1. redwan.iub@gmail.com : admin2021 :
  2. admin@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
  3. editor@parwana.net : Parwana Net : Parwana Net
Logo
নভেম্বর ২০২২
রেদওয়ান আহমদ চৌধুরী
  • ২ নভেম্বর, ২০২২

উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানি সংকটের কারণে উদ্ভূত একটি গুরুতর অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিতে রয়েছে বিশ্ব। বাংলাদেশ ব্যাপক ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষের প্রকৃত ঝুঁকির সম্মুখীন। কোভিড-১৯ মহামারী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত করেছে, যার ফলে শ্রমজীবী মানুষ তাদের কর্মসংস্থান এবং আয়ের উৎস হারাচ্ছে। বিশেষত নিম্ন আয়ের পরিবারগুলিতে ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। খাদ্য ঘাটতির ক্রমবর্ধমান সমস্যা সমাধান করতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

মহামারীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করে দেয়। ইউক্রেন বিশ্বব্যাপী খাদ্য সরবরাহের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইউক্রেনকে বিশ্বের রুটির ঝুড়ি বলা হয়। কারণ বেশ কয়েকটি দেশ গমের জন্য দেশটির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু রাশিয়ার আগ্রাসনের পর থেকে ইউক্রেন থেকে খাদ্য রপ্তানি কমে গেছে। বর্তমানে এসব দেশগুলোকে অন্য জায়গা থেকে খাদ্য আমদানি করতে হচ্ছে, যা পরিবহন এবং আনুষঙ্গিক খরচের পাশাপাশি সরবরাহের সময় বাড়িয়ে দিয়েছে। যার ফলে খাদ্যের দাম হচ্ছে আকাশচুম্বী। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্বজুড়ে ফসল কাটাকে ব্যাহত করেছে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়া পরিবর্তনের ঝুঁকিও তীব্র হয়েছে। ফলে বিশ্ব এখন এক নযীরবিহীন খাদ্য সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আশঙ্কা করছে, বিশ্বব্যাপী শস্য ও খাদ্য উৎপাদন ১.৪ শতাংশ হ্রাস পাবে।

খাদ্য সংকট দেখা দিলে খাদ্য রপ্তানিকারী দেশগুলো সুরক্ষাবাদের আশ্রয় নেয়। সম্প্রতি কয়েকটি দেশ তাদের খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে এটি পরিলক্ষিত হয়। নিজের মানুষকে বাঁচানোর তাগিদে বিশ্বব্যাপী সহযোগিতার চেতনা হারিয়ে যায়। বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থার নিয়মাবলিও এই জাতীয় সংকটের সময় পাতলা হয়ে যায়।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের কৃষিতে উল্লেখযোগ্য হারে প্রবৃদ্ধি ঘটছে। শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি দেশকে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সাহায্য করেছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং ফসলি জমির সংকোচন সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে। আমিষ এবং শাকসবজি বৈচিত্র্যের কারণে জনগণের পুষ্টিমান উন্নতি লাভ করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং ইউনিসেফের মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯ এর তথ্যমতে, অপুষ্টির মাত্রা ২০১৩ সালে ৪২ শতাংশ থেকে ২০১৯ সালে ২৮ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে খাদ্যের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এক দশক ধরে দেশটিতে যে সবুজ বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। কৃষি খাতের জন্য সরকারি নীতিমালা এমন একটি বিপ্লব অর্জনে সহায়তা করেছে।

তবে এফএওর অনুমান বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। সংস্থাটির প্রকাশিত প্রতিবেদনে খাদ্য সংকটের মুখে থাকা ৪৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তাই আমাদেরকে শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। মহামারী চলাকালে অনেক দেশে কৃষি উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থা ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন ভালোই ছিল। চলতি বছরের শুরুতে নদী ভাঙনে বোরো ধান ঘরে তুলতে পারেননি কৃষকরা। দুই ধাপের বন্যায় দেশের এক চতুর্থাংশের আউশ ধানের ফলন ব্যাহত হয়েছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে আগত সংকট উত্তরণের জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি প্রয়োজন।

