বাংলাদেশের রাজনীতিতে ধর্মের প্রাসঙ্গিকতা জাতিরাষ্ট্র হিসেবে এদেশের আত্মপ্রকশের বহু আগে থেকেই দৃশ্যমান ছিল। ব্রিটিশ ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের সফল পরিণতি এসেছে ধর্মকে প্রধান পরিচয় হিসেবে ধারণ করে সংগ্রাম করা দুটি দল তথা কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের হাত ধরে। বস্তুত ভারতে জাতিরাষ্ট্রের আবির্ভাব ধর্মীয় রাজনীতিরই ফলাফল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এবং অখণ্ড পাকিস্তানের চব্বিশ বছরে ইসলাম যেভাবে রাষ্ট্রে এবং রাজনীতিতে প্রাসঙ্গিক ছিলো স্বাধীন বাংলাদেশেও সে ধারা নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে এখনও চলমান রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের চুয়ান্ন বছরে মূল রাজনৈতিক লড়াই ধর্মনিরপেক্ষ এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দুটি শক্তির মাঝে হলেও উভয় গোষ্ঠীর মাঝেই নির্বাচনী রাজনীতিতে নিজেদের ধার্মিক প্রমাণের চেষ্টা বরাবরই পরিলক্ষিত হয়েছে। ইসলামী মূল্যবোধের দর্শনে বিশ্বাসী বিএনপি তো বটেই, ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামীলীগও নির্বাচনের সময় নিজেদেরকে ইসলামের সেবক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার প্রাণান্ত চেষ্টা সব সময়ই করেছে। এজন্য তাদের নির্বাচনী এজেন্ডাতেও দেখা যেতো কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী আইন পাশ না করার ঘোষণা,প্রচার করতো তাদের নেত্রীর নামাযরত ছবি, নির্বাচনী প্রচার শুরু করতো শাহজালাল (র.)-এর মাযার যিয়ারতের মাধ্যমে। ধর্মনিরপেক্ষ দল কিংবা ইসলামী মূল্যবোধের দলের নির্বাচনী রাজনীতিতে ইসলামকে গুরুত্বারোপের এই সংস্কৃতিকে অনেকে রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করলেও বস্তুত এমন গুরুত্বারোপ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতার বিশ্বাস ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন যা যে কোন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কেবল গ্রহণযোগ্যই নয় বরং প্রত্যাশিত এবং অনিবার্য।
যখন একটি ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি ও ইসলামী মূল্যবোধের শক্তির মধ্যে মূল নির্বাচনী লড়াই চলছিল তখন অনেক ক্ষেত্রেই মুসলিম আত্মপরিচয়ে সচেতন জনতা এবং উলামারা ইসলামী মূল্যবোধের শক্তিকেই সমর্থন দিয়েছেন। এক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামীলীগ নির্বাচনের সময় উলামাদের কাছে টানার চেষ্টা করেও কখনও কখনও ব্যর্থ হয়েছে তাদের শঠতা এবং দ্বৈততার জন্য। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ফলে আওয়ামীলীগের অপরাজনীতি অর্থাৎ তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি প্রাসঙ্গিকতা হারানোয় বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত বেশ কিছু ডানপন্থী অথবা মধ্য ডানপন্থী দলের রাজনীতি। এখনো ধর্মনিরপেক্ষতা অথবা সমাজতন্ত্রের নীতিতে বিশ্বাসী কিছু দল সক্রিয় থাকলেও রাজনৈতিক শক্তির ভরকেন্দ্রে এখন একাধিক ডানপন্থী অথবা মধ্য ডানপন্থী দলই আছে। এই ডানপন্থী অথবা মধ্য ডানপন্থী দলের তালিকায় বিএনপি ও ইসলামী দলসমূহ যেমনি আছে, তেমনি আছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সম্মুখ সারীর নেতাদের দল এনসিপিও। আগামী নির্বাচনে ডানপন্থী এবং মধ্য ডানপন্থী এসব দলের নির্বাচনী লড়াইয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক সংকট তৈরি হয়েছে তা হলো ধর্মীয় মূল্যবোধের ক্ষেত্রে দলগুলো প্রায় একই রকম সংবেদনশীল হওয়ায় নির্বাচনের প্রচারে ইসলামকে ধারণ করার ক্ষেত্রে নিজেদের মাঝে সুস্পষ্ট পার্থক্য খুঁজে বের করা। নিরপেক্ষ ও নির্মোহ অবস্থান থেকে এই ইস্যুতে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ দলগুলোর মধ্যে আদতে বড় কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া বেশ জটিল এবং পেলেও সে পার্থক্য সততার সাথে সাধারণ জনগণের বোধগম্য ভাষায় উপস্থাপন করা দুরূহ ব্যাপার।
যেহেতু ক্রিয়াশীল বড় দলসমূহ রাষ্ট এবং রাজনীতিতে ইসলামের প্রাসঙ্গিকতা স্বীকার করে, এমতাবস্থায় দলসমূহের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর দুটি গতিপথ হতে পারতো। প্রথমত,সকল গুরুত্বপূর্ণ দলই একটি অনুলেখ্য বুঝাপড়ায় আবদ্ধ হতে পারতো যে,তাদের রাজনীতিতে কেউ নিজেকে অতি ইসলামী এবং অন্য কাউকে অনৈসলামী দল সাব্যস্ত না করে এদেশের মানুষ,সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদার জন্য কে কী করবে তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক এবং একে কেন্দ্র করে নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করবে। এই গতিপথটিই কাঙ্ক্ষিত ছিলো। দ্বিতীয়ত যে গতিপথ হতে পারতো তা হলো,গুরুত্বপূর্ণ দলসমূহ যেহেতু ডানপন্থী অথবা মধ্য ডানপন্থী এবং এদেশের মুসলমানরা রাষ্ট্রে ধর্মকে প্রাসঙ্গিক দেখতে চায় সুতরাং দলগুলো নিজেদের মধ্যে কে কত বেশি ইসলামী তা প্রতিষ্ঠার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে। এই প্রতিযোগিতার ন্যূনতম উপস্থিতিও যে ভয়াবহ উগ্রবাদের জন্ম দিতে পারে তা বহু মুসলিম রাষ্ট্রে যেমন পরিলক্ষিত হয়েছে, একইভাবে গত দেড় বছরে বাংলাদেশের গতিপ্রকৃতি থেকেও প্রতিয়মান হচ্ছে। দুঃখজনকভাবে এদেশের ইসলামী দলগুলোর এককভাবে নিজেদের “ইসলামী” হিসেবে ঘোষণা এই প্রতিযোগিতাকেই উস্কে দেওয়ার একটি উপলক্ষ্য তৈরি করেছে। অন্য দুটি বৃহৎ শক্তি বিএনপি ও এনসিপি দৃশ্যমানভাবে এই প্রতিযোগিতায় এখনও পুরোপুরি সাড়া না দেওয়ায় বিপজ্জনক এই প্রতিযোগিতা এক পাক্ষিককই বলা চলে। এক পাক্ষিক এই প্রতিযোগিতার ফলে এককালে ইসলামিস্টদের ভরসাস্থল বিএনপিকে কিংবা জুলাই অভ্যুত্থানে ইসলামিস্টসহ সকলের নেতা এনসিপির নেতাদের “অনৈসলামী” বলে ট্যাগ করার যে চর্চা এখন দৃশ্যমান, এই চর্চা অদূর ভবিষ্যতে আবারও এদেশে ইসলামী মূল্যবোধ আর ধর্মনিরপেক্ষতার বাইনারির রাজনীতির পুনর্মঞ্চায়নের ক্ষেত্র প্রস্তুত করছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে ইসলামপন্থী কয়েকটি দলের সম্ভাব্য জোট যেভাবে নিজেদেরকে এককভাবে ইসলামের পক্ষের শক্তি এবং অন্যান্য মধ্য ডানপন্থী দল এমনকি ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বাসের দলসমূহকে ইসলামের বিপক্ষ শক্তি হিসেবে চিত্রিত করার চেষ্টা করছে এই বিপজ্জনক চেষ্টার মূল ভিত্তিটা আদৌ কি,সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোন ব্যাখ্যা সেসব ইসলামী দলসমূহ এখনও দেয়নি। যে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটাররা