1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন ও যাকাত ব্যবস্থা
মারজান আহমদ চৌধুরী
  • ১ এপ্রিল, ২০২১

ইসলামের অর্থনৈতিক দর্শন
ইসলামী অর্থনীতি হচ্ছে ইসলামী শরীআহ প্রদত্ত কিছু অর্থনৈতিক নীতিমালা, যা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা তাঁর বান্দাহদের ইহকালীন জীবনকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা ও আখিরাতের সাফল্য লাভের জন্য নির্ধারণ করেছেন। আল্লাহর কিতাব ও আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাতে মানবজীবন পরিচালনার যে সামষ্টিক নির্দেশনা রয়েছে, অর্থনৈতিক নীতিমালা তার মধ্যে একটি। যেহেতু অর্থনীতি ইসলামী জীবনব্যবস্থার-ই অংশ, তাই ইসলামী শরীআহর মূল সূত্রসমূহে (কুরআন-হাদীস) আলাদাভাবে অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। বরং অর্থের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনার জন্য কিছু মূলনীতি প্রদান করা হয়েছে।

আদর্শগত দিক থেকে ইসলামী অর্থনীতির দুটি ধারা রয়েছে। একটি Spiritual তথা রূহানী ধারা, যা অনুশীলন করা কারও ওপর আবশ্যক নয়। বরং এটি ইসলামী জীবনযাপনের সর্বোচ্চ শিখর। যাতে একজন মুসলমান সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় আরোহণ করে। আরেকটি ধারা হচ্ছে Legal তথা আইনী ধারা, যা অনুশীলন ও পরিপালন করা প্রত্যেক মুসলমানের উপর আবশ্যক। এটি ইসলামী জীবনযাপনের সর্বনিম্ন শেকড়। যার নিচে নামলেই ব্যক্তি হারামের মধ্যে পতিত হবে। আইনী ধারা সম্পদ অর্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে কোনোরূপ কড়াকড়ি আরোপ করে না, যদি আয় ও ব্যয় হালাল পন্থায় হয় এবং নির্ধারিত যাকাত ও অন্যান্য আবশ্যিক সাদকাহ প্রদান করা হয়। আইনী ধারাটি পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। স্বেচ্ছায় পালন না করলে জোরপূর্বক পালন করানোর অধিকার ইসলামী রাষ্ট্রের রয়েছে। অপরদিকে রূহানী ধারা হচ্ছে, নিতান্ত প্রয়োজনের অধিক সম্পদ অর্জন না করা। অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা থাকে, সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিলিয়ে দেওয়া। রূহানী ধারাটি একজন মুসলমান সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায় পালন করবে। এখানে আবশ্যকীয়তা কিংবা জোরজবরদস্তি প্রবেশ করলে রূহানিয়্যাতের সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنفِقُونَ قُلِ الْعَفْوَ

-আর তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? বলুন, প্রয়োজনের অতিরিক্ত সবকিছু। (সূরা বাকারা, আয়াত-২১৯)
উক্ত আয়াতে যে ব্যয়ের কথা বলা হয়েছে, সেটি আবশ্যক ব্যয় নয়। বরং স্বেচ্ছায় ব্যয়। এ পদ্ধতি অনুসরণ করাই ইসলামের রূহানী ধারা। অন্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন-

وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُونَ

-তোমরা নামায কায়িম করো, যাকাত প্রদান করো এবং রাসূলের আনুগত্য করো, যাতে তোমরা অনুগ্রহপ্রাপ্ত হতে পারো। (সূরা নূর, আয়াত-৫৬)