প্রথমত, জ্বালানি ও সারের উচ্চমূল্যের কারণে কৃষকদের জন্য ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই খাদ্য উৎপাদনে ভর্তুকি থাকা জরুরি। সরকারের উচিত ক্ষুদ্র কৃষকরা যাতে ভর্তুকি পায় তা নিশ্চিত করা। মহামারীর সময় সরকার প্রতিটি কৃষকের জন্য ৫০০০ টাকা প্রদান করলেও ব্যাংকগুলোর  অপ্রয়োজনীয় শর্তের কারণে অনেকেই তা পাননি। এখন উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য বিক্রয়মূল্য নিশ্চিত করতে হবে। ভালো দাম না থাকলে কৃষকরা খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহিত হবেন না। ফলে খাদ্যের প্রাপ্যতা আরও খারাপের দিকে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশে ডিজেল চালিত পাওয়ার টিলার এবং ট্রাক্টর ব্যবহার করে বেশিরভাগ জমি চাষ করা হয়। সরকার জ্বালানির দাম রেকর্ড মাত্রায় বাড়িয়েছে, যা জনসংখ্যার সমস্ত অংশকে কঠোরভাবে আঘাত করছে। তাই কৃষকদের জন্য ডিজেলে ভর্তুকি প্রদান করা উচিত। যাতে দেশের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য চাষাবাদ এবং মজুদ বজায় থাকে। সারের ক্ষেত্রে শুধু দামই নয়, প্রাপ্যতাও কৃষকদের জন্য উদ্বেগের বিষয়। সরকারকে সাশ্রয়ী মূল্যে সার সরবরাহ করতে হবে।

দ্বিতীয়ত, এটা একটা ভালো লক্ষণ যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকার জন্য জমির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের নীতিনির্ধারকরা যে ভবিষ্যত খাদ্য সংকটের জন্য চিন্তিত তা এখন বোধগম্য। সময়ের সাথে সাথে বাংলাদেশে একর প্রতি কৃষি ফলন বৃদ্ধি পেলেও তা এখনো অনেক খাদ্য উৎপাদনকারী দেশের তুলনায় কম। ফলন আরও বৃদ্ধির জন্য  উদ্ভাবন এবং কৃষি উন্নয়নে উচ্চতর বিনিয়োগ প্রয়োজন। কৃষি খাতে উৎপাদনশীলতা ও স্থায়িত্ব উন্নত করতে প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন প্রয়োজন। আমাদের বিজ্ঞানীরা বন্যা, খরা ও লবণাক্ত পানি সহনশীল ধান সহ বেশ কিছু জাত উদ্ভাবন করেছেন। এখন ফলন বৃদ্ধি এবং জমিকে আরও উৎপাদনশীলভাবে ব্যবহার করার উদ্ভাবনী উপায়গুলো খুঁজে বের করতে হবে।

তৃতীয়ত, বেশি উৎপাদন হলেও দেশে মজুদ সুবিধা অপ্রতুল। যার কারণে বেশিদিন খাদ্য সংরক্ষণ করা যায় না। সুতরাং সরকারের উচিত আরও উন্নত স্টোরেজ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা এবং কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে ফসল সংগ্রহ করা, যাতে তারা উৎপাদন খরচ কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে পারেন। ভালো দাম না থাকলে কৃষকরা পরবর্তী মৌসুমের জন্য নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন, যা খাদ্য সংকটকে বাড়িয়ে দেয়। মধ্যস্বত্বভোগী একটি ব্যাধিযুক্ত চক্র। এই প্রথা উচ্ছেদ করে সরকারের ক্রয় প্রতিনিধিদের কৃষকের দোরগড়ায় পৌঁছাতে হবে।

চতুর্থত, যদিও সারা বিশ্ব এখন খাদ্যের সন্ধান করছে, বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই প্রয়োজনীয় খাদ্য আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে উদ্বৃত্ত থাকে। খাদ্য আমদানিকারকদের দ্বারা বাজার নিয়ন্ত্রণ করা উচিত নয়। মজুতদাররা দেশের ফসলের মূল্য নিয়ন্ত্রণ করে, যা খুবই দুঃখজনক। যেকোনো সঙ্কটের সময় সাধারণ মানুষের ঘাম, শ্রম ও সংগ্রামের বিনিময়ে উৎপাদিত ফসলকে পুঁজি করে অল্প সংখ্যক অসাধু আড়তদার পুঁজি করার সুযোগ নেয়। কঠোরভাবে বাজার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে এই দুষ্টচক্র নির্মূল করতে হবে।

পঞ্চমত, এই সংকটময় সময়ে দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে সহায়তা করা উচিত। খোলা বাজারে সাশ্রয়ী মূল্যে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া উচিত। দুর্বল মানুষদের সরাসরি নগদ সহায়তা প্রয়োজন যাতে তারা খাবার কিনতে পারে এবং ক্ষুধার্ত না হয়।

পরিশেষে, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খাদ্য সংগ্রহ, বিপণন ও বিতরণের জন্য উপযুক্ত নীতি ও শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। আধুনিক কৃষি খাত গড়ে তোলার জন্য জমি, মূল্য নির্ধারণ, ভর্তুকি এবং রাজস্ব নীতির ক্ষেত্রে বিস্তৃত সংস্কার প্রয়োজন। অতএব, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা মুকাবিলা এবং ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য শুধু ভালো কৃষি নীতিই নয়, ভালো সামষ্টিক অর্থনৈতিক ও সেক্টরাল নীতিও প্রয়োজন।

ফেইসবুকে আমরা...