Logo
দাড়ি, গোঁফ ও অন্যান্য পশম কাটার বিধান
ইব্রাহিম আরিফ
  • ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন,

عَشْرَةٌ مِنَ  الْفِطْرَةِ: قَصُّ الشَّارِبِ، وَقَصُّ الْأَظْفَارِ، وَغَسْلُ الْبَرَاجِمِ، وَإِعْفَاءُ اللِّحْيَةِ، وَالسِّوَاكُ، وَالِاسْتِنْشَاقُ، وَنَتْفُ الْإِبْطِ، وَحَلْقُ الْعَانَةِ، وَانْتِقَاصُ الْمَاءِ قَالَ مُصْعَبٌ: وَنَسِيتُ الْعَاشِرَةَ إِلَّا أَنْ تَكُونَ الْمَضْمَضَةَ

-দশটি কাজ স্বভাবগত: গোঁফ কাঁটা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ (যে সব স্থানে ময়লা জমা হয় সেই স্থান গুলো) ধৌত করা, দাড়ি লম্বা করা, মিসওয়াক করা, নাকে পানি দেওয়া, বগলের পশম উপড়ে ফেলা, নাভির নিচের পশম কামানো, পেশাবের পর পানি দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা এবং শৌচকর্ম করা। মুসআব ইব্ন শাইবা (রা.) বলেন, আমি দশম কথাটি ভুলে গেছি, সম্ভবত তা হলো কুলি করা।

 أخرجه مسلم (٢٦١)، وأبو داود (٥٣)، والترمذي (٢٧٥٧)، والنسائي (٥٠٤٠) واللفظ له، وابن ماجه (٢٩٣)، وأحمد (٢٥٠٦٠)

এই দশটি কাজ কোনো মুমিন করবে না, এমনটা চিন্তাও করা যায় না। বরং এগুলো স্বভাবজাত বিষয়। একজন পুরুষের দাড়ি লম্বা থাকবে, গোঁফ খাটো থাকবে, যেসব স্থানে ময়লা তৈরি হয় সেগুলো ধৌত করবে, বগল এবং নাভির নিচের পশম কাটবে এটাই স্বাভাবিক। এর উলটো চলা তো পশুর আচরণ। আমরা এই স্বভাবজাত বিষয়গুলোর হুকুম আহকাম আলোচনা করার চেষ্টা করব, ইনশাআল্লাহ।

১. দাড়ি রাখার হুকুম আহকাম

ক. দাড়ির পরিচয়: দাড়ির পরিচয় সম্পর্কে ইমাম ইবন আবিদীন শামী (র.) বলেন,

الشَّعْرُ النَّابِتُ عَلَى الْخَدَّيْنِ مِنْ عِذَارٍ وَعَارِضٍ وَالذَّقَنِ.

অর্থাৎ, দুই গালের চিবুক, চেহারার আশপাশ এবং থুতনির উপর গজানো কেশগুচ্ছকে দাড়ি বলা হয়। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ১/১০০)

সুতরাং কেউ যদি শুধু পাতলা করে চিবুকের উপর বা শুধু থুতনিতে দাড়ি রাখে তবে তার দাড়ি রাখা হয়নি। বরং চিবুক, চিবুকের আশপাশে গালের উপর, এবং থুতনিতে দাড়ি রাখলেই পূর্ণ দাড়ি রাখা হবে।

খ. দাড়ি রাখার হুকুম: রাসূলুল্লাহ সা. দাড়ি রাখা সম্পর্কে বলেন,

أَحْفُوا الشَّوارِبَ وأَعْفُوا اللِّحى. وفي رواية : انْهَكُوا الشَّوارِبَ، وَأَعْفُوا اللِّحى.

অর্থাৎ তোমরা গোঁফ ছেঁটে ফেলো, আর দাড়িকে লম্বা করো।

 مسلم (٢٥٩) البخاري (٥٨٩٣)

অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

خالِفُوا المُشْرِكِينَ؛ وَفِّرُوا اللِّحى، وَأَحْفُوا الشَّوارِبَ.

