বাংলা ভাষা ও সাহিত্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতায় সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। ভারতে ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হলে ব্রিটিশের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও হুগলির শ্রীরামপুর মিশন থেকে আরবী-ফার্সী বর্জিত (যথাসম্ভব) সংস্কৃত শব্দবহুল আধুনিক বাংলার প্রচলন হয়। এই আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্য রামমোহন-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু এই সাহিত্যকে শিখরের অভিমুখে অগ্রসর হতে গতি সঞ্চার করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সাহিত্যিক হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আসন অত্যুচে। তার কাব্য, সংগীত ও সাহিত্য তাকে বিশ্ব দরবারে সমাদৃত করেছে। সাহিত্য বিচার মূলত রসবিচার। এই বিচারে রবীন্দ্র সাহিত্য নিশ্চয়ই নান্দনিক, তাই বলে রবীন্দ্র-আদর্শ সর্বোচ্চ প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে সমস্যাজনক বিষয় হলো, তাকে সাহিত্যিক হিসেবে বিবেচনাকে যথেষ্ট মনে না করে এখানে তাকে পূজনীয় হিসেবে প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়। উচ্ছ্বাসপ্রবণ রবীন্দ্রপ্রেমীরা রবীন্দ্রচিন্তা থেকে ছাঁচ আবিষ্কার করে বাঙ্গালিত্বের পরিচয় নির্ধারণ করার মতো মূঢ়তা প্রদর্শন করতেও দ্বিধান্বিত হন না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রয়োজনে রবীন্দ্রনাথকে শিল্পী হিসেবে বিচার-বিশ্লেষণ না করে দেবতা হিসেবে দেখার যে প্রচেষ্টা- সেটি নিশ্চয়ই আপত্তিকর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সাহিত্যে অখণ্ড হিন্দু ভারতের পক্ষে লিখেছেন। তিনি অকপটভাবে নিজের হিন্দু পরিচয় ও হিন্দু সংস্কৃতির প্রতি আস্থা প্রকাশ করে বলেছেন- “আমি হিন্দু এ কথা বলিলে যদি নিতান্তই কোনো লজ্জার কারণ থাকে তাতে সে লজ্জা আমাকে নিঃশব্দে হজম করিতেই হইবে”। এই প্রবন্ধের অন্যত্র তিনি লিখেছেন- “হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যদি কোন বিরোধ থাকে, তা মেটাবার জন্য ‘হিন্দু পরিচয়’ বিসর্জন দিতে হবে এ কখনও সুস্থমস্তিষ্ক কল্পনা হতে পারে না। আর আমি হিন্দু নই বলিলেই হিন্দু-মুসলমানের বিরোধটা যেমন তেমনই থাকিয়া যায়, কেবল আমিই তাহা হইতে পাশ কাটাইয়া আসি। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, আত্মপরিচয়, রবীন্দ্র রচনাবলী) হিন্দুত্বের প্রতি এমন নিখাদ আত্মসমর্পণ বাংলাদেশের মুসলমানের জন্য রবীন্দ্রনাথকে বাছবিচারহীনভাবে গ্রহণ করার পথকে স্বাভাবিকভাবেই সংকুচিত করে। তাছাড়া ঔপনিষদিক চেতনার সমাজব্যবস্থা পুনরুদ্ধার ও হিন্দু-অতীত পুনরুজ্জীবন চিন্তার পৌনঃপুনিক বিধৃতিসহ রবীন্দ্রসাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশই মুসলমানের কৃষ্টি-কালচারের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ। যেহেতু সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার দীর্ঘ সংগ্রাম পরিক্রমায় বাঙ্গালি মুসলমান আজকে বাংলাদেশি মুসলমান পরিচয়ে উপনীত হয়েছে, তাই বিপরীত কোন সংস্কৃতি তাদের উপর চাপানোর প্রচেষ্টা কোনভাবেই ন্যায্য নয়। অতএব হিন্দু জাতীয়তাবাদের ক্যানভাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙ্গালি সংস্কৃতির যে চিত্র এঁকেছিলেন, তাতে বাংলাদেশি মুসলমানের সংস্কৃতির স্থান কতটুকু ও কেমন, এটির পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন।
