সাদাকাতুল ফিতর-এর পরিচিতি
‘সাদাকাহ’ আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ দান। পরিভাষায়-
هِيَ الْعَطِية التِيْ يُرادُ بِهَا الثَّوَابُ مِنَ اللهِ تَعَالٰى
অর্থাৎ যে দান দ্বারা আল্লাহর নিকট সাওয়াবের আশা করা যায় তাকে সাদাকাহ বলে। আল ফিতর (الفطر) আরবী শব্দ। ফকীহদের পরিভাষায় তা হলো- রোযা না রাখা। এ অর্থেই ব্যবহার হয় ‘ঈদুল ফিতর’ (কাওয়াঈদুল ফিকহ)।
পরিভাষায় ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বলা হয় নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের উপর ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় যে দেওয়া ওয়াজিব হয়।
আল্লামা যুবাইদী (র.) বলেন, যেহেতু ‘সাদাকাতুল ফিতর’ রামাদান শেষে রোযা ভঙ্গের দরূণ ওয়াজিব হয়, তাই তাকে সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়। এর অপর নাম ‘যাকাতুল ফিতর’।
মূলত পবিত্র মাহে রামাদানের রোযা পালনের মাধ্যমে আল্লাহ পাক বান্দার প্রতি যে অফুরন্ত নিআমত দান করেছেন তার শুকর হিসেবে এবং রোযা পালনের মূল উদ্দেশ্য সাধনে যেসব ত্রুটি-বিচ্যুতি হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব করা হয়েছে।
ওয়াকী ইবনুল জাররাহ (র.) বলেন, ‘সাদাকাতুল ফিতর’ রামাদানের ক্ষতিপূরক, তেমনিভাবে সিজদায়ে সাহু নামাযের ক্ষতিপূরক।
ইমাম আযম আবূ হানীফা (র.) এর মতে, নিসাব পরিমাণ মালের মালিকের উপর সাদকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক খুতবায় ইরশাদ করেন, আযাদ, গোলাম, ছোট বড় প্রত্যেকের পক্ষ থেকে তোমরা আধা সা গম, বা এক সা যব বা এক সা খেজুর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ হিসেবে আদায় করবে। (আবূ দাউদ)
যাদের উপর সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব
আযাদ মুসলমান যিনি জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ যথা- আবাস গৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, ঘরের সরঞ্জামাদী, খাদ্যদ্রব্য, যুদ্ধের বাহন যথা ঘোড়া, উট ইত্যাদি, অস্ত্র সস্ত্র ও খিদমতের দাস ব্যতীত নিসাব পরিমাণ মালের মালিক তার উপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব। (ফাতহুল কাদীর, ২য় খণ্ড ও হিদায়া, ১ম খণ্ড)
সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজির হওয়ার জন্য নিসাব পরিমাণ মালের উপর একবছর অতিবাহিত হওয়া শর্ত নয়। বরং ঈদের দিনের সুবহে সাদিকের পূর্ব মুহূর্তে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হলেই ‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব হবে। (নূরুল ঈযাহ)
সাদাকাতুল ফিতরে মাল মালেনামী অর্থাৎ বর্ধনশীল হওয়া শর্ত নয়। যদি কোন ব্যাক্তি নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়ার পূর্বেই ‘সাদাকায়ে ফিতর’ আদায় করে দেয় এবং পরে সে নিসাব পরিমাণ মালের মালিক হয় তবে তার আদায়কৃত ফিতরা বৈধ হবে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
সাদাকায়ে ফিতর নিজের পক্ষ থেকে ও নিজের নাবালিগ সন্তানদের পক্ষ থেকে আদায় করা ওয়াজিব। সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার পর মাল ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে সাদাকার হুকুম বাতিল হবে না বরং তা আদায় করতে হবে। (শামী, ২য় খণ্ড)
এমনিভাবে কোন ব্যক্তি যদি তার অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে তুলে দেয় তবে পিতার উপর ঈদের দিন তার ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয়। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
