রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও মর্যাদা এমন একটি বিষয়, যার প্রকৃত অবস্থা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীবের শান ও মর্যাদা আমাদেরকে যতটুকু জানিয়েছেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাঁর শান ও মর্যাদা সম্পর্কে যা বলেছেন তার সামান্য অংশ আমরা আলোচনা করতে পারি মাত্র। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মর্যাদা এবং যে বিষয়ের সাথে এই সম্মেলন সংশ্লিষ্ট, যদি আমরা তা ধারাবাহিকভাবে আলোচনা করতেই থাকি তাহলে এই সময় অথবা আরও এতো সময় যদি দেওয়া হয় তবুও সেটা যথেষ্ট হবে না।
ইমাম আহমদ ইবন হাম্বল (র.) স্বীয় সনদে সায়্যিদুনা মাইসারাহ আল ফাজর (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বললাম, متى كنت نبيا আপনি কখন থেকে নবী? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, রূহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন তখনও আমি নবী ছিলাম। এই হাদীসের সনদ আমি উল্লেখ করলাম, এটা হচ্ছে সহীহ সনদ। ইমাম ইবন হাজার আসকালানী (র.) বলেন এই হাদীস খুবই শক্তিশালী এবং এর সনদ সহীহ। এর বর্ণনাকারীগণ বিশ্বস্ত এবং সনদ মুত্তাসিল।
এ মহান হাদীস রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান ও মর্যাদা বর্ণনা করছে। এক সাহাবী নবী করীম বকে প্রশ্ন করলেন متى كنت نبيا (আপনি কখন থেকে নবী ছিলেন?) অন্য বর্ণনায় আছে, متى وجبت لك النبوة (কখন থেকে আপনাকে নবুওয়াত দেওয়া হয়েছে) আরেকটি বর্ণনায় আছে متى وجبت لك النبوة এইসব বর্ণনাগুলোর উত্তরে নবীজি বললেন, وآدم بين الروح والجسد (যখন আদম (আ.) রূহ এবং দেহের মধ্যবর্তী অবস্থায় ছিলেন তখন থেকে) অন্য বর্ণনায় আছে وآدم لـم تنفخ فيه الروح (যখন আদম (আ.) এর শরীরে রূহ দেওয়া হয়নি তখন থেকে)।
এখানে আমি আমার ছাত্র ভাইদেরকে হাদীসটির অর্থের দিকে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করবো এবং সংক্ষিপ্তভাবে এই হাদীসগুলোর ব্যাখ্যা করব।
আল্লাহ তাআলা আদম (আ.) এর শরীর সৃষ্টি করেছেন, তাতে তখনও রূহ দেন নাই। দীর্ঘদিন তার শরীরকে রূহ ব্যতীত যমীনের মধ্যে রেখে দিলেন। তখনো মানবজাতির শরীর তৈরি করা হয়নি কিন্তু আল্লাহ তাআলার ইলমের মধ্যে রয়েছে যে মানবজাতি সৃষ্টি করা হবে। আল্লাহ তাআলা সকল রূহ সৃষ্টির আগে মুহাম্মদ ব এর রূহ সৃষ্টি করলেন। এই দৃষ্টিকোণ থেকে আদম (আ.) এর রূহের আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রূহকে সৃষ্টি করেছেন। আর নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রূহ সৃষ্টি করেই তাতে নবুওয়াতের… জারি করে দিলেন। অথচ তখনও আদম (আ.) এর শরীর সৃষ্টি করা হয়নি, তাতে রূহও দেওয়া হয়নি। আর এটাই হচ্ছে সাহাবীদের প্রশ্নের জবাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বলা, আমি তখনো নবী যখন আদম রূহ এবং শরীরের মাঝামাঝি অবস্থায় ছিলেন। সুতরাং নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর রূহ মুবারক হযরত আদম (আ.) কে রূহ দেওয়ার আগেই নবুওয়াত দ্বারা সম্মানিত করা হয়েছিল।
