খিলাফত পুনরুজ্জীবনের স্বপ্নদ্রষ্টা আরতুগ্রুল গাজী (র.)। ইউরেশিয়ার বসফরাস প্রণালির কাছে অর্ঘুজ তুর্কিদের কায়ী যাযাবর গোষ্ঠীতে ১১৯১ সালে তাঁর জন্ম। অর্ধবিশ্ব জয় করা দুর্দান্ত চেঙ্গিস খানের মোঙ্গল বাহিনীকে মাত্র গুটিকয়েক সৈন্য নিয়ে আহলাত ও সোগুতে প্রবেশ রুখে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান আলাউদ্দীনের ভাতিজি হালীমা সুলতানা। তাদেরই ঔরসে জন্মগ্রহণ করেন উসমানী খিলাফত তথা অটোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মহানায়ক উসমান গাজী। আজ আমরা আলোচনা করব এই সা¤্রাজ্যের এমন এক খলীফার কথা, যিনি স্বপ্ন, কর্ম, প্রচেষ্টা, আন্তরিকতা এবং উন্নয়ন সকল ক্ষেত্রেই মুসলিম উম্মাহর কল্যাণ নিয়ে ভাবতেন। তাঁর নাম আবদুল হামিদ, যিনি দ্বিতীয় আবদুল হামিদ নামে পরিচিত। তাঁকে উসমানী খিলাফতের সর্বশেষ প্রকৃত ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে মনে করা হয়।
জন্ম ও শৈশব
সুলতান দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ছিলেন উসমানী সাম্রাজ্যের ৩৪তম খলীফা। তাঁর পিতা ছিলেন সুলতান প্রথম আবদুল মজিদ এবং মা তিরিমুজগান কাদিন। ১৮৪২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ইস্তাম্বুলের তোপকাপি প্রাসাদে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাত্র দশ বছর বয়সে তিনি মাকে হারান। এরপর থেকে তিনি সৎমা রহিমা কাদিনের কাছে লালিত পালিত হন। সৎমায়ের ইবাদাত ও বিচক্ষণতা খলীফার মনে গভীর রেখাপাত করে। শৈশবে তিনি প্রাসাদের শিক্ষকগণের কাছ থেকে আরবী, ফারসী, অর্থনীতি, সাহিত্য ও ইতিহাসের উপর পা-িত্যপূর্ণ জ্ঞানার্জন করেন। অশ্বারোহণ ও তরবারি চালনায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। তিনি ছিলেন অত্যন্ত মিতভাষী এবং আবিদ ব্যক্তি। শৈশব থেকেই তিনি রাত জেগে ইবাদাত-বন্দেগী করতেন।
খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ
১৮৬৮-৬৯ সালে চাচা ও তৎকালীন খলীফা আবদুল আজীজের সাথে ইউরোপ ভ্রমণ করেন। চাচা তাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন এবং খিলাফতের জন্য যোগ্য ব্যক্তি মনে করতেন। ইউরোপীয়দের সভ্যতা, সামরিক সক্ষমতা এবং গোয়েন্দা তৎপরতা আবদুল হামিদকে এক নতুন জগতের সন্ধান দান করে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, উসমানী খিলাফত রক্ষা করতে হলে সামরিক সক্ষমতা এবং গুপ্তচরবৃত্তির ব্যাপক আধুনিকায়ন করতে হবে। পাশাপাশি ইউরোপীয় অনৈসলামিক সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করে ইসলামী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হবে।
আবদুল হামিদের খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের কোনো ইচ্ছে ছিল না। তাঁর পিতার জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন মসনদের তৃতীয় উত্তরাধিকার। ১৮৬১ সালে তাঁর পিতা সুলতান আবদুল মজিদ ইন্তিকাল করলে চাচা আবদুল আজীজ খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৮৭৬ সালে তিনি নিহত হলে তাঁর ভাই পঞ্চম মুরাদ মসনদের হাল ধরেন। ধারণা করা হয়, চাচাকে হত্যার ষড়যন্ত্রে ইয়াহুদী সংগঠন ‘ফ্রি মিশনে’র সাথে পঞ্চম মুরাদেরও হাত ছিল। তার ক্ষমতারোহণের পর বিষয়টি স্পষ্ট হতে থাকে। পঞ্চম মুরাদ ইহুদী লবীর পরামর্শে খিলাফতকে বুনিয়াদি রাজতন্ত্রে পরিণত করেন। এতে খলীফা নামমাত্র শাসক হয়ে ওঠেন এবং নির্বাহী ক্ষমতা চলে যায় উযীর ও পাশাদের হাতে। মসনদে আরোহণের কয়েক মাসের মধ্যে ৫ম মুরাদের মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ ফুটে ওঠে। কয়েকমাস পর যখন কোনো অবস্থাতেই তাকে সুস্থ করা যাচ্ছিল না, তখন আবদুল হামিদের ডাক আসে। ইয়াহুদীবাদী ফ্রি মিশন এবং নব্য তুর্কিদের অনেক অন্যায্য শর্ত মেনেই ১৮৭৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর তিনি খিলাফতের পদে আসীন হন। (তারিখে দাওয়াতিল উসমানীয়্যা, ইয়ালমায উসতুনা )
