1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
মদীনা শরীফ সফরকারীর নিয়ত
আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী
  • ১০ জুন, ২০২৩

ياَ خَيْرَ مَنْ يَّـمَّمَ الْعَافُوْنَ سَاحَتَهُ
سَعْيًا وَفَوْقَ مُتُوْنِ الْاَيْنُقِ الرُّسُمِ

যাদের আঙ্গিনায় করুণা প্রাপ্তির আশায় মানুষ ছুটে আসে দৌড়ে ও
সওয়ারীর উপর আরোহণ করে তাঁদের মধ্যে আপনি সর্বোত্তম হে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
হযরত মুহাম্মদ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন-

اِنَّـمَا الْاَعْمَالُ بِالنِّـــــيَّاتِ وَاِنَّـمَــا لِاِمْرِئٍ مَّا نَوٰي

-নিশ্চয় কর্মসমূহ (সুফল ও কুফল) নিয়তের উপর নির্ভরশীল। ব্যক্তি তার নিয়তের উপর ফল লাভ করে (সুফল বা কুফল)। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ০১)
যে মুমিন ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা মদীনা শরীফ পর্যন্ত পৌঁছার তাওফীক দান করলেন, তিনি কতইনা সৌভাগ্যবান! এ সৌভাগ্যবান ব্যক্তির কি ধরনের নিয়ত করা উচিত সে সম্পর্কে ইমাম ইবনে হুমাম ফতহুল কাদির গ্রন্থে লিখেছেন-

عند العبد الضعيف تـجريد النية لزيارة قبر النبي صلى الله عليه وسلم ثـم اذا حصل له اذا قدم زيارة الـمسجد او يستفتح فضل الله سبحانه فى مرة اخرى ينويهما فيها لأن في ذلك زيادة تعظيمه صلى الله عليه وسلم و إجلاله و يوافق ظاهر ما ذكرناه من قوله عليه الصلوة والسلام لا تعلمه حاجة إلا زيارتى.

-আমি অধমের মতে একমাত্র রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র রওদ্বা শরীফ যিয়ারতের নিয়তই খালিসভাবে করা উচিত। অতঃপর যদি এ ব্যক্তির ভাগ্য প্রসন্ন হয় এবং আল্লাহ তাআলা পুনরায় তাকে আসার তাওফীক দান করেন তবে সেসময় রওদ্বা মুবারকের সাথে মসজিদেরও নিয়ত করবে। কেননা এর দ্বারা রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শন করা হয় এবংلا تعلمه حاجة إلا زيارتي এই হাদীস শরীফের বাহ্যিক অর্থের উপর আমল করা হয়। (ফতহুল কাদির, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৯৪)
কারো কারো মতে, রওদা মুবারক যিয়ারতের সাথে পবিত্র মসজিদে নববীর নিয়ত করে ফেললে নিম্নোক্ত হাদীস শরীফের উপরও আমল করা হয়। যেহেতু নিম্নোক্ত হাদীস শরীফে মসজিদে নববীর মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে এবং সফর করার প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তাই রওদা মুবারক যিয়ারতের সাথে সাথে মসজিদের নিয়তও করা উচিত। হাদীসখানা হলো-

عن ابي هريرة رضي هنله قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم لا تشد الرحال إلا الى ثلاثة مساجد، مسجد الـحرام والـمسجد الأقصى ومسجدى هٰذا

