বিজাতীয় অপসংস্কৃতির সয়লাবে যখন আমাদের ছাত্র ও তরুণ সমাজ বিপথগামী হচ্ছিল, নাস্তিক, মুরতাদদের অপতৎপরতায় যখন সমাজ কলুষিত হচ্ছিল, ইসলামের নামে বাতিল আকীদার সাংগঠনিক কার্যক্রম যখন কোমলমতি ছাত্রসমাজকে বিভ্রান্ত করছিল, সর্বোপরি লেজুড়ভিত্তিক ছাত্র রাজনীতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার বদলে যখন অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছিল এমনি একটি ক্রান্তিকালে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ওলীয়ে কামিল শামসুল উলামা হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (র.) ১৯৮০ সালে তাঁর বহুমুখী দ্বীনী খিদমাতের অংশ হিসেবে দাওয়াতী সফরে ইউরোপ যাওয়ার প্রাক্কালে একঝাঁক মেধাবী তরুণ ১২৩ মনেশ্বর রোড, জিগাতলা, ঢাকায় তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন। দেশ ও জাতির এ ক্রান্তিকালে জাতির ভবিষ্যত কর্ণধার ছাত্রসমাজকে তাদের করণীয় ও বর্জণীয় সম্পর্কে দীর্ঘ নির্দেশনা প্রদান করেন এবং আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলীর সাথে পরামর্শক্রমে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদাভিত্তিক একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার নির্দেশ প্রদান করেন। পরবর্তীতে আল্লামা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী ফুলতলীর নির্দেশে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র নেতৃবৃন্দের এক সভা ১৯৮০ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি ইছামতি আলিয়া মাদরাসায় শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী (র.) এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান অতিথি আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী’র দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য ও পরামর্শের ভিত্তিতে মাওলানা নূরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ‘বাংলাদেশ সুন্নী ছাত্র পরিষদ’ নামে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৫ সদস্য বিশিষ্ট এ আহ্বায়ক কমিটির ফান্ড গঠনের জন্য হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ছাহেব তাঁর লিখিত প্রাথমিক তাজবীদের ২০০ কপি দান করেন।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের আকীদানুযায়ী আল্লাহ প্রদত্ত রাসূল সা. প্রদর্শিত পথে ছাত্রসমাজের জীবন গঠন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রেখে লেখাপড়াকে সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করা। আত্মিক, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে যেমন কাজ করতে হবে, তেমনিভাবে ইসলামের নামে বাতিল আকীদাপন্থী সংগঠনকে পরিহার করে খিলাফত আলা মিহাজিন নুবুওয়াত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যার যার অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে। কোনো অবস্থাতে লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে ছাত্রসমাজের ভবিষ্যত বিনষ্ট করা যাবে না। ঈমান, আমল ও আখলাকে হাসানার প্রতি যেমন গুরুত্বারোপ করতে হবে তেমনি খিদমাতে খালকের প্রতি থাকতে হবে নিরলস প্রচেষ্টা। এ সমস্ত কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দিয়ে প্রথম বছরেই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন ও সাংগঠনিক কার্যক্রম দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায়। পরের বছর একই নামে বাংলাদেশের অন্য এলাকায় আরেকটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠার সংবাদে সিলেটের সবুজ বিপণীতে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও উপদেষ্টামণ্ডলির যৌথ সভায় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়া। মাওলানা ইসহাক আহমদকে সভাপতি ও মাওলানা আব্দুল জব্বারকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কমিটি গঠন করে নূতন উদ্যোমে কাজ শুরু হয়।
নতুন নামে নতুন প্রেরণায় স্বল্প দিনে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উপজেলা, জেলা ও মহানগর কমিটি গঠন করে সুস্থ ধারার ছাত্র সংগঠন পরিচালনা ও স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরিয়ে আনার আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে বাংলাদেশের হক্কানী উলামায়ে কিরাম ও পীর-মাশায়িখ, যাদের সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতায় তালামীযের কাজ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যায়, শ্রদ্ধাভরে তাদের নাম স্মরণ করছি।
প্রধান উপদেষ্টা- আল্লামা ছাহেব কিবলাহ ফুলতলী (র.)
