আমাদের বাড়িতে মেহমান আসবে শুনলে আমরা স্বভাবত কী করে থাকি? বাড়ি-ঘর, পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন করা, আলনার অগোছালো কাপড়গুলো গুছিয়ে রাখা। বিছানা আর বালিশ সাজাই নতুন কাপড়ে। আর হ্যাঁ, মেহমানের জন্য হরেক রকম পদের রান্না না করলে কি আর হয়? অনেকের দরজায় তো রঙিন পর্দাও উঠতে দেখা যায়। র্অথাৎ এই নিয়ে আমাদের সাধ্যে কুলোয় এমন কোনকিছুই করা থেকে আমরা বিরত থাকি না। মোটকথা, সেদিন পুরো বাড়ির চেহারাটাই বদলে যায়। আমার আলাপ করার বিষয় এটা নয়। স্রেফ একটি উদাহরণ টেনেছি বোঝাবার স্বার্থে এবার আসল কথায় আসা যাক।
এই যে মেহমান আসা নিযে আমাদের এতো এতো আয়োজন। এটা অবশ্য ইতিবাচক দিক। কিন্তু দেখুন, আর কিছুদিন পর পবিত্র মাহে রামাদান আমাদের দরজায় কড়া নাড়বে। মহিমান্বিত সেই মাস; যে মাসে পবিত্র কুরআন অবর্তীণ হয়েছে। আকাশ থেকে ফিরিশতারা ঝাঁকে ঝাঁকে যমীনে নেমে আসে। কবরের আযাব বন্ধ হয়ে যায়। চিরশত্রু শয়তান হয় শিকলাবদ্ধ। আসমান থেকে বর্ষিত হয়ে রহমতের বারিধারা। অথচ সেই রামাদান আমাদের দোর-গোড়ায় থাকা সত্ত্বেও তাকে নিয়ে সেরকম প্রস্তুতি নেই আমাদের। সবকিছু ঠিকঠাক চললেও রামাদান নিয়ে আমাদের নেই কোন পরিকল্পনা।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রামাদান আসার অনেক আগ থেকেই প্রস্তুতি নিতেন। এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কিরামদের উপদেশ দিতেন। তিনি তাদের একটি দুআ শিক্ষা দিয়েছেন যা রামাদানের পূর্ব প্রস্তুতির উপদেশও দিতেন। তিনি তাদের একটি দুআ শিক্ষা দিয়েছেন যা রামাদানের পূর্বপ্রস্তুতির প্রতিই ইঙ্গিত প্রদান করে। কিন্তু পবিত্র রামাদান নিয়ে আমাদের যেন বিন্দুমাত্র ভাববার সময়-ই নেই। এটা কি সুন্নাহের খেলাপ নয়? আমাদের কি উচিত নয় আজ থেকে রামাদানের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা। তাই আসুন এখন থেকে, এই মুর্হূত থেকেই রামাদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করি। রামাদানের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা যে কাজগুলো করতে পারি।
০১। তাওবা-ইস্তগিফার করা ও দুআ করা
রামাদানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রথমেই আমরা তাওবা- ইস্তিগফারের মাধ্যমে নিজেদেরকে পূর্ববর্তী জীবনের গুনাহ থেকে পবিত্রার করার চেষ্টা করা উচিত। কারণ গুনাহমুক্ত মন ও শরীর নিয়ে আল্লাহর ইবাদত করার যে তৃপ্তি তা অতুলনীয়। আর রামাদান মাস পাওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শেখানো দুআ বারবার পাঠ করাও রামাদানের র্পূবপ্রস্তুতির একটি অন্যতম আলামত। দুআটি হলো,
اللهم بارك لنا في رجب وشعبان وبلغنا رمضان
-হে আল্লাহ রজব ও শাবান মাসের (ইবাদাতে) বরকত আমাদরে দিন। আর আমাদেরকে রামাদান মাস র্পযন্ত পৌঁছে দিন। (আদ-দাওয়াতুল কাবীর লিল বাইহাকী, হাদীস-৫২৯)
০২। রোযার মাসাইলের জ্ঞানার্জন
রামাদান মাসে রোযাগুলো সুন্দর ও যথাযথভাবে আদায় করার জন্য রোযার যাবতীয় মাসাইল সর্ম্পকে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক মুসলমানের জন্য জানা ফরয। কারণ যে বিধান ফরয তার জ্ঞান অর্জন করাও ফরয। তাই রোযার র্পূবপ্রস্তুতি হিসেবে আমাদের উচিত রোযা সম্পৃক্ত কুরআনের আয়াতগুলোর তাফসীর পড়া, হাদীস পড়া ও ফিকহের কিতাব থেকে রোযার মাসাইল পড়া। বিশেষ করে রোযা ভঙ্গের কারণ, মাকরূহ হওয়ার কারণ, রোযা অবস্থায় কী কী কাজ করলে রোযার ফদীলত নষ্ট হয়ে যায় ইত্যাদি বিষয় গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করা যা রামাদানের পূর্বপ্রস্তুতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