-আবূ হুরায়রা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাণী প্রদান করেছেন, তিনটি মসজিদ ব্যতীত যেন সফর করা না হয়: মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার মসজিদ। (বুখারী, হাদীস নং ১১৮৯)
হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গাযালী (র.) যিয়ারত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী فَزُوْرُوْهَا [যিয়ারত করো] প্রসঙ্গে বলেছেন, রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যিয়ারতের অনুমতি প্রদান করেছেন। অপরদিকে তিনটি মসজিদের ফযীলত সম্পর্কে আলাদা বাণী প্রদান করেছেন। উপরোল্লিখিত হাদীস শরীফের মর্মার্থ হচ্ছে- এ তিনটি মসজিদ ব্যতীত অন্য সব মসজিদ সমান।
মুহাদ্দিসীনে কিরাম বলেছেন, উপরোক্ত হাদীস শরীফ দ্বারা তিন মসজিদের প্রতি সফর করা ছাড়া অন্যান্য সব রকমের সফর অবৈধ বলে প্রমাণ করা মোটেই যুক্তিসঙ্গত নয়। অন্যান্য বহু প্রয়োজনেও যে সফর করা জায়িয এ সম্পর্কে কোনো দ্বিমত নেই। এমনকি অন্যান্য সফরগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি ফরয বা ওয়াজিব। যেমন হজ্জের জন্য সফর, জিহাদের জন্য সফর, ইলম তলব করার উদ্দেশ্যে সফর, ব্যবসা উপলক্ষ্যে সফর ইত্যাদি।
মোটকথা মসজিদের সফর সম্পর্কিত হাদীস শরীফ দ্বারা অন্য কোনো সফর নিষেধ বলে প্রতীয়মান হয় না। রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রওদা মুবারক যিয়ারতের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমূহ পর্যালোচনা করলে একথা দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, রওদা মুবারকের উদ্দেশ্যে সফর করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন অন্যতম একটি সফর।
হাদীস বিষয়ে সর্বজনস্বীকৃত বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, নিম্নলিখিত পবিত্র হাদীস দ্বারা তিনটি অন্যতম বরকতময় মসজিদের প্রতি সফর করার কথা বলা হয়েছে। উক্ত হাদীস শরীফে যিয়ারতের আদেশ বা নিষেধ সম্পর্কে কোনো ইশারাও নেই। যিয়ারতের ফযীলত অন্যান্য হাদীস দ্বারা আলাদাভাবে সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমাদের আলোচিত পবিত্র হাদীস হলো- لا تشد الرحال إلا الى ثلاثة مساجد، مسجد الـحرام والـمسجد الاقصى ومسجدى هٰذا.

-তিন মসজিদ ছাড়া সফর যেন না করা হয়: মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার মসজিদ।
প্রকাশ থাকে যে, ইমাম বুখারী (র.) নামাযের ফযীলত অধ্যায়ে এ হাদীস শরীফ উদ্ধৃত করেছেন। উক্ত অধ্যায়ের অন্য এক হাদীস হলো-

صَلٰوةٌ فِىْ مَسْجِدِىْ هٰذَا خَيْرٌ مِنْ اَلْفِ صَلٰوةٍ فِى مَا سَوَاهُ اِلاَّ الْمَسْجِدِ الْـحَرَامِ.

-আমার এ মসজিদের এক রাকাআত নামায অন্য মসজিদের হাজার রাকাআত নামায থেকেও উত্তম, তবে মসজিদে হারাম ব্যতীত। (বুখারী, হাদীস নং ১১৯০)
মিশকাত শরীফের যে অধ্যায়ে এ হাদীস শরীফ উদ্ধৃত করা হয়েছে সেখানে অধ্যায়ের নাম রাখা হয়েছে-

بَابُ الْمَسَاجِدِ وَ مَوَاضِعِ الصَّلٰوةِ

মুসনাদে ইমাম আহমদে উদ্ধৃত নিম্ববর্ণিত হাদীস শরীফ দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মসজিদত্রয় সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসসমূহের মূখ্য উদ্দেশ্য হলো বিশেষত উক্ত তিন মসজিদে নামায আদায় করার ফযীলত বর্ণনা করা। মুসনাদে আহমদে এসেছে-

شَهْرٌ قَالَ سَمِعْتُ أَبَا سَعِيدٍ الْخُدْرِيَّ وَذُكِرَتْ عِنْدَهُ صَلَاةٌ فِي الطُّورِ فَقَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَا يَنْبَغِي لِلْمَطِيِّ أَنْ تُشَدَّ رِحَالُهُ إِلَى مَسْجِدٍ يُبْتَغَى فِيهِ الصَّلَاةُ غَيْرَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَالْمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِي هٰذَا (مسند الامام احمد)