এ আয়াতে যে ব্যয়ের (যাকাত) কথা বলা হয়েছে, তা আবশ্যক। এটি স্বেচ্ছায় হোক, জোরপূর্বক হোক পালন করতেই হবে। নির্ধারিত সম্পদের মালিককে বছরান্তে নির্ধারিত পরিমাণ যাকাত প্রদান করতেই হবে। মোটকথা, ইসলামী অর্থনীতির আইনী ধারা হচ্ছে, হালাল পন্থায় সম্পদ অর্জন করা এবং নির্ধারিত আবশ্যিক ব্যয় যথাযথভাবে আদায় করা। নির্ধারিত ব্যয় নির্বাহ করার পর বাকি সম্পদ মালিকের কর্তৃত্বে থাকবে, চাই তা পাহাড়সম হোক না কেন। অপরদিকে রূহানী ধারা হচ্ছে, এত সম্পদ সঞ্চয় না করা, যাতে যাকাত প্রদান করা আবশ্যক হয়ে যায়। বরং প্রয়োজনের অতিরিক্ত যা কিছু থাকবে, সবই অন্যের প্রাপ্য। প্রসঙ্গত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রূহানী পরিসরেই তাঁর পুরো জীবন কাটিয়েছেন। আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনও যাকাত প্রদান করেননি। কারণ যাকাত প্রদান করার জন্য নির্ধারিত সম্পদ কখনও তাঁর কাছে জমা হয়নি। উপরন্তু আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনে এমন দিনও অতিবাহিত হয়েছে, যখন তাঁর ও তাঁর পরিবারের নিতান্ত প্রয়োজনই পূরণ হয়নি।

প্রখ্যাত আলিমে দ্বীন ও দার্শনিক ড. ইসরার আহমদ (১৯৩২-২০১০) ইসলামী অর্থনীতির এ দুটি ধারাকে বর্তমান যুগে প্রচলিত দুটি অর্থনৈতিক ধারা, তথা পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সংজ্ঞায়ন করেছেন। তিনি বলেছেন, ইসলামী অর্থনীতির রূহানী ধারা Spiritual Socialism বা আধ্যাত্মিক সমাজতন্ত্রের এক উচ্চমার্গীয় রূপ। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতির আইনী ধারা হচ্ছে Controlled and Managed Capitalism তথা পুঁজিবাদের একটি নিয়ন্ত্রিত ও ব্যবস্থাপিত রূপ। এ সংজ্ঞায়ন এজন্য করা হয়েছে যে, নিকট অতীতে পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ নিজ নিজ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। কোনটি সফল আর কোনটি বিফল, সেদিকে আমরা যাচ্ছি না। তবে এ দুটি ধারার সাথে সামঞ্জস্যতা রেখে সংজ্ঞায়ন করলে বুঝতে সুবিধা হবে, তাই এ প্রচেষ্টা।

মৌলিক দর্শনের বিচারে ইসলামী অর্থনীতি পুঁজিবাদ (Capitalism) ও সমাজবাদ (Socialism) থেকে অনেকটাই ভিন্ন; যদিও ব্যবহারিক দিক থেকে উভয়ের সাথে এর অনেকটা মিলও রয়েছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সাথে ইসলামী অর্থনীতির সামঞ্জস্য এই যে, ইসলাম ও সমাজবাদ উভয়েই রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জনসাধারণের মৌলিক প্রয়োজনীয়তা পূরণ করার দাবি করে। সমাজতন্ত্র সেটি কীভাবে এবং কতটুকু করেছে, সে তর্কে আমরা যাচ্ছি না। তবে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় নাগরিকদের জীবনধারণের মৌলিক উপাদান (كفالة عامة) প্রদান করার আবশ্যকীয়তা রয়েছে। আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) এর খিলাফতকালে এ আদর্শের যথার্থ বাস্তবায়ন দেখা গিয়েছিল। বস্তুত, ইসলামী অর্থনীতির রূহানী ধারা সমাজতন্ত্রের সাথে অনেকটাই সামঞ্জস্যপূর্ণ।

অপরদিকে সমাজতন্ত্রের মধ্যে যে অযাচিত কড়াকড়ি দেখা যায়, ইসলামে সেরকম অযাচিত বলপ্রয়োগ নেই। সমাজতন্ত্রে পুঁজিকে স্তব্ধ করে রাখা হয়। উৎপাদনের উপকরণের একচ্ছত্র মালিকানা চলে যায় রাষ্ট্রের হাতে। এর ফলে জনসাধারণের মধ্যে শ্রম দেওয়ার উৎসাহ (Incentive) মরে যায়। ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়, দারিদ্র অনিবার্য হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি-মালিকানাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়। পুঁজির কোনো লাগাম থাকে না। ফলে প্রায় সমস্ত সম্পদ পুঁজিপতিদের করতলগত হয়ে যায়। ইসলাম এ ধরনের এককেন্দ্রিক ব্যবস্থাকে অপছন্দ করে। আল্লাহ বলেছেন,