তিনি হচ্ছেন আমাদের হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। ইমাম হাকিম তার মুস্তাদরাক এর মধ্যে একটি হাদীস বর্ণনা করে এটিকে সহীহ বলেছেন। তবে হাফিয যাহাবী এই হাদীসটিকে মাওদূ বলেছেন। কিন্তু প্রকৃত কথা হলো, ইমাম হাকিম বর্ণিত হাদীসটির সনদ সহীহও নয় আবার মাওদূও নয়। এটি এমন এক দুর্বল হাদীস যার পক্ষে অনেক তাবে আছে। এই হাদীসটির ন্যূনতম স্তর হলো গ্রহণযোগ্য। সে হাদীসের বর্ণনা হলো, আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীবের সম্মানে তাঁর নাম মুবারককে আরশে আযীমের খুঁটির মধ্যে লিখে রেখেছেন। সায়্যিদুনা হযরত আদম (আ.) থেকে যখন একটি বিচ্যুতি দেখা দিলো তখন তিনি নবী করীম ব এর ওয়াসীলা নিয়ে এবং তাঁর সুপারিশ নিয়ে দুআ করলেন, যাতে আল্লাহ তাআলা তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ তাআলা তাকে জিজ্ঞেস করলেন হে আদম, তুমি কীভাবে জানলে যে মুহাম্মদ ব আমার কাছে সব থেকে সম্মানিত সৃষ্টি? আদম (আ.) বললেন, হে আমার রব! যখন আপনি আমাকে সৃষ্টি করলেন এবং আমার মধ্যে রূহ ফুঁকে দিলেন তখন আমি আরশ এর খুঁটির মধ্যে লিখা দেখলাম لا إله إلا الله محمد رسول الله। তখন আমি বুঝলাম যে সৃষ্টির মধ্যে সব থেকে প্রিয় কারো নাম ছাড়া অন্য কারো নাম আপনার সাথে যুক্ত করেননি। আল্লাহ তাআলা বললেন, হে আদম! যেহেতু তুমি মুহাম্মদ ব এর নামের ওয়াসীলা নিয়ে আমার কাছে দুআ করেছো তাই আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। এ থেকে আমরা সবাই জানলাম, সৃষ্টিজগত বানানো হয়েছে তাঁর কারণে। যেমনটি ইমাম বূসীরী (র.) বলেছেন।
এই হাদীসের মর্মার্থ হলো, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রবের কাছে সৃষ্টির মধ্যে সব থেকে উত্তম, সব থেকে মর্যাদাবান, সব থেকে সম্মানী এবং সব থেকে প্রিয়। কুরআন এবং সুন্নাহ থেকেও এটাই প্রমাণিত হয়। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, لَعَمْرُكَ إِنَّهُمْ لَفِي سَكْرَتِهِمْ يَعْمَهُونَ-আপনার জীবনের কসম! তারা তাদের নেশায় মত্ত ছিল। (সূরা হিজর, আয়াত-৭২)
ইমাম বাইহাকী (র.) শুআবুল ঈমান কিতাবে উল্লিখিত আয়াতের অর্থ থেকে মাসআলা ইসতিম্বাত করে বলেন, আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের কসম করেছেন। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাড়া সৃষ্টির অন্য কারো জীবনের কসম করেননি। এ থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তাআলা তাঁর যেই সৃষ্টির জীবনের কসম করেছেন তিনি তার কাছে গোটা সৃষ্টির মধ্যে সব থেকে সম্মানী ও মর্যাদাবান, তার সব থেকে বড় ইবাদতকারী বান্দা। আল্লাহ তাআলা অন্য কারো জীবনের কসম করেননি, না কোনো ফিরিশতার, না অন্য কোনো নবীর, না অন্য কোনো মানুষের, না কোনো