রবীন্দ্রনাথ ইংরেজ পোষিত সামন্তবাদী পরিবারে কৃষক-মজুর শোষণ ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠা আধুনিক ইউরোপীয় ভাবধারায় উজ্জীবিত সামন্ত জমিদার। তিনি তার সাহিত্যে প্রজাশ্রেণির জীবনের দুঃখ-কষ্ট, বঞ্চনা-বিড়ম্বনা শিল্পময় সৌকর্যে উপস্থাপন করেছেন। ইউরোপীয় উদারবাদী ভাবধারার প্রতি তার অনুবর্তীতা এতে তাকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তিনি এই সমাজের যুলমমূলক ব্যবস্থার অবসান চাননি বলেই পরিলক্ষিত হয়েছে। সাহিত্যে তিনি বলেছেন- “জমিদারী ব্যবসায়ে আমার লজ্জাবোধ হয়। আমার মন উপরের তলার গদি ছেড়ে নিচে এসে বসেছে”। (প্রতীমা দেবীকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র। উদ্ধৃতঃ রবীন্দ্র রচনাবলী) / তিনি বলেছেন- “জমিদারীর জমি আঁকড়ে থাকতে অন্তরের প্রবৃত্তি নেই”। (রায়তের কথা, কালান্তর) অথচ তার একান্ত সচিব কবি অমিয় চক্রবর্তী তাকে তার বিশাল জমিদারীর ক্ষুদ্র এক অংশ দরিদ্র প্রজাদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়ার অনুরোধ করলে তিনি তার পুত্র রথীন্দ্রনাথের ভবিষ্যতের দোহাই দিয়ে বলেছিলেন- “বল কি হে অমিয়, আমার রথীন তাহলে খাবে কী?” (অন্নদাশঙ্কর রায়, ‘রবীন্দ্রনাথ’, প্রবন্ধ সমগ্র, চতুর্থ খণ্ড, কলকাতা) দেখা যাচ্ছে সাহিত্যে মানবদরদী চিন্তার পক্ষে ছড়ানো বাক্যজাল আর বাস্তবিক জীবনের ক্রিয়াকলাপে রবীন্দ্রনাথ অভিন্ন থাকতে পারেননি। সুতরাং এমতাবস্থায় তার বাস্তব কর্মকাণ্ড যেন নিজের লেখাতেই দোষী না হয়, যেন তিনি নিজের লেখা ও ব্যক্তিগত অবস্থানের বৈপরীত্যে অপাঙ্গক্তেয় না হয়ে পড়েন, সে জন্য সর্বদা তাঁকে একধরণের কৌশলগত অবস্থান রক্ষা করে কথা বলতে হয়েছে। এজন্য সাম্রাজ্যবাদ বা ঔপনিবেশিকতা, জমিদারি শোষণ ব্যবস্থা, উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদ ইত্যাদি নেতিবাচক বিষয়ের ব্যাপারে তিনি কথা বললে একধরণের ধোয়াশার ছড়াছড়ি করতে ব্যত্যয় ঘটাতেন না। তিনি শিল্পী হিসেবে এক, কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে পুরোদস্তুর বিপরীত আরেক। এই বিষয়টিরই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় তার প্রজাশ্রেণির গুরুত্বপূর্ণ অংশ বাংলার মুসলমানকে পাত্তা না দেওয়ার মনোভাবে। সন্দেহ নাই যে রবীন্দ্রনাথ আপাদমস্তক শিল্পী, কিন্তু তার শিল্প এই অঞ্চলের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর ন্যায্য চিত্রায়ণ করতে অসম্মত হয়েছে। এটা কোনো অঘটন নয়, বরং রবীন্দ্র মানসের গঠনই এমন ছিলো, যেখানে ইসলাম ও মুসলমানের তাৎপর্যপূর্ণ অবস্থান সতর্কভাবেই পুরোপুরি তিরোহিত। আবুল মনসুর আহমেদ এই বিষয়টিকে আক্ষেপের সাথে বর্ণনা করে বলেছেন-
“বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর আকাশে কতবার শরতের চন্দ্রোদয় হয়েছে, তাতে শারদীয়া পূজায় ‘আনন্দময়ী মা’ কতবার এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদ-মুহাররমের চাঁদ উঠেনি। সে চাঁদ ওঠাবার ভার ছিল নজরুল ইসলামের ওপর। এতে দুঃখ করবার কিছু নেই। কারণ এটা স্বাভাবিক। কাজেই কঠোর সত্য”। (বাংলাদেশের কালচার, আবুল মনসুর আহমদ)