كَيْ لَا يَكُونَ دُولَةً بَيْنَ الْأَغْنِيَاءِ مِنكُمْ

-যেন সম্পদ কেবল তোমাদের মধ্যকার ধনাঢ্যদের মধ্যে কুক্ষিগত না হয়। (সূরা হাশর, আয়াত-৭)

ইসলাম পুঁজিকে স্তব্ধ করেনি। পুঁজিবাদের ন্যায় ইসলামও পুঁজিকে ছেড়ে দেয়। তবে ইসলাম পুঁজিকে নিয়ন্ত্রণ (Control) ও ব্যবস্থাপনা (Manage) করে। যাতে প্রতিযোগিতা বহাল থাকে, আবার লাগামহীন প্রতিযোগিতা না হয়। এটি সমাজতন্ত্রের মতো সর্ব-নিয়ন্ত্রক নয়। কিছু শর্ত পূরণ করা সাপেক্ষে ইসলামী অর্থনীতি বাজারকে (Market) খুলে দেয়, উৎপাদনকে উৎসাহ প্রদান করে, শ্রমের ইচ্ছাকে বাঁচিয়ে রাখে। ইসলামী অর্থনীতি হালাল-হারামের পার্থক্য সূচনা করার মাধ্যমে পুঁজিকে Control তথা নিয়ন্ত্রণ করে। সুদ, জুয়া, কালোবাজারি, মজুতদারী ও ফটকাবাজিকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে। পুঁজির চেয়ে শ্রমকে এবং সঞ্চয়ের চেয়ে বিনিয়োগকে অধিক উৎসাহ প্রদান করে, যেন উৎপাদনের অভাব দেখা না দেয়। ফলে পুঁজি নিয়ন্ত্রিত থাকে, আবার স্তব্ধও হয় না। এতে দেখা যায় যে, ইসলামী অর্থনীতিতে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা চলমান। আবার এ প্রতিযোগিতায় যারা পিছিয়ে পড়ে, তাদেরকে অর্থব্যবস্থার মূলধারার সাথে সংযুক্ত করার জন্য ইসলাম যাকাতের বাধ্যবাধকতা রেখেছে। যাকাত অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া গোষ্ঠীর সাথে পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠীর একটি চমৎকার সমতা বা সামঞ্জস্য তৈরি করে। এভাবে ইসলাম পুঁজিকে গধহধমব তথা ব্যবস্থাপনা করে।

পুঁজিবাদ ও সমাজবাদের সাথে ইসলামী অর্থনীতির মূল পার্থক্যের জায়গা হচ্ছে সম্পদের মালিকানাতত্ত্ব। সম্পদ তথা উৎপাদনের উপকরণ কার মালিকানায় থাকবে, সেটি অর্থনীতির মৌলিক আলোচ্য বিষয়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ তথা উৎপাদনের উপকরণের মালিকানা থাকে ব্যক্তির হাতে। ব্যক্তি একে ব্যবহার করে ইচ্ছেমতো উৎপাদন ও মুনাফা অর্জন করতে পারে। অধিক মুনাফা লাভের আশায় ব্যক্তি শ্রম দিয়ে যায়, যার ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। আবার সমাজবাদী অর্থব্যবস্থায় সম্পদ তথা উৎপাদনের উপকরণের একচ্ছত্র মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে। এখানে ব্যক্তির অধিকার নির্দিষ্ট এবং সীমাবদ্ধ। এর ফলে সমাজবাদী অর্থব্যবস্থায় শ্রমের উদ্দীপনা থাকে না, ফলে উৎপাদন হ্রাস পায়। অপরদিকে ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের মালিকানা চূড়ান্তভাবে ব্যক্তির হাতেও নয়, আবার একচ্ছত্রভাবে রাষ্ট্রের হাতেও নয়। বরং ইসলামী অর্থনীতিতে সম্পদের মূল মালিকানা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার হাতে নিহিত। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে-