অর্থাৎ তোমারা মুশরিকদের বিরোধিতা করো। দাড়িকে বড় করো, আর গোঁফকে ছেঁটে ফেলো।

البخاري، صحيح البخاري (٥٨٩٢)، ومسلم (٢٥٩)

যেহেতু রাসূলুল্লাহ সা. দাড়ি বড় করতে সরাসরি আদেশ করেছেন, তাই অধিকাংশ উলামায়ে কিরাম বলেন, দাড়ি রাখা ওয়াজিব এবং কাটা হারাম। ইমাম হাসকাফী (র.) বলেন,

يَحْرُمُ عَلَى الرَّجُلِ قَطْعُ لِحْيَتِهِ،

অর্থাৎ, পুরুষের জন্য (এক মুষ্টির কম রেখে) দাড়ি কাটা হারাম (মাকরূহে তাহরীমী)। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ৬/৪০৭)

দুররুল মুখতারের অন্য জায়গায় তিনি বলেন,

وَأَمَّا الْأَخْذُ مِنْهَا وَهِيَ دُونَ ذَلِكَ كَمَا يَفْعَلُهُ بَعْضُ الْمَغَارِبَةِ، وَمُخَنَّثَةُ الرِّجَالِ فَلَمْ يُبِحْهُ أَحَدٌ، وَأَخْذُ كُلِّهَا فِعْلُ يَهُودِ الْهِنْدِ وَمَجُوسِ الْأَعَاجِمِ فَتْحٌ.

অর্থাৎ, (এক মুষ্টির কম) দাড়ি রেখে ছাঁটা যেমনটা কিছু পশ্চিমারা এবং হিজড়ারা করে থাকে- এটাকে কেউই বৈধতা দেননি। আর পুরো দাড়ি কেটে ফেলা তো হিন্দুস্তানী ইয়াহুদী ও অনারবী অগ্নিপূজকদের কাজ! (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ২/৪১৮)

*এখানে হারাম হওয়ার বিষয়ে আরোও দু’একটি কিতাবের রেফারেন্স প্রয়োজন*

. দাড়ি রাখার পরিমাণ

প্রথমে আমরা আলোচনা করব রাসূলুল্লাহ সা. এর দাড়ি কেমন ছিলো- এবিষয়ে।

হযরত বারা (রা.) বলেন,

كَانَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ رَجِلًا مَرْبُوعًا عَرِيضَ مَا بَيْنَ الْمَنْكِبَيْنِ، كَثَّ اللِّحْيَةِ، تَعْلُوهُ حُمْرَةٌ جُمَّتُهُ إِلَى شَحْمَتَيْ أُذُنَيْهِ، لَقَدْ رَأَيْتُهُ فِي حُلَّةٍ حَمْرَاءَ مَا رَأَيْتُ أَحْسَنَ مِنْهُ

রাসূলুল্লাহ e এর অবয়ব ছিল মধ্যম ধরনের। তাঁর কাঁধের মধ্যবর্তী স্থান ছিল প্রশস্ত, তাঁর দাঁড়ি ছিল অতি ঘন, যার উপরিভাগে রক্তিমাভা বিরাজ করতো। তাঁর মাথার চুল কানের লতি পর্যন্ত ছিল। আমি তাঁকে লাল জোড়া কাপড় পরতে দেখেছি। আমি কাউকে তাঁর চাইতে সুশ্রী ও সুন্দর দেখিনি। (সুনান আন নাসাঈ, হাদীস-৫২৩২)

হযরত ইবন আব্বাস (রা.) বলেন,

قدْ مَلأتْ لِحيتَهُ ما بين هذهِ إلى هذهِ، قدْ مَلأتْ نحرَهُ

অর্থাৎ, রাসূলুল্লাহ e এর দাড়ি মুবারক তাঁর বুক পর্যন্ত পূর্ণ করে ফেলেছিলো।

أخرجه أحمد (٣٤١٠)، وابن أبي شيبة (٣٢٤٦٩) باختلاف يسير، • الهيثمي، مجمع الزوائد (٨/٢٧٥) • رجاله ثقات

এখন থেকে স্পষ্ট রাসূলুল্লাহ সা. এর দাড়ি মুবারক বুক বরাবর ছিলো। আসুন এবার দেখি সাহাবায়ে কিরামদের আমল।

