মধ্যযুগ অন্ধকার নয় বরং স্বর্ণযুগ ছিল। গর্বের সাথে বলি যে, এই আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মদাতা আমরাই। শিক্ষা ও বিজ্ঞানের উন্নয়নে এবং জ্ঞান গবেষণার নতুন নতুন অভিধার তালাশে মুসলিম বিজ্ঞানী ও মনীষীরা পৃথিবীর সামনে জ্বালালেন এমনই দীপ্ত শিখা যা সেই নবম-দশম শতক থেকে ১৮শ-১৯শ শতক পর্যন্ত দীর্ঘকাল পরিক্রমায় যুক্ত করল এক অনন্য মাইলফলক। আধুনিক বিজ্ঞানও আবিষ্কার যুগের পথিকৃৎ হয়ে রইলেন সেই যুগ প্রবর্তক বিজ্ঞানীগণ। আধুনিক বিজ্ঞান শুধু চমকপ্রদ আবিষ্কারের জন্যই নয়, তার নিজের অস্তিত্বের জন্যই মুসলমানের কাছে ঋণী। অমুসলিম অনেক সুধীজন মধ্যযুগকে অন্ধকার যুগ বলেছেন। হয় অজ্ঞতা, নয় হীনমন্যতা বশত তারা একথা বলেন। সময়টি ছিল প্রকৃতপক্ষেই আধুনিক সভ্যতার সূতিকাগার। পবিত্র কুরআনে কারীম নিজের বক্তব্য মতেই বিজ্ঞানময়। এ বিষয়ে গবেষক ড. মরিস বুকাইলি তার ‘বাইবেল কুরআন ও বিজ্ঞান’ গ্রন্থে স্বীকারোক্তি করেন “কুরআনে এমন একটা বক্তব্যও নাই- যে বক্তব্যকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিচারে খ-ন করা যেতে পারে”
পবিত্র গ্রন্থের এই অভ্রান্ততার ও বিজ্ঞানময়তার খবর মুসলিম গৌরবময় যুগের পরে মুসলিম জাতি ভুলে রইলেও ভুলে থাকেনি পাশ্চাত্য। ল্যাটিন, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় কুরআনের প্রচুর অনুবাদ হয় এবং তারা কুরআন গবেষণার মাধ্যমে প্রচুর বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও আবিষ্কার পৃথিবীকে উপহার দিতে সক্ষম হয়। মানুষ জানত মানুষের কথা বাতাসে হারিয়ে যায়। কিন্তু কুরআনের মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রথম জানল যে, মানুষের উৎক্ষিপ্ত কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। ইরশাদ হচ্ছে ‘একদিন সব কিছুই প্রকাশিত হয়ে পড়বে, তোমার প্রতিপালকের আদেশ অনুযায়ী।’ (সূরা যিলযাল: ৪-৫) এই আয়াতে বাতাসে সব কথা বাণীবদ্ধ হয়ে থাকার ইংগিত করা হয়েছে। একই সাথে বিশ্বনবী (সা.) এর বাণী, ‘তোমরা দুটি জিনিসের ব্যাপারে সতর্ক থাক। একটি তোমাদের স্ত্রীরা, অন্যটি এই পৃথিবী যার উপর তোমরা আস্ফালন করে চলছ।’ (মুসলিম)
এই হাদীসে মানুষের কথা রেকর্ড হয়ে থাকার ইংগিত দেওয়া হলো। সুতরাং বেতার আবিষ্কারের বহু শতকের সাধনা এই বাণীগুলোতে নিহিত এবং পাশ্চাত্য যথার্থভাবে তা কাজে লাগিয়েছে। একইভাবে মহাকাশ, চন্দ্র সূর্যের পরিভ্রমণ, মধ্যাকর্ষণ শক্তি, মানুষ ও জীবের সৃষ্টি-প্রক্রিয়া, উদ্ভিদ, প্রাণী ও রসায়ন প্রভৃতি বিষয়ের বেশির ভাগই পবিত্র কুরআনে উল্লেখ ছিল হাজার বছর আগেই। মুসলিম জাতি তাদের বৈজ্ঞানিক বিপ্লব সংঘটিত করেছিল কুরআনের বলেই, এই গ্রন্থ ছিল তাদের মূল প্রাণশক্তি। বিজ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে মুসলিম মনীষীদের হাতের ছোঁয়া লাগেনি। তাদের রচিত কালজয়ী গ্রন্থগুলো শত শত বছর ধরে ইউরোপে পাঠ ছিল। ইবনে সীনা, আল রাজী, আবুল কাসেম জাহারাভী, ইবনুল হাইছাম জারকালী, জাবির বিন হাইয়ান, মুসা আল খারেজমী ও ইবনে নাফিস প্রমুখ তাদের মধ্যে অন্যতম।
