1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
নারী কমিশনের সুপারিশমালা: নারীবাদীদের ইউটোপিয়ান সমাজ ব্যবস্থার স্বরূপ
হামিদ মাশহুর
  • ২ মে, ২০২৫

নারী কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে চলমান বিতর্কে এক ধরণের গণ সচেতনতা ইতোমধ্যেই তৈরি হয়েছে। এ গণ সচেতনতা যতোটা না কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর এক্টিভিজম এর ফলে হয়েছে, তার থেকে বেশি হয়েছে নারীবাদীদের প্রতি এদেশের মানুষের সম্মিলিত অনস্থা ও অবিশ্বাসের ফলে। এই রিপোর্টের বিস্তারিত না জেনেও তাই যে কেউ সিদ্ধান্ত নিতে পারছে যে এটা তাদের জন্য কল্যাণকর কিছু নয়। তারপরও আসলেই এই রিপোর্টে আপত্তিকর কি আছে তা পাঠককে জানানোর অভিপ্রায়ে রিপোর্টটি এক নযর দেখার চেষ্টা করলাম। প্রাথমিকভাবে রিপোর্টটিকে নারীবাদীদের ইউটোপিয়ান সমাজব্যবস্থার দলিল হিসেবেই আমার মনে হয়েছে। আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রথা এগুলাকে কোন গুরুত্ব না দিয়ে কমিশন শতভাগ ফোকাস করেছে আসলে নারীবাদীরা কেমন সমাজ চায় তার উপর। রিপোর্টের শত শত সুপারিশমালার অল্প কয়েকটা পর্যালোচনা করলেই আমরা বুঝতে পারবো আসলে নারীবাদীদের কল্পিত স্বর্গরাজ্যের স্বরূপ। প্রথমেই বলে রাখি, এই কমিশনের রিপোর্টে শব্দের মারপ্যাঁচ থেকেই আপনি বুঝে যাবেন যে আদতে কমিশন চায়নি তাদের রিপোর্টের মাধ্যমে এদেশের নারীদের জন্য উপকারী সর্বজন গ্রহণযোগ্য কিছু আইন পাশ হোক। তারা বরং শব্দের মারপ্যাঁচে নারীবাদী বয়ান প্রচারেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- জেলা, উপজেলা, ও ইউনিয়ন পরিষদের প্রধানকে বহু যুগ ধরেই আমরা “চেয়ারম্যান” হিসেবে জানি। কিন্তু কমিশনের রিপোর্টে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার প্রধানকে বারবার “চেয়ারপার্সন” বলা হয়েছে। এই যে প্রচলিত শব্দকে লিঙ্গ নিরপেক্ষ করার নারীবাদী বিকার এটা আদতে নতুন ভাষা তৈরি ছাড়া সম্ভব নয়। রিপোর্টে বহুবার নারী-পুরষ ছাড়াও “অন্যান্য লিঙ্গ” শব্দদ্বয় ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। এটা পড়ে মনে হবে যেন পুরুষ ও নারী ছাড়াও একাধিক লিঙ্গ রয়েছে। আমরা যারা স্বাভাবিক মানুষ, আমরা জানি পুরুষ ও নারী ছাড়া আর এক শ্রেণীর মানুষই জন্ম নেন, তারা হলেন তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া। কিন্তু এলজিবিটিকিউ (LGBTQ) প্রমোট করার উদ্দেশ্যে যে নানারকম লিঙ্গের কথা আজকাল উচ্চারিত হচ্ছে তারই প্রতিফলন রিপোর্টে নারী-পুরষ ছাড়াও “অন্যান্য লিঙ্গ” বলে তিনের অধিক লিঙ্গকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা। কমিশনের রিপোর্টে বৈবাহিক ধর্ষণ রোধে কার্যকর আইন প্রণয়ন করার সুপারিশ করা হয়েছে। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে যে অল্প-বিস্তর জোরাজুরি কখনো কখনো হয়ে থাকে সেটাকে কাঠামোবদ্ধ আইনের মাধ্যমে অবৈধ ঘোষণা করা। এর অর্থ হলো স্ত্রীর ‘কনসেন্ট’ ছাড়া কোনভাবেই নিজের বিবাহিত স্ত্রীর সাথে অন্তরঙ্গ হওয়া যাবে না। এখন প্রশ্ন হলো এই কনসেন্ট কি লিখিত হবে নাকি মৌখিক হবে? মৌখিক হলে তো পরে যেকোন কারণে স্ত্রী তা অস্বীকার করতে পারেন এবং স্বামীকে কোন অসৎ উদ্দেশ্যে ফাঁসিয়েও দিতে পারেন। তাহলে আমাদের কাছে অপশন বাকি থাকলো শুধু স্ত্রীর নিকট লিখিত কনসেন্ট নিয়ে অন্তরঙ্গ হওয়া। এই যে কনসেন্ট বিষয়ক মুখরোচক আলোচনার মাধ্যমে বিবাহিত সম্পর্কের মধ্যে জটিলতা তৈরি করা, এটা করে নারীবাদীদের কি লাভ তা বুঝতে হলে আপনাকে জানতে হবে বহুবিবাহ নিয়ে উনাদের সুপারিশ। রিপোর্টে সুপারিশ করা হয়েছে বহুবিবাহ নিরুৎসাহিত করতে আইন করতে হবে এবং বহুবিবাহের ক্ষেত্রে স্ত্রীর যথাযথ অনুমতি গ্রহণ অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। সহজভাবে আমি ‘কনসেন্ট’ বিষয়ক সুপারিশের সাথে ‘বহুবিবাহ’ বিষয়ক সুপারিশকে মিলিয়ে পড়লে যেটা বুঝতে পারি, স্ত্রী যদি স্বামীর জৈবিক চাহিদা পূরণে অক্ষম হন অথবা কনসেন্ট না দেন, তারপরও স্বামীর জন্য আরেকজন স্ত্রী গ্রহণ বৈধ হবে না যতক্ষণ না তার অক্ষম স্ত্রী দয়াপরবশ হয়ে স্বামীকে আরেকটি বিয়ের কনসেন্ট দেন। আর আমরা সবাই জানি অক্ষম স্ত্রীরাও স্বামীকে পুনরায় বিয়ের অনুমতি দেওয়া কার্যত অসম্ভব, ইম্প্র্যাক্টিক্যাল। তাহলে অবস্থা দাঁড়ালো স্ত্রীর সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার কনসেন্ট পাওয়া গেলো না, নতুন বিয়ের কনসেন্টও পাওয়া গেলো না। তাহলে বেচারা পুরুষ লোকের হবেটা কি? হতাশ হবেন না। আমাদের নারীবাদীরা এতোটাও নিষ্ঠুর না। পুরুষদের উপকারের জন্য উনারা সুপারিশ করছেন যেন যৌনকর্মীরা শ্রমিকের মর্যাদা পান। একজন পুরুষের জন্য বিবাহিত স্ত্রীর থেকে উপকৃত হওয়ার, অথবা বহুবিবাহ করে বৈধভাবে উপকৃত হওয়ার রাস্তা কঠিন করে আমাদের নারীবাদীরা সহজ করছেন যেন পুরুষ মানুষ বৈধভাবে যৌনকর্মীদের থেকে “উপকৃত” হতে পারেন। ‘কনসেন্ট’ বিষয়ক আইনের মারপ্যাঁচ, বহুবিবাহ কঠিন করা এবং ডিভোর্স আইনকে কঠোর করার মাধ্যমে প্রায়োগিকভাবে যেটা হবে তা হলো পুরুষরা বিয়ের ক্ষেত্রে অত্যন্ত খুঁতখুঁতে হবেন, অধিক বয়সী নারীদের বিয়ে থেকে বিরত থাকবেন এবং সকল বিয়েতেই সহজ ডিভোর্সের উপায় হিসেবে দেনমোহর কম ধার্য্য করার চেষ্টা করা হবে। সকল পুরুষই যখন কালেক্টিভলি এই কাজ করবেন তখন একটু বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে হওয়া তো কঠিন হবেই, অল্প বয়সী মেয়েদের বিয়ের ক্ষেত্রেও প্রত্যাশিত দেনমোহর পাওয়া কঠিন হবে। আর ‘কনসেন্ট’ ইস্যুর বাড়াবাড়ি ডিভোর্সের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি করবে। এই পুরো ব্যবস্থায় লাভবান হবে শুধু যৌনকর্মীরা। তাদের ব্যবসার যে সম্ভাবনা এতে তৈরি হবে তার সাথে যদি যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ে নারীবাদীরা সফল হন, তাহলে নিশ্চিতভাবেই প্রস্টিটিউশন একটা বিশাল সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে, আর বলাই বাহুল্য এই ইন্ডাস্ট্রির কর্ণধার হবেন আমাদের নারীবাদীরা। দয়াবান নারীবাদীরা নিজেদের ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিতে আরেকটি সুপারিশ করেছেন- তারা দাবি করেছেন যেসব নারী তার সন্তানের পিতৃপরিচয় প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক তাদের সন্তানদের শুধু মায়ের নামেই যাবতীয় রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করতে হবে, অর্থাৎ মানব সন্তানের পরিচয়ে বাবার নাম অপশনাল করতে হবে। যৌনকর্মীদের নিয়ে ইন্ডাস্ট্রি গড়তে এর থেকে ভালো সুপারিশ আর কিছু হতেই পারে না! রিপোর্টে যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতির ব্যাপারে যতোটা গুরুত্ব দিয়ে আলাপ করা হয়েছে সে তুলনায় এদেশের কোটি কোটি গৃহিণীদের সম্পর্কে রিপোর্টে তেমন কোন আলাপ নেই বললেই চলে। আমাদের অনেকেরই জানা আছে পশ্চিমের সাথে আমাদের সমাজের সবচেয়ে বড় ফারাক ওয়েস্ট বহু আগে থেকেই ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক সমাজে পদার্পণ করলেও আমাদের সমাজ এখনো কালেক্টিভিস্ট। আমাদের সমাজে এখনো একান্নবর্তী পরিবার প্রচুর পাওয়া যায়। এই সমাজে এখনো পরিবারের এক বা দুইজন সদস্য সবার জন্য রান্না করেন, গৃহস্থালির সকল কাজ করেন। আমাদের গৃহিণীদের এসব কাজের বিপুল অর্থমূল্য পশ্চিমে তো রয়েছেই, যেকোন সমাজেই রয়েছে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা কোটি কোটি নারীর এই কাজের অর্থমূল্যকে যথাযথভাবে অর্থনৈতিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করতে পারিনি, ফলে আমাদের একটা বিপুল জনগোষ্ঠীর উৎপাদনমুখী কর্মজজ্ঞ জিডিপির হিসাবের বাইরেই রয়ে গিয়েছে। এতো এতো রেডিক্যাল ফেমিনিস্ট ধারার সুপারিশের মধ্যে চাইলেই নারী কমিশন সুপারিশ করতে পারতো গৃহস্থালীর কাজের যথাযথ অর্থমূল্য জিডিপিতে হিসাব করতে হবে। তারা তা করেননি, কারণ গৃহিণী হওয়া তাদের জন্য অভিশাপ আর যৌন শ্রমিক হওয়া অপরচুনিটি।

আমাদের নারীবাদীরা নারীর প্রতি বৈষম্যমুক্ত সমাজের প্রচারণার আড়ালে যে আদতে একটি নারীতান্ত্রিক বা নারী শাসিত সমাজের স্বপ্ন দেখেন এটা বুঝা যায় তাদের রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ বিষয়ক সুপারিশ থেকে। সেখানে তারা দাবি করছেন সংসদ হবে ৬০০ আসনের। যার অর্ধেক হবেন নারী, এবং বাকি অর্ধেক হবেন নারী-পুরুষের সমন্বয়ে, অর্থাৎ যিনি জিতবেন তিনি। সহজ করে বললে তিনশত আসনে নিশ্চিতভাবেই নারীরা থাকবেন আর বাকি তিনশত আসন থেকেও পুরুষের সাথে কম্পিটিশন করে নারীরা আসতে পারবেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে এর মাধ্যমে মূলত জাতীয় সংসদের মতো জায়গায় নিশ্চতভাবেই পুরুষদের মাইনোরিটি হিসেবে রাখার সুপারিশই করা হয়েছে। এদেশের একটা বিপুল সংখ্যক নারীদের যেখানে ন্যূনতম রাজনৈতিক সচেতনতা আছে কি না তাই আলোচনাসাপেক্ষ, সেখানে নারী শাসিত সংসদের সুপারিশ করা আসলে এই কমিশনের সদস্যদের মশকরা। এসব নারীবাদীরা যে নারীকে তোয়াজ করে নুইয়ে পড়তেন সে নারী ফ্যাসিস্টকে আমরা ভুলিনি। জুলাইয়ের শহীদদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে উনাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো উনারা তা সিরিয়াসলি না নিয়ে এটাকে ঠাট্টা-তামাশার বস্তুতে পরিণত করেছেন। নারী কমিশনের সুপারিশে বারবার আলোচিত হয়েছে বিভিন্ন ধর্ম ভিত্তিক পারিবারিক আইন সংশোধন করে নারী-পুরুষের সম্পদ প্রাপ্তির সমতা, ডিভোর্সের সমতা ইত্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। ইউনিফর্ম ফ্যামিলি ল পাশ করে তা পালন করা ঐচ্ছিক হিসেবে রাখার যে সুপারিশ করা হয়েছে তা আপাতদৃষ্টিতে নিরীহ মনে হলেও আসলে এটি অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটি চালাকি। আমরা সবাই জানি ধর্মীয় নৈতিকতাবোধ থেকেই বিবাহের চর্চা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ বিয়ে কোন রাষ্ট্রীয় আইন হিসেবে সমাজে প্রচলন হয়নি, প্রচলন হয়েছে ধর্মীয় আইন হিসেবে। বিয়ে নামক এই ধর্মীয় বন্ধনের মাধ্যমেই পরিবারের সূচনা হয়েছে। অর্থাৎ বিয়ে এবং পরিবারের বুনিয়াদই হলো ধর্ম। আধুনিক জাতি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রাষ্ট্র সেসব ধর্মীয় বিধানকে আত্মিকরণ করে বিয়ে এবং পরিবার নামক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। যেসব মানুষ ধর্মে বিশ্বাসী নয় তারা আসলে বিয়ে নামক এই ধর্মীয় অনুশাসন মানারই কথা না। তারপরও ধর্মে বিশ্বাসী নয় এমন লোকজনের জন্য বিশেষ বিবাহ আইন, ১৮৭২ এর মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার সুযোগ আছে। সুতরাং বিবাহ এবং পারিবারিক জীবনে যারা ধর্মীয় আইন মানতে চান না, তাদের জন্য নতুন করে কোন আইন প্রণয়নের যৌক্তিকতা নেই। ইউনিফর্ম ফ্যামিলি ল পাশ করার সুপারিশ যে দুরভিসন্ধিমূলক তা স্পষ্ট হয় মুসলিম পারিবারিক আইনসহ অন্যান্য ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন সংশোধনের সুপারিশ থেকে। একদিকে কমিশনের সদস্যরা দাবি করছেন ইউনিফর্ম ফ্যামিলি ল ঐচ্ছিক আইন হবে, যারা চাইবে তারা এটা মানবে আর যারা চাইবে না তারা ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনসমূহ মানবে। আবার ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন সমূহ সংশোধন করে সেখানে নারী-পুরুষের সম্পদ প্রাপ্তির সমতা, ডিভোর্স, সন্তানের কাস্টোডি ইত্যাদির ক্ষেত্রে ধর্মীয় আইনের বিপরীত সুপারিশ করা হয়েছে। এই সুপারিশসমূহ রীতিমতো ধর্ম অবমাননা হিসেবে কমিশনকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। ইউনিফর্ম ফ্যামিলি ল এর অধীনে নারীবাদীরা যেমন পরিবার চান তার প্রস্তাব তারা করতেই পারেন, কিন্তু মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীদের নিজেদের ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইনকে সংশোধন করার সুপারিশ নিঃসন্দেহে সে ধর্ম এবং ধর্মাবলম্বী মানুষকে অবমামননা। নারী কমিশনের অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি সুপারিশ হলো নারীর প্রতি বৈষম্য বিলুপের বৈশ্বিক সনদ তথা সিডও সনদের যে দুটি ধারা বাংলাদেশ সংরক্ষণ করেছে (অর্থাৎ সমর্থন করেনি) সে দুটি ধারার সংরক্ষণ তুলে ফেলা। মূলত সিডও সনদের ২ এবং ১৬.