মাওয়ান ইবনু সালিম (র.) বলেন,

قَالَ رَأَيْتُ ابْنَ عُمَرَ يَقْبِضُ عَلَى لِحْيَتِهِ فَيَقْطَعُ مَا زَادَ عَلَى الْكَفِّ

আমি ইবন উমার (রা.) কে তার দাড়ি মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে মুষ্টির বাড়তি অংশ কেটে ফেলতে দেখেছি। (সুনান আবূ দাঊদ, হাদীস-২৩৫৭)

 سنن الدارقطني (٢/٤٠١) • إسناده حسن

তাছাড়া বুখারী শরীফে এসেছে,

وَكانَ ابنُ عُمَرَ إِذا حَجَّ أَوِ اعْتَمَرَ قَبَضَ على لِحْيَتِهِ، فَما فَضَلَ أَخَذَهُ.

‎ইবন উমার (রা.) যখন হাজ্জ বা উমরাহ করতেন, তখন তিনি তাঁর দাড়ি মুষ্টি করে ধরতেন এবং মুষ্টির বাইরে যতটুকু বেশি থাকত, তা কেটে ফেলতেন। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৫৮৯২ )

এজন্য উলামায়ে কিরাম বলেন, এক মুষ্টি বা চার আঙুল দাড়ি রাখা অত্যাবশ্যক। এর নিচে কাটা নিষিদ্ধ। তবে এক মুষ্টির পর বাড়তি দাড়ি কাটা জায়িয, কেউ কেউ কাটা সুন্নাত বলেছেন।

ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে-

وَلَا بَأْسَ إذَا طَالَتْ لِحْيَتُهُ أَنْ يَأْخُذَ مِنْ أَطْرَافِهَا وَلَا بَأْسَ أَنْ يَقْبِضَ عَلَى لِحْيَتِهِ فَإِنْ زَادَ عَلَى قَبْضَتِهِ مِنْهَا شَيْءٌ جَزَّهُ وَإِنْ كَانَ مَا زَادَ طَوِيلَةً تَرَكَهُ كَذَا فِي الْمُلْتَقَطِ.

وَالْقَصُّ سُنَّةٌ فِيهَا وَهُوَ أَنْ يَقْبِضَ الرَّجُلُ لِحْيَتَهُ فَإِنْ زَادَ مِنْهَا عَلَى قَبْضَتِهِ قَطَعَهُ كَذَا ذَكَرَ مُحَمَّدٌ رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى فِي كِتَابِ الْآثَارِ عَنْ أَبِي حَنِيفَةَ رَحِمَهُ اللَّهُ تَعَالَى قَالَ وَبِهِ نَأْخُذُ كَذَا فِي مُحِيطِ السَّرَخْسِيِّ.

অর্থাৎ, যখন দাড়ি লম্বা হবে তখন দাড়ির প্রান্ত সমূহ (সমান করার জন্য) ছাঁটতে অসুবিধা নাই। আর দাড়ি কে মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে মুষ্টি থেকে বেশি লম্বা হয়, তবে মুষ্টির অতিরিক্ত দাড়ি কাটতেও অসুবিধা নাই, এবং না কেটে লম্বা রাখতেও অসুবিধা নাই।

তবে মুষ্টির অতিরিক্ত অংশ কেটে ফেলা সুন্নত যেমনটা ইমাম মুহাম্মদ (র.) ইমাম আবূ হানীফা (র.) থেকে কিতাবুল আসারে বর্ণনা করেছেন।এবং বলেছেন, এই মত আমরা গ্রহণ করে থাকি। (আল ফাতাওয়া আল হিন্দিয়্যাহ ৫/৩৫৮)

তবে বুক বরাবর থেকে অতিরিক্ত বড় দাড়ি রাখা উচিত নয়। ইমাম শামী (র.) বলেন,

وَاشْتُهِرَ أَنَّ طُولَ اللِّحْيَةِ دَلِيلٌ عَلَى خِفَّةِ الْعَقْلِ

অর্থাৎ, প্রচলিত আছে অধিক লম্বা দাড়ি কম আক্বলের লক্ষণ। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ৬/৪০৭)

