1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মিরাজ
আহমদ হাসান চৌধুরী
  • ১ মার্চ, ২০২১

আল্লাহ তাআলা কুরআন কারীমে ইরশাদ করেন,

سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَىٰ بِعَبْدِهِ لَيْلًا مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الْأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا ۚ إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ الْبَصِيرُ

পবিত্রতা ও মহিমা সেই মহান সত্তার, যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছেন (মক্কার) মাসজিদুল হারাম থেকে (জেরুজালেমের) মাসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার আশপাশকে আমি বরকতময় করেছি তাকে আমার নিদর্শনসমূহ দেখানোর জন্য। নিশ্চয়ই তিনি সবকিছু শোনেন, সবকিছু দেখেন।
আল্লাহ তাআলা এ আয়াত শুরু করেছেন সুবহান (ﺳُﺒْﺤَﺎﻥَ) শব্দ দিয়ে। আমরা যখন আশ্চর্যান্বিত বা বিস্ময়কর কোনো ঘটনা শুনি বা দেখি তখন আমরা বলি ﺳُﺒْﺤَﺎﻥَ الله সুবহানাল্লাহ। আল্লাহ তাআলা এই শব্দ দ্বারা আয়াত শুরু করে এটাই বুঝাচ্ছেন যে আমি বিস্ময়কর এক ঘটনা বর্ণনা করছি।
ইসরা বলা হয় রাত্রিকালীন ভ্রমণকে। এর ব্যবহার কুরআন কারীমের অন্য জায়গায় এসেছে ,