لَهُ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَمَا بَيْنَهُمَا وَمَا تَحْتَ الثَّرَىٰ

-যা কিছু রয়েছে আসমানসমূহে, যা কিছু যমীনে এবং এতদুভয়ের মধ্যখানে এবং যা কিছু ভূগর্ভস্থ, সবকিছু তাঁরই। (সূরা ত্বাহা, আয়াত-০৬)

অপর আয়াতে বলা হয়েছে-

وَكَمْ أَهْلَكْنَا مِن قَرْيَةٍ بَطِرَتْ مَعِيشَتَهَا فَتِلْكَ مَسَٰكِنُهُمْ لَمْ تُسْكَن مِّنۢ بَعْدِهِمْ إِلَّا قَلِيلًا وَكُنَّا نَحْنُ ٱلْوَٰرِثِينَ

-কত জনপদকে আমি ধ্বংস করেছি, যার বাসিন্দারা নিজেদের ভোগ সম্পদের দম্ভ করত। এগুলোই তো তাদের ঘরবাড়ি। তাদের পরে এখানে খুব কম লোকজন বসবাস করেছে। আর আমিই চূড়ান্ত মালিকানার অধিকারী। (সূরা কাসাস, আয়াত-৫৮)

 

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় মানুষ বা রাষ্ট্র সম্পদের মূল মালিক (Absolute Owner) নয়; বরং আমানতদার (Sacred Trustee)। এ আমানত মানুষ তার রবের পক্ষ থেকে লাভ করেছে। অতএব সম্পদ যেহেতু রবের পক্ষ থেকে প্রদত্ত আমানত, তাই মানুষ এ আমানত তথা সম্পদকে তার রবের সন্তুষ্টির বিপরীত কোনো কাজে ব্যবহার করতে পারে না। মানুষ যখন একে অপরের কাছে সম্পদের মালিকানা হস্তান্তর করে, তখন কেবল ব্যবহারের অধিকার হস্তান্তর করা হয়। মূল মালিকানা যেহেতু মানুষের হাতে নয়, তাই এটি সংরক্ষণ করা কিংবা হস্তান্তর করার প্রশ্ন আসে না। মালিকানার ক্ষেত্রে এ মৌলিক পার্থক্য ইসলামী অর্থনীতিকে ভোগবাদী অর্থনীতির গহ্বর থেকে বের করে কল্যাণমুখী অর্থনীতিতে পরিণত করেছে। এখানে ব্যক্তি তার মালিকানার দোহাই দিয়ে সম্পদের যথেচ্ছা ব্যবহারও করতে পারে না, আবার রাষ্ট্র জোরপূর্বক ব্যক্তির সম্পদের ওপর থেকে ব্যক্তির ব্যবহারের অধিকারকেও কেড়ে নিতে পারে না। ইসলামী অর্থনীতিতে ভারসাম্য বজায় থাকে।

প্রসঙ্গত একটি কথা জেনে রাখা আবশ্যক যে, ইসলামী অর্থনীতির একমাত্র চারণভূমি হলো ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা। প্রচলিত পশ্চিমা ধাচের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় ইসলামী অর্থনীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। কারণ প্রচলিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী হয় জনগণ (Democracy), নয়তো রাজা-বাদশা  (Monarchy),, নয়তো একটি দল বা গোষ্ঠী (Oligarchy)। অপরদিকে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থায় সার্বভৌম ক্ষমতা আল্লাহর হাতে নিহিত, আর মানুষ আল্লাহর খলিফা। সার্বভৌম ক্ষমতা Sovereignty)  যেহেতু আল্লাহর হাতে, তাই খলীফা হিসেবে মানুষ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আদেশ-নিষেধ অমান্য করতে পারে না। আইন-কানুন যখন প্রণীত হয়, সেগুলো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্যের ভেতরেই প্রণীত হয়। খিলাফতের এ চেতনাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের হুকুম পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়ন করার নিশ্চয়তা প্রদান করে। অতএব ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা না করে অন্যত্র ইসলামী অর্থনীতির পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নেহায়েত অসম্ভব।