খিলাফতের দায়িত্ব গ্রহণের পর আবদুল হামিদ কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। একদিকে ইয়াহুদীবাদী ফ্রি মিশন সদস্যদের ব্যাপক তৎপরতা, অন্যদিকে ইউরোপীয় সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত নব্য তুর্কি তরুণদের আস্ফালন খলীফার জন্য রাষ্ট্র পরিচালনাকে কঠিন করে তুলেছিল। পাশা হিসেবে পরিচিত তুর্কি সামরিক-প্রশাসনিক আমলাদের চাপে খলীফা মিদহাত পাশাকে খলীফার প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। প্রথমদিকে মূলত, খিলাফতের মুখোশে মিদহাত পাশার নেতৃত্বাধীন আমলারা অটোমান সাম্রাজ্য শাসন করে। তারা খিলাফতের সমূহ ক্ষতি হয় এরকম অনেক সিদ্ধান্ত খলীফার উপর চাপিয়ে দেয়। তাদের সিদ্ধান্তে ১৮৭৭-৭৮ সালে রুশদের সাথে অটোমানদের এক রক্তক্ষয়ী সংঘাত ঘটে এবং অটোমানরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এই পরাজয়ের পর খলীফা পাশাদের লাগাম টেনে ধরেন। মিদহাত পাশা বলয়ের বহু পাশাকে পদচ্যুত করেন। ৫ম মুরাদের জারি করা রাজতান্ত্রিক তথা বুনিয়াদি সংবিধান বাতিল করেন এবং নির্বাহী ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। খলীফা মিদহাত পাশার অপসারণের পর তার ব্যাপারে লিখেন “মিদহাত পাশা আমাকে নির্দেশ দিত, যেন সে আমার উপর সকল কর্তৃত্বের অধিকারী। তার স্বেচ্ছাচারিতাই আমাদের এ খিলাফতকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে।’’ (অটোমান অ্যাম্পায়ার, ড. মুহাম্মদ আলী সাল্লাবি)
মুসলিম উম্মাহ’র স্বার্থে উন্নয়ন কার্যক্রম
নির্বাহী ক্ষমতা গ্রহণের পর খলীফা মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে একের পর এক চমকপ্রদ সিদ্ধান্ত নেন। তিনি হিজাজ রেলওয়ে চালু করে ইস্তাম্বুল ও ফিলিস্তীনের সাথে মদীনা শহরকে সংযুক্ত করেন। রুশ-উসমানীয় যুদ্ধের সময় ব্যাপক ঋণের বোঝা সাম্রাজ্যকে ভারী করে তুলছিল। খলীফা এসব ঋণ পরিশোধে আলাদা বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। আব্বাসী খিলাফতের সময়ে প্রতিষ্ঠিত জ্ঞানার্জন ও গবেষণাগার ‘বায়তুল হিকমাহ’র অনুকরণে দারুল ফুনুন নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের গবেষকদের জন্য এটি উন্মুক্ত করে দেন। বর্তমানে এটি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। তিনি মক্কা শহরকে বন্যা থেকে রক্ষার জন্য আধুনিক পানি সঞ্চালন লাইন তৈরি করেন, যা আজও বিদ্যমান।
খলীফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ সমগ্র মুসলিম উম্মাহর জন্য একটি স্বতন্ত্র ইউনিয়নের চেষ্টা চালান। কিন্তু পশ্চিমা দেশ ও ইয়াহুদী লবীগুলো তাকে এ মহৎ কাজটিতে সফল হতে দেয়নি। ভারত ও বিশ্বের নানা প্রান্তে গড়ে উঠা সম্রাজ্যবাদের তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি রাষ্ট্রীয় জাতীয়তাবাদকে প্রত্যাখান করে মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কোথাও মুসলিম আগ্রাসন, রাসূল সা. এর অপমান হয় এমন কিছু দেখলে গর্জে উঠতেন। বিশেষত, ব্রিটিশ-ফরাসি উপনিবেশবাদের জন্য তিনি ছিলেন মূর্তিমান আতঙ্ক।
মুহাম্মদ আলী সাল্লাবি বলেন, খলীফা তাঁর পাশাদের এক বৈঠকে বলেছিলেন, যখন তোমরা দেখবে তোমাদের শত্রুরা তোমার কোনো কাজের প্রশংসা করছে, তখন বুঝবে তোমার এই কাজের দ্বারা শত্রুর স্বার্থরক্ষা হয়েছে। আর যখন তোমার কোনো কাজে শত্রু নিন্দা করবে, তখন বুঝবে মুসলিম উম্মাহর জন্য কল্যাণকর কাজে শত্রুর শরীরে আগুন জ্বলছে। (অটোমান অ্যাম্পায়ার)
