মানুষ বা কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য নির্মাণ করা শরীয়তের দৃষ্টিতে বৈধ কি? বিস্তারিত জানতে চাই।
প্রশ্নকারী: মো. রায়হান চৌধুরী
রিয়াদ, সৌদী আরব
জবাব: মানুষ কিংবা যে কোনো প্রাণীর পূর্ণ দেহ বিশিষ্ট ভাস্কর্য নির্মাণ, অঙ্কন, ক্রয়-বিক্রয় কিংবা সংরক্ষণ এবং এমন পেশার উপার্জন ফুকাহায়ে কিরামের সর্বসম্মত ও গ্রহণযোগ্য অভিমত অনুসারে হারাম বা নিষিদ্ধ। চাই তা সৌন্দর্য হিসেবে হোক কিংবা সম্মান প্রদর্শনার্থে। উক্ত রায় প্রদানে ফুকাহায়ে কিরাম নিম্নবর্ণিত কুরআন ও সুন্নাহর স্পষ্ট ভাষ্য পেশ করেছেন।
পবিত্র কুরআন মাজীদে ইরশাদ হচ্ছে-
فَاجْتَنِبُوا الرِّجْسَ مِنَ الْأَوْثَانِ وَاجْتَنِبُوا قَوْلَ الزُّورِ (الحج:৩০
-তোমরা মূর্তিদের অপবিত্রতা থেকে বেঁচে থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর। (সূরা হজ্জ: ৩০)
অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,
إِذْ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوْمِهِ مَا هَٰذِهِ التَّمَاثِيلُ الَّتِي أَنتُمْ لَهَا عَاكِفُونَ (الانبياء:৫২
-যখন তিনি তার পিতা ও তার সম্প্রদায়কে বললেন, “এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারী হয়ে বসে আছ। (সূরা আম্বিয়া: ৫২)
অন্যত্র বলা হচ্ছে-
وَقَالُوا لَا تَذَرُنَّ آلِهَتَكُمْ وَلَا تَذَرُنَّ وَدًّا وَلَا سُوَاعًا وَلَا يَغُوثَ وَيَعُوقَ وَنَسْرًا (نوح
-তারা বলল, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের ত্যাগ করো না, আর ত্যাগ করো না ওয়াদ্দ, সুয়াআ, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসরকে। (সূরা নূহ: ২৩)
অন্য আয়াতে এসেছে-
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِّنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُونَ (المائدة
-হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা, ভাগ্য নির্ণয়কারী শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কাজ। অতএব, এগুলো থেকে বেঁচে থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হও। (সূরা মায়িদাহ; আয়াত: ৯০)
যেমন হাদীস শরীফে এসেছে-
عن أبي جحيفة، قال: لعن النبي صلى الله عليه وسلم الواشمة والمستوشمة، وآكل الربا وموكله، ونهى عن ثمن الكلب، وكسب البغي، ولعن المصورين
-হযরত আবূ জুহাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা.) দেহের চামড়া ক্ষত (কর্তন) করে উল্কি অঙ্কনকারী, এর নির্দেশকারী, সুদ গ্রহীতা এবং সুদ দাতাকে অভিসম্পাত করেছেন। আর কুকুরের মূল্য ও বেশ্যার উপার্জন থেকে নিষেধ করেছেন। আর প্রাণীর চিত্রাঙ্কনকারীর উপর অভিসম্পাত করেছেন। (সহীহ বুখারী: ৫৩৪৮)
عن ابن عباس قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم إن الله تعالى يعذب المصورين بما صوروا
-হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা প্রাণীর চিত্র অঙ্কন করার কারণে চিত্রাঙ্কনকারীকে শাস্তি প্রদান করবেন। (সুনানে নাসায়ী: ৯৭০০)
عن قتادة قال: كنت عند ابن عباس، وهم يسألونه، ولا يذكر النبي صلى الله عليه وسلم حتى سئل، فقال: سمعت محمدا صلى الله عليه وسلم يقول: من صور صورة في الدنيا كلف يوم القيامة أن ينفخ فيها الروح، وليس بنافخ
-হযরত কাতাদা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) এর নিকট ছিলাম আর লোকেরা এমতাবস্থায় তাকে প্রশ্ন করছিল। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কথা উল্লেখ করতেন না যদি না তাঁকে জিজ্ঞেস করতেন। তাই তাদের জবাবে তিনি বললেন, আমি মুহাম্মদ (সা.) কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি দুনিয়ার জীবনে কোনো প্রাণির আকৃতি অঙ্কন করবে বা ভাস্কর্য নির্মাণ করবে কিয়ামত দিবসে এতে রূহ ফুঁকে দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হবে অথচ সে তা ফুঁকে দিতে পারবে না। (সহীহ বুখারী: ৫৯৬৩)