ঢাকা কেন্দ্রিক ‘বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’র অন্যতম সংগঠক, রবীন্দ্র প্রভাব বলয়ের আরেক কর্ণধার ও রবীন্দ্রমুগ্ধ সাহিত্যিক আবুল ফজলও রবীন্দ্রনাথের এমন একপক্ষীয় অবস্থানকে প্রশ্ন করেছিলেন। বাঙ্গালি মুসলমান রবীন্দ্র সাহিত্যে যেরকম দৃষ্টিকটূভাবে অন্তর্হিত ও অবহেলিত, এ ব্যাপারটি অন্য অনেকের মতো তাকেও পীড়িত করেছিল। আবুল ফজল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লিখেছিলেন-
“বাঙলা সাহিত্যের অনির্বাণ ভাস্কর পর্যন্ত এ আধখানা বাঙলার দিকে ফিরে তাকাননি। রবির কিরণে বিশ্ব আলোকিত হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বাঙলার মাটির আঙিনায় রবির আলোকপাত হলো না। এর যথাযথ কারণ আমরা ধারণা করতে পারছি না। শুনেছি গল্পগুচ্ছের অনবদ্য গল্পগুলো শিলাইদহে আপনাদের জমিদারিতে বসেই লেখা, শিলাইদহের মুসলমান প্রজামণ্ডলীর মধ্যে আপনার কি আসন তা শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর প্রবন্ধ না পড়েও আমরা আন্দাজ করতে পারি, অথচ এদের জীবন আপনার কোনো সাহিত্য প্রচেষ্টার উপাদান হতে পারল না।” (সাহিত্য সংস্কৃতি ও জীবন, আবুল ফজল, চট্টগ্রাম)
স্বদেশী আন্দোলনের পরে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন প্রবন্ধে হিন্দু কর্তৃক মুসলমানকে অচ্ছ্যুত/ম্লেচ্ছ ভাবার প্রচলন সহ মুসলমানদের প্রতি হিন্দু সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে বিশেষ গুরুত্ব সহ লেখতে সচেষ্ট হয়েছেন, এটি স্বীকার্য। কিন্তু গভীর পর্যবেক্ষণে প্রতীয়মান হয় যে, তিনি এসব লিখেছেন হিন্দু সামন্তসমাজের জমিদারি হারানোর আর্থ-সামাজিক ক্ষতির আশংকার কারণে। স্বার্থহীন চৈতন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন নিজের মত করে লেখেন, সেখানে তিনি এমনভাবে লেখেন যেন মুসলমানরা বাংলার সাথে সম্পৃক্ত কোন সমাজ নয়। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে বাঙ্গালি মুসলমান লেখকরা যদি মুসলমানী উপাদানকে সাহিত্যে উপস্থাপন করেন, রবীন্দ্রনাথের পক্ষ থেকে সেটাকেও অননুমোদনের দৃষ্টান্ত অবিরল। কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন আধুনিক বাংলা কাব্যের পুরোধা এবং শ্রেণি-ধর্ম-বর্ণের ভেদরহিত চেতনার কবি। তিনি রবীন্দ্রনাথকে অগাধ সম্মান করতেন এবং কবিগুরু বলে সম্বোধন করতেন। নজরুল তার সাহিত্য সৃষ্টিতে বাঙ্গালি মুসলমানের অস্তিত্বের প্রতিনিধিত্ব উপস্থিত করতে কার্পণ্য করতেন না। বিশেষত বাংলার মুসলমানের লোকভাষার যে ভাষিক স্বাতন্ত্র্য, নজরুল থেকে এর প্রতি কোন অবহেলা প্রকাশ পায়নি তো বটেই, বরং নজরুল সাহিত্যে এটি অত্যুচ্চ শৈল্পিক মূল্য অর্জন করেছে। কিন্তু এতে আপত্তি করে বসেন রবীন্দ্রনাথ। ফলে, বাঙ্গালি মুসলমানের সংস্কৃতি কেন বাংলা সাহিত্য সৃষ্টিতে বিশেষ প্রেরণা হওয়া দরকার- এ ব্যাপারে নজরুলকে আলাদা করে স্পষ্টীকরণ করতে হয়েছিলো। তিনি বলেছিলেন- “কবিগুরু কেন, আজকালকার অনেক সাহিত্যিক ভুলে যান যে, বাংলার কাব্য-লক্ষ্মীর ভক্ত অর্ধেক মুসলমান। তারা তাঁদের কাছ থেকে টুপি আর চাপকান চায় না, চায় মাঝে মাঝে বেহালার সাথে সারেঙ্গীর সুর শুনতে, ফুল-বনের কোকিলের গানের বিরতিতে বাগিচায় বুলবুলির সুর। এতেই মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল যাঁরা মনে করেন, তাঁরা সাহিত্য- সভায় ভিড় না করে হিন্দু-সভারই মেম্বার হন গিয়ে।” (বড়র পিরীতি বালির বাঁধ, নজরুলের প্রবন্ধ-সমগ্র)
