1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
হজ্জের শিক্ষা
মাওলানা মুহম্মদ ফরীদুদ্দীন আত্তার (র.)
  • ৩ জুন, ২০২৫

হজ্জের শিক্ষা

মাওলানা মুহম্মদ ফরীদুদ্দীন আত্তার (র.)

যদিও মিল্লাতে ইবরাহীমীর অন্তর্গত বিত্তবান মুসলমানের  জীবনে একবার হজ্জ ফরয, তথাপি হজ্জের গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য সর্বসাধারণ বিশ্ব মুসলমানের অন্তরে কম চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে না। ইসলাম বিশ্বধর্ম- মানবধর্ম। মুসলমান কোনোদিন নিজেকে জগৎ ও জীবন থেকে আলাদা করে দেখে না। মুসলমানদের উপাসনা-আরাধনা, ধর্ম-কর্ম সবকিছুই বিশ্বব্যাপী ও সর্বকালের স্রষ্টা যেমন এক-অদ্বিতীয়, সৃষ্টিও তেমন এক অবিচ্ছেদ্য। কাজেই মুসলমানের ধর্ম-কর্মে, শিক্ষায় ও দর্শনে সর্বব‍্যাপী উদ্যম-উদ্দীপনা। হজ্জ মুসলমানের এমন একটি ইবাদত যাতে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে মুসলিম মানসের লালিত স্রষ্টার ভালোবাসা ও সৃষ্টির সাথে একাত্মতা।

হজ্জ আল্লাহ প্রেমের একটি বড় নিদর্শন। অকাতরে অঢেল অর্থ-সম্পদ ব্যয় করে বিত্তবান মুসলমানগণ দুনিয়ার দিকবিদিক থেকে ছুটে আসে মক্কায়, মিনায়, মুযদালিফায়, আরাফাতে। সবার মুখে একই তাকবীর-তালবীয়াহ- লাব্বাইক, আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! আল্লাহ আমি হাযির। আল্লাহ আমি হাযির। সকলের পোশাক এক, ভাষা এক, ইবাদত-বন্দেগী এক। দেশের দূরত্ব, ভাষার বৈচিত্র, রঙ ও বর্ণের বিভিন্নতা, বয়সের তফাত, নারী-পুরুষের বিভেদ, অর্থ-সামর্থ্যের বৈষম্য কোনো কিছুই হাজীদের মহা মিলনের পথে বাধা হয়নি। আল্লাহ প্রেমের আকর্ষণে একাত্ম হয়ে যায় সকল মানুষ। ভুলে যায় পার্থিব-জাগতিক সামান্য বিভেদ বৈষম্য। আল্লাহ প্রেম বিশ্বপ্রেম জন্ম দেয়।

আল্লাহর ঘর কাবা-বাইতুল্লাহর তাওয়াফ বা প্রদক্ষিণ করে হাজী বলে, আল্লাহ তুমি আমার মাবূদ, তুমি আমার মাকসুদ। তুমি আমার উপাস্য, তুমি আমার উদ্দেশ্য। দেনা-পাওনা সব তোমার সাথে। তুমি আমার, আমি তোমার। অন্যেরা কেউ আমার আরাধ্যও নয়, অস্পৃশ্যও নয়। তারা-আমরা, আমরা-তারা সবাই তোমার সৃষ্টি, তোমার ইচ্ছার প্রতিফলন। সবাই তোমার নিকট ফিরে যাবো একদিন। কাজেই মুসলমান সারাটা সৃষ্টির সাথে একাত্ম হবার মাধ্যমে স্রষ্টার সন্তোষ লাভ করে। সৃষ্টির সেবায় মুসলমানের অন্তরে কোনো গ্লানি নেই। মুসলমান কারো নিন্দা করে না। পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা করা মুসলমানের ঈমানী কর্তব্য। মিনায় দাঁড়িয়ে হাজী তিনদিন ধরে বড় শয়তান, মেঝো শয়তান ও ছোট শয়তানকে ঢিল ছুঁড়তে থাকেন। এই ঢিল ছোঁড়ার পিছনে রহস্য যে, আমরা পাপকে ঘৃণা করি, অবজ্ঞা করি এবং পুণ্য বা নেকের প্রতি আমাদের আন্তরিক আগ্রহ। ছোট, মেঝো ও বড় শয়তানের প্রতি ঢিল ছোঁড়ার অর্থ সকল প্রকার পাপের প্রতি, অন্যায়ের প্রতি, মিথ্যার প্রতি আমাদের আন্তরিক ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণা রয়েছে। স্রষ্টার প্রেমে সৃষ্টির সেবায় আত্মনিয়োগ করবো। শয়তান যেনো সেখানে আমাদের সাধন পথের বাধন হয়ে না দাঁড়ায়। মনের কুপ্রবৃত্তিসহ কোনো প্রকার শয়তানীর প্রতিই আমাদের কোনো অনুকম্পা নেই। আমরা মনের সমস্ত শক্তি দিয়ে সকল প্রকার শয়তানী শক্তির বিরোধিতা করবো। কষ্মিনকালেও কোনো শয়তানী শক্তির ক্রীড়নক হবো না। একমাত্র আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি বিধানের জন্যই আমাদের যথাসর্বস্ব ব্যয় করবো। আল্লাহ তাআলার সন্তোষ অর্জনই আমাদের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। আল্লাহর খলীলের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে হযরত ইসমাঈল যবীহুল্লাহ আলাইহিস সালামের মত সংকল্পে অটল, অচল-অনড় থাকবো। পার্থিব কোনো লালসা, নেশা আমাদের আল্লাহর পথ থেকে সরিয়ে নিয়ে জাহান্নামের পথে দাঁড় করাতে পারবে না।