রাসূল সা. এর প্রতি ভালোবাসা
১৯০৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে রাসূল সা. এর চরিত্রকে ব্যঙ্গ করে একটি নাটক প্রদর্শনীর বন্দোবস্ত করা হয়। খলীফা আবদুল হামিদ এ খবর জানতে পেরে সঙ্গে সঙ্গে ফরাসি দূতাবাসের কূটনীতিক প্রধানকে ডেকে পাঠান। খলীফাকে তখন প্রচ- বিক্ষুদ্ধ দেখাচ্ছিল। তিনি রাষ্ট্রদূতকে এ ঘটনা অবহিত করেন এবং নাটক প্রদর্শনী বন্ধ না হলে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে বলেন। ফরাসি সরকার টেলিগ্রামের মাধ্যমে এ সংবাদ জানতে পেরে আতঙ্কিত হয়ে মাত্র চৌদ্দ ঘন্টা আগে নাটকটির প্রদর্শনী বাতিল করে। এ সংবাদ খলীফার কানে এলে তাঁর মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। তিনি আফসিন পাশাকে বলেন, আবদুল হামিদ বেঁচে থাকতে রাসূল সা. এর অবমাননা সহ্য করা হবে না। ( Abdul Hamid: The Sultans. Abdullah al Muraisi.)
১৯০৭ সালে আবদুল্লাহ নামে এক ব্যবসায়ী খলীফার প্রাসাদে আসে। সে দাবি করে, খলীফার তাঁর নিকট চার হাজার লিরা ঋণী। রাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ব্যবসায়ীকে পাগল ভেবেছিলেন। সারাদিন অপেক্ষার পর যখন সে অবিরত এই দাবি করছিল, তখন একজন ঊর্ধ্বতন পাশা খলীফাকে জানানোর সিদ্ধান্ত নেন। কৌতূহলী খলীফা লোকটিকে কাছে ডাকেন এবং বিস্তারিত ঘটনা বলতে বলেন। ব্যবসায়ী লোকটি বলল, তাঁর ব্যবসা দুর্বৃত্তের খপ্পরে পড়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত। গত রাত সে রাসূল সা. কে স্বপ্নে দেখে। তাঁর দুঃসহ পরিস্থিতি শোনে রাসূল সা. বললেন, তুমি আমার আবদুল হামিদের কাছে গিয়ে বলবে তোমাকে চার হাজার লিরা দিয়ে দিতে। লোকটি তখন বলল, খলীফা কেন আমাকে ঋণ দেবেন? রাসূল সা. বললেন, আমার হামিদ প্রতিরাতে আমার উপর দরূদ পাঠ করে। গতরাতে সে কেন পাঠ করেনি? এজন্য তাকে ঋণশোধ করতে বলবে। একথা শোনে খলীফার চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়তে লাগল। তিনি বললেন, গতরাতে রাষ্ট্রীয় চিন্তায় এতটাই চিন্তামগ্ন ছিলাম যে, দরূদ শরীফ পাঠ না করে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বুঝতে পারিনি। এরপর সেই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ‘আমার আবদুল হামিদ’ শব্দটি চারবার শোনলেন এবং প্রতিবার একহাজার লিরা করে ব্যবসায়ীকে প্রদান করলেন। (Abdul Hamid: The Spiritual Leader of Ottoman Khilafah.. Stench Hamdallah)
বায়তুল মুকাদ্দাসের প্রতি ভালোবাসা ও ইয়াহুদী-ইংরেজ আঁতাত
১৯০১ সালে মিজ্ররারো কারো নামে বিশ্ববিখ্যাত এক ইয়াহুদী ব্যাংকার খলীফা আবদুল হামিদের কাছে আসে। সে অটোমান খিলাফতের সমস্ত ঋণ পরিশোধ, অটোমান খিলাফতের জন্য বিনা সুদে ৩ কোটি ৫০ লাখ লিরা ঋণ এবং অটোমান সেনাবাহিনীর জন্য একটি অত্যাধুনিক নৌঘাটি তৈরি করে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। এর বিনিময়ে বায়তুল মুকাদ্দাসে নির্বিঘেœ ইয়াহুদীদের প্রবেশ, অবস্থানের সুযোগ এবং জেরুজালেমের কাছে একটি ছোট্ট ইয়াহুদী বসতি স্থাপনের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করে। খলীফা সে ব্যবসায়ীকে বলেন, ‘‘যে ভূমি আমীরুল মুমিনীন উমর ইবনে খাত্তাব (রা.) জয় করেছেন আমি সে ভূমি তোমাদের বসবাসের জন্য খুলে দেব, এটা ভাবার দুঃসাহস করলে কীভাবে! আমি শাহাদাত চাই, মুসলমানদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে মরতে চাই না।’’ (Abdul Hamid: The Sultans. Abdullah al Muraisi.)
