নবী মুস্তাফা সা. এর জন্মের পূর্বে মানবজাতির ধর্মীয় বিশ্বাস, কর্ম ও চরিত্রের যে ভয়ঙ্কর অধঃপতন ঘটেছিল, আর তাঁর দাওয়াতের মাধ্যমে অল্প সময়ের মধ্যে সেই পরিস্থিতির যে উন্নতি ও সংস্কার সাধন হয়েছিল— তা যিনি জানেন, তার মধ্যে এই বিশ্বাস আরো শক্তিশালী হবে যে, আল্লাহ পাক নবীজি eকে অবশ্যই জগতসমূহের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। সে সময়ের পরিবেশ ছিল জাহিলিয়াতে গভীরভাবে নিমজ্জিত, নিজেদের তৈরি মূর্তির পূজায় মগ্ন, তারা বিশ্বাস করতো ফিরিশতাগণ আল্লাহর কন্যা — আল্লাহ এসব থেকে পবিত্র, লুটতরাজকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করাকে মোটেও খারাপ কিছু বলে মনে করতো না, কন্যা সন্তান যুদ্ধে বন্দী হলে সম্ভ্রম হানি হবে এই ভয়ে কিংবা রিযকের ভয়ে তারা তাদের কন্যা সন্তানকে জীবিত দাফন করতো, একই সাথে এক মহিলার সাথে একাধিক পুরুষ মিলিত হয়ে তারপর চেহারার সাদৃশ্য বিবেচনায় “বৈধ পিতা” নির্ধারণ করাকে বৈধতা দিতেও তাদের কোন আপত্তি ছিল না। এমনকি বলা হয়ে থাকে, বনী হানীফা গোত্র একবার এক ধরনের খাদ্যদ্রব্যকে তাদের উপাস্য নির্ধারণ করে বহুকাল উপাসনাও করেছিল, পরে ক্ষুধার্ত হয়ে সেই উপাস্যকেই তারা খেয়ে ফেলে!
আর এই পরিবেশের পাশাপাশি আরো বহু জাতি ছিল, যারা বিভিন্ন বিকৃত ধর্ম পালন করতো, যেমন একদল ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করতো, এবং বলতো– তিনই এক, আল্লাহর পুত্রকে হত্যা করা হয়েছে এরপর তাকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে, এবং তিনি তার পিতার (তথা আল্লাহ তাআলার) পাশে বসেছেন। অথচ আল্লাহ এসব থেকে পবিত্র। আর তাদের ধর্মগুরুরা তাদের জন্য জান্নাতের ভূখণ্ড ক্রয় করে দিতো, আর নিজেদের উপাস্যদের নিয়েই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতো।
আরেক দল বিশ্বাস করতো, আল্লাহ হচ্ছেন শুভ্রকেশ বিশিষ্ট এক বৃদ্ধ, যিনি আসমানে তাঁর সিংহাসনে উপবিষ্ট, আর সৃষ্টি জগৎ সৃষ্টি করার ক্লান্তির কারণে তিনি শনিবারে চিত হয়ে এক পায়ের উপর আরেক পা তুলে শুয়ে বিশ্রাম নেন। তাদের এসব মিথ্যা কল্পনা থেকে আল্লাহ পাক পবিত্র।
আরেকদল হলো সাবিঈ ধর্মের অনুসারী, যারা বিভিন্ন জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক বস্তুসমূহকে নিজেদের উপাস্য বলে বিশ্বাস করতো এবং সূর্য ছিল তাদের প্রধান উপাস্য। আবার হাররানিয়াগণ বিশ্বাস করতো স্রষ্টা একজন, তবে অসংখ্য! অর্থাৎ আসলে একজন, কিন্তু মানুষের দৃষ্টিতে বহু সত্তা আছে, তিনি বিভিন্ন সত্তা হিসেবে প্রকাশিত হন, এবং এই বহু সত্তার মাধ্যমে প্রকাশ লাভের ফলে তার একত্ববাদ নষ্ট হয় না। তাদের এসব অংশীদারি থেকে আল্লাহ পাক পবিত্র।
এদিকে অগ্নি উপাসক মাজুসিগণ বিশ্বাস করতো স্রষ্টা মূলত দুই জন, ভালো সবকিছুর স্রষ্টা হলেন আলো, আর মন্দ সবকিছুর স্রষ্টা হলেন অন্ধকার।
এরকম বহু বিশ্বাসে বিভক্ত ছিল হিজায এবং তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহ — ফিলিস্তিন, শাম, ইরাক, রুম, পারস্য, ভারতীয় উপমহাদেশ, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে শুরু করে পৃথিবীর সর্বত্র, সর্বশেষ রাসূলের আগমণের প্রাক্কালে এমনই পুরো পৃথিবীর অবস্থা। মানবেতিহাসে এরচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন, এর চেয়ে কালো যুগের দৃশ্য আর কী হতে পারে!