০৩। দৃঢ় মানসিক প্রস্তুতি
‘এবার রামাদান মাসে আমি এই এই কাজ করবোই করব’ এই রকম দৃঢ় নিয়ত করতে হবে। যেমন- কুরআন কারীম কয়কেবার খতম করব, পূর্ববর্তী সকল গুনাহ থেকে বিশুদ্ধ তাওবা করব। রামাদানে সবার সাথে আচার-আচরণে, কথাবার্তায় ভদ্রতা বজায় রাখব, কাউকে কষ্ট দিব না। এরকম দৃঢ় মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।
০৪। বিগত রামাদানের ভূল-ত্রুটি থেকে শিক্ষা নেওয়া
পূর্ববর্তী রামাদানে কী কী কারণে আমি ইবাদতে মনোযোগ দিতে পারিনি সেগুলো নির্ণয় করে তা থেকে দূরে থাকতে হবে।বর্তমানে নেট দুনিয়া আমাদের অনেক অনেক সময় নষ্ট করে, তাই এটা থেকে রামাদানে দূরে থাকার নিয়াত করতে পারি।
০৫। শাবান থেকে রোযার প্র্যাক্টিস
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শাবান মাসে বেশি বেশি রোযা রেখে উম্মাতকে রামাদান মাসের প্রস্তুতি নেয়ার পদ্ধতি শিখিয়ে গেছেন। তাই আমরাও রামাদান মাসে রোযা রাখার র্পূবপ্রস্তুতি হিসেবে শাবান মাসে কিছু রোযা রেখে নিজেদেরকে অভ্যস্ত করতে পারি যাতে রামাদান মাসে রোযা রাখা আমাদের জন্য সহজতর হয়। হাদীস শরীফে আম্মাজান আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
وما رأيته أكثر صياما منه في شعبان
-আমি শা’বান মাসের চেয়ে অন্য কোনো মাসে মহানবী সাল্লাল্লাহু ওয়াসাল্লামকে অধিক সাওম (নফল) পালন করতে দেখিনি। (সহীহ বুখারী, হাদীস-১৯৬৯)
০৬। রামাদানের ২৪ ঘন্টার রুটিন
রামাদান মাসের প্রতিটি দিন আমি কেমন করে অতিবাহিত করব তার একটি রুটিন থাকা উচিত। রুটিন মুতাবেক আমল করলে গুছানোভাবে বহু আমলই করা যায়। নতুবা দেখা যায় আমল করব করব বলে সময় নষ্ট হয় কিন্তু আমলের কিছুই হয় না। নিজের মতো করে প্রত্যেকেরই একটি রুটিন থাকা চাই। যেমন- সালাতুল ফজরের পূর্বে তাহাজ্জুদ পড়া, সাহরী গ্রহণ করা, এরপর না ঘুমিয়ে ফজরের পূর্বপর্যন্ত ইস্তিগফার পড়া, ফজরের ওয়াক্ত হলে সুন্নাত পড়া, তারপর মসজিদে গিয়ে জামাআতের সাথে ফজরের সালাত পড়া। ফজরের নামাযের পর ঘুমের প্রয়োজন হলে র্সবােচ্চ এক বা দুই ঘন্টা ঘুমানো (এই নিয়তে যাতে দিনের বেলা সুন্দরভাবে নেক আমল করতে ঘুম ডিস্টার্ব না করে)। ঘুম থকেে উঠে দীর্ঘ সময় নেক আমলের সাথে নিয়োজিত রাখা। বিশেষ করে কুরআন তিলাওয়াত, যিকর-আযকার ইত্যাদির মাধ্যমে যুহর ওয়াক্ত পর্যন্ত পৌঁছা।অতঃপর যুহরের সালাত জামাআতের সাথে আদায় করে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া যাতে রাতে ইবাদাতে মগ্ন থাকতে পারা যায়। তারপর আবার কিছু নেক আমল করে আসরের সময় হলে জামাআতরে সাথে নামায পড়ে মসজিদে বসে ইমাম সাহবেরে ওয়ায বা হাফিয সাহেবদের তিলাওয়াত শুনা। মহিলা হলে বিসমিল্লাহ বলে ইফতারের জন্য হালকা খাবার প্রস্তুতি করার কাজ করা তবে সেক্ষেত্রেও মৌখিক যিকর-আযকার পাঠ করা উচিত। মাগরিবের সময় হলে ইফতার করে জামাআতের সাথে মাগরিবের নামায পড়ে হালকা বিশ্রাম নিয়ে সালাতুল ইশা ও তারাবীর নামাযের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া। অতঃপর তারাবীর নামায শেষে বাসায় এসে রাতের খাবার গ্রহণ করে বিশ্রাম নিয়ে আবার যতটুকু সম্ভব নামায, কুরআন তিলাওয়াত ইত্যাদি নেক আমল করা উচিত। এরপর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আবার তাহাজ্জুদের জন্য জেগে ওঠা। এইভাবে নিজের মতো করে প্রত্যেকের একটি রুটিন থাকলে আমল করা সহজ হবে এবং বেশি ফায়িদাও লাভ করা যাবে। ইন শা আল্লাহ!