এ ঘটনার পর ইয়াহুদীরা বুঝে যায়, খলীফা দ্বিতীয় আবদুল হামিদ ক্ষমতায় থাকতে তারা আরবে কোনো রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে না। তৎকালীন ইয়াহুদী প্রধান ইসরাঈল রাষ্ট্রের স্বপ্নদ্রষ্টা থিওডোর হার্জেল খলীফার সাথে দেখা করতে এলে তিনি তাকে সাক্ষাৎ প্রদানে রাজি হননি। পরবর্তীতে হার্জেল ২০ মিলিয়ন পাউন্ডের মাধ্যমে সারা বছর ইহুদীরা বায়তুল মুকাদ্দাসে প্রার্থনা করার অনুমতি চায়। (অটোমান খিলাফতের সময় ইয়াহুদীরা তিন ঘন্টা অবস্থানের শর্তে প্রতি বছর মাত্র একমাসের জন্য জেরুজালেমে প্রবেশ করতে পারত।) খলীফা হার্জেলের এই প্রস্তাবও নাকচ করে দেন। ফিরতি চিঠিতে তিনি লেখেন, তারা যেন এই পরিকল্পনা নিয়ে আর অগ্রসর না হয়। তাদেরকে জেরুজালেমের এক মুঠো মাটিও দেওয়া হবে না, যেহেতু এটার মালিক তিনি নন। এটা মুসলিমদের রক্তে কেনা ভূমি। (তারিখে দাওয়াতিল উসমানীয়্যা, ইয়ালমায উসতুনা)
ইয়াহুদী হার্জেল হাল ছাড়েনি। সে ব্রিটিশদের সাথে আঁতাত করে এবং ব্যাপক সম্পদ আর ভোগ্যপণ্যের প্রলোভন দেখিয়ে অটোমান সেনাবাহিনীর একটি অংশকে সুলতানের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে। ওয়াহাবী মতবাদের সমর্থক আরবের প্রভাবশালী নেতৃত্ব ক্ষমতার মোহে ইয়াহুদী লবীর সুপারিশ অনুযায়ী খিলাফতের অধীন মুসলিমদের মধ্যে ব্যাপক ফাটল সৃষ্টি করে। জায়ানিস্ট, নব্য তুর্কি তরুণ, ইংরেজ বেনিয়া, সম্পদের মোহে অন্ধ শক্তিশালী পাশাদের ষড়যন্ত্র খলীফাকে ক্রমেই দুর্বল করে তুলে। ১৯০৮ সালে খলীফার বিরুদ্ধে এক সম্মিলিত অভ্যুত্থান সংগঠিত হয় এবং খলীফা পুনরায় রাজতান্ত্রিক শাসন জারি করতে বাধ্য হন। খলীফার সুপ্ত ইচ্ছে ছিল, পুনরায় খিলাফত ব্যবস্থা প্রবর্তন করবেন। এজন্য ১৯০৯ সালে তার অনুগত সৈন্যরা পুনরায় বিপ্লব শুরু করে। জয়নবাদীদের দুর্দান্ত তৎপরতায় তা ব্যর্থ হয় এবং খলীফাকে ক্ষমতাচ্যুত করে নির্বাসনে পাঠানো হয়। তাঁর ভাই পঞ্চম মুহাম্মদ নামমাত্র সুলতান হন।
ইন্তিকাল
খলীফা আবদুল হামিদ নির্বাসিত অবস্থায় মুসলিম উম্মাহর জন্য আকুল হয়ে কাঁদতেন। কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য তিনি কারও সাথে দেখা করতে পারতেন না। তার সহকারী হিসামিদ্দীন বলেন, খলীফা খিলাফতে আরোহণের পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত প্রায়শই দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতেন, ‘হয় খিলাফত, নয় শাহাদাত।’ গৃহবন্দি অবস্থায় ১৯১৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি তিনি বেইলেরবিক প্রাসাদে ইন্তিকাল করেন। তিনিই ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের সর্বশেষ প্রকৃত খলীফা।
তাঁর সম্পর্কে বিভিন্নজনের বক্তব্য
