হাদীসের মূল ভাষ্য
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ، رَضِيَ اللهُ عَنْهُ ، عَنِ النَّبِيِّ ، صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ، قَالَ: “مَنْ نَفَّسَ عَنْ مُؤْمِنٍ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ الدُّنْيَا نَفَّسَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرَبِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ يَسَّرَ عَلٰى مُعْسِرٍ، يَسَّرَ اللهُ عَلَيْهِ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ ، وَاللهُ فِي عَوْنِ الْعَبْدِ مَا كَانَ الْعَبْدُ فِي عَوْنِ أَخِيهِ، وَمَنْ سَلَكَ طَرِيقًا يَلْتَمِسُ فِيهِ عِلْمًا سَهَّلَ اللهُ لَهُ بِهِ طَرِيْقًا إلَى الْجَنَّةِ، وَمَا اجْتَمَعَ قَوْمٌ فِي بَيْتٍ مِنْ بُيُوْتِ اللهِ يَتْلُوْنَ كِتَابَ اللهِ، وَيَتَدَارَسُوْنَهُ فِيمَا بَيْنَهُمْ؛ إلَّا نَزَلَتْ عَلَيْهِمُ السَّكِينَةُ، وَغَشِيَتْهُمْ الرَّحْمَةُ، وَذَكَرَهُمُ اللهُ فِيمَنْ عِنْدَهُ، وَمَنْ أَبَطْأَ بِهِ عَمَلُهُ لَمْ يُسْرِعْ بِهِ نَسَبُهُ”.رواه مسلم بهذا اللفظ.
অনুবাদ: হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়ার কষ্টসমূহের মধ্য থেকে কোনো কষ্ট দূর করে দেবে আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের কষ্টসমূহের মধ্য থেকে একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্থ ব্যক্তির অভাব (সাহায্যের দ্বারা) সহজ করে দিবে আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়কে সহজ করে দিবেন। এমনিভাবে যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষত্রুটি গোপন রাখবে আল্লাহ তাআলা দুনিয়া ও আখিরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আল্লাহ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর বান্দার সহযোগিতায় থাকেন যতক্ষণ বান্দা তার অপর ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকে। যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার জন্য বেহেশতের পথ সহজ করে দেন। যখন কোনো দল আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনো একটি ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব (কুরআন শরীফ) তিলাওয়াত করে এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে তা আলোচনা করে তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবর্তীর্ণ হয়, রহমত তাদের ঢেকে ফেলে, ফেরেশতাগণ তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন এবং আল্লাহ তাআলা তার নিকটস্থ ফেরেশতাদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। আর যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশ মর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারে না। (মুসলিম)
হাদীসের আলোচ্য বিষয়
এ হাদীসে আমাদের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে।
১. মানুষের কষ্ট লাঘব করা,
২. অভাবীদের অভাব মোচন করা,
৩. মানুষের দোষত্রুটি গোপন রাখা,
৪. সদা-সর্বদা অপর ভাইয়ের সহযোগিতায় থাকা।
৫. জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব ও ফযীলত
৬. মসজিদে সমবেত হয়ে কুরআন তিলাওয়াত ও এর দারস-তাদরীসের গুরুত্ব।
৭. আমলের আবশ্যকতা ও বংশ মর্যাদার গুরুত্বহীনতা।
মুমিনের দুঃখ-কষ্ট লাঘব ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা
মুমিনের দুঃখ-কষ্ট লাঘব করা ও তাদের সাহায্য-সহযোগিতা করা নেক ও উত্তম কাজ। সাধারণত কোনো নেক কাজ করলে এর বিনিময়ে দশগুণ সাওয়াব পাওয়া যায়। পবিত্র কুরআন মজীদে এসেছে- مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ عَشْرُ أَمْثَالِهَا -কেউ কোনো নেক কাজ করলে সে এর দশগুণ পাবে (সূরা আনআম, আয়াত ১৬০)। কিন্তু এ হাদীসে এসেছে কোনো মুমিন অপর মুমিনের দুনিয়ার একটি কষ্ট দূর করলে আল্লাহ তার কিয়ামত দিবসের একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। অথচ আয়াত অনুযায়ী দশগুণ প্রতিফল হওয়া উচিত ছিল। এর জবাব হলো, আখিরাতের একটি কষ্ট দূর হওয়া দুনিয়ার দশগুণ বা ততোধিক প্রতিফল লাভের চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ। কেননা একজন মুমিনের জন্য আখিরাতের জীবনের কল্যাণ অধিক কাঙ্ক্ষিত ও অধিক উপকারী বিষয়। সুতরাং কিয়ামতের দিনের একটি কষ্ট দূর হলে তা দশগুণ প্রতিফলের সমান হয়ে যায়। অবশ্য অন্য আয়াতে আছে, مَنْ جَاءَ بِالْحَسَنَةِ فَلَهُ خَيْرٌ مِنْهَا -কেউ কোনো নেক কাজ করলে সে এর চেয়ে উৎকৃষ্ট ফল পাবে (সূরা কাসাস, আয়াত ৮৪)। এ হিসাবে দুনিয়ার একটি কষ্ট দূর করার বিনিময়ে আখিরাতের একটি কষ্ট দূর হলে নিঃসন্দেহে তা প্রতিফল হিসাবে অত্যন্ত উৎকৃষ্ট।