عن ابن عباس قال سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: “كل مصور في النار، يجعل له بكل صورة صورها نفس تعذبه في جهنم” فإن كنت لا بد فاعلا، فاجعل الشجر وما لا نفس له- (احمد: ২৮০৯، مسلم:২১১০)
-হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি সকল ছবি বা ভাস্কর্য নির্মাণকারী জাহান্নামে যাবে। সে যত ছবি বা ভাস্কর্য বানিয়েছিল প্রতিটির জন্য তাকে একটি করে আত্মা দিয়ে জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হবে। (তিনি প্রশ্নকারীকে বললেন) যদি তোমাকে ছবি বা ভাস্কর্য একান্ত বানাতে হয় তাহলে গাছের বা যার কোনো প্রাণ নেই এমন কিছুর ছবি বা প্রতিকৃতি তৈরি করতে পারবে। (সহীহ মুসলিম: ২১১০, মুসনাদে আহমদ: ২৮০৯)
عن عائشة رضي الله عنها قالت: قدم رسول الله صلى الله عليه وسلم من سفر، وقد سترت بقرام لي على سهوة لي فيها تماثيل، فلما رآه رسول الله صلى الله عليه وسلم هتكه وقال: أشد الناس عذابا يوم القيامة الذين يضاهون بخلق الله. قالت: فجعلناه وسادة أو وسادتين (৫৯৫৪ مسلم: ২১০৭)
-হযরত আয়শা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) কোনো এক সফর থেকে আগমন করলেন। আর আমি কয়েকটি প্রাণীর ছবি অঙ্কিত একখানা কাপড় পর্দা হিসেবে ঘরের মেঝে ঝুলিয়েছিলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) তা দেখামাত্র খুলে ফেললেন এবং বললেন, কিয়ামত দিবসে সবচেয়ে কঠিন শাস্তিপ্রাপ্ত তারা হবে যারা আল্লাহর সৃষ্টির সাদৃশ্য বানিয়ে তার প্রতিদ্বন্ধিতা করেছিল। তিনি (আয়শা রা.) বলেন, অতঃপর আমরা এর দ্বারা একটি বা দুটি বালিশ বানালাম। (সহীহ বুখারী: ৫৯৫৪, সহীহ মুসলিম: ২১০৭) এ প্রসঙ্গে নিষিদ্ধতার আরো বহু হাদীসের বর্ণনা রয়েছে, যেগুলোর দ্বারা যে কোনো প্রাণীর পূর্ণ ছবি বা ভাস্কর্য নির্মাণ শরীয়তের বিধানে হারাম সাব্যস্ত হয়েছে। কোনো কোনো মনীষী (ইসলাম ব্যতীত) অন্যান্য নবীর শরীয়তে তা বৈধ ছিল বলে অভিমত পোষণ করলেও সে অভিমত উপরিবর্ণিত দলীলের ভিত্তিতে পরিত্যাজ্য। এ সম্পর্কে তাফসীরে মাযহারী প্রণেতা কাযী সানাউল্লাহ পানিপথী (র.) উপরে বর্ণিত বহু হাদীস উল্লেখ পূর্বক রায় দিয়ে বলেছেন,
وسياق هذه الأحاديث يدل على ان حرمة التصوير غير مختص بهذه الامة
-এ সকল হাদীসের দৃষ্টিভঙ্গি একতার প্রমাণ বহন করে যে, ছবি বা ভাস্কর্য নির্মাণ হারাম হওয়া কেবল এ উম্মতেরই বিশেষত্ব নয় (বরং পূর্বেকার সকল ধর্মেও তা হারাম ছিল। (তাফসীরে মাযহারী, ৮ম খ-, পৃষ্ঠা: ১৬)
শরহে মিশকাত গ্রন্থকার আল্লামা তীবী (র.) লিখেছেন,
“هذا محمول على من صور الأصنام لتعبد، فله أشد عذاب؛ لأنه كافر. وقيل: هذا فيمن قصد المضاهاة بخلق الله، واعتقد ذلك وهو أيضا كافر، وعذابه أشد. ومن لم يقصدهما فهو فاسق لا يكفر كسائر المعاصي. وأما الشجر ونحوه مما لا روح فيه فلا يحرم صنعته ولا التكسب به. وهذا مذهب العلماء الا مجاهدا”
উপরি বর্ণিত শেষোক্ত হাদীসের ভাষ্যের প্রয়োগ এ অর্থে হবে যে, পূজার উদ্দেশ্যে যে মূর্তি নির্মাণ করবে তার সবচেয়ে কঠিন শাস্তি হবে, কেননা সে কাফির। আর কেউ কেউ বলেছেন কঠিন শাস্তি তারও হবে যে আল্লাহর প্রতিদ্বন্ধিতার মানসে সাদৃশ্যপূর্ণ কিছু বানাল বা এর মনোভাব পোষণ করল সে ব্যক্তিও কাফির। আর যে পূজা কিংবা আল্লাহর সাথে প্রতিদ্বন্ধিতার উদ্দেশ্য ব্যতীত এমন কিছু বানাবে সে অন্যান্য কবীরাহ গোনাহকারীর ন্যায় ফাসিক হবে, তবে কাফির নয়। আর গাছ কিংবা অনুরূপ যে সকল জিনিসের মধ্যে প্রাণ নেই সেগুলো নির্মাণ করা বা এর দ্বারা উপার্জন করা হারাম নয়। এটি ইমাম মুজাহিদ (র.) ব্যতীত সকল আলিমগণের সম্মিলিত অভিমত। (শরহুল মিশকাত লিত্তীবী; ৯ম খণ্ড)
জবাবদাতা: প্রিন্সিপাল ও খতীব, আল ইসলাহ ইসলামিক সেন্টার
মিশিগান, যুক্তরাষ্ট্র