মুসলমান,প্রার্থীরাও মুসলমান সে দেশে ইসলামের পক্ষের শক্তি এবং ইসলামের বিপক্ষের শক্তিতে পুরো রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে বিভক্ত করার যৌক্তিকতা তৈরি হতে পারে মোটাদাগে দুটি প্রেক্ষাপটে। প্রথম প্রেক্ষাপট এমন হতে পারে—যখন একটি পক্ষ চায় নির্বাচনে জয়লাভ করলে তারা দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবে অর্থাৎ ইসলামী শরীআতের ভিত্তিতে দেশ পরিচালনা করবে এবং অপরপক্ষ ইসলামী শরীআতের পূর্ণ বাস্তবায়নকে অস্বীকার করে। যারা শরীআতের পূর্ণ বাস্তবায়নকে অস্বীকার করে তারা ইসলামী মূল্যবোধের কথা বললেও যেহেতু অন্য একটি পক্ষের শরীআত বাস্তবায়নে তারা বাধা সৃষ্টি করছে সুতরাং এমন অবস্থায় পক্ষ দুটিকে ইসলামী ও অনৈসলামী হিসেবে বিভক্ত করা যায়, যদিও এর বিপজ্জনক পরিণতির সম্ভাবনা থাকে। দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট এমন হতে পারে যে,দেশে এমন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক পক্ষ রয়েছে যারা মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এবং তাদের বিপরীতে একটি দল ইসলামী মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার ব্যক্তকারী দল পরিপূর্ণভাবে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার না করলেও,বিপক্ষ দল সুস্পষ্ট ইসলামবিরোধী অবস্থান নেওয়ায় দল দুটিকে ইসলামের পক্ষের এবং বিপক্ষের শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। এই প্রেক্ষাপটে একাধিকবার বাংলাদেশের জনগণ ভোট দিয়ে ইসলামের পক্ষকে বিজয়ীও করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দেড় বছরের রাজনীতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে এ সত্য দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়,বর্তমানে প্রাসঙ্গিক ও বড় রাজনৈতিক পক্ষসমূহের মধ্যে উপরে উল্লিখিত দুটি পক্ষের কোনটিই উপস্থিত নয়। অর্থাৎ এখানে কেউই ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়িমের সুস্পষ্ট ঘোষণাও দেয়নি আবার কেউ সুস্পষ্টভাবে ইসলামের বিপক্ষেও অবস্থান নেয়নি। বরং দলগুলো ইসলামী মূল্যবোধের প্রতি এবং মুসলমানদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলে দাবি করে। এমন অবস্থায় কোন একটি পক্ষ অন্য পক্ষ বা পক্ষগুলোকে অনৈসলামিক সাব্যস্ত করা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক রাজনৈতিক শঠতা। ডান বা মধ্য ডানপন্থী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং এনসিপি যেখানে জাতি রাষ্ট্রের বিদ্যমান আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত রাখতে চায়,মুসলমানদের অনুভূতিকে সম্মান করতে চায় এবং সকলের সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চায় সেখানে জামায়াত বা তার মিত্ররা বিশেষ কী কী পদক্ষেপের কারণে নিজেদেরকে ইসলামী এবং বিএনপি বা এনসিপিকে অনৈসলামী সাব্যস্ত করছে এর কোন সুস্পষ্ট উত্তর এখনও জামায়াত দিতে পারেনি। জামায়াত ও তার মিত্ররা ক্ষমতায় গেলে ইসলামী শরীআত অনুযায়ী দেশ চালানোর কথা সুস্পষ্টভাবে অস্বীকার করেছেন একাধিকবার। তাহলে বিজয়ী হলে দেশের আইনি, অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক বা শিক্ষানীতি বিষয়ক কী ধরনের গাঠনিক পরিবর্তন তারা আনবেন যা বিএনপি বা এনসিপির প্রস্তাবিত রূপরেখা থেকে বেশি ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে এরও কোন সদুত্তর কিংবা রূপরেখা জামায়াত জোট এখনো হাযির করেনি।