হাদীসে আরো বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনো অভাবগ্রস্থ ব্যক্তির অভাব (সাহায্যের দ্বারা) সহজ করে দিবে আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয়কে সহজ করে দিবেন। পূর্বোক্ত ব্যাখ্যা মোতাবেক এখানে ব্যক্তি বহুগুণ প্রতিফল লাভ করছে, যেহেতু অন্যের অভাব মোচনের দ্বারা একই সাথে তার দুনিয়া ও আখিরাতের বিষয় সহজ হয়ে যাচ্ছে। এমনিভাবে কোনো মুসলমানের দোষত্রুটি গোপন রাখার মাধ্যমেও ইহ-পরকালীন কল্যাণ লাভ হয়। কোনো মুমিন অপর মুমিনের দোষ গোপন করলে আল্লাহ তার দোষ দুনিয়াতেও গোপন রাখেন, আখিরাতেও গোপন রাখেন। আর যদি আল্লাহর দয়ায় আখিরাতে দোষ গোপন হয়ে যায় তাহলে এটিই তো বড় সফলতা।
একজন মুসলমকে সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় সহযোগিতা করা অপর মুসলমানের অন্যতম দায়িত্ব। মুসলিম বান্দা যতক্ষণ এ দায়িত্বে নিজেকে নিয়োজিত রাখে আল্লাহ ততক্ষণ তাকে সহযোগিতা করতে থাকেন। তাই আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা পেতে হলে খিদমতে খালকে যথাসাধ্য নিয়োজিত থাকা প্রয়োজন।
জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব ও ফযীলত
ইসলাম জ্ঞানার্জনের প্রতি অত্যন্ত গুরুত্বারোপ করেছে। পবিত্র কুরআনের প্রথম বাণীই হলো, ইকরা- পড়। পবিত্র কুরআন মজীদে এসেছে- قُلْ هَلْ يَسْتَوِي الَّذِينَ يَعْلَمُونَ وَالَّذِينَ لَا يَعْلَمُونَ –আপনি বলুন, যারা জানে এবং যারা জানে না তারা কি সমান? (সূরা যুমার, আয়াত ০৯) অর্থাৎ তারা সমান নয়। বরং প্রকৃত কথা হলো, يَرْفَعِ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَالَّذِينَ أُوتُوا الْعِلْمَ دَرَجَاتٍ -তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে আল্লাহ তাদের মর্যাদায় উন্নত করবেন। (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত ১১)।
প্রিয়নবী (সা.) জ্ঞান অর্জনের প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এ হাদীসে তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি জ্ঞান অন্বেষণের উদ্দেশ্যে কোনো পথ অবলম্বন করে আল্লাহ তাআলা এর বিনিময়ে তার জন্য বেহেশতের পথ সহজ করে দেন। এখানে বিশেষভাবে জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বের হওয়া বা সফরের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে বের হলে আল্লাহ এর ওসীলায় জান্নাতের পথকে সহজ করে দেন। আমাদের পূর্বসূরী সালফে সালিহীন জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে সফর করতেন। ইলম অর্জনে দূর-দূরান্তের পথ পাড়ি দিতেও তাঁরা কুন্ঠাবোধ করতেন না।
কুরআন মজীদ তিলাওয়াত ও এর দারস-তাদরীসের গুরুত্ব
পবিত্র কুরআন মজীদ তিলাওয়াত একটি উত্তম আমল। হাদীস শরীফে একে ‘সর্বোত্তম যিকর’ বলা হয়েছে। কুরআন মজীদের একটি হরফ তিলাওয়াত করলে দশটি নেকী হয়। তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে অর্থ বুঝা আবশ্যক নয়। অর্র্থ না বুঝে তিলাওয়াত করলেও দশ নেকী হবে। তিলাওয়াত একাকী যেমন করা যায় তেমনি সম্মিলিতভাবেও করা যায়। এখানে রাসূলুল্লাহ (সা.) মূলত সম্মিলিতভাবে কুরআন তিলাওয়াত এবং কুরআনের দারস-তাদরীস তথা শিক্ষাদান ও আলোচনা পর্যালোচনার বিশেষ ফযীলতের প্রতি আলোকপাত করেছেন। যেমন হাদীসটিতে এসেছে, যখন কোনো দল আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোনো একটি ঘরে একত্রিত হয়ে আল্লাহর কিতাব (কুরআন শরীফ) তিলাওয়াত করে এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে তা আলোচনা করে তখন তাদের উপর প্রশান্তি অবর্তীর্ণ হয়, রহমত তাদের ঢেকে ফেলে, ফেরেশতাগণ তাদের পরিবেষ্টন করে রাখেন এবং আল্লাহ তাআলা তার নিকটস্থ ফেরেশতাদের কাছে তাদের কথা উল্লেখ করেন। এ হাদীস থেকে উলামায়ে কিরাম সম্মিলিত যিকরের দলীল গ্রহণ করে থাকেন। ইমাম মুসলিম (র.)ও এ হাদীসের বাবের শিরোনামে ‘যিকর’কে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি এ বাবের নাম দিয়েছেন باب فضل الاجتماع على تلاوة القرآن وعلى الذكر অর্থাৎ কুরআন তিলাওয়াত ও যিকরের উদ্দেশ্যে একত্রিত হবার ফযীলত।
আমলের আবশ্যকতা ও বংশ মর্যাদার গুরুত্বহীনতা
এ হাদীসটি সর্বশেষ আমলের আবশ্যকতা ও বংশ মর্যাদার গুরুত্বহীনতার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যার আমল তাকে পিছিয়ে দেয়, তার বংশ মর্যাদা তাকে এগিয়ে দিতে পারে না।” আল্লাহর দরবারে মানুষের অগ্রগামীতা বা নৈকট্যের মূল হাতিয়ার হলো তার নেক আমল। বিশেষত ফরয আমল বা বিধান প্রতিপালনের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর অধিক নৈকট্য অর্জন করে। পাশাপাশি নফল আমলের মাধ্যমেও আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে সহযোগিতা করে।
আল্লাহ আমাদের নেক আমলের মাধ্যমে আল্লাহর কুরবত তথা নৈকট্য অর্জনের তাওফীক দান করুন। আমীন।