অনুরূপভাবে কোন ব্যক্তির উপর তার দাদা-দাদী, নানা নানী, মাতা-পিতা, প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে সাদাকাহ আদায় করা ওয়াজিব নয়। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
একজনের ‘সাদাকাতুল ফিতর’ একজনকে অথবা কয়েকজনকে বণ্টন করে দেওয়া জায়িয আছে। যেমনিভাবে অনেক জনের সাদাকাহ একজনকে দেওয়া জায়িয। (ইমদাদুল ফাতাওয়া, ২য় খণ্ড ও ফাতাওয়ায়ে মাহমূদীয়া, ৩য় খণ্ড)
অনুমতি ব্যতিরেকে একজনের সাদাকাহ অন্যজনের আদায় করা জায়িয নেই। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
যাদের ফিতরা আদায় করা ওয়ালীর উপর ওয়াজিব
বিত্তহীন অপ্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়ালীর উপর ওয়াজিব। এমনিভাবে প্রাপ্তবয়স্ক, মতিভ্রম ও পাগল সন্তানের সাদাকাহ আদায় করাও ওয়ালীর উপর ওয়াজিব। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
প্রাপ্তবয়স্ক সন্তান এবং স্ত্রী ও পিতা-মাতার সাদাকাহ আদায় করা ওয়ালীর উপর ওয়াজিব নয়। তবে আদায় করলে আদায় হয়ে যাবে। (হিদায়া, ১ম খণ্ড ও আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
এক ভাইয়ের সাদাকায়ে ফিতর অন্য ভাইয়ের আদায় করা ওয়াজিব নয়। অনুরূপভাবে কোন নিকট আত্মীয়ের ফিতরা আদায় করা অন্য আত্মীয়ের উপর ওয়াজিব নয়। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
যার উপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করা ওয়াজিব ছিল সে যদি তা আদায় করার পূর্বেই মারা যায় তবে মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি হতে ‘সাদাকায়ে ফিতর’ আদায় করা ওয়াজিব নয়। কিন্তু তার উত্তরসূরীরা যদি সাদাকাহ আদায় করে দেয় তবে আদায় হয়ে যাবে। উত্তরসূরীরা নিষেধ করলে জোরপূর্বক তাদের থেকে সাদাকাহ আদায় করে কর্য জায়িয হবে না। অবশ্য মৃত ব্যক্তি যদি এ ব্যাপারে ওয়ারিসদের অসীয়ত করে গিয়ে থাকে তবে তার মালের এক তৃতীয়াংশ হতে সাদাকাতুল ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার সময়
ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হয়। সুতরাং কেউ যদি সুবহে সাদিকের পূর্বেই ইনতিকাল করে তবে তার সাদাকাহ আদায় করা ওয়াজিব নয়। সুবহে সাদিকের পূর্বে যদি কোন বিত্তবান লোকের সন্তান ভূমিষ্ট হয় তবে তার সাদাকাও আদায় করতে হবে। যদি কোন অমুসলিম ব্যক্তি সুবহে সাদিকের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করে তবে তার উপর সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। আর যদি সুবহে সাদিকের পর কোন বিত্তবান লোকের সন্তান ভূমিষ্ট হয় অথবা কোন কাফির সুবহে সাদিকের পর ইসলাম গ্রহণ করে তবে তাদের উপর সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে না। যদি কোন ফকীর সুবহে সাদিকের পূর্বে নিসাবের মালিক হয়ে যায় তবে তার উপরও সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে। আর যদি কোন ধনী ব্যক্তি সুবহে সাদিকের পূর্বে গরীব হয়ে যায় তবে তার উপর সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব হবে না। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড; শামী, ২য় খণ্ড ও হিদায়া, ১ম খণ্ড)
ফিতরা এবং বোযা দুটি পৃথক পৃথক ইবাদত। তাই কেউ যদি বার্ধক্যজনিত কারণে বা অসুস্থতা অথবা অন্য কোন কারণে রোযা রাখতে না পারে তবে তার থেকে সাদাকায়ে ফিতর রহিত হবে না। বরং তাদের উপর সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা ওয়াজিব। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
সাদাকাতুল ফিতর ঈদের নামাযের আগে বা পরে দেওয়ার হুকুম