কোন আনুষ্ঠানিক রূপরেখা না থাকলেও জামায়াত ও তার মিত্রদের নানা বক্তব্য থেকে বুঝা যায়,তারা আদতে বাংলাদেশকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এজন্য তারা রাষ্ট্রের সকল স্তরে ঘুষ ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন করবেন,নাগরিকদের যোগ্যতা অনুযায়ী পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবেন,নাগরিকদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন এবং নানা সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান নিশ্চিত করবেন। এসব অঙ্গীকার কোনভাবেই বিএনপি কিংবা এনসিপির রূপকল্পের চেয়ে বেশি বা কম ইসলামী কোনটাই নয়। বরং তিন পক্ষের রূপকল্পই প্রায় একই ধরণের। জামায়াত বা তার মিত্ররা মোটেও দাবি করেন না যে,তারা ক্ষমতা পেলে মুসলমান পরিচয়দানকারীদের জন্য ইসলাম পালন বাধ্যতামূলক করে দিবেন,ইসলামের নীতি অনুযায়ী মুসলমানদের বিচার করবেন কিংবা রাষ্ট্র থেকে সুদভিত্তিক অর্থনীতি উৎখাত করে ইসলামী শরীআর আলোকে অর্থনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করবেন। রাষ্ট্রের মৌলিক দর্শনে ইসলামী শরীআর আলোকে বড় কোন পরিবর্তনের ঘোষণা না দিয়েই জামায়াত ও তার মিত্ররা যেভাবে নিজেদেরকে ইসলামী এবং অন্যান্য মুসলমানদের দলকে অনৈসলামী বলে প্রচার করছেন,তা নিশ্চিতভাবেই উম্মাহর মধ্যে বিচ্ছিন্নতার আলামত। নিজেদের ব্যালটকে ইসলামের পক্ষের ব্যালট এবং অন্য মুসলমানদের ব্যালটকে ইসলামের বিপক্ষের ব্যালট বলার বৈধতা সম্ভবত জামায়াত ও তার মিত্ররা তাদের নিজেদের পোশাক এবং ভাষার মাধ্যমে আদায় করতে চাচ্ছেন। অর্থাৎ যেহেতু জামায়াত ও তার মিত্ররা টুপি পাঞ্জাবি পরেন,যেহেতু তাদের মাঝে কেউ কেউ কুরআন-হাদীস ভালোমতো পড়েন এবং বুঝেন বলে দাবি করেন সুতরাং তারা নিজেদেরকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ইসলামী পক্ষ আর যারাই তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে তারা মুসলমান হলেও ইসলামের বিপক্ষ। তাদের এ মনস্তুত্ব যে পোপতন্ত্র বা ব্রাহ্মণ্যবাদেরই একটি ধারা এটা দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হলেও তারা তা স্বীকার করবেন না।
শরীআভিত্তিক কোন গাঠনিক পরিবর্তনের অঙ্গীকার ছাড়াই কেবল পোশাকের ভিত্তিতে জামায়াত ও তার মিত্ররা যেভাবে ইসলামের পক্ষ-বিপক্ষ সাব্যস্ত করার নীতি অবলম্বন করছে এর ফলে খোদ ইসলামপন্থীদের মধ্যেই দিন দিন বিভাজন রেখা সুস্পষ্ট হচ্ছে। নিজেদের রূপে জামায়াত এতো মগ্ন যে অন্য কোন ইসলামী দলও যদি তাদের সমালোচনা করে,কোন ইসলামী বক্তাও যদি তাদের সমালোচনা করেন তাহলে জামায়াতের এক্টিভিস্ট ও আলিমরা সে ইসলামী দল বা আলিমকে দালাল, ইসলামের দুশমন ইত্যাদি বলতে এক মুহুর্তও ভাবছেন না। পরিস্থিতি এখন এমন যে, কোন আলিমও যদি জামায়াত ও তার মিত্রদের সিয়াসি,ফিকহী বা আকাইদী কোন সমালোচনা করেন তাহলে জামায়াত সে আলিমকে ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করছে। অথচ এখনও বালাকোটী, বেরেলভী ও দেওবন্দী ঘরানাসহ দেশের বেশিরভাগ উলামায়ে কিরাম জামায়াতের আকীদা ও ফিকহের ঘোর বিরোধী তো বটেই, রাজনৈতিক