আধুনিক ইউরোপ এ সকল বিজ্ঞানীদের প্রতি প্রণত হয়েছেন ও খোলাখুলি স্বীকৃতি প্রদান করেছেন। আবার মুসলিম বিজ্ঞানীদের অনেক আবিষ্কারকে আত্মস্থ করতেও কুণ্ঠিত হয়নি পাশ্চাত্য। তারা এসব পুরোধা ব্যক্তিত্বদের নাম বিকৃত করেছেন, কৃতিত্ব ঢেকে দিয়েছেন নানা জাল বিছিয়ে। অসংখ্য মুসলিম মনীষীদের নাম ও রচনাবলি পৃথিবী থেকে হারিয়ে গেছে।
বিজ্ঞান জগতে ৭৫০ থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দ এই সাড়ে তিনশত বছর মুসলিম জাতির শ্রেষ্ঠ যুগ চিহ্নিত হয় । অথচ এই উত্তরাধিকার কাজে লাগাতে ইউরোপকে ১৯শ-২০শ শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। স্পেনে যদি মুসলমানরা ঢুকতে না পারত তাহলে আধুনিক সভ্যতা আরো কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে যেত। মুসলিম শাসন হারিয়ে গেছে, সাথে হারিয়ে গেছে জ্ঞান বিজ্ঞানের স্বর্ণ যুগ। আমরা তা পুনরুদ্ধার করতে পারিনি।
পাশ্চাত্য জগৎ আজ বিজ্ঞানকে উন্নতির যে চরম শিখরে পৌঁছিয়েছে, তার ভিত্তিই হলো মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের আত্মত্যাগ ও পরিশ্রম। বিজ্ঞানের এই ক্রমবিকাশে পাশ্চাত্য জগৎ তাই বহুলাংশে মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের কাছে ঋণী। এটা কেবল মুসলমানদের বক্তব্য নয়, পাশ্চাত্য জগৎও এটি স্বীকার করে মুক্ত কণ্ঠেই।
উইল ডুরান্ট তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘দা স্টোরি অব সিভিলাইজেশন’ এর ৪র্থ খ-ে অনিবার্যভাবেই মুসলিম বিজ্ঞানী, দার্শনিক এবং চিকিৎসকদের বিস্তৃত বর্ণনা দিয়েছেন। ডুরান্টের মতে, ‘ইবনে সিনা ছিলেন ওষুধ বিষয়ক মহত্তম লেখক, আল-রাজী ছিলেন মহত্তম চিকিৎসক, আল-বিরুনী মহত্তম ভূতত্ত্ববিদ, আল-হায়তাম ছিলেন মহত্তম চক্ষু বিশেষজ্ঞ এবং জাবির ছিলেন মধ্যযুগের সম্ভবত সেরা রসায়নবিদ।’
মুসলিম জাতি যখন জীবনের সার্বিক ক্ষেত্রে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে, তখন তারা ক্লান্ত হয়ে ভোগ বিলাসে মত্ত হয়ে পড়ে। ফলে জ্ঞান চর্চার প্রদীপও ম্লান হয়ে আসতে থাকে। ভাটা পড়তে থাকে তাদের সৃজনশীল কর্মতৎপরতায়। অন্যদিকে পাশ্চাত্য জগৎ মুসলিম বিজ্ঞানীদের লব্ধ জ্ঞানের পরিচর্যা করে ধাপে ধাপে উন্নতির চরম সোপানের দিকে এগুতে থাকে। ইউরোপীয়রা মুসিলম দেশগুলো একে একে গ্রাস করে তাদের কৃষ্টির প্রসার ঘটাতে থাকে। এমন সময়ে সমর্থনের পরিবর্তে মুসলিম বিজ্ঞানীদের উপর নেমে আসে চরম বাধা-বিপত্তি। তাই ক্রমেই তাদের কর্মতৎপরতা বন্ধ হয়ে যেতে থাকে এবং তারা হারিয়ে যেতে থাকেন বিজ্ঞানের জগৎ থেকে। মুসলিম বিজ্ঞানীদের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নিয়ে পাশ্চাত্যের বিজ্ঞানীরা আজ বিজ্ঞানের কর্ণধার সেজেছে। তবু অকপটে তাদেরকেও স্বীকার করতেই হবে সেইসব মধ্যযুগীয় মুসলিম বিজ্ঞানীদের কথা, যারা বিজ্ঞানের এই উন্নতির জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাদেরই কয়েকজনের কথা উল্লেখ করছি।
