খিলাফাতে রাশিদার যুগ তখন শেষ হবার পথে। উসমান (রা.) এর মর্মান্তিক শাহাদাতের মাধ্যমে ফিতনার দরজা চিরকালের জন্য উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপর আর কখনই মুসলিম বিশ্বে ঐক্য আর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধির সেই ধারা ফিরে আসেনি। মুসলমানদের সেই দুর্দিনে প্রায় একইসাথে দুটি বিভ্রান্ত ফিরকার জন্ম নিয়েছিল- খারিজী আর শিয়া সম্প্রদায়।
আলী (রা.) এর সময়ে একজন ছদ্মবেশী ইহুদি আব্দুল্লাহ ইবন সাবার অপতৎপরতা মূলত শিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভবের পেছনে দায়ী। সে-ই জনসাধারণকে সর্বপ্রথম প্রথম তিন খলীফার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। তার মাধ্যমে আলী (রা.) এর উপর ঈশ্বরত্ব আরোপকারী এবং সাহাবী বিদ্বেষী যে দলটি জন্ম নেয়, তারাই আজকের ইসনা আশারিয়্যাহ বা দ্বাদশবাদী শিয়াদের পূর্বসূরী। জন্মলাভের সময় থেকে এরা নিজেদের সবসময়ই আলী (রা.) ও আহলুল বাইতের পক্ষের লোক বলে প্রচার করে এসেছে। সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য এ ধরনের দাবীর খুব উপযোগিতা আছে। কারণ ঈমানের দাবী হিসেবেই সবাই আহলুল বাইতকে ভালোবাসে। কিন্তু বর্তমান শিয়াগণ ও তাদের পূর্বসুরী ইবন সাবার অনুসারীগণ প্রকৃতপক্ষে কখনই আহলুল বাইতের পক্ষের ছিলো না। শিয়াদের বিভিন্ন বই-পুস্তক থেকে আমি কিছু তথ্য পাঠকদের সামনে তুলে ধরছি। এখানে একমাত্র যায়িদ ইবন আলী (রা.) এর ঘটনা ছাড়া প্রবন্ধের কোথাও তথ্যসূত্র হিসেবে সুন্নীদের কোনো বই ব্যবহার করা হয়নি।
আহলুল বাইতের নামে অপবাদ
ইবন সাবা ও তার দলবল আলী (রা.) কে পর্যন্ত অপবাদ দিতে ছাড়েনি। ইবন সাবা প্রকাশ্যে প্রথম তিন খলীফাকে দোষারোপ করতো আর বলতো, আলী (রা.)ই তাকে এই আদেশ করেছে। আলী (রা.) তাকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞেস করার পর একথা সে স্বীকারও করেছিলো। এরপর আলী (রা.) তাকে মৃত্যুদন্ড দেন।
আলী (রা.) এর ব্যাপারে তারা আরও অপবাদ দিয়েছে, তিনি ইসলাম গ্রহণ করতে গিয়ে প্রথমে কিছুটা দ্বিধায় ভুগছিলেন। শিয়াদের বিখ্যাত আলীম ইবন তাউস সাদুস সুউদে লিখেছেন, আলী (রা.) ইসলাম গ্রহণের দাওয়াত পেয়ে বলেছিলেন, ‘এই ধর্ম তো আমার বাবার ধর্ম নয়। আমি এ বিষয়ে ভেবে দেখবো, আমার বাবার সাথে পরামর্শ করবো।’ (সাদুস সুউদ, পৃ. ২১৬)
ফাতিমা (রা.) ও আলী (রা.) এর পবিত্র পারিবারিক জীবন নিয়েও তাদের বইয়ে অনেক ধরনের ধৃষ্টতাপূর্ণ বর্ণনা বিদ্যমান। ফাতিমা (রা.) নাকি এই বিয়ে নিয়ে অসন্তুষ্ট হয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছিলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাকে আলীর সাথে বিয়ে দিলেন! সে তো দরিদ্র, তার কোনো টাকা পয়সা নেই।’ (কাশফুল গুম্মাহ ফি মারিফাতিল আইম্মাহ, খ.১, পৃ. ৩২১) এমনকি আয়িশা (রা.) কে বিয়ে করা নিয়ে কিছু শিয়া আলীম স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নিয়ে এমন জঘন্য উক্তি করেছে যে, তা উল্লেখ করাও চূড়ান্ত বেয়াদবি মনে হচ্ছে।
শিয়াদের ব্যাপারে আহলুল বাইতের ইমামগণের মতামত