ﻓَﺄَﺳْﺮِ ﺑِﻌِﺒَﺎﺩِﻱْ ﻟَﻴْﻠًﺎ ﺇِﻧَّﻜُﻢْ ﻣُﺘَّﺒَﻌُﻮْﻥَ

ইসরা শব্দের অর্থ রাত্রিকালীন ভ্রমণ। এরপরও আয়াতে ﻟَﻴْﻼً (রাত) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে রহস্যের ভিত্তিতে। প্রথম ﻟَﻴْﻼً বা রাত শব্দ নাকারাহ বা অনির্দিষ্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর আরবী ভাষায় অনির্দিষ্ট হিসেবে ব্যবহৃত শব্দ-শব্দপ্রয়োগের একাংশের অর্থ প্রকাশও করে থাকে, অর্থাৎ ﻟَﻴْﻼً লাইলান বা রাত শব্দটি উল্লেখ করে রাতের আংশিক সময়কে বুঝানো হয়েছে। অতএব মিরাজ সারা রাত্রব্যাপি হয়নি, বরং রাতের সংক্ষিপ্ত সময়ে মিরাজের মতো এক সুবিশাল ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। আর মসজিদে আকসা থেকে সিদরাতুল মুনতাহা তারপরে আল্লাহর আরশে গিয়ে মহান রবের সাথে সাক্ষাতকে মিরাজ বলে। মিরাজ সম্পর্কে সহীহ সনদে অনেক সাহাবী থেকে হাদীস বর্ণিত আছে।
মিরাজ স্বপ্নযোগে হয়েছিল বলে কেউ কেউ বলেছেন। কিন্তু জমহুর উলামায়ে কিরামের মত হলো মিরাজ স্বশরীরে হয়েছে। এর স্বপক্ষে অনেক সাহাবীর বর্ণনা আছে। যারা মিরাজকে স্বপ্নযোগে বলতে চান তারা দুজন সাহাবীর হাদীসকে প্রমাণ হিসাবে পেশ করেন। একজন আম্মাজান হযরত আয়িশা (রা.), অন্যজন হযরত মুআবিয়া (রা.)। মুহাদ্দিসীনে কিরাম এর জবাবে বলেছেন এ দুজন সাহাবীর হাদীস দিয়ে মিরাজ স্বপ্নযোগে প্রমাণ হয় না। কেননা, যখন মিরাজ সংঘটিত হয়েছে তখন আম্মাজান আয়শা সিদ্দীকা (রা.) অল্প বয়স্কা ছিলেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে তখনও তার শাদী মুবারক হয়নি। আর মুআবিয়া (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেছেন মক্কা বিজয়ের এক বছর পূর্বে। মিরাজের সময় তিনি মুসলমান ছিলেন না। তাই বহুসংখ্যক জলীলুল কদর সাহাবীর মুকাবিলায় তাদের হাদীস গ্রহণযোগ্য নয়।
জমহুর মুফাসসিরীনে কিরাম এর মত হলো মিরাজ স্বশরীরে হয়েছে। কেননা আল্লাহ তাআলা আয়াত শুরু করেছেন ﺳُﺒْﺤَﺎﻥَ (সুবহান) শব্দ দিয়ে। যা দ্বারা বিস্ময়কর ঘটনা বুঝায়। স্বপ্নযোগে মিরাজ অসম্ভব কিছু না। এটা বিস্ময়করও হতো না। তাছাড়া পরবর্তী শব্দ ﺑِﻌَﺒْﺪِﻩِ (আবদ) দ্বারা রূহ এবং দেহের সমন্বয়কে বুঝায়। এটা থেকেও বুঝা যায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বশরীরে মিরাজে গিয়েছিলেন।
প্রসঙ্গত আল্লাহ তাআলা তার হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে ﻋﺒﺪ (আবদ) বলেছেন। যার অর্থ বান্দাহ। এটা আমাদের নবীর জন্য অত্যন্ত সম্মানের যে আল্লাহ তাআলা তাঁকে বান্দাহ বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মালিক যখন তাঁর দাসকে দাস বলে স্বীকার করে তখন দাসের জন্য সেটা পরম সৌভাগ্য। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল আপনি বান্দাহ নবী হতে চান নাকি বাদশাহ নবী? রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আমি বান্দাহ নবী হতে চাই।
অনেকে যুক্তি বা বিজ্ঞান দিয়ে মিরাজ প্রমাণ করতে চান। এটা ঠিক নয়। কারণ মুজিযাকে যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করার অবকাশ নেই। মুজিযা অর্থই তো অক্ষম করে দেওয়া। যুক্তিতে ধরুক বা না ধরুক মুজিযা বিশ্বাস করতে হবে। তবে এটা ঠিক যে, বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার কারণে বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর বিশ্বাস করতে মানুষের জন্য সুবিধা হয়েছে। যেমন রকেট, বিমান, ফোন ইত্যাদি আবিষ্কারের ফলে সময়, দূরত্ব, গতির ব্যাপারে মানুষ পূর্বের ধারণা থেকে সহজেই বেরিয়ে আসতে পারছে।
মিরাজের রাতের সংক্ষিপ্ত ঘটনা হলো- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানীর ঘরে ছিলেন, কোনো বর্ণনা মতে শিআবে আবী তালিবে ছিলেন, কোনো বর্ণনা মতে হাতীমে ছিলেন, আবার কোনো বর্ণনা মতে মসজিদে হারামে ছিলেন। বর্ণনাগুলোর সামঞ্জস্য এভাবে করা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মে হানীর ঘরে ছিলেন, ঘরটি ছিল শিআবে আবী তালিবে অবস্থিত, যা হাতীমের নিকটবর্তী। সেখান থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে শক্কে সদর করার জন্যে মসজিদে হারামে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেখান থেকে বুরাকে আরোহন করানো হয়। বুরাক সম্পর্কে হাদীসে সংক্ষিপ্ত বিবরণে বলা হয়েছে এটি খচ্চর থেকে ছোট আর গাধা থেকে বড়। এটি একটি জান্নাতী প্রাণী। বলা হয়েছে তার দু’পায়ের দুরত্ব দৃষ্টিসীমা পর্যন্ত। অনেকে বুরাকের কাল্পনিক ছবি এঁকেছে। এটা সম্পূর্ণ ভূয়া। আবার আমাদের মধ্যে অনেকে বরকত মনে করে এই কাল্পনিক বোরাকের ছবি ঘরের দেয়ালে রাখেন। অথচ হাদীস হলো-