জিনের। জিন-ইনসানের মধ্যে একমাত্র মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর জীবনের কসম করেছেন। এ থেকেও বুঝা যায়, তার মর্যাদা অন্য সকল থেকে বেশি। কারণ কোন কিছুর প্রতি আল্লাহর কসম দ্বারা ওই জিনিসের সম্মান এবং মর্যাদা বুঝায়। ইমাম বাইহাকী বলেন, আল্লাহ যখন অন্য কোনো সৃষ্টির কসম করেছেন যেমন ‘তীন ও যাইতুন’। এই দুই ফলের কসমের দ্বারা বুঝায় ফলসমূহের মধ্যে এ দুই ফল খুবই মূল্যবান।
হাদীসের বিশুদ্ধ কিতাবগুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর একটি হাদীস খুবই প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি বলেছেন, أنا سيد ولد آدم يوم القيامة ولا فخر (আমি কিয়ামতের দিন সকল আদম সন্তানের সরদার। তবে এতে আমার কোনো অহংকার নেই।) ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করেছেন এবং বলেছেন হাদীসটি হাসান গরীব। এই হাদীসে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সম্মানিত অবস্থান সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন। কিয়ামতের ভয়াল দিনে যখন সকল নবী-রাসূলকে আল্লাহর ভয় আতঙ্কিত করে রাখবে, ভয়-ভীতি যখন সকলকে আচ্ছন্ন করে রাখবে একমাত্র আমাদের নবী ব ভয়ের মধ্যে থাকবেন না, কোনো আতঙ্ক তাকে আচ্ছন্ন করবে না। কারণ, সেই দিন হবে তাঁর। কেননা এই কঠিন দিনে আল্লাহ তাআলা তাঁর হাবীবকে গোটা সৃষ্টির সামনে সম্মান এবং মর্যাদার আসন দান করবেন। (আমার জীবন তাঁর জন্য কুরবান হোক)।
কিয়ামতের এই কঠিন সময়ে নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলবেন,أنا خطيبهم إذا أنصتوا (সবাই যখন চুপ থাকবে তখন আমি তাদের হয়ে কথা বলবো)। কিয়ামতের দিন সকল মানুষ নেককার, ওলী-আউলিয়া, আলিমগণ, রাসূলগণ এবং সকল নবীগণ আল্লাহর সামনে চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবেন। একমাত্র মুহাম্মদ ব ছাড়া আর কেউ কথা বলতে পারবে না। সেদিন তিনি বলবেন-
أنا خطيبهم إذا أنصتوا، وأنا مبشرهم إذا أيسوا، لواء الحمد بيدى وخزائن المفاتيح عندي
সবাই যখন চুপ থাকবে তখন আমি তাদের হয়ে কথা বলবো, সবাই যখন নিরাশ হয়ে যাবে তখন আমি তাদেরকে সুসংবাদ দিবো, সেদিন প্রশংসার পতাকা থাকবে আমার হাতে, সকল চাবির ভা-ার থাকবে আমার হাতে। অন্য বর্ণনায় আছে, জান্নাতের চাবিসমূহ থাকবে আমার হাতে।
মুহাদ্দিসগণ জানেন, এই হাদীসটি তার অন্যান্য শাওয়াহেদের কারণে হাসান হওয়ার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই।
আমি এখন আপনাদেরকে আমাদের নবীজি বসহ অন্যান্য নবী-রাসূলগণের সাথে সম্পর্কিত একটি মাসআলায় নিয়ে যেতে চাই। সেটা হচ্ছে, হায়াতুল আম্বিয়া তথা ইন্তিকালের পর কবরে নবীগণের জীবিত থাকার বিষয়টি। ইন্তিকালের পর নবীগণ কবরে জীবিত থাকা এবং তাদের দেহ মুবারক যেভাবে দাফন করা হয়েছিল সেভাবে অক্ষত অবস্থায় থাকার বিষয়ে বিশ্বাস রাখা আবশ্যক। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র আকীদা হলো- ইন্তিকালের পর নবীগণ তাদের কবরে স্বশরীরে জীবিত থাকায় বিশ্বাস করা। তাদের দেহ মুবারক মাটি খেতে পারে না।
যেসকল মাসআলায় মুসলমানদের ইমামগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন সেসকল মাসআলা একত্রিত করে ইমাম ইবন হাযম (র.) ‘মারাতিবুল ইজমা’ নামে কিতাব সংকলন করেছেন। এমনকি যে ব্যক্তি এ কিতাবের মাসআলাগুলোর বিপরীত বিশ্বাস রাখবে তিনি তাকে কাফির মনে করতেন। এ কিতাবে তিনি লিখেন, যে মাসআলাগুলোর উপর মুসলমানদের ইজমা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম হলো, সকল নবীর দেহ মুবারক তাদের কবরে অক্ষত অবস্থায় আছে। মাটি তাদের পবিত্র দেহগুলো খেতে পারে না বা পরিবর্তন করতে পারে না। কিয়ামত পর্যন্ত তাদের শরীর এভাবেই অক্ষত থাকবে। কুরআন সুন্নাহর দলীলও একথা প্রমাণ করে।
কুরআন কারীমে আছে,
فَلَمَّا قَضَيْنَا عَلَيْهِ ٱلْمَوْتَ مَا دَلَّهُمْ عَلَىٰ مَوْتِهِ إِلَّا دَابَّةُ ٱلْأَرْضِ تَأْكُلُ مِنسَأَتَهُ فَلَمَّا خَرَّ تَبَيَّنَتِ ٱلْجِنُّ أَن لَّوْ كَانُواْ يَعْلَمُونَ ٱلْغَيْبَ مَا لَبِثُواْ فِى ٱلْعَذَابِ ٱلْمُهِينِ
যখন আমি সুলাইমান (আ.) এর মৃত্যু ঘটালাম তখন মাটির পোকারাই জিনদেরকে তার মৃত্যু সম্পর্কে অবহিত করল। সুলাইমান (আ.) এর লাঠি খেয়ে যাচ্ছিল। যখন তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন তখন জিনেরা বুঝতে পারল যে, অদৃশ্য বিষয়ের জ্ঞান থাকলে তারা এই লাঞ্চনাদায়ক শাস্তিতে আবদ্ধ থাকত না। (সূরা সাবা, আয়াত-১৪)
সায়্যিদুনা আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন সায়্যিদুনা সুলাইমান (আ.) যখন ইন্তিকাল করেন তখন তিনি তার লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পুরো এক বছর কেটে গেল তিনি লাঠির উপর ভর দিয়ে দ-ায়মান ছিলেন। তার সামনে জিনরা কঠোর পরিশ্রমে কাজ করছিল। তারা মনে করেছিল সুলাইমান (আ.) এখনও জীবিত আছেন। অতপর মাটি যখন তার লাঠিকে খেয়ে ফেলল তখন তিনি যমীনে লুটে পড়লেন। জিনরা এ অবস্থা দেখে বুঝতে পারলো তারা গাইব জানে না। আমাদের শায়খ ইমাম হাফিয সায়্যিদ আব্দুল্লাহ ইবনস সিদ্দীক আল গুমারী (র.) তার ‘দালালাতুল কুরআনিল মুবীন আলা আন্নান নাবিয়্যা আফদালুল আলামীন’ কিতাবে লিখেন, এই আয়াত প্রমাণ করে ইন্তিকালের পরও নবীগণের দেহের কোন পরিবর্তন হয় না। কেন? কারণ, নবী সুলাইমান (আ.) মৃত্যুর পর এমন এক অবস্থায় ছিলেন যা মৃত্যুর পর কোন মানবীয় শরীরের পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। কেননা, মৃত্যুর পর মানবীয় শরীর পরিবর্তিত হয়, ধ্বংস হয়, অথবা কোনোকিছু খেয়ে ফেলে। কিন্তু নবীগণ অন্যান্য মানুষের মতো নন। হ্যাঁ! তারা মানুষ, তবে সকল গুণাবলির দিক থেকে অন্যান্য মানুষের মতো নয়। এখানে দেখা যায়, হযরত সুলাইমান (আ.) এর শরীর পূর্ণ এক বছর রৌদ্রের মধ্যে ছিল, রাত-দিন অতিবাহিত হয়েছে, শীত-গরম অতিবাহিত হয়েছে, আবহাওয়ার বিভিন্ন পরিবর্তন হয়েছে কিন্ত তার শরীরের কোন পরিবর্তন হয়নি।