-হযরত আবূ সাঈদ খুদরী (রা.)-এর নিকট ‘তুরে’ নামায পড়া সম্পর্কে আলোচনা করা হলে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নামায আদায় করার জন্য উষ্ট্রপৃষ্ঠে (সফরের উদ্দেশ্যে) হাওদা স্থাপন করা উচিত নয় মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার মসজিদ ব্যতীত। (মুসনাদ আহমদ, হাদীস নং ১১৫৫২)
পূর্বে উল্লেখিত হাদীসের মূখ্য উদ্দেশ্য কী তা মুসনাদে ইমাম আহমদে উদ্ধৃত এ হাদীস দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গেল। সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই যে, রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উদ্দেশ্য হলো তিন মসজিদে নামায আদায় করার ফযীলত বর্ণনা করা।
সহীহ মুসলিম শরীফে বর্ণিত আছে- عن سعيد بن الـمسيب عن ابى هريرة رضى الله عنه قال قال رسول الله صلى الله عليه وسلم صلوٰة فى مسجدى هٰذا خير من الف صلوة فى غيره من الـمساجد الا المسجد الـحرام (مسلم- ১৩৯৪)

আল্লামা কাসতাল্লানী তৎপ্রণীত ‘আল মাওয়াহিবুল্লাদুন্নিয়া’ গ্রন্থে একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, শায়খ ওলীউদ্দিন ইরাকী (র.) বলেন, আমার পিতা [যইনুদ্দীন ইরাকী (র.)] শায়খ আব্দুর রহমান বিন রজব দিমাশকী হাম্বলী (র.) এক সঙ্গে হযরত ইবরাহীম (আ.) এর শহরের উদ্দেশ্যে সফর আরম্ভ করেন। শহরের নিকট পৌঁছলে ইবনে রজব বলেন, আমি ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ.) এর মসজিদে নামায আদায় করার নিয়ত করে ফেলেছি যেন কবর যিয়ারতের নিয়ত না হয়। ইবনে রজবের কথা শুনে যইনুদ্দীন ইরাকী বলেন, আপনি রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লমের নির্দেশের খেলাফ করেছেন। কেননা রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের  নির্দেশ হলো, তিন মসজিদের উদ্দেশ্য ব্যতীত যেন সফর করা না হয়। অথচ আপনি ঐ তিন মসজিদ ছাড়া চতুর্থ আর একটি মসজিদের নিয়ত করে ফেলেছেন। পক্ষান্তরে আমি রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ পালন করেছি। রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নির্দেশ হলো زُوْرُوْهَا অর্থাৎ কবর যিয়ারত কর। আর কোনো হাদীস শরীফে বলা হয়নি যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের কবর যিয়ারত করা নিষেধ। আমি নির্দেশ মোতাবিক কাজ করছি। উত্তর শুনে শায়খ আব্দুর রহমান বিন রজব দিমাশকী (র.) স্তব্ধ হয়ে গেলেন। (মাওয়াহিব, ৩য় খ-, পৃষ্ঠা-৩০১)
শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) লিখেছেন, যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা একটি বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও বরকতময় কর্ম। এ সফরের আদবসমূহের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আদব হচ্ছে নিয়তের সংশোধন। যেহেতু রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারত আল্লাহর নৈকট্য লাভের একটি উপায়, সেহেতু আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে, শাফাআতের আশায় হুযূর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্র দরবারে উপস্থিত হওয়ার চেয়ে উত্তম আর কী হতে পারে?
তিনি আরো বলেন, সরওয়ারে কায়েনাত হযরত রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারতের সাথে পবিত্র মসজিদের (মসজিদে নববীর) ইরাদাও করবেন। কেননা তাও মুস্তাহাব। (জযবুল কুলুব)
যিয়ারতকারীগণকে একটি বিষয়ে বিশেষভাবে লক্ষ্য রাখার জন্য বুযুর্গানে দ্বীন বলেছেন যে, সফর যেন দুনিয়ার কোনো উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্ত, লোক দেখানোর জন্য বা নিছক ভ্রমণের জন্য না হয়; যদি হয় তবে সম্পূর্ণ আমল নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া কেউ যদি লোকে কৃপণ বলবে এ অপবাদ থেকে নিষ্কৃতি লাভের জন্য অথবা মদীনা শরীফের মহত্ত্ব-গুরুত্ব সম্পর্কে (মন্দ লোকের প্রভাবে) আদৌ বিশ্বাসী না হয়, কেবলমাত্র লোকজন অমুক হাজী মদীনা শরীফ না গিয়ে ব্যয় সংকোচন করেছে এ অপবাদ মোচনের জন্য সফর করে থাকে তবে তার সফর অর্থহীন।
উর্দূতে একটি শ্লোক