ﻻ ﺗﺪﺧﻞ ﺍﻟﻤﻼﺋﻜﺔ ﺑﻴﺘﺎً ﻓﻴﻪ ﺗﺼﺎﻭﻳﺮ

-এমন ঘরে রহমতের ফিরিশতা প্রবেশ করেন না যে ঘরে কোনো প্রাণীর ছবি থাকে।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বোরাকের উপর আরোহণ করতে ইচ্ছা করলেন তখন সে একটু নড়া-চড়া করতে লাগলো। হযরত জিবরাইল (আ.) তাকে সম্বোধন করে বললেন, তোমার কি হলো? আল্লাহ পাকের নিকট প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর চেয়ে অধিকতর কোনো সম্মানী ব্যক্তি তোমার উপর আরোহণ করেনি। এ কথাটি শ্রবণ করা মাত্র সে শান্ত হয়ে গেল।
হাদীস শরীফে এসেছে, শাদ্দাদ বিন দাউস কর্তৃক বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, পথিমধ্যে এমন এক প্রান্তর অতিক্রম করলাম যেখানে অসংখ্য খেজুর বৃক্ষরাজি দৃষ্টিগোচর হল। জিবরাইল (আ.) বললেন, এখানে অবতরণপূর্বক দুরাকআত নামায আদায় করুন। আমি অবতরণ করে নামায পড়লাম। জিবরাইল (আ.) বললেন, জানেন কি আপনি কোন স্থানে নামায পড়লেন? আমি বললাম, না, তা আমার জানা নেই। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি ইয়াসরিব অর্থাৎ পবিত্র মদীনায় নামায পড়লেন, যেখানে আপনি হিজরত করবেন। অতঃপর পুনরায় যাত্রা শুরু হলো। অপর এক স্থানে এসে জিবরাইল (আ.) আবার অবতরণপূর্বক নামায আদায় করতে বললেন। আমি নেমে নামায আদায় করলাম। জিবরাইল বললেন, এ জায়গার নাম সীনা উপত্যকা। এখানে ছিল একটি বৃক্ষ। এর নিকটে মূসা (আ.) আল্লাহর সাথে কথা বলেছিলেন। আপনি সেই বৃক্ষের কাছেই নামায পড়লেন। আবার আরেকটি প্রান্তর অতিক্রম কালে জিবরাইল (আ.) তথায় নামায পড়তে বললে আমি নেমে নামায পড়লাম। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি মাদায়েনে নামায পড়লেন। এখানে নবী শোয়ায়েব (আ.) এর বাসস্থান ছিল। আবার যাত্রা শুরু হলো। আরেক স্থানে পৌঁছে জিবরাইল (আ.) পুনরায় নামায পড়তে বললেন। আমি নামায পড়লাম। জিবরাইল (আ.) বললেন, এটা বায়তুল লাহাম, যেখানে ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছেন। (ইবনে আবূ হাতিম, বায়হাকী, বাযযার এবং তাবরানী শাদ্দাদ বিন আউস থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন।)
এই হাদীস থেকে আমরা দলীল পাই যে নেককারগণ যে স্থানে জন্মগ্রহণ করেন, ইন্তিকাল করেন, বসবাস করেন সেটা বরকতপূর্ণ। কুরআন শরীফেও এর দলীল আছে। ইসরার আয়াতের শেষাংশ হলো ﺍﻟَّﺬِﻱ ﺑَﺎﺭَﻛْﻨَﺎ ﺣَﻮْﻟَﻪُ (যার আশপাশকে আমি বরকতময় করেছি) মুফাসসিরগণ বলেছেন বায়তুল মুকাদ্দাসের চারপাশ বরকতের কারণ হলো এখানে আম্বিয়ায়ে কিরাম এবং নেককারদের আবাসস্থল ছিল।
হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বুরাক পৃষ্ঠে আরোহী হয়ে চলছিলেন। পথিমধ্যে এক বৃদ্ধ তাঁকে ডাকলো। জিবরাইল (আ.) বললেন, সামনে চলুন। এদিকে লক্ষ্য করার প্রয়োজন নেই। কিছুটা অগ্রসর হবার পর আরেক বৃদ্ধ তাঁকে ডাক দিলে জিবরাইল (আ.) বললেন, সামনে চলুন। আরো কিছুটা পথ অতিক্রান্ত হলে একটি জামাত হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম জানালেন।

ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴﻚ ﻳﺎ ﺍﻭﻝ، ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴﻚ ﻳﺎ ﺍﺧﺮ، ﺍﻟﺴﻼﻡ ﻋﻠﻴﻚ ﻳﺎ ﺣﺎﺷﺮ .
আসসালামু আলাইকা ইয়া আউয়াল।
আসসালামু আলাইকা ইয়া আখির।
আসসালামু আলাইকা ইয়া হাশির।

জিবরাইল (আ.) তাদের সালামের উত্তর দিতে বললেন। অতঃপর জানালেন, প্রথম বৃদ্ধা হলো দুনিয়া। দ্বিতীয় বৃদ্ধটি হলো শয়তান। উভয়ের উদ্দেশ্য পার্থিবতার দিকে আকর্ষণ করানো। যদি আপনি তাদের ডাকে সাড়া দিতেন তাহলে আপনার উম্মত আখিরাতের উপর দুনিয়াকে প্রাধান্য দিত। আর যারা আপনাকে সালাম জানিয়েছে তারা হলেন ইবরাহীম (আ.), মূসা (আ.) এবং ঈসা (আ.)। ইবনে জারীর এবং বায়হাকী এই হাদীসখানা আনাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণনা করেছেন।
মুসলিম শরীফে আনাস (রা.) কর্তৃক বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মিরাজের রজনীতে মূসা (আ.) এর নিকট দিয়ে অতিক্রম করার সময় তাকে কবরের উপর দাঁড়িয়ে নামায পড়তে দেখেছি।
বায়হাকী শরীফে বর্ণিত আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, আমি এবং জিবরাইল (আ.) বায়তুল মুকাদ্দাস প্রবেশ করি। আমরা দুই রাকাআত নামায আদায় করি। সেখানে অনেক লোকের সমাগম হলো। একজন মুআযযিন আযান দিলেন, ইকামতও দেওয়া হলো। আমরা সকলে কাতারবন্দী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কে ইমাম হবেন। এমন সময় জিবরাইল (আ.) আমার হাত ধরে আমাকে সামনে এগিয়ে দিলেন, আমি সকলের ইমামতী করলাম। নামায শেষে জিবরাইল (আ.) আমাকে বললেন আপনি কি জানেন আপনার পিছনে কারা নামায আদায় করেছেন? আমি বললাম না। তিনি বললেন পৃথিবীতে যত নবী-রাসূল প্রেরিত হয়েছেন সকলেই আপনার পিছনে নামায আদায় করেছেন।
নামায শেষে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বাইরে তাশরীফ আনলেন তখন জিবরাইল তাঁর সম্মুখে দুটি পাত্র রাখলেন। একটিতে ছিল দুধ আরেকটিতে ছিল শরাব। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুধ বেছে নিলেন। জিবরাইল (আ.) বললেন, আপনি স্বভাব ধর্মকে পছন্দ করেছেন।
বায়তুল মুকাদ্দাস থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিবরীল আমীনকে নিয়ে আকাশের দিকে রওয়ানা দিলেন। প্রথম আসমানে যাওয়ার পর দ্বাররক্ষী জিজ্ঞেস করলেন কে? জিবরীল (আ.) উত্তর দিলেন আমি জিবরীল। আবার জিজ্ঞেস করা হলো আপনার সাথে কে? জিবরাইল (আ.) বললেন মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। জানতে চাওয়া হলো তাঁকে আনার জন্যেই কি আপনি আদিষ্ট হয়েছেন? জিবরীল (আ.) বললেন হ্যা! আমাকে তাঁর কাছেই পাঠানো হয়েছে। দ্বার খুলে দেওয়া হলো। প্রথম আসমানে প্রবেশ করে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আদম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত করলেন। আদম (আ.) তাকে স্বাগত জানালেন ﻣَﺮﺣَﺒﺎً ﺑﺎﻻﺑﻦِ ﺍﻟﺼﺎﻟﺢ ﻭﺍﻟﻨﺒﻲِّ ﺍﻟﺼﺎﻟﺢ হে সুসন্তান, হে সৎ নবী! আপনাকে স্বাগতম। অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দ্বিতীয় আসমানে হযরত ঈসা (আ.) এবং হযরত ইয়াহইয়া (আ.) এর সাথে সাক্ষাত করেন। তৃতীয় আসমানে হযরত ইউসূফ (আ.) এর সাথে সাক্ষাত করেন। চতুর্থ আসমানে হযরত ইদরীস (আ.), পঞ্চম আসমানে হযরত হারূন (আ.), ষষ্ট আসমানে হযরত মূসা (আ.) এবং সপ্তম আসমানে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর সাথে সাক্ষাত করেন।
ইবরাহীম (আ.) প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলেন আপনি আপনার উম্মতকে আমার সালাম দিবেন, আর বলবেন জান্নাতের পানি এবং ফল খুবই মিষ্টি, এর মাঠ ফাঁকা। এই ফাঁকা মাঠের চারা হলো-

