শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ স্বাস্থ্য সংকট শুরু হওয়ার সাত মাস পর করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দৌঁড় এখনো চলমান। বিশ্বের ৭০০ কোটি মানুষ একটা সফল টিকার জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুণছে। বর্তমানে বিশ্বে ১৭৬টি টিকা আবিষ্কারের কাজ চলছে। তার মধ্যে মানব পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে ৩৪টি, ৮টি আছে পরীক্ষার তৃতীয় পর্যায়ে। এ আয়োজনে থাকছে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে এগিয়ে থাকা কোম্পানি ও টিকা নিয়ে চিকিৎসাবিষয়ক আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিন নির্ভর আলোচনা।
জার্মানির ভ্যাকসিন: বিএনটি-১৬২
করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কারে প্রথম আশার কথা শোনাল জার্মানি। সুখবরটি এলো ড. উগার শাহিন ও ওজলেম তুরেসি মুসলিম দম্পতির হাত ধরে। তাদের প্রতিষ্ঠিত জার্মান কোম্পানি বায়োনটেক জানিয়েছে ভ্যাকসিনটি নিরাপদ। আমেরিকার ফাইজার কোম্পানির অর্থায়নে তৈরি ভ্যাকসিনটি মানবদেহে প্রয়োগেই সফল ফলাফল দিতে শুরু করছে। যা ইমিউনিটি তৈরি ও রক্তে শ্বেতকণিকা তৈরিতে সহায়তা করে, করোনার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ৯০ শতাংশ কার্যকর। ভ্যাকসিনটির নাম দেওয়া হয়েছে বিএনটি-১৬২। তবে ভ্যাকসিনটি বাজারে পাওয়ার জন্য আরো মাস ছয়েক অপেক্ষা করতে হবে।
রাশিয়ার ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক-৫’
ভ্যাকসিন দৌঁড়ে বিশ্বকে সুখবর দিল রাশিয়া। মানব শরীরে এর সফল প্রয়োগে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন রুশ বিজ্ঞানীরা। ভ্যাকসিনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘স্পুটনিক-৫’। রাশিয়ার দাবি, ‘স্পুটনিক-৫’ টিকা প্রয়োগের পর রোগীর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি তৈরি করতে সফল হয়েছে। চিকিৎসাবিষয়ক সাময়িকী দ্যা ল্যান্সেট একটি প্রতিবেদনে তা সমর্থন করে বলছে, স্পুটনিক-৫ প্রয়োগের পরীক্ষায়, শরীরে করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করার মতো অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে এবং বড় কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। রুশ সরকার বলছে, বিশ্বের অন্তত ৫০টি দেশ ইতোমধ্যে ১২০০ মিলিয়ন ডোজ ভ্যাকসিন চেয়ে রেখেছে। জানুয়ারিতে গণহারে ভ্যাকসিন দেওয়ার কথা রয়েছে।
চীনা ভ্যাকসিন
ভ্যাকসিন দৌঁড়ে এগিয়ে থাকা ১০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটিই চীনের। দেশটির ক্যানসিনো বায়োলজিকস ইনকরপোরেশন ও সেনাবাহিনীর গবেষণা ইউনিটের যৌথ উদ্যোগে তৈরি ভ্যাকসিনটি বেশ সম্ভাবনাময় বলে দাবি করা হয়েছে। বর্তমানে বাজারজাতকরণের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে এটি। চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত ওষুধ প্রস্তুতকারক সাইনোফার্মের গবেষণাধীন প্রতিষেধক জানুয়ারির শুরুতেই বাজারে পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যম। এ ছাড়াও চীনের জাতীয় জৈব-প্রযুক্তি গ্রুপ-সিত্রনবিজির অঙ্গ প্রতিষ্ঠান বেইজিং ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল প্রোডাক্টস এবং উহান ইনস্টিটিউট অব বায়োলজিক্যাল নতুন করোনা ভাইরাস প্রতিষেধক যৌথভাবে প্রস্তুত করছে; সেটিও তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে আছে।
অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিন
রাশিয়া প্রথম ভ্যাকসিন আবিষ্কারের ঘোষণা দিলেও বিশ্ববাসী তাকিয়ে অক্সফোর্ডের ভ্যাকসিনের দিকে। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের দিক থেকেই নয়, ফলাফলেও ব্যতিক্রমী এই ভ্যাকসিন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ সুইডিশ ওষুধ প্রস্তুতকারক জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা যৌথভাবে এটা তৈরি করেছে। ভ্যাকসিনটির নাম ঈযঅফঙী১হ ঈড়া-১৯। প্রতিষেধকটির শেষ পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করার পর মানব শরীরে কোভিড-১৯ প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে, এমনটাই দাবি গবেষণার প্রধান সারা গিলবার্টের। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে জানুয়ারির শেষে বাজারে আসতে পারে এই ভ্যাকসিন।
বণ্টনের নেতৃত্বে থাকবে ইউনিসেফ
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে অন্তত ১০টি ভ্যাকসিন মানবদেহে প্রয়োগ করার কাজ চলছে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী খুব শীঘ্রই করোনার ভ্যাকসিন বাজারজাতকরণ করা হবে। দরিদ্র দেশের মানুষের টিকার চাহিদা মেটানোর জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, দ্যা গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিন্স অ্যা- ইমুনাইজেশন (গ্যাভি) ও কোয়ালিশন ফল এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস ইনোভেশন্স (সিইপিআই) যৌথভাবে একটি উদ্যোগ গড়ে তুলছে। এর নাম- কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন গ্লোবাল অ্যাকসেস বা কোভ্যাক্স। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে টিকা কিনে মজুদ গড়ে তুলবে কোভ্যাক্স। কোভ্যাক্সের টিকা যৌক্তিকভাবে বিশ্বব্যাপী বণ্টনে নেতৃত্ব দিবে ইউনিসেফ।
আমাদের প্রত্যাশা
সাধারণত সংক্রামক রোগের টিকা উদ্ভাবন, পরীক্ষা ও উৎপাদনের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। গবেষণা ও উৎপাদন থেকে কার্যকর টিকা মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে সচরাচর সময় লাগে ৫ থেকে ১০ বছর। কিন্তু করোনার ক্ষেত্রে সেটা করা হচ্ছে কয়েক মাসের মধ্যে। তারপরেও উদ্ভাবিত টিকা সবসময় যে সফল হয়, তাও নয়। এ পর্যন্ত মাত্র একটি সংক্রামক রোগের টিকা সফল হয়েছে। সেটি হলো গুটিবসন্ত; যেটি সম্পূর্ণ নির্মূল করা গেছে। কিন্তু তাতেও সময় লেগেছে ২০০ বছর। যক্ষ্মা, পোলিও, টিটেনাস, হাম মাম্পস- এখনও মানুষের সঙ্গ ছাড়েনি। যদিও এসব রোগের টিকা আছে এবং টিকার কল্যাণে অন্তত এসব রোগের মহামারি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে। তাই করোনাও আমাদেরকে পুরোপুরি ছাড়বে কি না বলা যাচ্ছে না। সময় সময় রূপ বদলানোয় বিজ্ঞানীদেরকে নাজেহাল করে ছাড়ছে। তাই করোনার টিকায় শেষ বলতে কিছু নেই, আবার পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে সফল টিকার কথা বলা যাচ্ছে না। তবে টিকা আবিষ্কারে মহামারি ঠেকানো সম্ভব হবে -এ আমাদের বিশ্বাস।