চার বছরের শিশু আব্দুল আহাদ। ঘরের ব্যালকনিতে বাবা-মায়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দেখছিল বাসার নিচে চলমান আন্দোলনের দৃশ্য। হঠাৎ পড়ে যায়, বাবা-মা হয়তো ভেবেছিলেন ছেলে মাথা ঘুরে পড়ে গেছে, কিন্তু তুলতে গিয়ে দেখেন ছেলের চোখে গুলি লেগেছে। একদিন লাইফ সাপোর্টে থাকার পর হাসপাতালেই মৃত্যুবরণ করে শিশুটি। ছয় বছরের শিশু রিয়া দুপুরের খাবার শেষে ছাদে খেলছিল। বাসার বাইরে গোলযোগ শুনে বাবা দৌড়ে যান ছাদে, মেয়েকে ঘরে নিয়ে আসতে। ছাদে উঠে শিশুটিকে কেবল কোলে নিয়েছেন, অমনি ঘাতক বুলেট এসে আঘাত করে অবুঝ শিশুর মাথায়। বাসার কাছের ক্লিনিক পাঠিয়ে দেয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, সেখানে অস্ত্রপাচার হলেও শেষ পর্যন্ত মারা যায় শিশুটি।
না, এগুলো ফিলিস্তিনের গাযা উপত্যকার কোন গল্প নয়, নয় কোন যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের যুদ্ধের করুণ কাহিনী। এসবই ঘটেছে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরে। যুদ্ধপরিস্থিতিতেও যে শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত থাকা উচিত বলে মনে করা হয়, বলতে গেলে খুব সাধারণ একটা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে সেই শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। দেশজুড়ে গণমাধ্যম কর্তৃক নিশ্চিতকৃত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় আড়াই শতাধিক মানুষের জীবনাবসান হয়েছে, সরকারি হিসেবে যদিও সে সংখ্যাটি আরো শ খানেক কম। ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া বাংলাদেশে সেই কয়েক দিনে প্রকৃত অর্থে কী ঘটেছে, তা অবশ্য আমরা কেউই জানি না। কিন্তু যতটুকু জানি, তাতেই যেন নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
এতোগুলো নিরপরাধ জীবনের অবসান হলো ছোট্ট এক দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে কেবল যথাসময়ে সাড়া না দিয়ে তার বদলে মাত্রাতিরিক্ত শক্তি প্রদর্শনের কারণে। সরকারের তরফে সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের বদলে নিরীহ আন্দোলনকারীদের উপর উল্টো যথেচ্ছা শক্তিপ্রয়োগ করতে গিয়ে উপরে বর্ণিত দুই শিশুর মতো এমন অনেক নাগরিককেও প্রাণ হারাতে হলো, যাদের আসলে এই আন্দোলন কিংবা কোন আন্দোলনের সাথেই নেই কোন সম্পর্ক। চার বছরের শিশুটি হয়তো আন্দোলন শব্দটিও জানে না, বুলেট সম্পর্কে হয়তো তার ধারণা ছিল শূন্য, কিন্তু তারও রক্ষা হলো না। অনলাইনে বিচরণ করতে গেলেই উপরের দুটি ঘটনার মতো এমন আরো বহু ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠে, তার চেয়েও বেশি সংখ্যক ঘটনা আমাদের অজানাই থেকে গেছে, হয়তো কোন দিনই জানতে পারবো না।
বিশাল এই মৃত্যু মিছিলের আলোচনা পূর্ণ করার সুবিধার্থে কেবল কিছু পরিসংখ্যান উল্লেখ করছি। গত অক্টোবর থেকে ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি নিবীড় পর্যবেক্ষণের ফলে যে হিসেবগুলো বারবার সামনে আসছে— ১৯৮৭ সালে প্রথম ইন্তিফাদার প্রথম একমাসে শহীদ হয়েছেন ৩৫ জন ফিলিস্তিনী। ২০০০ সালের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার প্রথম এক মাসে সেই সংখ্যা ছিল ১৪১ জন। ২০০৭ এর গাযা যুদ্ধের প্রথম সপ্তাহের শহীদের সংখ্যা দুই শতাধিক, ২০২১ সালে সেই সংখ্যা ২৫৬ জন। আর ২০২৪ এর দূর্বিসহ জুলাই মাসে রংপুরের আবু সাঈদের মৃত্যুর পরের এক সপ্তাহে মোট মৃত্যু সংখ্যা প্রথম সারির গণমাধ্যমের হিসেবে আড়াই শতাধিক, সরকারি হিসেবে দেড় শত!