کو ئ دیوانا بنتا ھے * اور کو ئ دیوانا ھو تا ھے

অর্থাৎ কেউ পাগল সাজে, আবার কেউ পাগল হয়।
প্রকৃত আশিক যে ব্যক্তি সে আশিকের বাহ্যিক রূপ ধারণ করে না। বাহ্যিক আড়ম্বর পরিত্যাগ করে হৃদয়ে প্রজ্জ্বলিত আগুনের উষ্ণতা অনুভব করতে থাকে। নীরবে সে হৃদয়ের কান্না শ্রবণ করে। তাই মদীনার সার্থক মুসাফিরগণকে আমরা দেখতে পাই যে, তারা ধৈর্য সহকারে অফুরন্ত ব্যথা হৃদয়ে লয়ে গিরি-মরু অতিক্রম করে মদীনার পথে চলছেন। শত শত ঢেউ বুকে লয়ে সমুদ্র যেমন শান্ত-স্তব্ধ, তিনিও তেমন।
ঘাত প্রতিঘাত ব্যথা বেদনায় আমার জীবন ভরা
ভাঙ্গা গড়ার ইতিহাস যেন আমার জীবন সারা।
বহুদূর থেকে কত ব্যথা লয়ে মরু-গিরি পার হয়ে
অধম কাঙ্গাল এসেছে হেথায় বুক ভরা আশা নিয়ে।
(ইমাদ উদ্দিন ফুলতলী)
হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.)-এর খিদমতে এক মহিলা উপস্থিত হয়ে বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাযার শরীফ যিয়ারত করব। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রা.) পর্দা সরিয়ে মেয়েলোকটিকে রওদা মুবারকের দিকে ইঙ্গিত করলেন। মেয়েলোকটি যিয়ারত শেষ করে কাঁদতে আরম্ভ করল এবং কাঁদতে কাঁদতে সেখানেই মৃত্যুবরণ করল। (মাওয়াহিব, ৮ম খ-, পৃষ্ঠা-৩০৫)

দুঃখজনক ব্যতিক্রম
শায়খ ইবনে তায়মিয়া (মৃত্যু সন ৭২৮ হিজরী) মত প্রকাশ করেন যে, রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা অবৈধ। তিনি দালিলিক প্রমাণ হিসাবে নিম্ন বর্ণিত হাদীস পেশ করেন-

لَا تُشَدُّ الرِّحَالُ إِلَّا إِلٰى ثَلَاثَةِ مَسَاجِدَ، مَسْجِدِ الْحَرَامِ وَمَسْجِدِ الْأَقْصَى وَمَسْجِدِي هٰذَا

অর্থাৎ তিনটি মসজিদ ছাড়া সফর যেন না করা হয়: মসজিদুল হারাম, মসজিদুল আকসা ও আমার মসজিদ।
কিন্তু ইসলামের সঠিক বাহক উলামায়ে কিরাম এ আশ্চর্যজনক মতবাদকে অবাঞ্ছিত বলে আখ্যায়িত করেন। ইমাম কাসতাল্লানী এ প্রসঙ্গে বলেন-

وللشيخ تقى الدين ابن تيمية هنا كلام شنيع عجيب يتضمن منع شد الرحال للزيارة النبوية وانه ليس من القرب بل بضد ذالك، وردَّ عليه الشيخ تقي الدين السبكى )رح( فى شفاء السقام فشفى صدور المؤمنين .

-এ প্রসঙ্গে শায়খ তকিউদ্দিন ইবনে তায়মিয়া এখানে আশ্চর্যজনক ঘৃণ্য উক্তি করেছেন। সে উক্তির মধ্যে রয়েছে রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করা ঠিক নয় এবং এ কর্ম আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উপকরণ নয়; বরং তার বিপরীত। ইবনে তায়মিয়ার উক্তিকে খ-ন করেছেন শায়খ তকিউদ্দিন সুবুকী তৎপ্রণীত “শিফাউস সাকাম” কিতাবে। যা দ্বারা তিনি মুমিনগণের অন্তরকে সুস্থ করেছেন। (মাওয়াহিব, ৮ম খ-, পৃষ্ঠা ৩০০)