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য সৃষ্টিতে মুসলমানের জন্য কোন প্রেরণার জন্ম দিতে অসম্মত ছিলেন। তবে এটা তাঁর বড় কোন সাহিত্যিক ত্রুটি- এমনটা মনে করা জরুরি নয়, যেহেতু তিনি তার পরিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতিকে প্রাধান্য দেওয়ার এবং সেসবের প্রতিনিধিত্ব করার স্বাধীনতা রাখেন। কিন্তু রবীন্দ্র সাহিত্য যে বাঙ্গালী মুসলমানের সমাজ-সংস্কৃতি ও মনোগঠনের আকাঙ্ক্ষা ধারণ করেনি এবং এই সাহিত্যের গঠনকাঠামো যে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির জনসমষ্টিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, এটাকে কোনরূপ বিবেচনা না করে হিন্দু রাবীন্দ্রিক-মানস প্ররোচিত সংস্কৃতিকে এই দেশের মানুষের জন্য অনবদ্য হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার যে প্রচেষ্টা বাংলাদেশে যুগের পর যুগ ধরে পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটিই মূলত সমস্যার উৎসস্থল হিসেবে চিহ্নিত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের মুসলমানের সাহিত্য তাদের স্বকীয় সমাজ-সংস্কৃতি, চেতনা ও বিশ্বাসকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছেন- “এটা খুবই উন্নত সাহিত্য। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ এ সাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গেছেন। তবু এ সাহিত্য পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। কারণ এটা বাঙলার মুসলমানের সাহিত্য নয়। এ-সাহিত্যে মুসলমানদের উল্লেখযোগ্য কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ কোনো প্রেরণা পায়নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে এ সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়; এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়। এর স্পিরিটও মুসলমান নয়; এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়।” (বাংলাদেশের কালচার, আবুল মনসুর আহমদ)
ভারত যখন ব্রিটিশ উপনিবেশ, তখন ব্রিটিশের সমর্থনপুষ্ট কলকাতার হিন্দু জমিদারদের অধীনে পূর্ব বাংলা ছিলো ব্রিটিশ-হিন্দুর দ্বৈত উপনিবেশ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে বাঙালি মুসলমান ছিলো জমিদারদের দ্বারা শোষিত, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। রবীন্দ্রনাথ এই সবকিছু প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি শোষণমূলক জমিদারি ব্যাবস্থার ফলে সৃষ্ট বাংলার পূর্বাঞ্চলের মুসলমানদের বঞ্চনা প্রত্যক্ষ করেছেন এবং সাহিত্যে এর চিত্রায়ণও করেছেন, কিন্তু তা উৎখাতের প্রয়োজনীয়তা তিনি সতর্কভাবে এড়িয়ে গেছেন। তদুপরি সামন্তশ্রেণির শোষণ-পীড়ন থেকে উত্তরণের জন্য এখানকার মানুষজন ছোট-বড় যেসব প্রচেষ্টা চালিয়েছিল, তিনি সেগুলোকে একধরনের হুমকি হিসেবে দেখেছেন এবং কঠোরভাবে অসমর্থন করেছেন। তার এমন অবস্থান একাধিকবার আবরণহীন হয়ে প্রকাশিত হয়েছে এবং এরই একটা উদাহরণ হচ্ছে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে বাংলার