উপদেষ্টাম-লি
আল্লামা নিজামুদ্দীন চৌধুরী, পীর ছাহেব বিশকুটি
আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী
শায়খুল হাদীস আল্লামা হবিবুর রহমান ছাহেব, রারাই
আল্লামা ইসহাক আহমদ শায়দা, বিশ্বনাথ
আল্লামা ফরীদুদ্দীন আত্তার, ঢাকা
আল্লামা রূহুল আমীন খান, ঢাকা
শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল জব্বার গোটারগ্রামী
আল্লামা আব্দুর রহমান ছাহেব, বর্ণী
আল্লামা জালাল সিদ্দিকী
আল্লামা আব্দুল খালিক, বুরাইয়া
আল্লামা আব্দুল কাইয়ুম সিদ্দিকী, মৌলভীবাজার
মাওলানা মুহিবুর রহমান (সাবেক অধ্যক্ষ হবিবপুর)
মাওলানা মহিউদ্দিন (সাবেক অধ্যক্ষ ভানুগাছ)
হাফিয নোমান আহমদ চৌধুরী, ইমামবাড়ি
আরো অনেকেই যাদের নাম এ মুহূর্তে স্মরণ হচ্ছে না। উপদেষ্টা ও ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা ইতিমধ্যে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন রাব্বুল আলামীন তাঁদের জান্নাতের উচ্চ মাকাম নসীব করুন এবং যারা জীবিত আছেন আল্লাহ তাদেরকে নেক হায়াত দান করুন। আমীন।
দেশ ও জাতির ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার ভূমিকা ও যুগান্তকারী খিদমাতসমূহ সচেতন নাগরিক হিসেবে কারো অজানা নয়। কুখ্যাত দাউদ হায়দার, সালমান রুশদী, তাসলিমা নাসরীনসহ নাস্তিক মুরতাদরা যখনই মহানবী সা. এবং ইসলাম সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করেছে তখনই তালামীযে ইসলামিয়া আন্দোলনের মাধ্যমে মাঠে ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে তা অনন্য। বিশেষ করে ভারতের অযোধ্যায় বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে এবং মাদরাসা শিক্ষা সংকোচনের বিরুদ্ধে মুসলিম জাতিকে এক কাতারে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিল। হযরত শাহজালাল মুজাররদে ইয়ামনী (র.) এর মাযারসহ ৬৪ জেলায় একসাথে বোমা হামলার প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিল সিলেট বিভাগ। ২০০১ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের নামকরণে সর্বদলীয় ছাত্র আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে ভূমিকা রেখেছে এ ছাত্র সংগঠনটি। এ আন্দোলনে কতিপয় তালামীয নেতৃবৃন্দ গুলিবিদ্ধ হন। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার আমাদের দাবি মানতে বাধ্য হন। ইরাকে মার্কিন হামলার প্রতিবাদে ঢাকার রাজপথে এবং সিলেটে তালামীযের বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সভা ছিল সমকালীন সময়ের বৃহৎ আন্দোলন, যা বাংলাদেশ ছাড়াও বহির্বিশ্বের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় প্রচার করা হয়।
১৯৮৯ সালে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউটে বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার আহ্বানে বাংলাদেশের সকল তরীকার পীর মাশায়িখ, আলিম-উলামা, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে এ কথা প্রমাণিত হয়েছে যে, আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহর নির্দেশে তালামীযই পারে দেশের সকল অঞ্চলের পীর-মাশায়িখ ও আলিম উলামাকে এক কাতারে নিয়ে আসতে। তখন কয়েকদিন টক অব দ্যা কান্ট্রি ছিল যে, দেশের এত পীর-মাশায়িখ একসাথে ইতিপূর্বে দেখার সুযোগ হয়নি। যদিও এ সমাবেশের পূর্বে হোম ওয়ার্কে অনেক সময় লেগেছিল। তখন থেকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে অগ্রণী ভূমিকা রেখে সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে তালামীযে ইসলামিয়া। বিশেষ করে সিডর, আইলা আক্রান্ত এলাকা ও রোহিঙ্গা পূনর্বাসনে শুধুমাত্র অন্ন, বস্ত্র দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি বরং তৈরি করে দিয়েছে মসজিদ ও ঘর এবং বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল। আর্ত-মানবতার সেবায় বারবার যাতায়াত ও প্রচার বিমুখ খিদমাতের জন্য প্রশাসন ও সেনা বাহিনীর লোকজন তাদের প্রশংসা করেছে। অপরদিকে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে যুগপথ আন্দোলনে বলিষ্ট ভূমিকা রেখেছে তালামীযে ইসলামিয়া।
ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন কারো অজানা নয়। আল্লামা ছাহেব কিবলাহর নির্দেশে তালামীযের নেতৃত্বে লক্ষাধিক লোকের ঢাকামুখী লংমার্চের ফসল হলো আজকের ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এ সংগঠনের নগণ্য কর্মী হিসেবে আমার মূল্যায়নে মানুষ গড়ার কারিগর এ সংগঠন অগণিত যোগ্য লোক তৈরি করেছে। যারা আজ দেশ-বিদেশে কর্মজীবনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করছেন। অধ্যক্ষ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, অধ্যাপক, ইমাম, প্রশাসক, ডাক্তার, সম্পাদক, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি ও ব্যবসায়ী ইত্যাদি সর্বক্ষেত্রে তাদের সততা ও ন্যায় নিষ্ঠার স্বাক্ষর এগিয়ে যাচ্ছেন। আল্লাহ তাআলা এ সংগঠনকে কবূল করুন এবং এর কর্মীবৃন্দকে দ্বীনী খিদমাত করার তাওফীক দান করুন। আমীন।
বাংলাদেশ আনজুমানে তালামীযে ইসলামিয়ার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সচিব