একটি সহজ অংক
আমাদের দেশের অনেক হাজী হজ্জ সমাপন করে মদীনা মুনাওয়ারায় যান। মক্কা শরীফ থেকে মদীনা মুনাওয়ারা সফর করার সময় সফরের কষ্ট ছাড়াও বাংলাদেশী কয়েক হাজার টাকা খরচ করেন। এদিকে মক্কা শরীফ অবস্থান করে মসজিদুল হারামে নামায আদায় করলে এক রাকাতের বিনিময়ে এক লক্ষ রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে মদীনা শরীফের মসজিদে নামায আদায় করলে এক রাকাতের বিনিময়ে হাজার রাকাতের সওয়াব পাওয়া যায়।
এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় সফর যদি কেবল মসজিদের জন্যই হয় তবে এত কষ্ট সহ্য করার ও অর্থ ব্যয় করার কি প্রয়োজন আছে, যখন বিনা অর্থ ব্যয়ে ও পরিশ্রমে মক্কা শরীফে একশত গুণ বেশি সওয়াব পাওয়া যায়? এখানে মূল বিষয়টি হলো ভিন্ন।

মদীনা মুনাওয়ারা সফরের আসল উদ্দেশ্য
রাহমাতুল্লিল আলামীনের শান্তির নীড় মদীনা মুনাওয়ারার দিকে সফর করার আসল উদ্দেশ্য হলো যিয়ারত। কারণ যিয়ারত এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যার জন্য ইমানদারগণ অর্থ ব্যয় করতে ও অপরিসীম কষ্ট সহ্য করতে মানসিকভাবে স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রস্তুত। আশিকের জন্য সে কষ্ট আনন্দদায়ক। ইকবাল বলেছেন-

جفاجو عشق میں ھو تی ھے وہ جفا ھی نہیں
ستم نہ ھو تو محبت میں کچہ مزا ھی نہیں (اقبال رح)

পাঠক মনে করতে পারেন যে আমার স্বল্প জ্ঞানের আলোকে একটি খোঁড়া যুক্তি আপনাদের সামনে তুলে ধরছি। তাই তিরমিযী শরীফের ভাষ্য “মাআরিফুস সুনান” কিতাবে মুহাদ্দিস মাওলানা ইউসুফ বিন্নূরী এ বিষয়ে যে সুন্দর যুক্তি পেশ করেছেন তা নিম্নে উদ্ধৃত করলাম:

ومن ذا الذى يتحمل متاعب الرحلة ومكابدة السفر نـحو سبع مأة ميل ايابا وذهابا الى تـحصيل اجر الف صلاة فى حين ان يتمكن بدله اجر مأة الف صلاة فى الـمسجد الـحرام من غير اَيَّة مكابدة وعناء, فأيَّة نفس تسمح بـهذه التفدية العظيمة والتضحية الـجليلة فى نقص اجوره العزيزة من غير متاعب و عناء, كلا ثـم كلا! وانـما تستحث النجب والركائب الى تلك البقعة الـمقدسة التى ثوى فيها حبيب رب العالـمين ورحمة للعالمين وامام المرسلين و سيد ولد ادم اجـمعين الى تلك البقعة التى اشرقت بـها الانوار الالـهية وحفته التجليات الربانية.

তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাকার কর্তৃক প্রদত্ত যুক্তির সার সংক্ষেপ হলো এই-
মক্কা শরীফের মসজিদুল হারামে এক লক্ষ রাকাতের সওয়াব ছেড়ে এক হাজার রাকাতের সওয়াব প্রাপ্তির জন্য প্রায় সাতশত মাইল সফরের কষ্ট সহ্য করে মদীনায় কেউ কি যাবে? না, কখনও না; বরং সফরকারীকে উৎসাহিত করে সেই পবিত্র মাটি যেখানে সমাহিত আছেন হাবীবু রাব্বিল আলামীন, ইমামুল মুরসালিন, সায়্যিদে ওলাদে আদম। সেই সে পবিত্র ভূমির দিকে লোক সফর করে যেখানে ভাস্মর হয়েছে নূরে ইলাহী ও তজল্লিয়াতে রব্বানী।
এ সুন্দর যুক্তিটি পেশ করার পর তিনি লিখেছেন জামহারাতুল উম্মা অর্থাৎ মুসলিম উম্মার বেশিরভাগের মতে রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর শরীফ যিয়ারত করা আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উত্তম উপকরণসমূহের মধ্যে একটি এবং এতদুদ্দেশ্যে সফর করা জায়িয বরং উত্তম। অতঃপর ‘ওফাউল ওফাʼরʼ বরাত দিয়ে লিখেছেন হানাফী মাযহাবের মতে রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর শরীফ যিয়ারত উত্তম মুস্তাহাব কর্ম, যা ওয়াজিবের নিকটবর্তী। অনুরূপভাবে মালিকী হাম্বলী মাযহাবেরও মত রয়েছে।
অতঃপর তিনি লিখেছেন,

