বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির হারে ভারসাম্য আনয়নে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পখাতকে সবসময়ই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। রপ্তানী আয়ের সিংহভাগ (প্রায় ৮০%) রেডিমেইড গার্মেন্টস (আরএমজি) শিল্প থেকে অর্জিত হয় বলে এ খাতে সরকারের গুরুত্ব, প্রণোদনা সবই বেশি । কিন্তু গার্মেন্টস শিল্পের প্রায় সব কাঁচামালই আমদানি নির্ভর হওয়ায় এ খাত থেকে অর্জিত রপ্তানি আয়ের শতকরা প্রায় (৮০-৯০) ভাগই কাঁচামাল আমদানিতে ব্যয় হয়ে যায়। ফলে এ দাবি করাই যায় যে দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সহ অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রেই আরএমজি সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও রিজার্ভ বৃদ্ধি ও বাণিজ্য ঘাটতি পূরণে রেমিট্যান্স যে ভূমিকা রাখে সে তুলনায় আরএমজির ভূমিকা খুব সামান্যই।
চলতি অর্থবছরে হঠাৎ করে রিজার্ভ কমে যাওয়া এবং ব্যাপক বাণিজ্য ঘাটতি তৈরির কারণ শুধু যে বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধি তা নয়, বরং সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারণ সম্ভবত বিগত অর্থবছরে রেমিট্যান্স প্রবাহের ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি। ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার ছিলো যা ২০২১-২২ অর্থবছরে কমে ১৯.১৯ বিলিয়ন ডলার হয়। রেমিট্যান্স প্রবাহে এমন ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধিই যে দেশে বিদ্যমান অস্থিতিশীল মুদ্রাব্যবস্থার প্রধান কারণ তা বলা বাহুল্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ে স্থিতিশীলতা নিশ্চিতে কেবল শ্রমবাজার বর্ধিত করলে আর শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিলেই রেমিট্যান্স খুব বেশি বৃদ্ধি পাবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেশের প্রতি প্রবাসীদের আন্তরিকতা নিশ্চিত করা। এজন্য নিচের পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি-
উল্লেখযোগ্য হারে প্রণোদনা বৃদ্ধি
বিদেশে কর্মরত প্রবাসীদের সংখ্যার তুলনায় রেমিট্যান্সের হার সন্তোষজনক না হওয়ার অন্যতম কারণ প্রবাসীদের একটি বড় অংশ এখনো হুন্ডির মাধ্যমে দেশে টাকা পাঠান। এক্ষেত্রে প্রবাসীদের দায় যতটুক তার থেকে বেশি দায় আমাদের নীতি নির্ধারকদের। যেসব রপ্তানি শিল্পে ১০০ ডলার আয় করার জন্য ৮০-৯০ ডলার আমদানি প্রয়োজন হয় সেসব স্বল্প লাভজনক খাতে সরকার ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদান করলেও রেমিট্যান্সের মতো নিশ্চিত বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের খাতে প্রণোদনার হার মাত্র ২.৫ শতাংশ। যা কেবল কমই নয় বরং অন্যায়ও বলা যায়। রেমিট্যান্সে প্রণোদনা প্রদানের দাবি উঠানোর মতো শক্তিশালী প্রবাসী চাপ সৃষ্টিকারী গ্রুপ না থাকায় বহুকাল এ খাত উপেক্ষিত থেকেছে। বর্তমান সরকারের প্রণোদনা প্রদানের সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় হলেও তা অন্তত ৫ শতাংশে উন্নীত করা একান্ত প্রয়োজন।
প্রেরিত অর্থের পরিমাণের ভিত্তিতে বিশেষ মর্যাদা দান
রাষ্ট্রীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ দেশের যেকোন প্রান্তে ভিআইপি প্রটোকল পেয়ে থাকেন। একইভাবে রাষ্ট্রের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যেসব ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা ব্যাপক ভূমিকা রাখেন এবং রপ্তানির মাধ্যমে নির্দিষ্ট পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন তাদেরকে সিআইপি প্রটোকল দেওয়া হয়। তারা রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নানা রকম সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হন। প্রবাসীদের মধ্যে যারা অধিক রেমিট্যান্স প্রেরণ করেন তাদের ক্ষেত্রেও এরকম বিশেষ কোন মর্যাদা প্রদান করলে তাদের মধ্যে সন্তুষ্টি বৃদ্ধি পাবে এবং রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রতি তারা আরো বেশি উৎসাহিত হবেন।
প্রবাসীদের যথাযথ অভ্যর্থনা প্রদান ও হয়রানি বন্ধ
প্রবাসে যারা কাজ করেন তাদের একটি বড় অংশ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী উচ্চশিক্ষিত নন। এসব প্রবাসীদের নিয়ে বাঁকা কথা বলতে বোধহয় কারোরই বাধে না। তাই মন্ত্রী থেকে আমলা, শিল্পপতি থেকে সাধারণ মানুষ সবাই মোটামুটি ইচ্ছেমতো দেশের বাইরে খেটে খাওয়া প্রবাসীদের নিয়ে মাঝে মাঝেই বেফাঁস মন্তব্য করেন। অর্থনীতিতে এতো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার পরও দেশে অবতরণের পরপরই আমাদের এয়ারপোর্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের সাথে কী জঘন্য ব্যবহার করেন তা মোটামুটি সবারই জানা। এতকিছু সত্ত্বেও তারা দেশে ছুটে আসেন পরিবার ও স্বজনের টানে, আবার ফিরে যান দায়িত্বের বোঝা কাঁধে নিয়ে। যাদের পাঠানো রেমিট্যান্স কমে গেলে দেশের অর্থনীতি এমন সংকটের মুখে পড়ে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ, যথাযথ সম্মানের সাথে তাদেরকে এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানানো এবং যাবতীয় হয়রানি বন্ধ করা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত জনগোষ্ঠীর নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
বিদেশে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান
যাদের পরিবারের প্রবাসী কেউ আছেন তারা সকলেই এ অভিযোগের সাথে মোটামুটি পরিচিত যে বিদেশে কর্তব্যরত প্রবাসীরা কোন অসুবিধায় পড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের ধারস্থ হলে দূতাবাস কর্তৃপক্ষ থেকেই যথাযথ সহায়তা পান না। এমনকি পাসপোর্ট রিনিউয়ের মতো একটি রুটিন কাজেও তারা নানা রকম অসহযোগিতার মুখোমুখি হন। প্রবাসীদের মাঝে দেশের প্রতি আন্তরিকতা বৃদ্ধি করতে সব রকম সহায়তা করা দূতাবাসে কর্মরত প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মচারীর কর্তব্য। যত তাড়াতাড়ি তাদের ব্যবহারের পরিবর্তন আসবে এবং প্রবাসী শ্রমিকবান্ধব সেবা প্রদানের চর্চা শুরু হবে ততোই এই দেশমাতৃকার মঙ্গল।