হায়াতুন নবী সম্পর্কে সুন্নাহর দলীল হলো, ইমাম আহমদ এবং ইমাম আবূ দাউদ (র.) বিশুদ্ধ সনদে নবী করীম ব থেকে বর্ণনা করেন, নবীজি ইরশাদ করেন, তোমাদের দিনসমূহের মধ্যে সব থেকে উত্তম হলো জুমুআর দিন। কেননা এই দিনে হযরত আদম (আ.) কে সৃষ্টি করা হয়েছে, এই দিনে তার ইন্তিকাল হয়েছে, আর এই দিনেই শিংগায় ফুৎকার দেওয়া হবে। এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ ব বললেন, সুতরাং তোমরা এই দিনে আমার উপর বেশি বেশি দরূদ পাঠ করো। কারণ তোমাদের দরূদ আমার নিকট পেশ করা হয়। সাহাবায়ে কিরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম! আমাদের দরূদ আপনার কাছে কিভাবে পেশ করা হবে, অথচ আপনি (ইন্তিকাল ও দাফনের পর) নিঃশেষ হয়ে যাবেন? সাহাবায়ে কিরাম প্রথমে এরূপ ধারণা করেছিলেন। তাই তারা প্রশ্ন করেছেন। তাদের প্রশ্নের প্রেক্ষিতে নবীজির জবাব কেমন ছিল? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদেরকে বললেন,
إن الله حرم على الأرض أجساد الأنبياء
-আল্লাহ তাআলা নবীগণের দেহ ভক্ষণ করাকে মাটির জন্য হারাম করে দিয়েছেন।
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন আমাদের জন্য মহান এক বরকত। তিনি আমাদের শাফাআতকারী। তাকে আল্লাহ তাআলা এমন অনেক কিছু দিয়েছেন যা সৃষ্টির অন্য কাউকে দেননি। যারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সম্মান এবং মর্যাদা সম্পর্কে অবগত নয় তারা তাকে শুধুমাত্র একজন নবী মনে করে, যিনি রিসালত নিয়ে এসেছেন এবং আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, অতঃপর ইন্তিকাল করেছেন। এর মাধ্যমে তার দায়িত্ব শেষ হয়ে গেছে। আহ! কত নিকৃষ্ট এমন মনোভাব, কত নিকৃষ্ট এমন ধারণাকারী, আর কত নিকৃষ্ট এ আকীদা-বিশ্বাস। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের বিশ্বাস হলো, নবী কারীম ব তাঁর ইহকালীন জীবনে উম্মতের সাথে ছিলেন, ইন্তিকালের পরও আছেন, কিয়ামত পর্যন্ত থাকবেন এমনকি জান্নাতেও তিনি তার উম্মতের সাথে থাকবেন। তার সকল উম্মতকে জান্নাত এবং আল্লাহর সন্তুষ্টিতে প্রবেশ না করিয়ে তিনি উম্মতকে ছেড়ে যাবেন না।
নবীজি তাঁর ইহকালীন জীবনে উম্মতের কা-ারী ছিলেন। যেমন কুরআন কারীম আমাদেরকে বলছে,
النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ
-নবী করীম ব মুমিনদের নিকট তাদের নিজেদের অপেক্ষা আরো অধিক ঘনিষ্ঠতর।
নবী করীম ব ইরশাদ করেন,
أنا أولى بالمؤمنين، من ترك مالا فلورثته ومن ترك دينا أو ضياعا فإليّ وعليّ-
-আমি মুমিনদের কাছে সব থেকে অধিক ঘনিষ্ঠ। তাই কোন মুমিন যদি ধন-সম্পদ রেখে মারা যায় তাহলে তার সম্পদ উত্তরাধিকারীদের, আর যদি কেউ ঋণ রেখে অথবা অসহায় পরিবার-পরিজন রেখে মারা যায় তাহলে সেটা আমার দায়িত্বে এবং তারা যেন আমার কাছে আসে।