১(গ) নং ধারা বাংলাদেশ সমর্থন করেনি। ২ নম্বর ধারায় বলা আছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। ১৬.১(গ) ধারায় বিবাহ এবং বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে। এই দুটি ধারা অনুসমর্থন করলে সিডও সনদের পরিপূর্ণ স্বাক্ষরকারী হিসেবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে সকল ধর্মীয় আইনের ঊর্ধ্বে উঠে সকল ক্ষেত্রে কথিত “সমানাধিকার” বাস্তবায়ন করা। এবং এজন্য সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিকট জবাবদিহিতার আওতায়ও আসবে। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষের সেন্টিমেন্ট বিবেচনায় নিয়ে স্বৈরাচার আওয়ামীলীগও এই দুটি ধারা অনুসমর্থন করেনি। দৈনিক প্রথম আলোর ০৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ এর প্রতিবেদনে বলা হয়- “জাতিসংঘের নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলোপ সনদ বা সিডওর গুরুত্বপূর্ণ দুটি ধারা (২ ও ১৬.১.গ) থেকে আপত্তি তুলবে না বলে সিডও কমিটিকে সরকার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে। যুক্তি হিসেবে বলেছে, দেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ধর্মীয় অনুশাসন মেনে তালাক ও সম্পত্তি বণ্টন হয়। ভবিষ্যতে আপত্তি তুলে নেওয়া হবে, এবার সে ধরনের কোনো অঙ্গীকারও করেনি সরকার।” যে ধারাসমূহ স্বৈরাচার অনুমোদন করতে ভয় পেয়েছিলো, সেই ধারাসমূহ এদেশের মানুষের রক্তে রঞ্জিত জুলাইয়ের ম্যান্ডেটে আসা সরকারের তৈরি কমিশন অনুমোদন করার সুপারিশ জুলাইয়ের বিপুল গণ আকাঙ্ক্ষার প্রতি চরম অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই নয়। জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে তৈরি নারী কমিশন তাদের সুপারিশমালা প্রস্তুতে যাদের সাথে বৈঠক করেছে এটি সম্পূর্ণভাবে একপাক্ষিক। সেখানে এনজিও, কিছু সেক্যুলার গোষ্ঠী এবং পেশাজীবী ছাড়া আর কেউ নেই। এই নারী কমিশনকে জবাব দিতে হবে, যেসব নারীরা পর্দার বিধান রক্ষার জন্য ছবি না তুলে বায়োমেট্রিকের মাধ্যমে নিজের পরিচয়পত্র করতে চান তাদের সাথে তারা কথা বলেছে কি না, যেসব নারীরা নামায পড়ার জায়গার দাবি করায় ছাত্রলীগের প্রতিহিংসার শিকার হয়েছিলেন তাদের সাথে কথা বলেছে কি না, হিজাব পরার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দ্বারা যেসব নারী হেনস্থার শিকার হয়েছিলেন তাদের সাথে কথা বলেছে কি না। এই কমিশন কোটি কোটি গৃহিণীদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ এন্টিটি হিসেবে কাউন্টই করেনি, তাদের সাথে বসেনি, লাখ লাখ মাদ্রাসার ছাত্রীদের সাথে বসেনি, আলিম-উলামা, পাদরি-পণ্ডিত কারো সাথেই বসেনি। বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কারো সাথে না বসে উলটো রিপোর্টের পাতায় পাতায় ইসলামোফোবিক অথবা ধর্মবিদ্বেষী মন্তব্যে ভর্তি করা হয়েছে। রিপোর্টের ৭০ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে “বিয়ের বাইরে যেকোন যৌন সম্পর্ককে পাপ হিসেবে দেখা হয় বলেই যৌন সহিংসতার শিকার নারীকে অচ্ছ্যুত ভাবা হয়।” এই বাক্য দ্বারা ধর্মবিদ্বেষী নারী কমিশন দাবি করছে মানুষ যে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ককে পাপ মনে করে এটা অন্যায়। ধর্মের প্রভাবে যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায় বা পাপ-পুণ্যের যে বোধ মানুষের মধ্যে তৈরি হয় নারী কমিশন এই বোধের বিলোপ চান, তারা চান এমন এক ধর্মহীন জনগোষ্ঠী যারা অবাধ যৌনাচারকে পাপ মনে করবে না। এই বাক্য থেকে আরো বোঝা যায়, কালেক্টেভলি সমাজিক মূল্যবোধের বিকৃতি এবং সহমর্মিতার অভাবে ধর্ষিতা নারীর প্রতি যে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায় নারী কমিশন এর পুরো দায় দিতে চান ধর্মের উপরে, যেন ধর্মই মানুষকে সহমর্মী হতে বাধা দিচ্ছে, যেটা ধর্মের উপর মিথ্যা অপবাদ ছাড়া কিছুই নয়। এই একটি বাক্যই কমিশনের সদস্যদের ধর্মবিদ্বেষী মনোভাব স্পষ্ট করে, যা একটি গ্রহণযোগ্য সুপারিশমালা প্রণয়নের প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করেছে। যেকোন রাষ্ট্রে সরকার দুই রকমের হতে পারে। এক রকমের সরকার গণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নকে তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য মনে করে, অর্থাৎ অর্গানিকভাবে তৈরি জনগণের অভিপ্রায় বাস্তবায়ন করাই নিজেদের প্রধান দায়িত্ব বলে গ্রহণ করে। আরো এক রকমের সরকার গণ কে অজ্ঞ জ্ঞান করে, মনে করে গণের অভিপ্রায় তাদের জন্য কল্যাণকর নয়। তাই এই ধরণের সরকার অন্যান্য সমাজে প্রচলিত বা অপ্রচলিত বিধিব্যবস্থা গণের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং দাবি করে এটা গণের উপকারের জন্যই করা হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের ফলে তৈরি সরকারকে ম্যান্ডেট দেওয়া হয়েছে এদেশে গণের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করার জন্য। গণের আকাঙ্ক্ষাকে তুচ্ছজ্ঞান করে পশ্চিমের নারীবাদী ধারণা এদেশে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলে এই সরকার তার ম্যান্ডেট হারাবে। অর্গানিকভাবে তৈরি হওয়া ধর্ম, ঐতিহ্য এবং আচার নির্ভর যে পারিবারিক আইন এদেশে চালু আছে এসব আইনই মূলত এদেশের গণের সামাজিক চুক্তি, যে চুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ নামক এই আধুনিক জাতিরাষ্ট্র। তাই গণের আকাঙ্ক্ষা বিরোধী এই সুপারিশমালা বাতিল এবং কমিশন বিলুপ্ত করে জনরোষ থেকে রক্ষা পাওয়াই হবে সরকারের জন্য সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ। এই কমিশনের সুপারিশ যে গণ আকাঙ্ক্ষার সাথে বিরোধ করে এটা যদি সরকার বিশ্বাস না করে, সেক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে একটি অনলাইন পোল তৈরি করতে পারে। যেখানে জনতা মতামত দিবে এই কমিশন এবং কমিশনের সুপারিশমালা জনগণ বাস্তবায়ন চায়, নাকি বাতিল চায়। এরকম একটি পোল হলে ১০ শতাংশ লোকও এসব সুপারিশের পক্ষে থাকবে না, এটা ওপেন চ্যালেঞ্জ করে বলে দেওয়া যায়।

ফেইসবুকে আমরা...