০৭। গরীবদের সহযোগিতা করা
রামাদান মাসে গরীব মুসলমানরা যেন শান্তিতে রোযা রাখতে পারে এজন্য সমাজের ধনীদের উচিত গরীবদেরকে এক মাসের জন্য যা প্রয়োজন তার ব্যবস্থাপনা করা। অনেকে রামাদানের শেষের দিকে যাকাতের ফরয আদায় করেন। আমি বলব আপনারা শাবান মাসে যাকাতের ফরয আদায় করুন, এতে গরীবরা পরিবারের খরচ সংগ্রহের পেরেশানি থেকে রেহাই পাবে, ফলে রামাদানের রোযা সুন্দরভাবে আদায় করতে পারবো।
০৮। গুনাহ থেকে নিজেকে দূরে রাখা
পবিত্র রামাদান মাসের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে এখন থেকেই যাবতীয় গুনাহ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করা। ফাহিশা বা অশ্লীল কাজ ও কথাবার্তা থেকে নিজেকে দূরে রাখা। গীবত, মিথ্যা কথা, গালিগালাজ ইত্যাদি গুনাহ থেকে নিজেকে হিফাযতের মাধ্যমে রামাদানের পবিত্রতাকে স্বাগত জানানো।
০৯। চাঁদ দেখার সুন্নাত পালন
চাঁদ দেখার সুন্নাত তো এখন প্রায় বিলুপ্ত। হেলাল কমিটি বা জাতীয় চাঁদ দেখা কমিটিকে এই দায়িত্ব দিয়ে নিজেদের আর এই সুন্নাত পালনে কোনো আগ্রহ এখন আর আমাদের নেই। আমরা চাঁদ দেখার সেই সুন্নাতকে আবার জাগ্রত করব। মাসের ২৯ তারিখে চাঁদ দেখার চেষ্টা করব। ঐ দিন চাঁদ দেখা না গেলে ৩০ তারিখ আবার চাঁদ দেখার চেষ্টা করব।
১০। অন্যান্য পরিকল্পনা
নিজের পরিবারের লোকদের জন্য রামাদান মাসে যা কিছু প্রয়োজন তা ব্যবস্থা করে রাখা যাতে রামাদানে পেরেশানিতে পড়তে না হয়। তাছাড়া রামাদানে আমি প্রতিদিন কিছু দান-সাদাকাহ করব, কিছু মানুষকে সাহায্য করব, সামাজিক কিছু খিদমত করব, ইয়াতীম-মিসকীনদের পাশে দাঁড়াবো এই রকম বিভিন্ন নেক আমলের পরিকল্পনা করে রাখা উচিত।
পরিশেষে বলতে চাই, নেক আমলের জন্য বছরের শ্রেষ্ট মাস হলো রামাদান। এই মাস হলো রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের উপলক্ষ্য। এই মাসের যাবতীয় ফদীলত লাভের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি খুবই জরুরী। এই মাসের প্রতিটি মুহূর্ত যেন আমরা নেক আমলে ব্যয় করতে পারি এবং তার প্রস্তুতি নেওয়ার তাওফীক যেন আল্লাহ আমাদের সবাইকে দান করেন। আমীন!