আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে মাওলিদের আমলের ভিত্তি কী? আমি জবাব দিলাম, কুরুনে সালাসার কোনো সালাফের কাছ থেকে এর বর্ণনা পাওয়া যায়নি, পরে তা আবিষ্কৃত হয়েছে। অতঃপর বিভিন্ন অঞ্চলে, শহর-বন্দরে মুসলমানরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মের মাসে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করতে থাকেন। মর্যাদাবান ও সম্মানিত লোকেরা চমৎকার ভোজ আয়োজন করেন, যাতে উন্নত রুচিসম্মত বিষয় আশয় অন্তর্ভুক্ত থাকে। তারা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের মাসের রাতসমূহে বিভিন্ন প্রকার দান সাদকাহ করেন, আনন্দ প্রকাশ করেন, বেশি বেশি পুণ্যের কাজ করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহিমান্বিত জন্মবৃত্তান্ত পাঠ করেন। এর বরকতে তাদের উপর ব্যাপক অনুগ্রহ বর্ষিত হয়। আর এ বিষয়টা ছিলো পরীক্ষিত। এ প্রসঙ্গে ইমাম শামসুদ্দীন ইবনুল জাযারী বলেছেন, মীলাদুন্নবী উদযাপনের বিশেষ উপকারিতার একটি হলো, পুরো বছরের জন্য তা একটা পূর্ণ নিরাপত্তা হয়ে দাঁড়ায়। এ উপলক্ষে মেহমানের জন্য ভুনা করা খাবার প্রস্তুত করা হয় যথোচিত ও কাক্সিক্ষতভাবে। আর এ ব্যাপারে সর্বাধিক যতœশীল ছিলেন মিশর এবং শামের (বর্তমান সিরিয়া) অধিবাসীরা। মিশরের রাজার জন্য এই দিন ছিলো বছরের সর্বাধিক মাহাত্ম্যপূর্ণ দিন। তিনি বলেন, আমি সাতশত পঁচাশি হিজরী সালে পাহাড়ের একটি দূর্গে তৎকালীন রাজা জাহির বারকুক (র.)-এর সামনে উপস্থিত হলাম। সেখানে যা দেখলাম, তা আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছে। আমি হিসাব করলাম সেখানে কুরআন তিলাওয়াতকারী এবং ওয়াইয ও কাসীদা পরিবেশনকারীগণ সহ অন্যান্য যারা উপস্থিত হয়েছিলেন, তাদের পোশাক, খাবার, পানীয়, সুগন্ধি এবং আলোর ব্যবস্থা বাবত তিনি দশ হাজার পরিমাণ স্বর্ণমুদ্রা ব্যয় করেছেন। আর আমি গণনা করে দেখলাম সেখানে শিশু কারীদের জন্য পঁচিশটি আসন রয়েছে। তারা একেকজন যখন আসন হতে অবতরণ করতো, তখন রাজা-বাদশাহদের পক্ষ থেকে তাদেরকে প্রায় দশ দশটি করে পোশাক দেয়া হত। এসব পোশাক ছিলো আড়ম্বরপূর্ণ ও মনোমুগ্ধকর।
আল্লাহ তাআলা যাদেরকে বিভিন্ন (নিষিদ্ধ) বিষয় ধ্বংস করার সামর্থ দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে হারামাইন শরীফাইনের খাদিম হিসেবে নিয়োজিত মিশরের রাজারাও ছিলেন। তারা তাদের প্রজাদের বিষয় এমনভাবে দেখাশুনা করতেন, যেমন পিতা তার সন্তানের বিষয় দেখে থাকেন। ন্যায়পরায়ণতার দ্বারা তারা নিজেদের প্রসিদ্ধি ঘটিয়েছিলেন। আর আল্লাহও তাদের শক্তি দিয়ে সহায়তা করেছেন। এক্ষেত্রে শহীদ আবূ সায়ীদ জাকমকের নাম উল্লেখ করা যায়। এসব রাজারা সুন্নাতের প্রতি মনোযোগী ছিলেন এবং এ পথেই বিচরণ করতেন। এমনকি সে সময় (মীলাদের মাসে) দান-খায়রাত করার দিনগুলোতে কারীদের বসার জন্য বিশেষ স্থান নির্দিষ্ট ছিলো। তারা সুন্দর সুন্দর আলোচনা করতেন এবং অন্যান্য ব্যস্ততা হতে বিরত থাকার সর্বাত্মক চেষ্টা করতেন। আর আন্দালুস (বর্তমান স্পেন) এবং মরক্কোর রাজাগণের ব্যাপারে বললে তাদের তো এজন্য একটি রাতই নির্দিষ্ট ছিলো, লোকেরা এ রাতে দূর হতে এসে জমায়েত হতো এবং বিভিন্ন স্থান হতে শীর্ষস্থানীয় উলামায়ে কিরামকে একত্রিত করা হতো। ফলে এ রাতে কাফিরদের উপর উন্নীত হতো ঈমান এবং ঈমানদারের শ্রেষ্ঠত্ব। আর মক্কাবাসীরা ঐ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্মের স্থান বলে যে স্থানটি মানুষের নিকট সুপ্রসিদ্ধ, গভীর আশা নিয়ে সেখানে যেতেন। তারা ঈদের চাইতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামেরজন্মের দিনকে বেশি গুরুত্ব দিতেন। এমনকি এই কাজ হতে পুণ্যবান, পাপী, গরীব ও ধনী কেউ পশ্চাদপদ হতো না।