ঘ. নিম দাড়ির হুকুম

*ঠোঁটের নিচে গজানো ছোট দাড়ি যেগুলো নিম দাড়ি বলা হয়, এই অংশের দাড়িও রাসূলুল্লাহ সা. রেখেছিলেন বর্ণনা পাওয়া যায়।* হযরত আবূ হুহাইফা (রা.) বলেন,

رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم وَرَأَيْتُ بَيَاضًا مِنْ تَحْتِ شَفَتِهِ السُّفْلَى الْعَنْفَقَةَ‏.‏

আমি আল্লাহর রাসূলুল্লাহ সা. কে দেখেছি আর তাঁর নিচ ঠোঁটের নিম্নভাগে দাড়িতে সামান্য সাদা চুল দেখেছি। (সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৫৪৫)

২. গোঁফ কাটার হুকুম আহকাম

ক. গোঁফ কাটার হুকুম

আমরা আগেই বর্ণনা করেছি, রাসূলুল্লাহ e দশটি কাজ কে ফিতরাত ঘোষণা করেছেন। তাই শরীআতে গোঁফ কাটাও একটি আবশ্যকীয় কাজ। যাকে ওয়াজিব বলে ব্যক্ত করাই উচিত। কেননা রাসূলুল্লাহ সা. গোঁফ কাটার প্রতি সরাসরি নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে যারা গোঁফ বড় রাখে এদের ধমকি প্রদান করেছেন। তিনি সা. বলেন,

ليس منّا مَن لَمْ يأخُذْ شاربَه

অর্থ, যে ব্যক্তি গোঁফ কাটে না সে আমার অন্তর্ভুক্ত নয়!

  • مصنف ابن أبي شيبة (٢٥٤٩٣)، والطبراني (٥٠٣٦) (٥/ ١٨٥)

খ. গোঁফ কাটার পদ্ধতি

ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে,

وَيَأْخُذُ مِنْ شَارِبِهِ حَتَّى يَصِيرَ مِثْلَ الْحَاجِبِ كَذَا فِي الْغِيَاثِيَّةِ.

وَكَانَ بَعْضُ السَّلَفِ يَتْرُكُ سِبَالَيْهِ هُمَا أَطْرَافُ الشَّوَارِبِ كَذَا فِي الْغَرَائِبِ.

ذَكَرَ الطَّحَاوِيُّ فِي شَرْحِ الْآثَارِ أَنَّ قَصَّ الشَّارِبِ حَسَنٌ، وَتَقْصِيرُهُ أَنْ يُؤْخَذَ حَتَّى يَنْقُصَ مِنْ الْإِطَارِ وَهُوَ الطَّرَفُ الْأَعْلَى مِنْ الشَّفَةِ الْعُلْيَا قَالَ وَالْحَلْقُ سُنَّةٌ وَهُوَ أَحْسَنُ مِنْ الْقَصِّ وَهَذَا قَوْلُ أَبِي حَنِيفَةَ وَصَاحِبِيهِ رَحِمَهُمْ اللَّهُ تَعَالَى كَذَا فِي مُحِيطِ السَّرَخْسِيِّ

অর্থাৎ, গোঁফ কাটার পদ্ধতি হচ্ছে, গোঁফকে ছেঁটে ফেলা যাতে তা চোখের ভ্রুর সমান হয়ে যায়। কিছু কিছু বুযুর্গ বলেন, গোঁফের উভয় প্রান্ত কে কাটবে না (বরং দাড়ির সাথে মিলিয়ে রাখবে)।

ইমাম তাহাবী (র.) বলেন: গোঁফ কে ছেঁটে ফেলা উত্তম। আর ছেঁটে ফেলার পদ্ধতি হচ্ছে, এতোটা ছোট করা যে উপরের ঠোঁটের মাথা থেকে উপরে থাকবে। অতঃপর তিনি বলেন, গোঁফ হলক করাও সুন্নাত, এবং ছেঁটে ফেলার চেয়ে মুন্ডানো উত্তম। এটি ইমাম আবূ হানীফা ও সাহেবাইনের মত। (আল ফাতাওয়া আল হিন্দিয়্যাহ ৫/৩৫৮)