কোন ব্যক্তি যদি ঈদের নামাযের আগে রামাদানের মধ্যে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করে দেয় তবে তাও জায়িয আছে। ঈদের দিন তা পুনরায় আদায় করতে হবে না। আর যদি ঈদের নামাযের আগে আদায় না করে তবে তার সাদাকায়ে ফিতর মাফ হবে না। অন্যসময় তা আদায় করতে হবে। অবশ্য নামাযের আগে আদায় করা মুস্তাহাব। (হিদায়া, ১ম খণ্ড)
সাদাকাতুল ফিতর ওয়াজিব হওয়ার নিসাব ও পরিমাণ
কোন ব্যক্তি জীবিকা নির্বাহের আবশ্যকীয় উপকরণ যথা আবাস গৃহ, পরিধেয় বস্ত্র, খাদ্যদ্রব্য, ঘরের সরঞ্জামাদি এবং খিদমতের গোলাম ব্যতীত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমমূল্যের কোন সম্পদের মালিক থাকলে তার উপর ‘সাদাকায়ে ফিতর’ ওয়াজিব হবে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড; শামী, ২য় খণ্ড ও হিদায়া, ১ম খণ্ড)
‘সাদাকাতুল ফিতর’ ওয়াজিব হওয়ার জন্য মালেনামী অর্থাৎ বর্ধনশীল মাল হওয়া শর্ত নয়। পূর্ণ এক বছর অতিবাহিত হওয়াও শর্ত নয়। বরং ঈদুল ফিতরের দিন সুবহে সাদিকের সময় উপরোক্ত পরিমাণ মালের মালিক থাকলে সাদাকায়ে ফিতর ওয়াজিব হবে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
সাদাকাতুল ফিতর আদায়ের মুস্তাহাব তরীকা
ঈদের দিন সুবহে সাদিকের পর ঈদের নামায আদায়ের পূর্বে ‘সাদাকায়ে ফিতর’ আদায় করা মুস্তাহাব। কোন কারণবশত সাদাকাহ আদায় না করতে পারলে পরে আদায় করলেও তা আদায় হয়ে যাবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের নামাযের পূর্বেই সাদাকায়ে ফিতর আদায় করতেন। (হিদায়া, ২য় খণ্ড ও আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
ফকীহগণের মতে সাদাকায়ে ফিতর বছরের যে কোন সময় আদায় করা জায়িয আছে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড ও বাদাইয়ুস সানাঈ)
সাদাকাতুল ফিতর এর পরিমাণ এবং যে যে জিনিস দ্বারা তা আদায় করা যায়
সাদাকায়ে ফিতর গম, যব, খেজুর এবং কিসমিস দ্বারা আদায় করা জায়িয আছে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
সাদাকায়ে ফিতর যদি গম বা গমের আটা বা গমের ছাতু দ্বারা আদায় করা হয় তবে আধা সা অর্থাৎ এক কেজি সাড়ে ছয়শ গ্রাম আদায় করতে হবে।
আর যদি খেজুর বা যব বা ঘরের আটা বা কিসমিস দিয়ে সাদাকাহ আদায় করা হয় তবে এক সা অর্থাৎ তিন কেজি তিনশ গ্রাম আদায় করতে হবে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড ও হিদায়া, ১ম খণ্ড)
গমের আটা ও গমের ছাতু গমের অন্তর্ভুক্ত এবং যবের আটা ও যবের ছাতু যবের হুকুমে অন্তর্ভুক্ত। রুটি দিয়ে সাদাকায়ে ফিতর আদায় করা জায়িয নেই। তবে মূল্য হিসাব করে তা দিয়ে আদায় করলে আদায় সহীহ হবে। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
সাদাকায়ে ফিতর আদায়ের ক্ষেত্রে গমের তুলনায় আটা এবং আটার তুলনায় তার মূল্য দ্বারা আদায় করা উত্তম। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
যদি সাদাকাতুল ফিতর গম বা যব ব্যতীত অন্য কোন শস্য যেমন ধান, চাউল, বুট, কলাই ইত্যাদি দিয়ে আদায় করতে হয় তবে আধা সা গমের মূল্য পরিমাণ চাউল, ধান, বুট দ্বারা ফিতরা আদায় করলে আদায় সহীহ হবে। মূল্য হিসাব না করে অনুমান করে আদায় করলে সাদাকাহ আদায় হবে না। (ফাতাওয়ায়ে মাহমুদীয়া, ৩য় খণ্ড)
অমুসলিমকে সাদাকাতুল ফিতর প্রদান
কোন অমুসলিম ব্যক্তি বিধর্মী রাষ্ট্রের প্রজা হলে সর্বসম্মতিক্রমে তাদেরকে সাদাকায়ে ফিতর প্রদান করা জায়িয নেই, আর ইসলামী রাষ্ট্রের প্রজা হলে তাদেরকে ফিতরা দেওয়া জায়িয। তবে মুসলমানকে দেওয়া উত্তম। ইসলামী রাষ্ট্রের বিধর্মী প্রজাদেরকে সাদাকায়ে নফল দেওয়া সর্বসম্মতিক্রমে জায়িয। (আলমগীরী, ১ম খণ্ড)
[ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রকাশিত ‘ফাতাওয়া ও মাসাইল’ থেকে নেওয়া।]