আল্লাহর মুহব্বতে মুসলমান তার যাবতীয় উপার্জনকে বিলিয়ে দিতে পারে। এমনকি নয়নমনি, আঁখির পুতুলি, কলিজার টুকরা, নিজের সন্তানকেও অকাতরে যবেহ করতে পারে। হাজী মিনায় পশু কুরবানী করেন, অথচ তাঁর মনের ভাব এমন হয় যে, যদি আল্লাহ তাআলা খুশী হতেন তবে নিজের ছেলে বা নিজের জীবনটাকেও ঐ মুহূর্তে কুরবানী করতে পারতেন। স্রষ্টার প্রতি এরূপ আত্মোৎসর্গ করার মত মনোভাব মুসলমানেরই আছে। আল্লাহর খলীলের ভাষায় হাজী বলেন, আমার যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী, উপাসনা-আরাধনা, এমনকি আমার বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়া- হে বিশ্বপালক, তোমারই জন্য। গোশত খাবার জন্য কুরবানী নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির কাছে জাগতিক সহায়-সম্পদ যে মুসলমানের নিকট তুচ্ছ, তার প্রমাণ দেওয়া, এই যা। আমি তাও আবার খামখেয়ালের বশবর্তী হয়ে নয়, বরং আল্লাহর হুকুমের আনুগত্যের মাধ্যমেই এ সমুদয় বিসর্জন বা কুরবানী। মুসলমান খামাখা সম্পদ নষ্ট করে না, এ কথা যত সত্য, আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যাবতীয় সুখ-সম্পদ ব্যয় করতেও মুসলমান কুণ্ঠাবোধ করে না, এ কথাও সমান সত্য।

আরাফাত! সে তো পরিচয়ের ময়দান। সে যে মানুষ এই তো তার শ্রেষ্ঠ পরিচয়। হজ্জের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিধান আরাফাতের অবস্থান। ৯ই যিলহজ্জ সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত আরাফাতে মানবের মহামিলন। সকল আল্লাহ-প্রেমিকের সম্যক পরিচিতির স্থান। জাবালে রহমতের চূড়া থেকে শুরু করে মসজিদে নুমিরাহ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ আল্লাহ-প্রেমিকের গননবিদারী তালবিয়াহ-তাকবীরের আওয়াযে একই সুর ভেসে আসে ‘আল্লাহ’ আমি হাযির। তোমার ডাকে সাড়া দিতে আমি হাযির। আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ, সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।