কিন্তু ইমাম মুল্লা আলী কারী (র.) বলেন,

(وَأَحِفُّوا) : بِقَطْعِ الْهَمْزَةِ أَيْ قُصُّوا (الشَّوَارِبَ) : فِي الْجَامِعِ الصَّغِيرِ: قَدَّمَ هَذِهِ الْجُمْلَةَ عَلَى الْأُولَى، ثُمَّ فِي الْمُغْرِبِ: أَحْفَى شَارِبَهُ بِالْحَاءِ الْمُهْمَلَةِ أَيْ بَالَغَ فِي جَزِّهِ. قِيلَ: الْإِحْفَاءُ قَرِيبٌ مِنَ الْحَلْقِ، وَأَمَّا الْحَلْقُ فَلَمْ يَرِدْ، بَلْ كَرِهَهُ بَعْضُ الْعُلَمَاءِ وَرَآهُ بِدْعَةً.

অর্থাৎ, হাদীসে আশা শব্দের অর্থ গোঁফ ছেঁটে ফেলা। কেউ কেউ বলেন, ছেঁটে ফেলা মুন্ডনের কাছাকাছি। তবে একেবারে মুন্ডনের কথা হাদীসে আসেনি। বরং কিছু কিছু উলামায়ে কিরাম মুন্ডানো কে বিদআত মনে করেন। (মিরকাতুল মাফাতিহ, ৭/২৮১৫)

ইবনে আবিদীন শামী (র.) বলেন,

وَفِيهِ حَلْقُ الشَّارِبِ بِدْعَةٌ وَقِيلَ سُنَّةٌ……..وَالْقَصُّ مِنْهُ حَتَّى يُوَازِيَ الْحَرْفَ الْأَعْلَى مِنْ الشَّفَةِ الْعُلْيَا سُنَّةٌ بِالْإِجْمَاعِ اهـ

অর্থাৎ, গোঁফ মুণ্ডানো বিদআত, কেউ কেউ সুন্নাত বলেন। তবে গোঁফ ছেঁটে একেবারে উপরের ঠোঁটের অগ্রভাগ বরাবর করা সকলের মতে সুন্নাত। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ৬/৪০৭)

*ইমাম আবূ জাফর তাহাভী রাহিমাহুল্লাহ’র শারহু মাআনিল আসারে গোড়া থেকে কাটাকে অধিক উত্তম বলে ইমাম আবূ হানীফা ও সাহেবাইনের মত তুলে ধরেছেন,*

 *فالنظر على ذلك أن يكون كذلك حكم الشارب قصه حسن، وإحفاؤه أحسن وأفضل وهذا مذهب أبي حنيفة، وأبي يوسف، ومحمد رحمهم الله*

*তাহলে গোঁফের ব্যাপারে হুকুম হবে, কেটে ছোট করা ভালো, আর ইহফা (গোড়া থেকে নেওয়া) আরও ভালো ও উত্তম। আর এটাই ইমাম আবূ হানীফা, আবূ ইউসুফ ও মুহাম্মদ رحمهم الله এর মাযহাব। (শারহু মাআনিল আসার ৪/২৩১)

 

*তাই আমরা বলব, গোঁফের ক্ষেত্রে বড় করে না রেখে ছোটো করে কাটা বা গোড়া থেকে কেটে ফেলা উভয় সুরতই জায়িয, এতে কোনো বিধিনিষেধ নাই।*

৩. বগলের পশম কাটার হুকুম

বগলের পশম লম্বা হলে তাকে কেটে ফেলাও একটি ফিতরাতি বিষয়।

রাসূলুল্লাহ e বলেন,

الْفِطْرَةُ خَمْسٌ….  وَنَتْفُ الإِبْطِ وَقَصُّ الشَّارِبِ

ফিতরাত (স্বভাব) পাঁচটি,…তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, বগলের লোম উপড়িয়ে ফেলা এবং গোঁফ কাটা। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৫৮৯১, সহীহ মুসলিম, হাদীস-৪৮৫)

হাদীসে نتف শব্দ এসেছে। যার অর্থ উপড়ে ফেলা। তাই বগলের পশম উপড়ে ফেলা উত্তম, কিন্তু কারো জন্য অসম্ভব হলে তিনি মুণ্ডাতে পারবেন। ফতোয়ায়ে আলমগীরীতে এসেছে-