খলীফা আবদুল হামিদ ছিলেন বিভিন্ন ষড়যন্ত্রকারী সাহিত্যিক, সাংবাদিকের লেখনির নির্মম শিকার। তাঁর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে এসব বিষয় অনেকটা প্রভাব ফেলেছিল। তবুও তাকে অভ্যুত্থানের সময় তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল ঈর্ষণীয়। এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা আর্লন্ড টয়েনবি ১৯১৭ সালে প্রকাশিত তার ইতিহাসগ্রন্থ Turky: A Past and A Future এ বলেন, “সুলতান আবদুল হামিদের অনন্য উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের মুসলিমদের একই পতাকার নিচে একত্রিত করা। নিঃসন্দেহে তা ছিল ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ। দুঃখের বিষয়, তাঁর বিরুদ্ধে ইউরোপীয়রা এত বেশি লিখেছে যে, আর কোনো মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে তারা এতটা লিখেনি। মুসলিমদের উচিৎ ছিল তাঁর পাশে থাকা। কিন্তু তাদের চিরায়ত অনৈক্য তা হতে দেয়নি, না হলে মুসলমানদের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে লিখতে হতো।”
খলীফা ইন্তিকালের আট বছর পর অন্যতম ষড়যন্ত্রকারী আনোয়ার পাশা একটি সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, ‘‘ আমাদের ভুলটা বলি, আমরা খলীফার বিরুদ্ধে বিপ্লব করতে করতে কখন যে জয়নবাদীদের (ইয়াহুদীদের) ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছি, তা নিজেই জানতাম না। আমরা নির্বোধ ছিলাম, মুসলিম বিশ্বকে এর ফল ভোগ করতে হবে।’’ । ( Abdul Hamid: The Spiritual Leader of Ottoman Khilafah. Stench Hamdallah )
নব্য তুর্কি নাস্তিকদের প্রেরণাদাতা তুর্কি কবি রেজা তাওফিক নিজেদের ভুল অনুধাবন করে বলেছিল,
‘‘আপনার পক্ষে থাকবে ইতিহাস/আপনাকে হারিয়ে করি হাসফাঁস।
নির্লজ্জভাবে চাপিয়ে অপবাদ/পেয়েছি কাফেরের কাছে পরাজয়ের স্বাদ।
আমাদের করুন ক্ষমা হে সৎ খলীফা/তাহলে মনে পাব শান্তির শিফা।
(ইংরেজী থেকে অনূদিত)
খিলাফতের বিলুপ্তি
খলীফা আবদুল হামিদের পতনের পর অটোমান শাসন নামমাত্র টিকে ছিল। জামাল, তালাত ও এনভার পাশার একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে উসমানী সাম্রাজ্য প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লিসবন চুক্তির মধ্য দিয়ে ১৯২৪ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের বিলুপ্তি ঘোষণা করা হয়। সমাধি হয় ১২৯৯ সাল থেকে ৬২৫ বছর ধরে চলা সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী খিলাফতের।
এর পরের ইতিহাস বেদনার কাঁটাঘেরা ইতিহাস। মুসলিম শাসকগণ পাশ্চাত্যের কাছে অবিরত আত্মসমর্পণ করতে থাকেন। অভিভাবকহীন মুসলিমগণ মার খেতে থাকেন বিশ্বের নানা প্রান্তে। পশ্চিমাদের সাম্রাজ্যবাদী নীতি আর কর্তৃত্বে সীমাহীন অন্ধকারে ডুবে যায় মুসলিম বিশ্ব।
লেখক: শিক্ষার্থী