মুসলমানের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠালাভের প্রচেষ্টায় তার সর্বাত্মক বিরোধিতা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সময়ের সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আর্য-ব্রাহ্মণ্য জাত্যাভিমান ও ভেদজ্ঞানের যে স্বাক্ষর বিরাজিত ছিলো তা নিশ্চয়ই দেখেছেন। কিন্তু তিনি রাজনৈতিক বিবেচনায় এর বর্তমানের সমস্যা ও ভবিষ্যতের হুমকি নিয়ে ভাবার প্রয়োজনটুকু বোধ করেননি, বরং এসব সামাজিক অসঙ্গতির যে আশু-পরিণতি, এর প্রতিবিধান করার জন্য পূর্ববঙ্গের মুসলমান জনমানসে সঞ্চার হওয়া আত্মপ্রতিষ্ঠার চেতনাকে প্রশ্রয় না দিতে তিনি তার ব্যক্তিত্ব ও শিল্পীসত্তার যথাসম্ভব ব্যয় করে বাঙালি মুসলমানের স্বার্থের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
আজকের বাংলাদেশে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের মোড়কে ভারতীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ভয়ংকর রূপ এখন অনেকটাই স্পষ্ট। কিন্তু এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সাংস্কৃতিক উপাদান কী, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা অত্যন্ত জরুরি। বললে মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না, বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব সময় থেকেই এদেশের একশ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের সাংস্কৃতিক কিবলা বা অভিমুখ হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতকে সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠভূমি ভাবার প্রবণতাটি সৈয়দ আলী আহসান চিহ্নিত করেছেন এবং এর ক্ষতির দিকটিও তিনি উল্লেখ করেছেন। সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন- “আমাদের দুর্ভাগ্য হচ্ছে প্রথম যখন বাংলাদেশ হল তখনকার দিনে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একটি অন্তরঙ্গতা আমরা কল্পনা করেছিলাম। সেই অন্তরঙ্গতা যে ভুল ছিল এটা ক্রমশ স্পষ্ট হল। পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটি অঙ্গরাজ্য। ভারতের মেধা ও মনন পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত প্রসারিত। সুতরাং পশ্চিমবঙ্গকে আমাদের সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠভূমি ভাবা অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক।” (বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ: আমাদের আত্মপরিচয়, সৈয়দ আলী আহসান)
তাছাড়া নিজেদের সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্যকে অগ্রাহ্য করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সাথে নিজেদেরকে একই মালায় গ্রথিত করার প্রবণতাকেও সৈয়দ আলী আহসান নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন- “দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের দেশে একশ্রেণির অমেরুদণ্ডী বুদ্ধিজীবী সাহিত্যিক আছেন যারা নিজেদেরকে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে একাত্ম করে বাঙালি বলে ঘোষণা দেন। এরা এক অর্থে মানসিক বিকারগ্রস্ত। কখনও কখনও নিজেদের বাঙালি বলেই ক্ষান্ত হন তাই নয়, তারা স্পষ্ট বলে থাকেন যে, তারা বাংলাদেশি নন, বাঙালি।” (বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ : আমাদের আত্মপরিচয়, সৈয়দ আলী আহসান)