وَفِي الْإِبْطِ يَجُوزُ الْحَلْقُ وَالنَّتْفُ أَوْلَى

অর্থাৎ, বগলের পশম মুণ্ডানো জায়িয, কিন্তু উপড়ে ফেলা উত্তম। (৫/৩৫৮)

মোল্লা আলী কারী (র.) বলেন,

قَالَ النَّوَوِيُّ: النَّتْفُ أَفْضَلُ لِمَنْ قَوِيَ عَلَيْهِ، لِمَا حُكِيَ أَنَّ الشَّافِعِيَّ كَانَ يَحْلِقُ إِبِطَهُ فَقَالَ: عَلِمْتُ أَنَّ السُّنَّةَ نَتْفُهُ، لَكِنْ لَا أَقْوَى عَلَى الْوَجَعِ.

অর্থাৎ, যার সামর্থ্য আছে তার জন্য বগলের পশম উপড়ে ফেলা উত্তম। বর্ণিত আছে, ইমাম শাফিঈ (র.) বগলের পশম মুণ্ডাতেন। তিনি বলেন, আমি জানি উপড়ে ফেলা সুন্নাত কিন্তু আমি ব্যথা সহ্য করতে পারি না। (মিরকাত ৭/২৮১৫)

৪. নাভীর নিচের পশম কাটার হুকুম

এটাও একটি স্বভাবজাত বিষয়। রাসূলুল্লাহ সা. বলেন,

الْفِطْرَةُ خَمْسٌ الْخِتَانُ وَالاِسْتِحْدَادُ

পাঁচটি কাজ হলো ফিতরাত এর অন্তর্ভুক্ত- এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, খাতনা করা, ক্ষুর দ্বারা নাভির নিচের লোম পরিষ্কার করা। (সহীহ বুখারী, হাদীস-৫৮৯১, সহীহ মুসলিম, হাদীস-৪৮৫)

মোল্লা আলী কারী (র.) এই হাদীসের ব্যাখ্যায় বলেন,

وَالِاسْتِحْدَادُ أَيْ حَلْقُ الْعَانَةِ، وَهُوَ اسْتِفْعَالٌ مِنَ الْحَدِيدِ، وَهُوَ اسْتِعْمَالُ الْحَدِيدِ مِنْ نَحْوِ الْمُوسَى فِي حَلْقِ الْعَانَةِ ذِي الشَّعْرِ الَّذِي حَوَالَيْ ذَكَرِ الرَّجُلِ وَفَرْجِ الْمَرْأَةِ. زَادَ ابْنُ شُرَيْحٍ: وَحَلْقَةُ الدُّبُرِ، فَجَعَلَ الْعَانَةَ مَنْبَتَ الشَّعْرِ مُطْلَقًا، وَالْمَشْهُورُ الْأَوَّلُ، فَإِنْ أَزَالَ شَعْرَهُ بِغَيْرِ الْحَدِيدِ لَا يَكُونُ عَلَى وَجْهِ السُّنَّةِ.

অর্থাৎ, হাদীসে বর্ণিত استحداد অর্থ হচ্ছে, নাভির নিচের পশম মুণ্ডানো। আর এর পদ্ধতি হচ্ছে, ধারালো ক্ষুর ব্যবহার করে পুরুষাঙ্গ ও নারীর লজ্জা স্থানের চারপাশের পশম মুণ্ডিয়ে ফেলা। ইবন শুরাইহ (র.) এই শব্দের ব্যাখ্যায় একটু বৃদ্ধি করে বলেন : এবং পায়ুপথের পশমও হলক করা।…. কেউ যদি ক্ষুর ব্যবহার না করে অন্য কিছু দিয়ে তা পরিষ্কার করে ফেলে (যেমন লোম নাশক) তবে এর দ্বারা সুন্নত আদায় হবে না। (মিরকাত ৭/২৮১৪)

তবে ইমাম শামী (র.) বলেন,

وَالسُّنَّةُ فِي عَانَةِ الْمَرْأَةِ النَّتْفُ

নারীরা নাভির নিচের পশম উপড়ে ফেলা সুন্নত। (হাশিয়াতু ইবন আবিদীন, ৬/৪০৬)