ইরবলের বাদশাহ মুযাফফর মাওলিদের ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতেন এবং এর তত্ত্বাবধানও করতেন। তিনি এ বিষয়ে অতিমাত্রায় যত্নবান ছিলেন। এ কাজের জন্য আল্লামা আবু শামাহ (র.) তার ‘আল বাইস আলা ইনকারিল বিদঈ ওয়াল হাওয়াদিস’ কিতাবে বাদশাহ মুযাফফরের প্রশংসা করেছেন। আবূ শামাহ (র.) হলেন ইমাম নববী (র.) এর উস্তাদগণের অন্যতম একজন, যিনি সর্বদা সত্যের উপর অবিচল ছিলেন। তিনি বলেন, এই ধরনের ভালো কাজের সংস্পর্শে আসা যাবে এবং যিনি এ ধরনের কাজ করবেন তিনি কৃতজ্ঞতা ও প্রশংসার দাবি রাখেন। ইমাম ইবনুল জাযারী (র.) আরো বাড়িয়ে বলেছেন, যদি এ কাজ শয়তানকে লাঞ্ছিতকরণ এবং ঈমানদারের খুশি হওয়ার সাথে সম্পৃক্ত নাও হয় (তা সত্তে¡ও এটা উত্তম কাজ)। তিনি বলেন, যেখানে শূলে চড়ানো জাতি তাদের নবীর জন্ম দিনকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করছে, সেখানে সম্মান দানের ব্যাপারে তো মুসলমানরা সর্বাধিক অগ্রাধিকারী এবং উপযুক্ত।
আমাদের শাইখ, ইসলামের মহান অনেক ব্যক্তিবর্গের শাইখ, মহাজ্ঞানী ইমামদের শেষ ব্যক্তি আল্লামা ইবনু হাজার আসকালানী (র.) মীলাদ উদযাপনের একটা দৃঢ় ভিত্তি আবিষ্কার করেছেন। সেটা হলো সহীহাইনের একটি হাদীস, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মদীনায় গেলেন, তখন ইয়াহুদীদেরকে আশুরার দিনে রোযা রাখতে দেখলেন। তিনি তাদের রোযা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তারা জবাব দিলো, এই দিনে আল্লাহ তাআলা ফিরআউনকে ডুবিয়ে মেরেছিলেন এবং মূসা (আ.) কে নাজাত দিয়েছিলেন। তাই আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের নিমিত্ত এই দিনে রোযা রাখি। তাদের বক্তব্য শুনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, আমরা মূসা আলাহিস সালাম এর ব্যাপারে সর্বাধিক হকদার। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে আশুরার দিনে রোযা রাখলেন এবং এই দিনে রোযা রাখার আদেশও দিলেন। আর বললেন, আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলে আগামী বছর দুদিন রোযা রাখবো।
আমাদের শাইখ বলেন, এ হাদীস হতে যে দলীল পাওয়া যায় তা হলো- আল্লাহ কর্তৃক নিআমত প্রদান বা শত্রæর বিদ্বেষকে নস্যাৎ করাসহ কোনো অনুগ্রহ যে দিনে প্রকাশিত হয়, সেই দিনে ঐ অনুগ্রহের জন্য আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করা এবং প্রত্যেক বছরের ঐদিনে নিআমতের শুকরিয়ার পুনরাবৃত্তি করা যাবে। এ শুকরিয়া সিজদা, নামায ও রোযার মত বিভিন্ন ধরনের ইবাদত দ্বারাই সম্পন্ন হবে। আর পৃথিবীতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আগমনের চেয়ে আর বড় নিআমত কি কিছু হতে পারে? সুতরাং এক্ষেত্রে উচিৎ উল্লেখিত ইবাদতগুলোর অনুরূপ যে কাজগুলোর মাধ্যমে আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের বিষয়টা বুঝা যায়, কেবল সেগুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকা। বিবিধ ঘটনা শ্রবণ, তামাশা বা এ ধরনের অন্যান্য যে কাজগুলো (মীলাদ উদযাপনের নামে) করা হয়, সেক্ষেত্রে এই সিদ্ধান্ত দেওয়া উচিৎ যে, যে কাজগুলো বৈধ এ দিনের (মীলাদের) আনন্দ প্রকাশার্থে তা করতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু যেগুলো হারাম বা মাকরূহ বা প্রথমে উল্লেখিত বিষয়ের বিপরীত, সেগুলো নিষিদ্ধ।