দর্শনেরও বিরোধী। নিজেদের মত ও পথের বিরোধী ইসলামী শক্তিসমূহকে অনৈসলামিক সাব্যস্ত করার যে ভ্রম জামায়াতের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই পরিলক্ষিত হতো। তার পরিপূর্ণ বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে বিরোদ্ধমতের উলামাদের নানা ভাবে হয়রানির মাধ্যমে। প্রশাসনে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে দেশের ডি-ফ্যাক্টো শাসক বনে যাওয়া দলটি অসংখ্য সুন্নী উলামায়ে কিরামকে তাদের মাদরাসা থেকে বিতাড়িত করেছে, অসংখ্য খতীবকে মসজিদ থেকে বিতাড়িত করেছে, খানেকা ও দরগাহ ধ্বংসে ইন্ধন যুগিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় জামায়াতপন্থী কোন এক এমপি প্রার্থীর কুফুরী কথার সমালোচনা করায় একজন খতীবের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে মসজিদ কমিটিকে হুমকি দিয়েছে দলটি। সেখানে তারা মসজিদের মিম্বরকে রাজনীতিমুক্ত রাখার আহ্বান জানিয়েছে,অথচ তারা নিজেরাই মসজিদে ভোটের রাজনীতি করে যাচ্ছে।
ইসলাম ও অনৈসলাম বাইনারীর এই রাজনীতিতে নতুন করে সংকট তৈরি হয়েছে আমাদের মসজিদসমূহে। আমাদের মসজিদগুলো সব সময়ই একটি নির্দিষ্ট লোকালয়ের সকল শ্রেণী,পেশা ও দলের মানুষের ইবাদতগাহ হিসেবে ঐক্যের প্রতীক হয়ে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। এ মসজিদ সমূহে যখন জামায়াতের কুফুরীর সমালোচনা হয় তখন জামায়াত আহ্বান জানায় মিম্বরকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে আবার অন্য জায়গায় জামায়াতের পলিসি মেকাররাই দলের অনুগত খতীবদের আহ্বা জানান মিম্বরে বসে মানুষকে ঈমানের ভয় দেখিয়ে, জাহান্নামের কথা বলে যেন তথাকথিত ইসলামের পক্ষের শক্তি তথা জামায়াতের পক্ষে ভোট দেওয়া নিশ্চিত করেন। দলের অনুগত আলিমদের প্রতি জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতার এমন নির্দেশনা মুসলমানদের ঐক্যের বুনিয়াদকে একটি গভীর সংকটের মুখোমুখি করে। প্রথমত, মুসলমানদের দেশে যেখানে উভয় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পক্ষ অথবা প্রার্থী মুসলমান সেখানে শরীআহ কায়িমের সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছাড়া কোন এক পক্ষে ভোট দেওয়াকে ঈমানদার হওয়ার জন্য শর্তারোপ করা এবং তাদেরকে ভোট না দিলে কাফির হয়ে যাওয়ার ফাতাওয়া আরোপ করা, তাদেরকে ভোট দিলে জান্নাতী এবং না দিলে জাহান্নামী সাব্যস্ত করা নিঃসন্দেহে একটি জঘন্য প্রতারণা এবং ভিন্নমতের মুসলমানদের ঈমানহীন ভাবার খারিজী মনস্তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ যা মওদূদীবাদের মৌলিক বৈশিষ্ট্যকে সত্যায়িত করে। দ্বিতীয়ত, মসজিদের মিম্বরে বসে এরকম ফাতাওয়া আরোপ এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মুসলিম সমাজের ভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষকে সুস্পষ্ট উস্কানি দেয়। এর ফলে বিরোধী রাজনৈতিক পক্ষও মসজিদের মিম্বরকে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডার জন্য ব্যবহারের চেষ্টায় নিয়োজিত হয় অথবা জামায়াতের এমন একপাক্ষিক বয়ান প্রচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়। উভয় ক্ষেত্রেই মসজিদের সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট হয়ে একটি