এই লেখা যখন লিখছি, তখনো প্রিয় বাংলাদেশে শান্তি ফিরেনি, মৃত্যুর মিছিল থামলেও গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছে হাজার হাজার শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ। এমনকি মৃত ব্যক্তির বাসভবনে পর্যন্ত গ্রেফতার করতে পুলিশ চলে গেছে, এমন খবরও গণমাধ্যমে পড়তে হচ্ছে।
সব ধরনের আইন ভঙ্গ করে ১৮ বছরের কম বয়সী কিশোরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সামাজিক মাধ্যমে তীব্র সমালোচনায় যদিও সে দুর্ভাগ্য শেষ পর্যন্ত বরণ করতে হয়নি কিশোরটিকে। এসব ঘটনা থেকে সহজেই অনুমেয় কতটা নির্বিচারে চলছে গ্রেফতারযজ্ঞ।
এই যে শত শত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের পঙ্গুত্ব বরণ— এর পিছনের কারণটা আসলে কী? ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী সব কোটা বাতিল করেছিলেন যে পরিপত্র জারি করে, গত জুন মাসে উচ্চাদালত সেই পরিপত্রকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। তার প্রেক্ষিতে মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছিলেন। প্রথমে খুবই সাদামাটা আন্দোলন চলছিল, ক্রমে সে আন্দোলনের উত্তাপ খানিকটা বৃদ্ধি পেলেও মোটের উপর শান্তিপূর্ণই ছিল বলা চলে। এরকম পরিস্থিতিতে দেশের সরকার প্রধান চীন সফরে গেলে আন্দোলনকারীদের আশা ছিল, তিনি দেশে ফিরলে হয়তো সমাধান হতে পারে, কারণ কে না জানে তিনি ব্যতীত দ্বিতীয় কারোরই কোন সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা নাই। কিন্তু তিনি দেশে ফিরে যে সংবাদ সম্মেলন করলেন তাতে আন্দোলনের আগুনে পানির বদলে যেন ঘি ঢেলে দেওয়া হলো।
তারপরের ঘটনা সকলের জানা— আন্দোলনের উত্তাপ বৃদ্ধি, সরকার দলের সাধারণ সম্পাদক কর্তৃক ছাত্রলীগের মাধ্যমে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের ঘোষণা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ ছাত্রদের তোপের মুখে ছাত্রলীগের পলায়ন, রংপুরে বলতে গেলে লাইভ গুলিবর্ষণ করে শিক্ষার্থী খুন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের হলসমূহ থেকে শিক্ষার্থীদের বিতাড়ন এবং সেই প্রেক্ষিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জীবন বাজি রেখে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়া। এই পর্যায়ে এসে আর কোটা সংস্কার আন্দোলনের মূল ইস্যু থাকেনি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিকট সরকারি চাকরির কোটা ব্যবস্থা মোটেও প্রাসঙ্গিক কোন বিষয় নয়। মূলত আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মৃত্যুর ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে সর্বত্র আন্দোলন বিস্তৃত হতে শুরু করে, এমনকি সাধারণ মানুষও এই আন্দেলনে সংযুক্ত হয়ে পড়েন।
পুরো আন্দোলনের শুরু থেকে এখন অবধি যে বিষয়টি সবচেয়ে দুঃখজনক, তা হলো আন্দোলনকারীদের প্রকৃত ভাষা বুঝতে না পেরে কর্তারা কেবলই ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে কেবলই বিলম্ব করছেন। শেষ অবধি আপিল আদালতের শুনানি এগিয়ে এনে কোটা সংস্কারের দাবি বাস্তবায়ন করা হলেও তার মধ্যেই যে মানুষগুলোর জীবন চলে গেছে, সে বিষয়ে বলতে গেলে কোন ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। উল্টো রংপুরে লাইভ ভিডিওতে পুলিশের গুলিতে নিহত শিক্ষার্থীর মৃত্যুর মামলায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদেরকেই গ্রেফতার করা হচ্ছে, তাদের ছোড়া ইট-পাটকেলে নাকি তার মৃত্যু হয়েছে — এমন হাস্যকর দাবি তুলে।
এই আন্দোলন এবং তৎপরবর্তী দেশের পরিস্থিতি নিয়ে লেখার মতো ইস্যুর শেষ নেই, কিন্তু এতোগুলো নিরপরাধ মানুষের মৃত্যুর পর গুছিয়ে সেসব কথা লেখা সম্ভবও না। অবিলম্বে মামলা ও গ্রেফতারের নামে আন্দোলনকারীদের হয়রানি বন্ধ করে আন্দোলনকারীদের মৃত্যুর জন্য দায়ি প্রত্যেকের বিচার নিশ্চিত করা এবং উসকানিদাতা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণ করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য উপায়ে পরিস্থিতির সমাধান নিশ্চিত করা হোক, এই দাবি রইলো। অন্যথায় শক্তি প্রয়োগ করে তারুণ্যের দ্রোহের আগুন নেভানো যাবে না, বরং সুযোগ পেলেই তা আবারো জ্বলে উঠবে, হয়তো আরো ভয়ঙ্কররূপে। এখনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ থাকায় হয়তো কিছুটা নিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতির দেখা মিলছে, কিন্তু ক্যাম্পাস খুললে নিহত শিক্ষার্থীদের সহপাঠীরা তাদের সহপাঠীদের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিচারের দাবিতে আবারো উত্তাল যে হবে না, সে নিশ্চয়তা দেওয়া বেশ কঠিন। তাই দমন-পীড়ন ছেড়ে যৌক্তিক উপায়ে পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত এখনই। তরুণ প্রজন্মের প্রতি তাচ্ছিল্য নয়, বরং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ও সহমর্মী হতে হবে, তাদের বিপক্ষে নয় বরং তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে, তবেই কেবল দূর্বিসহ জুলাইয়ের ভয়াল স্মৃতিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাওয়া যাবে সম্মুখপানে।