বিজ্ঞজনের নিকট এমন আরো বহু ভ্রান্ত ধারণার ইতিহাস অজানা নয়, যা আমরা এখানে উল্লেখ করিনি। এমন পরিস্থিতিতে হাশিমী আবতাহী নবী সালাওয়াতুল্লাহি ওয়া সালামুহু আলাইহি— ইসলামের দাওয়াত শুরু করলেন। তিনি এমনভাবে প্রমাণসহ দাওয়াত দিলেন, যাতে বিরোধীরা কোন আপত্তি তুলতে না পারে, এমন পদ্ধতিতে তিনি মানুষের বিবেককে জাগ্রত করে তুললেন, যা সাধারণ মানুষের মাথার উপর দিয়ে যায় না, আবার বিশিষ্টজনের নিকটও অগ্রাহ্য মনে হয় না, তিনি তার পালনকর্তার প্রতি মানুষকে প্রজ্ঞা আর সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে ডাকলেন, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নিকট তাদের মতবাদের চেয়ে উত্তম মতবাদ পেশ করলেন, এক পর্যায়ে সকলে তার অনুসারী হয়ে উঠলো। তিনি তাদেরকে শিক্ষা দিলেন আল্লাহ সম্পর্কে কোন কোন বিশ্বাস রাখা যাবে, আর কোন কোন বিশ্বাস রাখা যাবে না, তাদেরকে বুঝিয়ে দিলেন আল্লাহ পাককে সব ধরনের সৃষ্টির সাদৃশ্য থেকে পবিত্র রাখার অপরিহার্যতা, শিখিয়ে দিলেন আমলের পদ্ধতি, তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিলেন উত্তম স্বভাবের, আর সকলকে জ্ঞান, সৎকর্ম, চরিত্র ইত্যাদির প্রতি এমন ধারাবাহিক অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত করলেন, এমন অনুপ্রেরণা, যা মোটেও অস্থিতিশীল নয়, বরং উপযুক্ত ক্ষেত্রে করুণাময়ী, আবার উপযুক্ত ক্ষেত্রে কঠোর, ফলশ্রুতিতে তার সে দাওয়াত সেই সীমিত পরিসর অতিক্রম করে দিগ্-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়ে ইসলামের সুমহান বার্তা, প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জাতি গ্রহণ করে নেয় তারই প্রদর্শিত আদর্শকে।
তার এই বরকতময় দাওয়াত আর শুভ জাগরণের ফলে জগৎজুড়ে যে কল্যাণ ছড়িয়ে পড়ে, এতো অল্পসময়ে বৃহৎ পরিসরে এমন জাগরণের কোন নযীর পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যায় না। এ বিষয়ে চিন্তা করলে বিশ্বাসের দৃঢ়তা বৃদ্ধি পায়, আর মহানবীর শরীআতের মধ্যে খোঁজে পাওয়া যায় এমন সব মুজিযা, যা কিনা যুগে যুগে যেন নতুন করে প্রকাশিত হয়, অভ্যন্তর এবং বাইরে থেকে তার প্রদর্শিত পথকে বিকৃত করার অপচেষ্টা সত্ত্বেও।