হিংসাত্মক ও বিশৃঙ্খল পরিবেশ বিরাজ করে,যা ইদানীং বেশ কিছু মসজিদে বিএনপি এবং জামায়াতের কর্মীদের হট্টগোলের ঘটনা থেকে প্রমাণিত। শত মত ও পথে বিভক্ত উম্মাহ যে মসজিদে এসে এক হওয়ার অনুভূতি পায় সেখানেই এমন অনৈক্যের সূচনা উম্মাহর মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক ফাটল তৈরি করছে এর প্রভাব ভয়ংকর। একইভাবে এদেশের মুসলমানের সংস্কৃতিতে পরিণত হওয়া ওয়াজ মাহফিলেও ভোটের উপর ভিত্তি করে ঈমান ও কুফর, জান্নাত ও জাহান্নাম সাব্যস্ত করার জামায়াতী প্রচার ওয়াজ মাহফিল সমূহকে নতুন করে বিতর্কিত করছে এবং অনৈক্য ও হানাহানির উপলক্ষ্য তৈরি করছে।
শরীআহ বাস্তবায়নের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা না দিয়েই সকল পোশাকি ইসলামী দল একতাবদ্ধ হয়েও যদি ভোটের রাজনীতিতে ইসলাম-অনৈসলাম বাইনারির এই প্রচারণা চালায় তবুও অনেক সচেতন মুসলমানের কাছেই এটি একটি ধোঁকাবাজির ক্যাম্পেইন হিসেবে চিহ্নিত হবে এবং ফলশ্রুতিতে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হবে। নিজেদেরকে ইসলামী দাবি করে অন্যদের অনৈসলামী বলে দূরে সরানোর পর যদি কথিত সেই ইসলামী জোটের পরাজয় হয় তাহলে রাষ্ট্রে ইসলাম ও মুসলমানের মূল্যবোধ এখন যেরকম গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে গণ্য হয়, তা অনেকাংশেই খর্ব হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে যা রাষ্ট্র থেকে ইসলামী মূল্যবোধকে অপ্রাসঙ্গিক করার পশ্চিমা এজেন্ডা বাস্তবায়নের পথকে সুগম করবে। আমাদের পোশাকি ইসলামী দলসমূহ কেবল নিজেদের ইসলামী এবং বিএনপি অথবা এনসিপির মতো মধ্য ডানপন্থী দলকে অনৈসলামী ট্যাগ দেওয়ার এই বিপজ্জনক খেলা কতদূর নিয়ে যাবে তার নিশ্চয়তা নেই। বিএনপি ও এনসিপির মতো দলকে ইসলাম প্রশ্নে মারাত্মক কোনঠাসা করা এবং নিজেদের ইসলামের একক কর্তৃপক্ষ হিসেবে হাযির করার অসৎ প্রচেষ্টা চলমান থাকলে মধ্যপন্থী বা মধ্য ডানপন্থী দলসমূহের মাঝে উলামায়ে কিরামের প্রতি অশ্রদ্ধা জ্যামিতিক হারে বাড়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। এই অশ্রদ্ধা বাড়তে থাকলে কোন এক সময় পোশাকি ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর এসব বাড়াবাড়িকে পোপতন্ত্রের সমার্থক ভাবা শুরু করতে পারে বিএনপির মতো দলগুলো। তখন তারা নির্বাচনে জয়লাভ করলে চার্চকে চার্চের প্রাপ্য এবং সিজারকে সিজারের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার নীতি অনুসরণ করে এদেশের রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে ইসলাম অথবা ইসলামী মূল্যবোধের প্রভাবক শক্তি হ্রাস করে ইসলামকে একটি আলংকারিক শক্তি হিসেবে পরিগণিত করার নীতি গ্রহণ করলে নতুন করে এদেশে আবারও ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ইসলামোফোবিয়ার বিভীষিকার সূচনা হতে পারে। এই ভয়াবহ পরিণতির দিকে ধাবমান হওয়া থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করতে বিএনপি ও এনসিপির মতো দলসমূহের সাথে কিছু ইসলামী দল বা গোষ্ঠীর জোট গড়ে তোলাই হতে পারে একমাত্র সমাধান। এসব দলের সাথে সুন্নী ইসলামী দলগুলোর পারস্পরিক বুঝাপড়া তৈরির মাধ্যমে উভয় রাজনৈতিক বলয়ে ইসলামের সুষম উপস্থিতি নিশ্চিত করে ইসলামী এবং অনৈসলামী ট্যাগের বিপজ্জনক রাজনীতির ইতি টানা একান্ত জরুরি।

