দুনিয়ার প্রতি ভালোবাসা, জাঁকজমক প্রীতি, আল্লাহর আনুগত্যে অলসতা, কামনা-বাসনা, রিয়া ও খ্যাতি ইত্যাদি বিষয় থেকে অন্তরকে রক্ষা করা। এর আরো উপকারিতা হচ্ছে, উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অর্জন করা, তৎসঙ্গে গুনাহ থেকে তাওবাহ করা, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা, তাঁর নিআমতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা এবং বালা-মুসীবতে ধৈর্য ধারণ করা ইত্যাদি। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো হারাম এবং মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের গুনাহের চাইতেও অধিকতর হারাম। পাশাপাশি নামায, রোযা ও অন্যান্য ইবাদত অপেক্ষাও অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ফরয। কেননা যেকোনো ইবাদত ইখলাস ও বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত নিষ্ফল। (মাযহারী)

আর নিয়ত বিশুদ্ধ হওয়ার নামই হলো তাসাওউফ।

ইমাম গাযালী (র.) বলেন, وكذلك يفترض عليه علم احوال القلب من التوكل والخشية والرضا (تعليم المتكلمين)

(অন্য সকল শাস্ত্রের ন্যায়) ইলমে তাসাওউফ বা অন্তরের অবস্থাবলি তথা তাওয়াক্কুল বা আল্লাহর উপর ভরসা, খাশিয়্যাত বা খোদাভীতি এবং রেদা বিল কাযা বা আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকার জ্ঞান অর্জন করাও ফরয। ইমাম গাযালী (র.) এর সুচিন্তিত মতামত হচ্ছে তাসাওউফের জ্ঞান অর্জন করা ফরযে আইন।

মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব তার التكشف عن مهمات التصوف কিতাবে তাসাওউফ শিক্ষা করাকে ফরযে আইন সাব্যস্ত করেছেন।

আল্লামা ইবনু আবেদীন আশ-শামী (র.) অন্তরের অবস্থাসমূহ বিস্তারিত বর্ণনা করে ফল বের করেছেন যে,

فيلزمه ان يتعلم منها ما يري نفسه محتاجا اليه وازالتها فرض عين (رد المحتار)

-অন্তরের কুস্বভাব দূর করার জন্য তাসাওউফ এতটুকু অর্জন করবে, যতটুকু নিজের জন্য প্রয়োজনীয় মনে করবে। আর অন্তরের কুস্বভাব দূর করা ফরযে আইন। (রদ্দুল মুহতার)

তাফসীরে জুমালে উল্লেখ করা হয়েছে-        والدين الذي لا يقبل التغير هو التوحيد والاخلاص والايمان بما جائت جميع الرسل عليهم السلام

-যে দ্বীন পরিবর্তন কবূল করে না, তা হচ্ছে তাওহীদ, ইখলাস ও নবী-রাসূলগণ আনীত বিষয়াদির প্রতি ঈমান আনা।

এর দ্বারা প্রমাণিত হয় তাসাওউফ তথা ইখলাস ও ইহসান দ্বীনের মৌলিক বিষয়াদির অন্যতম। ইখলাস ছাড়া তাওহীদ যেমন গ্রহণীয় নয় অনুরূপ ঈমান আমলও গ্রহণীয় নয়।

হযরত শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) বলেন, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে শরীআত ও তরীকত। তারা এ দুটি বিষয়কেই বুযুর্গীর মূল বিষয় মনে করেন। (তুহফায়ে ইসনা আশারিয়্যাহ)

এ থেকে বুঝা গেল যারা তাসাওউফকে অস্বীকার করে তারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের দলভুক্ত নয়। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের অনুসারী সূফীগণ তাসাওউফ ও তাসাওউফের আকীদা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে লাভ করেছেন। এটা সূফীগণের সর্বসম্মত চলার পথ। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে এতে যেসব ত্রুটি বিচ্যুতি দেখা দিয়েছে অনুসন্ধানকারীগণ তা সংশোধন করে দিয়েছেন।

তাসাওউফ ও সুলূক তাওয়াতুর পদ্ধতিতে প্রমাণিত

তাসাওউফ ও সুলূক তাওয়াতুর পদ্ধতিতে প্রমাণিত। সর্বযুগেই অগণিত অসংখ্য ব্যক্তি তাসাওউফ চর্চায় নিমজ্জিত ছিলেন, বর্তমানেও রয়েছেন। আর তা এমন বিপুল সংখ্যক লোকের পরম্পরাগত বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত যারা জ্ঞানে, আমলে, সংসার অনাসক্তিতে ও তাকওয়া-পরহেযগারীতে নযীরবিহীন। কাজেই এমন গুণসম্পন্ন অগণিত লোকের মিথ্যার উপর একমত হওয়া অসম্ভব।

লেখক: চেয়ারম্যান, দারুল ফিকির ওয়াল ইফতা আল ইসলামি

ফেইসবুকে আমরা...