সম্ভবত নারীদের ত্বক নরম হওয়ায় তিনি এমনটা বলেছেন। কিন্তু হাদিসের আম লফয থেকে সবার জন্য ক্ষুর ব্যবহারই সুন্নত প্রমাণিত হয়।

৫. এগুলো কাটতে হয় কত দিনের ভিতর

নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের পশম কাটার ক্ষেত্রে সুন্নাত হচ্ছে এগুলো লম্বা হলেই কেটে নিতে হয়, তবে প্রত্যেক জুমুআবারে একবার কাটা মুস্তাহাব। তবে চল্লিশ দিনের বেশি দেরি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ফাতওয়ায়ে শামীতে এসেছে-

(وَ) يُسْتَحَبُّ (حَلْقُ عَانَتِهِ وَتَنْظِيفُ بَدَنِهِ بِالِاغْتِسَالِ فِي كُلِّ أُسْبُوعٍ مَرَّةً) وَالْأَفْضَلُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ وَجَازَ فِي كُلِّ خَمْسَةَ عَشْرَةَ وَكُرِهَ تَرْكُهُ وَرَاءَ الْأَرْبَعِينَ أَيْ تَحْرِيمًا لِقَوْلِ الْمُجْتَبَى وَلَا عُذْرَ فِيمَا وَرَاءَ الْأَرْبَعِينَ وَيَسْتَحِقُّ الْوَعِيدَ اهـ

অর্থাৎ, মুস্তাহাব হচ্ছে, এগুলো সপ্তাহে একবার মুণ্ডানো। তবে (প্রত্যেক) জুমুআবারে করা অধিক উত্তম। পনেরো দিন পরেও কাটা জায়িয। তবে চল্লিশ দিনের বেশি দেরি করা মাকরূহে তাহরীমি। চল্লিশ দিন পার হওয়ার পর আর কোনো ওযর চলে না, তখন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। (শামী, ৬/৪০৬,৪০৭)

কারণ হযরত আনাস (রা.) বলেন,

وَقَّتَ لَنَا رَسُولُ اللَّهِ  صَلَّى اللهُ  عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي قَصِّ الشَّارِبِ، وَتَقْلِيمِ الْأَظْفَارِ، وَحَلْقِ الْعَانَةِ، وَنَتْفِ الْإِبْطِ، أَنْ لَا نَتْرُكَ أَكْثَرَ مِنْ أَرْبَعِينَ يَوْمًا

রাসূলুল্লাহ e আমাদের জন্য গোঁফ ছাঁটা, নখ কাটা, নাভির নিম্নভাগের লোম চেঁছে ফেলার ও বগলের পশম উপড়ে ফেলার মেয়াদ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যে, আমরা যেন এ কাজগুলো চল্লিশ দিনের বেশি সময় পর্যন্ত ফেলে না রাখি। (সুনান আন নাসাঈ, হাদীস ১৪)

মুল্লা আলী কারী (র.) বলেন,

وَالْمَعْنَى أَنْ لَا نَتْرُكَ تَرْكًا يَتَجَاوَزُ أَرْبَعِينَ، لَا أَنَّهُ وُقِّتَ لَهُمُ التَّرْكُ أَرْبَعِينَ ; لِأَنَّ الْمُخْتَارَ أَنْ يُضْبَطَ الْحَلْقُ وَالتَّقْلِيمُ وَالْقَصُّ بِالطُّولِ، فَإِذَا طَالَ حَلَقَ وَقَصَّ وَقَلَّمَ، ذَكَرَهُ النَّوَوِيُّ.

অর্থাৎ, এই হাদীসের ব্যাখ্যা হচ্ছে, আমরা যেন কোনোভাবেই এগুলো না কেটে চল্লিশের বেশিদিন অতিক্রম না করি। এর অর্থ এটা নয় যে, চল্লিশ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে কাটবো, কেননা মুখতার হচ্ছে, যখনই নখ, গোফ, বগল ও নাভির নিচের পশম লম্বা হবে তখনই কেটে ফেলব যেমনটা ইমাম নববী (র.) বলেছেন। (মিরকাত ৭/২৮১৬)

আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সুন্নাত মুতাবিক যিন্দেগী যাপনের তাওফীক দান করুন। আমীন।

ফেইসবুকে আমরা...