مالسنا في حاجة الى نقله بعد ثبوت الإجماع القولي والعمل معا

অর্থাৎ, যেহেতু এ বিষয়টির উপর মুসলমানদের বক্তব্য ও আমলের দিক থেকে ইজমা হয়ে গেছে সেহেতু এগুলো উদ্ধৃত করার কোনো প্রয়োজন মনে করি না।
ইমাম সুয়ূতী প্রমাণ করেছেন রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারত যে আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভের উপকরণ তা কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস দ্বারা প্রমাণিত।
তকিউদ্দীন আলহিসনী বলেন,

كان ابن تيمية مـمن يعتقد ويفتى بأن شد الرحال الى قبور الانبياء حرام لا تقصر فيه الصلوة .

-ইবনে তায়মিয়া বিশ্বাস করতেন এবং ফতওয়া দিতেন যে, আম্বিয়ায়ে কিরামের কবরের উদ্দেশ্যে সফর করা হারাম। এ সফরে নামায কসর আদায় করা যায় না।
তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাকার ইবনে তায়মিয়ার মতবাদের সার সংক্ষেপ নিম্নরূপ বর্ণনা করেছেন-

ويقول ابن تيمية أن السفر اليه غير جائز -نعم يسافر إلى مساجده صلى الله عليه وسلم ثـم بلغ الـمدينة و صلى فى الـمسجد فيستحب له أن يزور قبره صلى الله عليه وسلم لـما كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يزور قبر بقيع الغرقد وغيره.

-ইবনে তায়মিয়া বলেন, (যিয়ারতের উদ্দেশ্যে) সফর করা জায়িয নয়। হ্যাঁ, রাসূলুল্লাহ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মসজিদের দিকে সফর করবেন, যখন মদীনায় পৌঁছবেন এবং মসজিদে নামায সম্পন্ন করবেন, তখন কবর শরীফ যিয়ারত করা মুস্তাহাব। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জান্নাতুল বাকী ও অন্যান্য কবরস্থান যিয়ারত করতেন।
তিরমিযী শরীফের ব্যাখ্যাকার বলেন, আলোচনা ও পর্যালোচনার পর একথাই প্রমাণিত হয় যে ইবনে তায়মিয়া ও তার অনুসারীগণ এ অভিমতটি নিয়ে আলাদা হয়ে গেছেন (অর্থাৎ একঘরে হয়ে গেছেন)। যদিও সমস্ত ইমামগণের ও জমহুর উম্মতের অভিমতের বিপক্ষে ইবনে তায়মিয়ার অভিমতগুলোর কোনো কোনোটির সাথে একমত পোষণকারী আছেন। যদি আমরা ধরে নেই যে, কিছু সংখ্যক লোক ইবনে তায়মিয়ার দিকে চলে গেছেন, তবে যেতে দিন। পূর্বে যে নগণ্য সংখ্যক লোক এরূপ মতবাদ পোষণ করেছিলেন তাদের সে মতবাদ নিছক উক্তি হিসাবে পুস্তকের পাতার ভাজে লুক্কায়িত ছিল এবং তার প্রভাব নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইবনে তায়মিয়া এমন ব্যক্তি যিনি সেগুলো কবর খোঁড়ে বের করে নিয়ে আসলেন এবং নতুনভাবে তা প্রবর্তন করলেন। এমনি করে ইবনে তায়মিয়া মুসলিম উম্মার মধ্যে নতুন ফ্যাসাদের একটি দরজা উম্মুক্ত করে দিলেন।
আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী (র.) ইবনে তায়মিয়ার মতবাদ খ-নকারী উলামায়ে কিরামের আলোচনা করার পরে লিখেছেন-

ولـم يقدر ابن تيمية و اتباعه ان يـجيبوا عنه بـجواب شاف.

ইবনে তায়মিয়া ও তদীয় অনুসারীগণ তার মতবাদ খ-নকারীগণের সন্তোষজনক কোনো জবাব দিতে সক্ষম হননি। (মাআরিফুস সুনান, খ- ৩, পৃষ্ঠা ৩২৯-৩৩৩)

ফেইসবুকে আমরা...