১. আবূ যায়দ আব্দুর রহমান ইবনে মুহাম্মদ ইবনে খালদুন: তিনি প্রাচীন ঐতিহাসিকদের মধ্যে শীর্ষস্থানীয়। মনে করে থাকেন, তিনি হলেন ইবনে খালদুন। ‘আল ইবারওয়া দিওয়ান আল মুবতাদা ওয়াল খবর’ (ঞযব গড়ৎধষ ধহফ ঃযব ইড়ড়শ ড়ভ ঃযব ঝঁনলবপঃ ধহফ ঙনলবপঃ) গ্রন্থে তিনি জাতিসমূহের বিবর্তন এবং গঠন সম্পর্কে ঐতিহাসিক সূত্রের উদ্ভাবন করেন। এজন্য তাকে সমাজ বিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
২. আবুল ওয়ালিদ মুহাম্মদ ইবনে আহমদ ইবনে রুশদ: মুসলিম দার্শনিকদের মধ্যে ইউরোপে তার বিশেষ আধিপত্য ছিল। তিনি এরিস্টটলের দর্শনের সবচেয়ে বড় অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকার।
৩. আবূ আলী আল হুসায়ন ইবনে আব্দুল্লাহ ইবনে সিনা: তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব। তার লিখা ‘আল কানুন ফিল তিব’ গ্রন্থখানা উনিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইউরোপীয় চিকিৎসকদের অন্যতম প্রধান পাঠ্যপুস্তক ছিল। তিনি প্রথম মনস্তত্ত্ব সম্পর্কিত ধারণা উদ্ভাবন করেন। তিনি বিভিন্ন প্রকার রোগ এবং ৭৬০ প্রকার প্রতিকার পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। তিনি যক্ষ্মা, মস্তিস্কবিল্লির প্রদাহ ও অনুরূপ আরো কয়েকটি সংক্রামক রোগের চিকিৎসা উদ্ভাবন করেন।
৪. আবূ রায়হান মুহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বিরুনী: গণিত, ভূগোল, ইতিহাস, জ্যোতির্বিদ্যা এবং ভেষজ শাস্ত্রের উপর শতাধিক গ্রন্থ প্রণেতা। ভারতবর্ষের উপর ‘কিতাবুল হিন্দ’ নামক অমর গ্রন্থ সভ্যতার ইতিহাসে এক অমূল্য সংযোজন। বৃত্তের ব্যাসার্ধ নির্ণয়ের জন্য তিনি যে পন্থা উদ্ভাবন করেন তা ‘বিরুনী পদ্ধতি’ নামে খ্যাত। তিনি ঝরহব এবং ঞধহমবহঃ এর ছক তৈরি করেন। তরল পদার্থের চাপের প্রকৃতি নির্ণয় সম্পর্কেও তিনি ধারণা দেন। তিনি সমুদ্রের পানি থেকে লবণ উদ্ভাবনের প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন।
৫. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মূসা আল খাওয়ারিজমী: অংক শাস্ত্র ও জ্যোতিষ শাস্ত্রের অগাধ পা-িত্যের জন্য খলিফা মামুন তাকে বায়তুল হিকমার প্রধান নিযুক্ত করেন। তিনি লগারিদমের প্রকৃত উদ্ভাবক। গণিত শাস্ত্রের উপর লেখা তার অনেক বই ল্যাটিন ও ইংরেজি ভাষা অনূদিত হয়ে ইউরোপে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়।