আবূ ইসহাক ইবরাহীম ইবন আবদির রহমান ইবন ইবরাহীম ইবন জামাআহ (র.) মদীনা শরীফে থাকাকালে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মীলাদের দিনে খাবারের আয়োজন করতেন এবং মানুষকে খাওয়াতেন। তিনি বলতেন, যদি সম্ভব হতো তাহলে আমি পুরো মাসব্যাপী প্রত্যেক দিন মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করতাম।
মাওলিদের সাথে যে সকল নিষিদ্ধ কাজ সংযুক্ত হয়েছে, এগুলোর ব্যাপারে ইবনুল হাজ্জ মালিকী (র.) তার ‘আল মাদখাল’ কিতাবে নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন এবং জহির জাকমক (র.) তানদাহ (বর্তমান নাম তানতা) অঞ্চলে মাওলিদ মাহফিল বন্ধ করেছেন।
আমাদের শাইখ (ইবন হাজার) বলেন, মাওলিদের ব্যাপারে অনুসন্ধান করতে হবে। যদি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ালাদাত রাতে হয়, তাহলে মানুষকে খাওয়ানোর মতো যে আমলগুলো রাতে করার উপযোগী সেগুলো করতে হবে। আর যদি তা দিনে হয়, তাহলে দিনে যেসব আমল করা যায় সেগুলো করতে হবে, যেমন রোযা রাখা। আর মাওলিদ উদযাপন করতে হবে ঐ মাসেরই একটা নির্দিষ্ট দিনে, যাতে তা মূসা (আ.) এর আশুরার দিনের ঘটনার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হয়। তা না হলে যিনি এ বিষয়ে খেয়াল রাখেন না তিনি ঐ মাসের যেকোনো দিনকে মাওলিদের দিন হিসেবে নির্দিষ্ট করতে দ্বিধা করবেন না। এমনকি এ কারণে একদল লোক মাওলিদকে বছরের যেকোনো দিনে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে যাবে এবং মাওলিদের আমলগুলো সেদিন করবে।
সর্বাধিক বিশুদ্ধ মতে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ালাদাত শরীফ হয়েছিল রবীউল আউয়াল মাসের বারো তারিখ সোমবারে। কারো মতে রবিউল আউয়াল মাসের দু’রাত, কারো মতে আট রাত বা কারো মতে দশ রাত অতিক্রান্ত হওয়ার পর। এছাড়াও এ ব্যাপারে আরো মত রয়েছে। সুতরাং এ তারিখগুলোর দিনে ও রাতে সাধ্য অনুযায়ী মাওলিদ মাহফিলের আয়োজন করা যাবে। বরং উত্তম হবে ঐ মাসের প্রতিদিন ও প্রতিরাতে মীলাদ মাহফিলের আয়োজন করা। আর মাওলিদ পাঠে উচিৎ হলো আইম্মায়ে হাদীস তাদের মাওলিদ সংক্রান্ত কিতাবসমূহে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওয়ালাদাত সংক্রান্ত যেসব রিওয়ায়াত এনেছেন, সেগুলো পাঠে সীমাবদ্ধ থাকা। যেমন এ ধরনের একটি কিতাব হলো, ইমাম আবদুর রহীম আল ইরাকীর ‘আল মাওরিদুল হানী ফি মাওলিদিন নাবী’। এ প্রসঙ্গে মক্কা শরীফে আমি আলোচনা করেছি। অথবা মাওলিদ সংক্রান্ত হাদীসের কিতাব ছাড়াও অন্যান্য যেসব কিতাবে মাওলিদের আলোচনা এসেছে, সেগুলোর রিওয়ায়াত পাঠ করা। এ বিষয়ে ইমাম বায়হাকী (র.) এর ‘দালাইলুন নবুওয়াহ’ কিতাবের নামও উল্লেখ করা যায়।
রওদা শরীফে আমাকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যে, ওয়াইযদের কাছে মাওলিদ সংক্রান্ত যেসব রিওয়ায়াত আছে, তার অধিকাংশই মিথ্যা এবং কৃত্রিমতায় ভরা। এমনকি যেসব রিওয়ায়াত অন্যকে বলা এবং শ্রবণ করা দুটিই নিষিদ্ধ, সেসব রিওয়ায়াতের চেয়েও নিকৃষ্ট এবং জঘন্য বিষয়ও তারা তৈরি করছেন। সুতরাং এক্ষেত্রে এসব বিষয়ে অবগত ব্যক্তির দায়িত্ব হলো তিনি এই সকল রিওয়ায়াতকে পরিত্যাগ করবেন এবং এগুলো পাঠ করা বাদ দেওয়ার জন্যেও আদেশ দিবেন। কেননা মাহফিলে মাওলিদে তো ওয়ালাদাত সংক্রান্ত রিওয়ায়াত পাঠ করার আবশ্যিকতা নেই। বরং কুরআন তিলাওয়াত, মানুষকে খাবার খাওয়ানো, সাদকাহ করা এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রশংসা সংক্রান্ত কবিতা ও দুনিয়া বিমুখতা সংক্রান্ত হৃদয়স্পর্শী কবিতা, যেগুলো ভালো কাজ করতে এবং আখিরাতের জন্য আমল করতে উৎসাহিত করে, সেগুলো আবৃত্তি করাই মীলাদ মাহফিলের জন্য যথেষ্ট। আল্লাহ তাআলা যাকে ইচ্ছা তাকে হিদায়াত দান করেন।