আহলুল বাইতের ইমামগণ শুরু থেকেই গোঁড়াপন্থী ও সাহাবীদের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন শিয়াদের উপর সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাদের উগ্রতা, গোঁড়ামি, নির্বুদ্ধিতা এবং ধোঁকাবাজির জন্য তাঁরা শিয়াদের বারবার সতর্ক করেছেন। আলী (রা.) বলেছিলেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সাথে যুদ্ধ করুন (ক্ব-তালাকুমুল্লাহ)। আমার অন্তরকে তোমরা পুঁজ দিয়ে আর বুককে ক্রোধে পরিপূর্ণ করে দিয়েছো।’ (নাহজুল বালাগা, ২৭ নং খুতবা) তিনি আরও বলেছিলেন, ‘যদি আমি তোমাদের কখনও না দেখতাম, যদি কখনও তোমাদের সাথে আমার পরিচয় না হতো!’ (ফুরুউল কাফি, খ.৫, পৃ. ৭৭৫)
শিয়াদের বিখ্যাত আলিম মুহাম্মদ ইবন ইয়াকুব আল কুলায়নী আল কাফী গ্রন্থে বলেন, ইমাম মুসা কাযিম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা শিয়াদের উপর রাগান্বিত হয়েছেন এবং আমাকে হয় তাদেরকে নয়তো নিজেকে বেছে নিতে বলেছেন। আল্লাহর কসম! আমি নিজেকে তাদের থেকে পরহেজ করে নিয়েছি।’ (আল কাফী, খ. ১, পৃ. ২৬০) আল কাফী-এর ব্যাখ্যায় এর কারণ হিসেবে বলা আছে, তাকিয়া না করা, ইমামদের অনুসরণে একনিষ্ঠতার অভাবই আল্লাহর রাগান্বিত হবার কারণ।
যুদ্ধক্ষেত্রে আহলুল বাইতকে পরিত্যাগ
শিয়ারা যুগে যুগে যুদ্ধক্ষেত্রে এবং সবচেয়ে সঙ্কটময় মুহূর্তে বারবার আহলুল বাইতকে ফেলে পালিয়ে গেছে। ইমাম হুসাইন (রা.) এর সাথে ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতকতা তারা করেছে। তাঁকে একের পর এক চিঠি পাঠিয়ে কুফায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাঁরা। কিন্তু যখন তিনি দ্বীন রক্ষার খাতিরে কুফায় রওয়ানা হয়ে কারবালা পর্যন্ত আসলেন, তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে শহীদ করা হলো। শিয়াদের আহলুল বাইত প্রীতি তখন অদৃশ্য হলো। বিশিষ্ট শিয়া আলিম সায়্যিদ মুহসিন আল আমীনের মতে, বাইআত ভঙ্গকারীরা অভিশপ্ত ইয়াযীদি বাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছিল। তিনি বলেন, ‘ইরাকের বিশ হাজার লোক ইমাম হুসাইন (রা.) এর কাছে বাইআত হয়েছিল। এরপর তারা তাঁর সাথে গাদ্দারি করে। তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে এবং নিজেদের বাইআত ছিন্ন করে তাঁকে হত্যা করে।’ (আইয়ানুশ শিয়া, পৃ. খ.১, পৃ. ৩৪)
আলী আকবর (রা.) যখন যুদ্ধে বের হবার জন্য শেষবারের মতো অনুমতি চাইলেন, ইমাম হুসাইন (রা.) অনুমতি দিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাঁর দুচোখ অশ্রæতে ভরে উঠলো। শিয়াদেরকে তখন বদদুআ করে তিনি বললেন, ‘আল্লাহ! ওদেরকে যদি আরও কিছুদিন বেঁচে থাকার অবকাশ দেন, তবে নানান দলে-উপদলে বিভক্ত করে দিন, বিভিন্ন পথের অনুসারী করে দিন। তাদের প্রতি কোনো শাসককে কখনও সন্তুষ্ট করবেন না। কারণ তারা আমাদের সাহায্য করার কথা বলে ডেকেছে এরপর আমাদের সাথে শত্রুতা করে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে।’ (তাবারিসি লিখিত ইলামুল ওয়ারা, পৃ. ৯৪৯, কাশফুল গুম্মাহ, খ.২, পৃ. ১৮)
বিখ্যাত শিয়া ঐতিহাসিক ইয়াকুবীর সূত্রেই আমরা এজন্য জানতে পারি, ইমাম আলী ইবন জয়নুল আবেদীন (রা.) কুফায় এসে দেখলেন কুফার সেখানকার নারী-পুরুষরা কান্নাকাটি করছে। তিনি তখন বলেছিলেন, ‘এরা আমাদের জন্য কাঁদছে! আমাদেরকে এরা ছাড়া আর কে হত্যা করেছে?’ (তারীখে ইয়াকুবী, খ. ১, পৃ. ২৩৫)