৬. আবূ মূসা জাবির ইবনে হাইয়ান আল তুসী: তিনিই সর্বপ্রথম এসিড আবিষ্কারক এবং সালফিউরিক এসিড তরলীকরণে সাফল্য অর্জন করেন। সোডিয়াম কার্বনেট, পটাশিয়াম, আর্সেনিক এবং সিলভার নাইট্রেট উদ্ভাবন তার এক অমূল্য আবিষ্কার। তাকে আধুনিক রসায়ণবিদদের একজন ধরা হয়। তার রচিত ৫০০ বইয়ের মাঝে দর্শন, তর্ক ও রসায়ন শাস্ত্রে আমরা মাত্র ৮০টি সম্পর্কে জানি।
৭. মুহাম্মদ ইবনে জাবির ইবনে সিনান আল বাত্তানী: তিনি একজন শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ হিসাবে পাশ্চাত্য জগতে বিশেষভাবে সমাদৃত। বিবিধ ত্রিকোণোমিতিক সমীকরণ সমাধান তার উল্লেখযোগ্য আবিষ্কার। তিনি এর গাণিতিক ছক প্রস্তুত করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনিই ত্রিকোণমিতি শাস্ত্রের জন্মদাতা। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত তার গ্রন্থগুলো রেফারেন্স বই হিসেবে পঠিত হতো।
৮. আবূ আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ আল ইদরিসি: তিনি ছিলেন ভূগোলবিদ, বিজ্ঞানী ও মানচিত্রাঙ্কনবিদ। তিনিই সর্বপ্রথম পৃথিবীর মানচিত্র অংকন করেন, যা যথার্থতার দিক থেকে আধুনিক মানচিত্রের কাছাকাছি ছিল। তিনি সমান্তরাল সরল রেখা দিয়ে পৃথিবীকে ৭টি ভাগে ভাগ করেন। তার বিখ্যাত বই ‘নুগহাত আল মোস্তফা কিফ ইখতিরাক আল অরফাক’ তিন শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের প্রধান ভৌগলিক গ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হতো।
৯. জিয়াউদ্দিন আবূ মুহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল বিতার: এই বিজ্ঞানী জীববিজ্ঞান ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যবহারিক প্রয়োগের দিকে তিনি বিশেষভাবে মনোযোগী ছিলেন। তার বিখ্যাত বই ‘আল জামি লি মোফরাদাত আল আদওয়াইয়া ওয়াল আগদিয়ে’ ১৮৮১ সালে ফরাসী ভাষায় প্রকাশিত হলে ফরাসী বিজ্ঞানীরা এমন ৮০টিরও বেশি বিষয়ের সাথে পরিচিত হন যা ইতিপূর্বে তাদের অজানা ছিল। এই অভিধানটি বর্ণানুক্রমিকভাবে সাজানো হয় এবং এতে ১৪০০ প্রকার ওষুধের বর্ণনা ছিল। যার ৩০০টি এর আগে কখনো জানা ছিল না।
১০. আবূ আলী আল হাসান ইবনে হাইসাম: দৃষ্টিবিজ্ঞান ও আলোকরশ্মি সংক্রান্ত গবষেণায় তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। তিনিই সর্বপ্রথম চোখের ছবি অংকন করে আলোকের প্রতিফলন ও প্রতিসরণের নিয়মাবলি ব্যাখ্যা করেন। তিনি চোখের কাঠামোতে আলোর প্রতিফলন, কর্নিয়ার উপর পতিত ছবি, আলোকরশ্মি একত্রীকরণের সূত্র, কোন ছবির সম্প্রসারণ, প্রতিফলন এবং সংযুক্ত এবং বস্তুর রং পরিদর্শন ইত্যাদি ব্যাপারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। মানুষের চোখের সাথে ক্যামেরার সাদৃশ্যও আবিষ্কার করেন তিনি। ১০৩৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, ফ্রান্স প্রবাসী