ﺳُﺒْﺤَﺎﻥَ اللهِ ﻭَﺍﻟْﺤَﻤْﺪُ لِلّٰهِ ﻭَﻻَ ﺍِﻟٰﻪ ﺍِﻻَّ اللهُ ﻭَاللهُ ﺍَﻛْﺒَﺮُ

‘সুবহানাল্লাহি ওয়ালহামদু লিল্লাহি ওয়া লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার।’
আমাদের পিতা হযরত ইবরাহীম (আ.) এর শিখানো এই আমল আমাদের করা উচিত। সালাতুত তাসবীহ আদায়ের মাধ্যমে এই দুআ বেশি বেশি পাঠের সুযোগ হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে জাহান্নামের শাস্তি দেখানো হলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন কতক লোক দেখলেন যাদের নাসিকা তামার তৈরি, তারা নিজেদের নখ দ্বারা স্বীয় বক্ষ ও অবয়ব খামচাচ্ছিল। তিনি এর হেতু জানতে চাইলে জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা মানুষের গোশত ভক্ষণ করত অর্থাৎ গীবত এবং অপরের দোষ-ত্রুটির অনুসন্ধান করত। ইমাম আহমদ এবং ইমাম আবূ দাঊদ হাদীসখানা আনাস (রা.) এর সূত্রে বর্ণনা করেন।
আরেক সম্প্রদায়ের লোকদের অতিক্রমকালে দেখা গেল প্রস্তরাঘাতে তাদের মাথা চূর্ণ করা হচ্ছে। অত:পর তাদের মাথা আগের মতো হয়ে যাচ্ছে। এই দৃশ্য নিরন্তর চালু ছিল। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, ফরয নামাযের ক্ষেত্রে এরা গড়িমসি করত।
অতঃপর আরো কিছু লোক দেখা গেল, তাদের সম্মুখে এক পাত্রে রান্না করা গোশত এবং অপর পাত্রে কাঁচা ও পচা গোশত রক্ষিত ছিল। তারা রান্নাকৃত গোশতের পরিবর্তে কাঁচা ও পচা গোশত ভক্ষণ করছিল। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জানতে চাইলেন তারা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা আপনার উম্মতের মধ্যে ঐ সকল পুরুষ যারা বৈধ ও সতী স্বীয় পতœী রেখে অপর নারীর সাথে রাত্রি যাপন করত। আর এদের মধ্যে যারা মহিলা তারা আপনার উম্মতের ঐ সকল রমণী যারা পবিত্র স্বামীকে ছেড়ে ব্যভিচারী পুরুষের সাথে রাত কাটাত।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরপর দেখলেন, কিছু লোকের জিহ্বা ও ঠোঁট কাঁচি দ্বারা কাটা হচ্ছিল। কাটা শেষ হলে আবার তা আগের মতো হয়ে যায়। পুনরায় কাটা হয়। এভাবে এ কাজ অব্যাহত ছিল। হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের পরিচয় জানতে চাইলেন। জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা ঐ সব বক্তা যারা অপরকে আমল করতে বলত অথচ নিজেরা আমল করত না। (খাসায়েসুল কুবরা)
এরপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদরাতুল মুনতাহায় গেলেন। জিবরাইল (আ.) সিদরাতুল মুনতাহায় থেমে গেলেন। সেখান থেকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একা একা ঊর্ধ্বলোক সফর করেন। যখন তিনি আল্লাহর জালালিয়াতের সামনে উপস্থিত তখন পড়লেন, ﺍﻟﺘَّﺤِﻴَّﺎﺕُ ﻟِﻠَّٰﻪِ ﻭَﺍﻟﺼَّﻠَﻮَﺍﺕُ ﻭَﺍﻟﻄَّﻴِّﺒَﺎﺕُ
“আত্তাহিয়্যাতু লিল্লাহি ওয়াসসালাওয়াতু ওয়াত ত্বাইয়িবাত”।
আল্লাহ তাআলা তার নবীকে সালাম দিলেন,

ﺍﻟﺴَّﻼﻡُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﺃَﻳُّﻬَﺎ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲُّ ﻭَﺭَﺣْﻤَﺔُ اللهِ ﻭَﺑَﺮَﻛَﺎﺗُﻪُ

“আসসালামু আলাইকা আইয়ুহান নাবিয়্যু ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ”।
আমাদের জন্য সে সালামকে ওয়াজিব করে দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি নামাযে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে সালাম না দেই তাহলে আমাদের নামায সহীহ হবে না।
আল্লাহ পাকের সালাম রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধুমাত্র নিজের জন্য নিতে পারতেন কিন্তু মহান আল্লাহর সালামের সৌভাগ্যে তার নেককার উম্মতকে শামিল করলেন। তাই তিনি বললেন,

ﺍﻟﺴَّﻼﻡُ ﻋَﻠَﻴْﻨَﺎ ﻭَﻋَﻠَﻰ ﻋِﺒَﺎﺩِ اللهِ ﺍﻟﺼَّﺎﻟِﺤِﻴﻦ

“আসসালামু আলাইনা ওয়া আলা ইবাদিল্লাহিস সালিহীন”।
তাঁদের সেই কথোপকথন শুনে আকাশবাসী ফিরিশতারা বলে উঠলেন,

ﺃَﺷْﻬَﺪُ ﺃَﻥْ ﻻ ﺇِﻟٰﻪَ ﺇِﻻ اللهُ ﻭَﺃَﺷْﻬَﺪُ ﺃَﻥَّ ﻣُﺤَﻤَّﺪًﺍ ﻋَﺒْﺪُﻩُ ﻭَﺭَﺳُﻮﻟُﻪُ

“আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়া আশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আবদুহূ ওয়া রাসূলুহ”।
এ বর্ণনা তাফসীরে কুরতুবী এর মধ্যে রয়েছে।
মিরাজ রজনীতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলাকে দেখেছেন কি না এ সম্পর্কে ইখতিলাফ আছে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদা হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলাকে দেখেছেন। সূরা নাজমে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

ﺛُﻢَّ ﺩَﻧَﺎ ﻓَﺘَﺪَﻟَّﻰ ﻓَﻜَﺎﻥَ ﻗَﺎﺏَ ﻗَﻮْﺳَﻴْﻦِ ﺃَﻭْ ﺃَﺩْﻧَﻰ (সুম্মা দানা ফাতাদাল্লা)

এই আয়াতের তাফসীরে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রা.) বলেন, ﻗﺪ ﺭﺁﻩ ﺍﻟﻨَّﺒِﻲّ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ তাআলাকে দেখেছেন। (শিফা)
তিনি আরো বলেন,

ﺃﺗﻌﺠﺒﻮﻥ ﺃﻥ ﺗﻜﻮﻥ ﺍﻟﺨﻠﺔ ﻹﺑﺮﺍﻫﻴﻢ، ﻭﺍﻟﻜﻼﻡ ﻟﻤﻮﺳﻰ، ﻭﺍﻟﺮﺅﻳﺔ ﻟﻤﺤﻤﺪ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ

“(মহান আল্লাহর সাথে) ইবরাহীম (আ.) এর বন্ধুত্ব, মূসা (আ.) এর কথা বলা এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর দীদার হওয়াতে তোমরা কি আশ্চর্যবোধ করো?”
মিরাজ রাতে আল্লাহ তাআলা উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য উপহার হিসাবে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ফরয করে দিলেন। প্রথমে ৫০ ওয়াক্ত ছিল। তারপরে হযরত মূসা (আ.) এর অনুরোধে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায কমানোর আবেদন করেন। এভাবে বার বার আল্লাহর দরবারে গিয়ে অবশেষে ৫ ওয়াক্ত নির্দিষ্ট হয়। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিলেন যারা এই ৫ ওয়াক্ত নামায আদায় করবে তাদেরকে ৫০ ওয়াক্ত নামাযের সাওয়াব দেওয়া হবে।
সকল নবীর মিরাজ হয়েছে যমীনে, আমাদের নবীর মিরাজ হয়েছে আরশে মুয়াল্লায়। এর কারণ হিসেবে কোনো কোনো কিতাবে বলা হয় আকাশবাসী মহান আল্লাহর কাছে তার প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ফায়য ও বারকাত লাভের আবেদন করে। আল্লাহ তাআলা তাদের আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মিরাজে নেন।
তাছাড়া আরেকটি কারণ হতে পারে আমরা জান্নাত-জাহান্নাম, আখিরাত ইত্যাদির সাক্ষী দেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথার ভিত্তিতে। তিনি বলেছেন এগুলো সত্য তাই আমরা বিশ্বাস করি। কেউ যদি প্রশ্ন করে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি এগুলো স্বচক্ষে দেখেছেন? কেউ যেন এই প্রশ্নের সুযোগ না পায় সেজন্য আল্লাহ তাআলা তার হাবীবকে স্বশরীরে মিরাজে নিয়ে দেখিয়ে এনেছেন। আর প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সত্যবাদিতার ব্যাপারে কাফিররাও নিঃসন্দেহ ছিল। নবুওয়াত পূর্ব যুগেই তারা তাকে আল-আমীন উপাধিতে ভূষিত করেছে।
মিরাজ থেকে ফিরে এসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মিরাজের কথা বর্ণনা করলেন তখন কাফিররা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করলো, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলো। কেননা তারা জানত মক্কা থেকে বায়তুল মুকাদ্দাস যেতে হলে একমাস লাগে। সেখানে তিনি রাতের সামান্যতম সময়ে গিয়ে আবার ফিরে আসলেন। এটা অসম্ভব। তারা আবূ বকর (রা.) কে রাস্তায় পেয়ে বলল তোমার নবী এরকম বলেছেন। আবূ বকর (রা.) এটা শুনে বললেন আল্লাহর কসম! যদি তিনি এ কথা বলে থাকেন তাহলে আমি অবশ্যই বিশ্বাস করব। এদিন থেকে আবূ বকর (রা.) সিদ্দীক উপাধি লাভ করলেন। কাফিররা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা প্রমাণের জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে এসে প্রশ্ন করলো, আপনি তো বায়তুল মুকাদ্দাস গেছেন, তাহলে বায়তুল মুকাদ্দাসের বিবরণ আমাদেরকে দিন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন আমি এই দিন সবচেয়ে বেশি পেরেশান হয়েছি। তারপর বলেন,

ﻓﺠﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻟﻲ ﺑﻴﺖ ﺍﻟﻤﻘﺪﺱ ﻓﻄﻔﻘﺖ ﺃﺧﺒﺮﻫﻢ ﻋﻦ ﺁﻳﺎﺗﻪ ﻭﺃﻧﺎ ﺃﻧﻈﺮ ﺇﻟﻴﻪ

-আল্লাহ তাআলা আমার জন্য বায়তুল মুকাদ্দাসকে তুলে ধরালেন। আমি বায়তুল মুকাদ্দাস দেখে দেখে তার বিবরণ দিয়েছি।
তারপর তারা আরো প্রমাণ চাইলো। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তোমাদের এক কাফেলা বাণিজ্যে গেছে। আমি তাদেরকে রাস্তায় দেখেছি তারা তাদের উট হারিয়ে ফেলেছে। পরবর্তীতে তা খুঁজে পেয়েছে। তারা তিন দিন পর মক্কায় আসবে।
এখানে বিক্ষিপ্তভাবে মিরাজের রাতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কিছু আলোকপাত করা হলো। এ বিষয়ে যারা বিস্তারিত জানতে চান তারা ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূতী (র.) এর খাসায়িসুল কুবরা, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) এর মুনতাখাবুস সিয়ার দেখতে পারেন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ফেইসবুকে আমরা...