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি আমরা দেখি নবী বংশের আরেকজন সূর্য ইমাম যায়দ ইবন আলী ইবন হুসাইন (রা.) এর সাথে। উমাইয়া যালিম শাসক হিশামের বিরুদ্ধে তিনি যখন সংগ্রামে অবতীর্ণ হন, কুফার শিয়ারা এসে তাঁর কাছে দাবি করে, তিনি যেন আবু বকর ও উমর (রা.) থেকে নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করেন। ইমাম যায়িদ (রা.) রাজি হলেন না। বললেন, ‘আমার পূর্বপুরুষদের কাউকে তাঁদের থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন করতে দেখিনি। তাঁরা তাঁদের সুনামই করেছেন সবসময়।’ শিয়াদের এই মতামত পছন্দ হলো না। তারা তাঁকে পরিত্যাগ করে চলে গেলো। ইমাম যায়িদ বললেন, ‘আ-রাফাদতুমুনি? তোমরা আমাকে পরিত্যাগ করছো?’ এখান থেকেই তাদের নাম হয়ে গেলো রাফেদী। কুফায় ঐসব দলত্যাগী বিশ্বাসঘাতকদের ছাড়া ইমাম যায়দ বিশ্বস্ত সঙ্গীদের নিয়ে উমাইয়াদের বিরুদ্ধে জিহাদ শুরু করে দেন। হিশামের গভর্ণর ইউসুফের সৈন্যবাহিনী তাঁকে শহীদ করে দেয়।
অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় শিয়াদের বিখ্যাত জাওয়াহেরুল বিহার গ্রন্থে তারা রাফেদী নামকরণের ফদীলত নিয়ে ফাদলুর রাফিদাহ ওয়া মাদহুত তাসমিয়াতি বিহা নামে আলাদা অধ্যায় রাখা হয়েছে। বুঝা যায় ইমামের সঙ্গত্যাগ করার জন্য তারা বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নয়।
আহলুল বাইতের অন্যান্য সদস্যদের অস্বীকার
উসমান (রা.) এর প্রতি রাফেদী শিয়াদের বিদ্বেষ মজ্জাগত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর কাছে প্রাণপ্রিয় কন্যাদ্বয়কে বিয়ে দিয়েছিলেন বলে শিয়ারা তাঁদের পিতৃপরিচয়ই অস্বীকার করে বসেছে। তাদের নামকরা আলিম আবুল কাসেম কুফী বলেন, ‘উসমানের দু’স্ত্রী যাইনাব ও রুকাইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কন্যা ছিলেন না। এমনকি তাঁর স্ত্রী খাদিজারও কন্যা ছিলেন না।’ (আল ইসতিগাসা ফি বিদাইস সালাসা, খ. ১, পৃ. ১০৮) তাদের একদলের মতে তাঁরা ছিলেন খাদিজা (রা.) এর বোন হালার কন্যা।
এভাবে পরবর্তীতেও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর বংশধরদের মধ্যে অনেকের সাথে তাঁরা চূড়ান্ত বেয়াদবি করেছে। প্রসঙ্গত শায়খ আব্দুল কাদীর জিলানী (র.) এর কথা এখানে উল্লেখ করতে হয়। তিনি শিয়াদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তাঁর মা উম্মুল খাইর ফাতিমা ছিলেন হুসাইন (রা.) এর বংশধর। এখনও যদি আপনি ইরানে যান, দেখবেন শিয়ারা আজও তাঁর মায়ের কবরকে অযত্নে অবহেলায় ফেলে রেখেছে। অন্যদিকে উমর (রা.) এর খুনী আবু লুলুর জাঁকজমকপূর্ণ কল্পিত মাযার নির্মাণ করে তাতে সিজদাহ পর্যন্ত দেওয়া হচ্ছে। ১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে শিয়া সম্রাট শাহ ইসমাঈল চূড়ান্ত ধৃষ্টতা দেখিয়ে বাগদাদে ইমাম আবূ হানীফা (র.) এবং বড়পীর আব্দুল কাদীর জিলানী (র.) এর পবিত্র মাযার ধ্বংস করেছিল। এ ঘটনায় পুরো মুসলিম বিশ্ব আহত হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, উগ্রপন্থী এসব শিয়াদেরকে আহলুল বাইতের ভালোবাসা কিংবা অনুসরণ নয়, নিজেদের কল্পিত মতাদর্শই তাদেরকে চালিত করছে। ঐতিহাসিকভাবে শিয়াদের ভূমিকা এবং আচরণের প্রেক্ষিতে তারা আসলেই কতটুকু আহলুল বাইত প্রেমিক, সে বিষয়ে প্রশ্ন তোলা যৌক্তিক।
আহলুল বাইতের মহান ইমামগণ শিয়াদের সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে গিয়েছেন। এরপরও আহলুল বাইতের প্রেমের দোহাই দিয়ে, তাসাউফের নাম করে কেউ যদি শিয়াদের ফাঁদে পা দেয়, তার দায়ভার একান্ত তারই।