ইসলাম যে বিশ্বজনীন, স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক যে অবিচ্ছেদ্য, মানুষে মানুষে যে প্রভেদ নেই, আরাফাতের ময়দানে তা প্রমাণিত হয়। শুধু চিন্তা ও পুস্তকে নয়, হাজী সরেযমিনে বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন করেন আরাফাতে যে, মুমিন-মুমিনের ভাই। মানুষের উপরে সৃষ্টিজগতে আর কিছু নেই। আর এই মানুষ যিনি সৃষ্টি করেছেন এবং বিশ্বময় সকল কিছু সৃষ্টি করে সবকিছু মানুষের কল্যাণে মানুষের বশীভূত করে দিয়েছেন, তিনি না জানি কতো মহান। কতো উদার। এই তো ‘আরাফাত’- এই তো পরিচয়। নিজের পরিচয়ের সাথে সাথে রবের পরিচয় লাভ করে হাজী ভক্তি-বিশ্বাসে আপ্লুত হয়ে মহিমাময়ের দরগাহে যাবতীয় পাপ মুক্তির জন্য প্রার্থনা শুরু করেন। বিশ্বাস যে, যিনি আপন মহিমায় আমাকে মানুষরূপে সৃষ্টি করে জগতে শ্রেষ্ঠত্বের আসন দান করেছেন, নিশ্চয়ই তাঁর অপরিসীম দয়া ও বিভায় আজকের এই মহালগ্নে মানবের মহামিলনে সমুদয় পাপ-তাপ মোচন হয়ে যাবে। হাদীস শরীফে আছে, যে হাজী বিশ্বাস করবে যে আজকের এই মুবারক দিনে নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার সমুদয় পাপ মাফ করে দিয়েছেন, আল্লাহ তাআলা তার সম্মান এতো বৃদ্ধি করবেন যে আরাফাতের ময়দানে যতো লোক সংকুলান হয়, ততো সংখ্যক লোক সেই হাজীর সুপারিশে বেহেশতে প্রবেশ করবে। আর যে হাজী মনে করবে যে, এতো গুনাহ করেছি। কি জানি এতো গুনাহ কী করে মাফ হবে। সে অবশ্যই বেঈমান ও জাহান্নামী হবে।

হযরত ইমাম গাযযালী রাহমাতুল্লাহ আলাইহি হজ্জ যাত্রাকে পরলোক যাত্রার সঙ্গে তুলনা করেছেন। হজ্জ যাত্রার জন্য সকল আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সংসারবাস ত্যাগ করে এক মনে এক ধ্যানে উপযুক্ত পাথেয়সহ যানবাহনে করে রওয়ানা দিতে হয়। স্বজনেরা কিছুটা রাস্তা আল্লাহ-রাসূলের মুহব্বতে এগিয়ে নিয়ে আল্লাহর পথে ছেড়ে দিয়ে আসে। এছাড়া হাজী হজ্জের উদ্দেশ্যে ইহরাম বা মৃত্যুর ন্যায় পোশাক পরে রওয়ানা দেন। ঠিক পরলোক যাত্রীকেও সংসার-স্বজন ত্যাগ করে, কাফন পরে, খাটিয়ায় চড়ে স্বজনের সাথে কবর অভিমুখে যেতে হয় এবং অবশ্যই পরকালের জন্য পাথেয় সংগ্রহ করে নিতে হয়। ইহরামের কাপড় আর কাফনের কাপড়ে আদৌ তফাত নেই। পাপ পথে অর্জিত সহায় সম্পদ যেমন পরকালের সাথি হয় না, ঠিক তেমনিভাবে হারাম রুজির আয়ে হজ্জ হয় না।

আরাফাতের অবস্থান রোজ হাশরের কথা মনে করিয়ে দেয়। হাজী সাহিবান হাশর-নশর, রোয কিয়ামত, নেকী-বদীর হিসাবনিকাশ, হজ্জের যাবতীয় আরকান ও আহকাম সম্পন্ন করার পর হজ্জের শিক্ষা ও আদর্শ নিয়ে দেশে ফিরেন। পাপকে ঘৃণা করা ও নেক কাজে প্রতিযোগিতা করে অগ্রগামী থাকার ইচ্ছা তার প্রবল হওয়া স্বাভাবিক। হজ্জ পার্থিব সুখ-সম্পদের প্রতি অনাসক্তি সৃষ্টি করে এবং একথা সর্বজন স্বীকৃত যে, অনাসক্তি মুক্তির পথ প্রশস্ত করে। হজ্জ ভোগলিপ্সা মিটিয়ে দেয় এবং ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত করে। সর্বোপরি স্রষ্টা ও সৃষ্টির সম্পর্ক উন্নয়নে হজ্জের ভূমিকা অপরিসীম। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হজ্জের শিক্ষা ও সার্থকতা দান করুন। আমীন।

ফেইসবুকে আমরা...