ইসলামী অর্থনীতিতে যাকাতের অবস্থান
ইসলামী অর্থব্যবস্থার যে দুটি ধারা আমরা আলোচনা করলাম, তন্মধ্যে যাকাত ইসলামী অর্থনীতির আইনি ধারার মূল উপাদান, যেহেতু রূহানী ধারার জীবনযাপনে যাকাতের প্রশ্ন আসে না। ইসলামী অর্থনীতি যাকাতের মাধ্যমে পুঁজিকে গধহধমব তথা ব্যবস্থাপনা করে। যাকাত Bridge between the gap  তথা শূন্যস্থান পূরণকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলে সমাজে ধনী ও দরিদ্র পরিচয়ে যে দুটি শ্রেণীর জন্ম হয়, যাকাত এদের মধ্যকার ফাটলকে যথেষ্ট পূর্ণ করে দেয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকাত গ্রহণের নির্দেশ দেওয়ার সময় স্পষ্ট করে বলেছেন,
أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ
-আল্লাহ তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের বিত্তশালীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। (বুখারী ও মুসলিম)

 

যাকাতের পরিচয় ও প্রয়োজনীয়তা
যাকাত ইসলামের মূল স্তম্ভসমূহের মধ্যে একটি স্তম্ভ, যা আল্লাহ তাঁর বান্দাহদের মধ্যে সামর্থবানদের ওপর ফরয করেছেন। পবিত্র কুরআনে ঈমান ও নামাযের পর যাকাতের বিধান সর্বাধিক গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ

-যারা ঈমান আনে, নেক আমল করে, নামায কায়িম করে এবং যাকাত প্রদান করে তাদের জন্য তাদের প্রতিপালকের নিকট প্রতিদান রয়েছে। (সূরা বাকারা, আয়াত-২৭৭)

একইসাথে, যাকাত প্রদান না করার ফলশ্রুতিতে যে মর্মন্তুদ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে, তা-ও বলে দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন,

وَلَا يَحْسَبَنَّ الَّذِينَ يَبْخَلُونَ بِمَا آتَاهُمُ اللهُ مِن فَضْلِهِ هُوَ خَيْرًا لَّهُم بَلْ هُوَ شَرٌّ لَّهُمْ سَيُطَوَّقُونَ مَا بَخِلُوا بِهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلِلّٰهِ مِيرَاثُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ

-আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন, তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটি তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটি তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে, কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি দেওয়া হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা করো আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত। (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৮০)

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

بُنِيَ الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةِ أَنْ لَا إلَهَ إلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ وَإِقَامِ الصَّلَاةِ وَإِيتَاءِ الزَّكَاةِ وَحَجِّ الْبَيْتِ وَصَوْمِ رَمَضَانَ

-পাঁচটি বিষয়ের উপর ইসলামের বুনিয়াদ রাখা হয়েছে। সাক্ষ্য দেওয়া যে, আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোনো উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল, নামায কায়িম করা, যাকাত প্রদান করা, আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা এবং রামাদানের রোযা পালন করা। (বুখারী ও মুসলিম)

একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক যদি ওই পরিমাণ নিসাবের মালিক থাকা অবস্থায় এক বছর পূর্ণ করে, তবে তার সম্পদের চল্লিশ ভাগের একভাগ তথা ২.৫% নির্ধারিত খাতে দান করে দেওয়ার নাম যাকাত। শর্ত হচ্ছে, ব্যক্তিকে সম্পদের বৈধ মালিক হতে হবে, সম্পদ নিসাব পরিমাণ হতে হবে এবং এক বছর হাতে থাকতে হবে। তাছাড়া ব্যক্তিকে অবশ্যই মুসলমান হতে হবে, সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন হতে হবে, স্বাধীন ও সাবালক হতে হবে। অমুসলিম, নাবালক বা পাগলের ওপর যাকাত ফরয নয়। যাকাতের নিসাব হচ্ছে সাড়ে সাত তুলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তুলা রৌপ্য অথবা তৎসমপরিমাণ সম্পদ। যাকাতে আয়-ব্যয়ের কোনো পরিসংখ্যান হিসাব করা হয় না। বরং বছরান্তে হাতে থাকা মোট সম্পদ যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তবে এর ওপরই ২.৫% যাকাত ধার্য করা হয়। এক বছর যদি সম্পদ দশ লাখ হয়, তবে এ দশ লাখের ওপরই যাকাত ফরয হবে। পরের বছর ব্যবসায় লোকসান হয়ে যদি সম্পদ পাঁচ লাখে চলে আসে, তাহলে সেই পাঁচ লাখের ওপর যাকাত ফরয হবে। এ দুই বছরে সম্পদের মালিক কতটুকু আয় করলেন আর কতটুকু ব্যয় করলেন, যাকাত আদায়ের ক্ষেত্রে এর কোনো হিসাবই আসবে না। হাতে যখন যা আছে, যদি নিসাব পরিমাণ হয়, তাহলেই বছরান্তে যাকাত ফরয হয়ে যাবে। যাকাতের সাথে প্রচলিত আয়করের পার্থক্য এই জায়গায়। আয়করে আয়-ব্যয় হিসেব করা হয়, যাকাতে কেবল হস্তগত সম্পদ বিবেচনা করা হয়। ঘর-বাড়ি, খাদ্যদ্রব্য, দোকানপাট, অফিস-আদালত ইত্যাদির ওপর যাকাত ধার্য হয় না। শুধু নগদ অর্থ, স্বর্ণ-রৌপ্য তথা অলংকার, গবাদিপশু, ব্যবসায়িক পণ্য, ব্যাংক ব্যালেন্স ইত্যাদির ওপর যাকাত ফরয হয়। এছাড়া ফসলের যাকাত আলাদাভাবে ধার্য হয়, যাকে উশর বলা হয়। যাকাত প্রদান করার জন্য নির্ধারিত ৮টি খাত রয়েছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এ খাতসমূহের কথা উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ বলেছেন,

إِنَّمَا الصَّدَقَاتُ لِلْفُقَرَاءِ وَالْمَسَاكِينِ وَالْعَامِلِينَ عَلَيْهَا وَالْمُؤَلَّفَةِ قُلُوبُهُمْ وَفِي الرِّقَابِ وَالْغَارِمِينَ وَفِي سَبِيلِ اللهِ وَابْنِ السَّبِيلِ فَرِيضَةً مِّنَ اللهِ وَاللهُ عَلِيمٌ حَكِيمٌ

-নিশ্চয়ই সাদকাহ হলো ফকির, মিসকিন ও তৎসংশ্লিষ্ট কর্মচারী ও যাদের মন জয় করা উদ্দেশ্য, তাদের জন্য এবং দাসমুক্তি ও ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে (ব্যয় করার জন্য) এবং মুসাফিরের জন্য। এটি আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত ফরয। আর আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। (সূরা তাওবাহ, আয়াত-৬০)
প্রসঙ্গত বনূ হাশিম ও তাঁদের মাওলা তথা ক্রীতদাসরা যাকাত গ্রহণ করতে পারেন না। যেহেতু বনু হাশিম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর গোত্র, তাই তাঁদের জন্য যাকাত গ্রহণ করা হারাম।

 

যাকাত একটি ফরয ইবাদত এবং এর আবশ্যকীয়তা নিয়ে প্রশ্ন করারও সুযোগ নেই। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুআয ইবনে জাবালকে ইয়েমেনে প্রেরণ করার সময় বলেছিলেন,

إِنَّكَ سَتَأْتِيْ قَوْمًا مِنْ أَهْلِ الْكِتَابِ فَإِذَا جِئْتَهُمْ فَادْعُهُمْ إِلَى أَنْ يَشْهَدُوْا أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ فَإِنْ هُمْ طَاعُوْا لَكَ بِذٰلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فِيْ كُلِّ يَوْمٍ وَلَيْلَةٍ فَإِنْ هُمْ طَاعُوْا لَكَ بِذَلِكَ فَأَخْبِرْهُمْ أَنَّ اللهَ قَدْ فَرَضَ عَلَيْهِمْ صَدَقَةً تُؤْخَذُ مِنْ أَغْنِيَائِهِمْ فَتُرَدُّ عَلَى فُقَرَائِهِمْ فَإِنْ هُمْ طَاعُوْا لَكَ بِذَلِكَ فَإِيَّاكَ وَكَرَائِمَ أَمْوَالِهِمْ