এই উম্মত নববী দাওয়াত থেকে যা অর্জন করেছে, তার মূলকথা হলো, আল্লাহ সম্পর্কে এবং তার সকল সিফত সম্পর্কে জ্ঞান, ইবাদত ও মুআমালাত সম্পর্কে সেই সকল হুকুম-আহকামের জ্ঞান, যাকে কেন্দ্র করে এ উম্মতের আত্মিক সংস্কৃতি পরিচালিত হয়, ন্যায় প্রতিষ্ঠা হয়, উত্তম বৈশিষ্ট্য অর্জন ও নিকৃষ্ট মানসিক বৈশিষ্ট্য থেকে মুক্ত হওয়ার উপায়সমূহের জ্ঞান, যা মানুষকে আত্মা পরিশুদ্ধ করার পথপ্রদর্শন করে, ফলশ্রুতিতে মানুষের নিকট থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোন ধরনের কৃত্তিম প্রচেষ্টা ছাড়াই শুভ কাজসমূহ প্রকাশিত হতে থাকে, আর এর মধ্যদিয়ে ইলমী এবং আমলী পূর্ণতা অর্জিত হয়। (লেখক এখানে মূলত ঈমান, ইসলাম ও ইহসানের (তাসাউফ) প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যার মধ্যদিয়ে মানুষ পূর্ণতা অর্জন করে।- অনুবাদক।) আমি ইমাম ইবন আসাকির (র.) প্রণীত ‘তাবয়ীনু কাযিবিল মুফতারী’ কিতাবের ভূমিকায় নবীর আবির্ভাবের সময়ের সার্বিক পরিস্থিতি বিষয়ে আলোচানায় আমি এসব বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করেছি।
উম্মতে মুহাম্মদীর পূর্বসুরী সালাফগণ এই সঠিক দ্বীনকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরতেন, ইলম ও আমলের ক্ষেত্রে এই দ্বীন থেকে সুফল লাভের জন্য সাধ্যের সবটুকু উজাড় করে দিতেন। তাদের দেশ জয়, মানুষের নিকট হিদায়াতের বাণী পৌঁছে দেওয়া, বিভিন্ন শাস্ত্রে তাদের রচিত অমর গ্রন্থাবলি প্রভৃতি পর্যালোচনা করলে যে কারো নিকট এ বিষয়টি সহজেই প্রতীয়মান হবে, এসব কিছু সগৌরবে তাদের স্বপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করে। অন্যদিকে সেই সালাফগণেরই উত্তরসূরীগণ নিজেদের ঐতিহ্যকে হারিয়েছে, বিজাতির সাথে মিশে যেতে শুরু করেছে, যার ফলে তারা হেয় প্রতিপন্ন হচ্ছে, অপদস্থ হচ্ছে, এমনকি এই সুদৃঢ় ধর্ম আর প্রজ্ঞাময় শরীআত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া আর কোন শক্তি নেই— আমরা আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করি যেন তিনি আমাদের এই গাফিলতী থেকে জাগ্রত করেন, সুপথ প্রদর্শন করেন। তার নিকট প্রার্থনা করলে তিনি তো সাড়া দেন।
(ইমাম যাহিদ কাওসারী ঈদে মীলাদুন্নবী উপলক্ষ্যে তৎকালীন একটি সাময়িকীতে এ প্রবন্ধটি লিখেন, যা পরবর্তীতে মাকালাতুল কাওসারী নামক গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে। মাসিক পরওয়ানার পাঠকদের জন্য এ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন মুহাম্মাদ ইবন নূর। — সম্পাদক)