বাংলাদেশের সংস্কৃতি নির্মাণের বেলায় পশ্চিমবঙ্গ পানে মুখিয়ে থাকা এবং ওখানকার সংস্কৃতির প্রতি বিশেষ মোহমুগ্ধতায় ভোগা এখনো এখানকার উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বুদ্ধিজীবীর মধ্যে পরিদৃষ্ট সাধারণ বাস্তবতা। আর সন্দেহাতীতভাবে পশ্চিমবঙ্গের সবচেয়ে খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক প্রতিভূ হলেন রবীন্দ্রনাথ। অতএব এদেশে ভারতীয় সাংস্কৃতিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বড় মাধ্যম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
যখন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের লাল বাতি জ্বলার দশা, তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ টিকিয়ে রাখার হাতিয়ার হিসেবে রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত হয়েছিলেন। তিনি গীতাঞ্জলির অনুবাদ Song Offerings কাব্যগ্রন্থের জন্য নোবেল পুরষ্কার পান। এই কাব্যগ্রন্থেরই ভূমিকা লেখক W.B. Yeats পরবর্তীতে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দ সালে ব্রিটিশ কর্তৃক রবীন্দ্রনাথ ব্যবহৃত হওয়ার সত্যটিকে সামনে এনে বলেছিলেন- “A piece of wise imperialism from the English point of view”. (উদ্ধৃত, রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতা, ফাহমিদ উর রহমান) বাংলাদেশে রাজনীতির আদর্শ হিসেবে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদকে নির্ধারণ করে ভারতীয় রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করার যে দীর্ঘমেয়াদি ও বহুরূপী প্রচেষ্টা, এটাও করা হচ্ছে একই ব্যক্তিকে পুঁজি করে। তিনি রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্যকর্ম বাঙ্গালি মুসলমানের সংস্কৃতির সাথে অপরিচয়ের দূরত্ব রক্ষা করে গড়ে উঠেছে। এই সাহিত্য উন্নত হতে পারে, কিন্তু একে অনধিকারে আপন সাহিত্য কল্পনা করা বাংলাদেশিদের জন্য নিতান্তই নির্বুদ্ধিতা। যে সাহিত্যে মুসলমানের কৃষ্টি-কালচার বর্জিত ও তাদের প্রগতির প্রেরণা তিরোহিত এবং যে সাহিত্য মুসলমানের প্রতি অবজ্ঞার প্রতীক দ্বারা বিশেষভাবে চিহ্নিত, সে সাহিত্য নিয়ে গৌরবান্বিত হওয়া চূড়ান্ত আত্মঘাতী, ফলতঃ হীনমন্যতা উৎপাদক। এমনকি এই ধরণের প্রচেষ্টা দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের মুসলমানের জন্য উপকার তো বয়ে আনবে না, বরং এটি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে এক ধরণের অমৌলিকতা ও দেওলিয়াত্বকে স্বাগত জানাবে। আবুল মনসুর আহমদ যথার্থই অনুধাবন করে তার ‘বাংলাদেশের কালচার’ গ্রন্থে বলেছেন- “বাঙলার মুসলমানও তেমনি রবীন্দ্রনাথের নকল করে বড়ো হতে পারবে না। তাকে বড়ো হতে হবে তার স্বকীয়ত্বের ওপর দাঁড়িয়ে, নিজের কৃষ্টিকে বুনিয়াদ করে।”
হদিস:
১. বাংলাদেশের কালচার, আবুল মনসুর আহমদ
২. বাংলাদেশ সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি প্রতিক্রিয়া, এবনে গোলাম সামাদ
৩. বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ – আমাদের আত্মপরিচয়, সৈয়দ আলী আহসান
৪. ঠাকুরের মাৎস্যন্যায়— ভাষা-শিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতা, সলিমুল্লাহ খান