-অচিরেই তুমি আহলে কিতাবদের এক গোত্রের কাছে যাচ্ছ। তাদের কাছে পৌঁছে তুমি তাদেরকে শাহাদাতের দাওয়াত দেবে যে, আল্লাহ ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর রাসূল। তারা যদি তোমার কথা মেনে নেয়, তখন তাদেরকে এ কথা জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের ওপর দিনে ও রাতে পাঁচবার নামায ফরয করেছেন। তারা তোমার কথা মেনে নিলে তুমি তাদেরকে জানিয়ে দেবে যে, আল্লাহ তাদের ওপর যাকাত ফরয করেছেন, যা তাদের বিত্তশালীদের নিকট হতে গ্রহণ করা হবে এবং তাদের অভাবগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করা হবে। যদি তারা তোমার কথা মেনে নেয়, তাহলে (যাকাত গ্রহণকালে) তাদের সম্পদের উৎকৃষ্টতম অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবে। (বুখারী ও মুসলিম)

ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী বলেছেন,

الزكاة أمر مقطوع به في الشرع يستغني عن تكلف الاحتجاج له وإنما وقع الاختلاف في بعض فروعه وأما أصل فرضية الزكاة فمن جحدها كفر

-যাকাত শরীআতের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলীল-প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। যাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসআলায় ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। যাকাতের আবশ্যকীয়তাকে যে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়। (ফাতহুল বারী, ৩/৩০৯)

 

যাকাতের মাধ্যমে কেবল ধনী-গরীবের মধ্যকার শূন্যস্থান-ই পূরণ করে না; বরং যাকাত অর্থের প্রবহণকেও (Circulation of wealth) গতি দান করে। যাকাতের ফলে অর্থ কুক্ষিগত হওয়া থেকে রক্ষা পায় এবং সমাজের সব শ্রেণির মধ্যে অর্থের প্রবহণ নিশ্চিত হয়।

এছাড়াও, যাকাত ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ধনী ব্যক্তি যখন তার সমাজের দরিদ্র ব্যক্তির কাছে যাকাতের অর্থ প্রদান করে, তখন সে অর্থ দরিদ্র ব্যক্তির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। যদি একটি সমাজের ৫০% মানুষ যাকাত গ্রহণের যোগ্য হন, আর তাদেরকে যাকাত না দেওয়া হয়, তাহলে এরা বাজারে অপাংক্তেয় হয়ে পড়বে। ফলে বাকি ৫০% যে পণ্য উৎপাদন করবে, তার ক্রেতা হবে কেবল তারাই। কারণ বাকি ৫০% মানুষের তো সেই ক্রয়ক্ষমতাই নেই যে, এদের উৎপাদিত পণ্য ক্রয় করতে পারে। যাকাত এ অসমতাকে পূরণ করে দেয়। ফলে বাজার গতিশীলতা পায়, উৎপাদিত পণ্য অধিকহারে হস্তান্তর হয় রাষ্ট্রব্যবস্থা যদি ইসলামী রাষ্ট্র হয়, তাহলে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হচ্ছে জনগণের কাছ থেকে যাকাত গ্রহণ ও বণ্টন করা। যদি সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায়, তাহলে যাকাত, উশর ও খারাজ থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতে আসা সম্ভব যে, ইসলামী রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনধারণের মৌলিক উপাদান (كفالة عامة) প্রদান করার জন্য রাষ্ট্রের আর কোনো ট্যাক্স আদায় করার প্রয়োজনই থাকবে না।

সামনে রামাদান মাস আসছে। যদিও আমাদের দেশে ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত নয়, তবুও আমরা ব্যক্তিগত অথবা সম্মিলিতভাবে যাকাত প্রদান করার মাধ্যমে আমাদের সমাজকে দারিদ্রমুক্ত করতে পারি। যাকাত এমন একটি ইবাদত, যার সরাসরি উপকারিতা আমরা পার্থিব জীবনে চোখের সামনে দেখতে পাই। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছার, প্রয়োজন শুধু সুব্যবস্থাপনার।

ফেইসবুকে আমরা...