ইন্তিকালের পরেও النَّبِيُّ أَوْلَىٰ بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنفُسِهِمْ এই আয়াতের ব্যাপকতার ভিত্তিতে নবীজি আমাদের জন্য অধিক ঘনিষ্ঠ। বিশেষ করে মুসনাদে বাযযারের এই হাদীস থেকেও ইহা বুঝা যায়। ইমাম বাযযার সহীহ সনদে হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আমার জীবন তোমাদের জন্য কল্যাণকর, তোমাদের সাথে কথা বলা হচ্ছে তোমরাও কথা বলছো। আমার ওফাতও তোমাদের জন্য কল্যাণের। কারণ আমার ইন্তিকালের পর তোমাদের আমল আমার কাছে পেশ করা হবে। আমি যদি তাতে ভালো দেখি তাহলে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবো, আর যদি এর বিপরীত কিছু দেখি তাহলে তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করবো।
প্রিয় দ্বীনী ভাইয়েরা! আরবের মানুষদের থেকে অনারবরা দ্বীন ইসলামের খিদমত বেশি করেছেন। আর অনারব মুসলমানরা ইসলামের প্রহরী হিসাবে অবশিষ্ট থাকবেন, হারামাইন শরীফাইনের প্রহরী হিসাবে থাকবেন। এই সমাবেশ থেকে আমি আপনাদেরকে দৃঢ়ভাবে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ’র আশআরী ও মাতুরিদী আকীদাকে আঁকড়ে ধরার প্রতি গুরুত্বারোপ করছি। ইলমে তাসাওউফের আদর্শ লালন করার পাশাপাশি চার মাযহাবকে আঁকড়ে ধরার প্রতি গুরুত্বারোপ করছি। আমার আহলুস সুন্নাহর কর্মীবৃন্দ, ছাত্র ভাই এবং উলামায়ে কিরামকে সন্ত্রাসী চিন্তা-চেতনা থেকে সতর্ক থাকার আহবান জানাচ্ছি। যারা মানুষকে দ্বীন থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। সতর্ক করছি তাদের থেকে, যারা সাহাবায়ে কিরামের সমালোচনার মাধ্যমে অথবা আল্লাহর যাত-সিফাত সম্পর্কে দেহবাদী কথাবার্তার মাধ্যমে অথবা চার মাযহাবের বিরুদ্ধে কথা বলার মাধ্যমে মুসলমানদের আকীদা-বিশ্বাস নিয়ে খেলা করে। আমি উলামায়ে কিরাম ভাইদেরকে ভ্রান্ত শিয়া, ওয়াহাবী এবং মুজাসসিমাসহ সকল বাতিল আকীদা থেকে মুসলমানদের আকীদাকে নিরাপদ রাখার প্রতি গুরুত্বারোপ করছি। যে সকল ভ্রান্ত আকীদা একজন মুসলমানকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআত থেকে বের করে দেয়, তাদের থেকে সতর্ক থাকার আহবান করছি।
আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের এই একত্রিত হওয়াকে বরকতময় এবং ক্ষমাময় বানিয়ে দেন। হে আল্লাহ! আমাদেরকে ক্ষমা করে দিন, আমাদের সকলের জীবনের পরিসমাপ্তিকে সুন্দর বানিয়ে দিন। দরূদ ও সালাম পেশ করছি সায়্যিদুনা মুহাম্মদ ব এর প্রতি, তাঁর পরিবারবর্গ এবং সকল সাহাবীর প্রতি।
আমি আল্লামা আব্দুল লতিফ ফুলতলী (র.) এর সন্তানগণের প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপন করছি। বিশেষ করে, মুরশিদে কামিল (হযরত বড় ছাব), মুফতী ছাহেব, শায়খ হুছামুদ্দীন ছাহেবসহ তাদের সম্মানিত সকল ভাইয়ের শুকরিয়া আদায় করছি।
صلى الله على سيدنا محمد وعلى آله وصحبه أجمعين، والحمد لله رب العالمين.
[প্রবন্ধটি আন্তর্জাতিক শানে রিসালত মহাসম্মেলন- ২০১৭ এ প্রদত্ত ভাষণ থেকে অনুবাদ করেছেন মুহাম্মদ মাহমুদুল হাসান]